বিপিএলের উইকেট নিয়ে এবার খুব খুশি মুশফিকুর রহিম। চ্যাম্পিয়ন হতে ব্যর্থ হলেও ফাইনাল ম্যাচশেষে সংবাদ সম্মেলনে রানার্সআপ দলের এই অধিনায়ক কিউরেটরদের অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তার মত, বৈশ্বিক ক্রিকেটে এগিয়ে থাকতে হলে এমন উইকেটই প্রয়োজন। যেখানে ব্যাটিংয়ে বেশি রান আসবে, বোলাররাও ভালো করবে। মোদ্দা কথা, ক্রিকেটের ভাষায় ‘স্পোর্টিং উইকেট’ বলতে যা বোঝায়। সেই ধারাবাহিকতায়, দারুণ সাফল্যে পেয়েছে বোলাররা।
টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির দৌড়ে সেরা পাঁচজনের সবাই পেসার। স্থানীয় ক্রিকেটার রয়েছেন তিনজন। তবে পরিসংখ্যানের বাইরেও দারুণ করেছেন তরুণ বোলাররা। মেহেদী হাসান রানা, মুগ্ধরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, দেশের পেস বোলিংয়ের ভবিষ্যৎ তারাই। পাকিস্তানের বিপক্ষে আসন্ন টি-টোয়েন্টি সিরিজে গতির তাণ্ডব দেখিয়ে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছেন ঢাকা প্লাটুনের হাসান মাহমুদ। ১৩ ম্যাচে ১০ উইকেট নিলেও, গতি আর লাইনলেন্থের দৌড়ে নির্বাচকদের চোখে আরও আগে থেকেই ছিলেন হাসান। সবকিছু মিলিয়ে বোলিংয়ে দারুণ কিছু মুখ উঠে এসেছে।
পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, সর্বোচ্চ উইকেটশিকারের তালিকায় এবার লড়াই হয়েছে উইকেটের সংখ্যা দিয়ে নয়, বরং কে কত রান দিয়েছে, ইকোনোমি রেট, কিংবা এক ম্যাচে সর্বোচ্চ উইকেটের বিচারে। কেমন ছিল সেই তালিকাটা, চলুন পড়ে ফেলা যাক।
মুস্তাফিজুর রহমান
ফিরে আসার লড়াইয়ে এবারের বঙ্গবন্ধু বিপিএলকে মনে রাখবেন বাঁহাতি পেস বোলার মুস্তাফিজুর রহমান। অফ ফর্মের কারণে মাঠে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফর্মে ফিরতে না পারায় সমালোচনা আর বিতর্ক তাকে একরকম ছেঁকে ধরেছিল। সেই জবাবটা মুস্তাফিজ দিতে পেরেছেন এবারের টুর্নামেন্ট দিয়ে। রংপুর রেঞ্জার্সের হয়ে ১২ ম্যাচে মাঠে নেমে তুলে নিয়েছেন ২০ উইকেট, যা এই আসরে বোলার হিসেবে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত উইকেট শিকার। যদিও খরচের খাতাটা একেবারে মুস্তাফিজসুলভ নয়। ইকোনোমি রেট ছিল ৭.০১। তারপরও এই পরিসংখ্যানটা সেরা পাঁচের মধ্যে শীর্ষে।
মুস্তাফিজের পারফরম্যান্স নিয়ে স্বয়ং জাতীয় দলের নির্বাচক কমিটির সদস্য এবং রংপুর রেঞ্জার্সেরই টেকনিক্যাল উপদেষ্টা হাবিবুল বাশার সুমন সমালোচনা করেছিলেন প্রকাশ্যে। তিনি বলেছিলেন,
‘মুস্তাফিজ এক বছর ধরে মিসিং! … সে একটু বেশি অনুমেয় হয়ে যাচ্ছে। এটাই আমার চিন্তা। ব্যাটসম্যানরা ওকে পড়ে ফেলছে যে, সে কী করতে যাচ্ছে।’
শুধু হাবিবুল বাশার নয়, সরাসরি কিংবা নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক অনেক বোর্ড পরিচালকই মুস্তাফিজের বিরুদ্ধে ছিলেন। অনেকের মতে, মুস্তাফিজের কাটারে সেই ধার নেই, নেই আগের মতো প্রাণ। কিন্তু এর সবকিছুর বিরুদ্ধেই মুখ খোলেন ওয়ানডে অধিনায়ক এবং এবারের ঢাকা প্লাটুনের নেতৃত্ব দেওয়া মাশরাফি বিন মুর্তজা।
কাটারমাস্টার মুস্তাফিজকে আগলে রেখেই তিনি উল্টো প্রশ্ন তোলেন,
‘বাংলাদেশে মুস্তাফিজের অর্ধেক (দক্ষতায়) যদি থাকে, দেখান। সে বিশ্বকাপে ২১ উইকেট (২০ উইকেট) পেয়ে এসেছে। হ্যাঁ, সেখানে ওর ইকোনমি রেট কিংবা অনেক কিছু নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। এ জিনিসটা ঠিক করার নিশ্চয়ই পদ্ধতি আছে।’
তিনি আরও বলেন,
‘মুস্তাফিজের যত্ন নেওয়া খুবই জরুরি। খারাপ করলে আপনারা সংবাদমাধ্যম কিংবা দর্শকেরা সমালোচনা করতেই পারেন। কিন্তু আমি যখন মোস্তাফিজের দায়িত্বে আছি, তখন তাকে নিয়ে কেন সাংবাদিকদের সামনে সমালোচনা করব? আমি বরং তাকে আগলে রাখব। পৃথিবীর অনেক খেলোয়াড় ছন্দ হারিয়ে ফেলে। তারা ফিরেও আসে। আমাদের দেশে কেন হচ্ছে না? মুস্তাফিজকে নিয়ে যারা কাজ করছে, তারা মাঠে সাংবাদিকদের ভাষায় কথা বলছে। তাদের সেই নিজস্ব চিন্তাভাবনা কই, যে মোস্তাফিজকে ঠিক করবে?’
