ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ শুরু হয়েছিল। এই মুহূর্তে সেই মহামারী বাংলাদেশেও ঢুকে গেছে। করোনাভাইরাস। আর, এ ভাইরাস থেকে সৃষ্ট রোগ কোভিড-১৯। যত দিন যাচ্ছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আরো বেশি, আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এই ভাইরাস।
সবাই আতংকিত। কেমন একটা অস্বস্তি। ভয়। এই ভয় মূলত অজানাকে ঘিরে। কতদিন এভাবে চলবে? কী হবে কিছুদিন পরে? শেয়ারবাজার ঠিক থাকবে তো? কাঁচাবাজার? কিছুদিন পরে পর্যাপ্ত জিনিস পাওয়া যাবে তো বাজারে?
সব দেশের চেয়ে করোনাভাইরাস সবচেয়ে ভয়ংকর ও তীব্রভাবে আঘাত করেছে ইতালিকে। কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে এখানেই। এই মুহূর্তে (২১ মার্চ) ইতালিতে আক্রান্তের সংখ্যা ৫৩,৫৭৮ এবং মৃতের সংখ্যা ৪,৮২৫। এমনকি, গত রাতে আক্রান্তদের সেবায় নিয়োজিত ১৭ জন ডাক্তার মারা গেছেন বলে জানা গেছে। এত বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং হচ্ছেন যে, ডাক্তাররা বুঝতে পর্যন্ত পারছেন না, কাকে রেখে কাকে চিকিৎসা দেবেন। পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায়, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে চিকিৎসাবঞ্চিতও হচ্ছে অনেকে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? অন্যান্য দেশের তুলনায় ইতালিতে করোনাভাইরাস এত তীব্রভাবে আঘাত করার পেছনে কারণ কী?
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এ নিয়ে ডেমোগ্রাফিক সায়েন্স জার্নালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, ইতালিতে পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক বয়স্ক মানুষ বাস করেন। আর, তরুণেরা এখানে একদম নিয়মিত হারে বয়ষ্কদের সঙ্গে মেশে। ইতালিতে করোনাভাইরাস এত বেশি ছড়িয়ে যাওয়ার পেছনে এই ব্যাপারটির অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। বলে রাখা ভালো, বয়স্ক মানুষ বলতে ৬৫ এর বেশি বয়সীদেরই ধরা হয়েছে।
ইতালির মোট জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ মানুষের বয়সই ৬৫ এর বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি ১৬ শতাংশ। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেমোগ্রাফার, মানে জনতত্ত্ববিদ এবং এপিডেমিওলজিস্ট, মানে মহামারী-গবেষক জেনিফার বিম এই নতুন পেপারটির মূল লেখক। তিনি বলেছেন, একটা দেশের জনসংখ্যা কাঠামো কেমন হবে, সেটা নির্ভর করে দুটো জিনিসের ওপরে। এক, দেশটির মানুষ কতটা দীর্ঘায়ু পাচ্ছেন। আর দুই, তরুণ দম্পতিরা কী হারে সন্তান নিচ্ছেন।
ইতালির জনসংখ্যার কাঠামো এমন হওয়ার পেছনে মানুষের দীর্ঘায়ুর চেয়ে কম সন্তান নেওয়ার ব্যাপারটি বেশি প্রভাব ফেলেছে। এজন্যই বয়স্কদের সংখ্যা এত বেশি।
দেখা গেছে, তরুণ ইতালিয়রা বয়ষ্কদের সঙ্গে খুব বেশি মেশে। তাছাড়া, ইতালির গ্রাম বা মফস্বল এলাকায় তরুণ-তরুণীরা তাদের বাবা-মা, এমনকি নানা-নানী, দাদা-দাদীর সঙ্গেও একসাথে থাকে। আবার, এই তরুণেরাই চাকরি বা কাজের জন্য মিলানের মতো শহরে নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। জরিপ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, শহরেও অনেকেই এভাবে বাবা-মায়ের সঙ্গে একসাথে থাকেন।
পেপারের লেখক ও গবেষকরা বলেছেন, এভাবে নিয়মিত কাজে যাওয়া-আসা করার ফলে নিরব সংক্রামক করোনাভাইরাস তাদের দেহে সহজেই প্রবেশ করার সুযোগ পেয়ে গেছে। কারণ, শহরে এই তরুণরা অনেক বিশাল জনসমাগমের মধ্যে থাকেন, কাজ করেন। নানা জনের সাথে মেশেন। আর, এদের মধ্যে যে কেউ আক্রান্ত থাকতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি হয়তো জানেও না, তার দেহে এই রোগ আছে। কারণ, আক্রান্ত হওয়ার একদম শুরুর দিকে কোনো লক্ষণ প্রকাশ নাও পেতে পারে। ফলে, এ সময় যেকোনো তরুণ সেই আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হতে পারেন। তারপর, দেহে ভাইরাস নিয়ে ফিরে যেতে পারেন ঘরে।
আর, তাদের নিজেদের মধ্যেও যদি কোনো লক্ষণ না থাকে, তারা যে পরিবারের বয়স্কদের আক্রান্ত করছেন, এ ব্যাপারে তাদের কোনো ধারণাও থাকবে না। আর, বয়ষ্করা যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন, সেটা তো আমরা এতদিনে জেনে গেছি।
বয়ষ্করা যে ঠিক কেন বেশি ঝুঁকিতে আছেন, আর শিশুরা কেন তুলনামূলক কম ঝুঁকিতে আছে, এর সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ পাওয়া যায়নি। তবে, এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, বয়ষ্কদের দুর্বল শারীরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং দুর্বল শ্বাসতন্ত্র। বয়ষ্কদের নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি যে কারণে বেশি থাকে, ঠিক একই কারণে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি—এমনটা হতে পারে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে শিশুদের ব্যাপারটিও ব্যাখ্যা করা যায়। শিশুদের ফুসফুসে থাকে প্রিস্টিন। অ্যালার্জি, ধুমপান বা নানা ধরনের দূষক পদার্থ কিংবা রোগের কারণে তাদের ফুসফুস খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। ফলে, এটি করোনাভাইরাসের হাত থেকে দেহকে রক্ষা করতে পারে।
এখানে একটা জিনিস একটু স্পষ্ট করে বলা দরকার। গবেষণা থেকে দেখা গেছে, তরুণ বা বয়ষ্কদের মতো শিশুরাও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। তবে শিশুদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা (এবং হার) কম। উল্টোভাবে, বয়ষ্কদের বেশি।
খুব দ্