মোহাম্মদ আমির
পাকিস্তানি পেসার মোহাম্মদ আমির খুলনা টাইগার্সের হয়ে ১৩ ম্যাচে ২০ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির তালিকায় রয়েছেন দ্বিতীয় অবস্থানে। সেরা বোলিং ফিগার ছিল ১৭ রানে ৬ উইকেট। ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে প্রথম কোয়ালিফায়ার ম্যাচে রাজশাহী রয়্যালসের বিপক্ষে এই দারুণ বোলিং করেন আমির। ফাইনালেও দেখা হয়েছিল একই প্রতিপক্ষের সাথে। এবার ব্যর্থ হয় খুলনা। আমিরও খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি, ৩৫ রানে নিয়েছিলেন ২ উইকেট।
কিন্তু পুরো টুর্নামেন্টের হিসেবে দারুণ ফর্মে রয়েছেন তিনি। যদিও বিপিএলের পারফরম্যান্স দিয়ে শোয়েব মালিকের মতো ভাগ্য ফেরেনি আমিরের, জায়গা হয়নি বাংলাদেশের বিপক্ষে আসন্ন সিরিজে।
এই ইস্যুতেও সরব আমিরভক্তরা। গেল বছরের জুলাইয়ে মাত্র ২৭ বছরে সাদা পোশাকের টেস্ট থেকে অবসর নেওয়াকেই আমির টি-টোয়েন্টি দলে জায়গা না পাওয়ার কারণ হিসেবে দেখছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে সে কথা শুরুতে উল্লেখ করলেও পরবর্তীতে টুইট সরিয়ে নেন। যদিও ওয়াসিম আকরামের করা সমালোচনার ভাষা দেখে টের পাওয়া যায়, এটা সত্যিই বড় কারণ।
‘পাকিস্তানের সেরা বোলাররা টেস্ট থেকে অবসর নিয়েছে। পুরো দেশ ও পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড আমিরের পিছনে ৫ বছর ধরে বিনিয়োগ করেছে। ওর বয়স মাত্রই ২৭। অন্তত একটা টেস্ট সিরিজ খেলে আগামী বছরেও যেতে পারতো। আমি হলে ওকে কেন্দ্রীয় চুক্তিতেই রাখতাম না।’
রুবেল হোসেন
জাতীয় দলের নিয়মিত ফাস্ট বোলার রুবেল হোসেন এবারের বিপিএলে ছিলেন চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স শিবিরে। ১৩ ম্যাচে ২০ উইকেট নিয়ে তিনি আছেন তালিকার তিন নম্বরে। তালিকার প্রথম ও দ্বিতীয়জনের সাথে তার পার্থক্য কেবল মোট রান খরচে আর ইকোনমি রেটে। তবে গতির দৌড়ে অনেকটাই পিছিয়ে ছিলেন এই ফাস্ট বোলার। এ নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে খানিকটা। বিপিএলের চলমান ফর্ম তাকে পাকিস্তান সিরিজে বাংলাদেশের হয়ে বাড়তি আত্মবিশ্বাস দেবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
রবি ফ্রাইলিঙ্ক
দক্ষিণ আফ্রিকান অলরাউন্ডার রবি ফ্রাইলিঙ্ক বিপিএল মাতিয়েছেন তার অলরাউন্ডিং পারফরম্যান্স দিয়েই। ১৪ ম্যাচে ২০ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি সমান ম্যাচ খেলে ব্যাট হাতে সংগ্রহ করেছেন ১৪৪ রানও। রানার্সআপ খুলনা টাইগার্সের হয়ে দলের প্রয়োজনে বারবার জ্বলে উঠেছিলেন ডানহাতি এই মিডিয়াম পেসার ও মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। যদিও আন্দ্রে রাসেলের রাজশাহী রয়্যালসের বিপক্ষে শিরোপা-নির্ধারণী ম্যাচটা জিতলেই হয়তো ফ্রাইলিঙ্কের অবদান আরও বেশি পূর্ণতা পেতে পারত। তারপরও, ফাইনালে আসার লড়াইয়ে তার অবদান মনে রাখবেন অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম।
শহীদুল ইসলাম
বাংলাদেশি ডানহাতি পেসার শহীদুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু বিপিএলে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির তালিকায় পাঁচ নম্বরে অবস্থান করছেন। নারায়ণগঞ্জের এই ক্রিকেটার খুলনা টাইগার্সে রবি ফ্রাইলিঙ্কের সতীর্থ। ১৩ ম্যাচে তার সংগ্রহ ১৯ উইকেট। ৮.৯৮ ইকোনোমি রেটে পুরো টুর্নামেন্টে তিনি রান খরচ করেছেন ৩৯৬। এবারের আসরে যে ক’জন জাতীয় দলের বাইরে থাকা স্থানীয় ক্রিকেটার নজর কেড়েছেন, তার মধ্যে শহীদুল ইসলাম অন্যতম। নতুন মুখ হিসেবে অন্যান্যদের সাথে তিনিও পাকিস্তান সিরিজে জায়গা পাওয়ার দৌড়ে এগিয়ে ছিলেন।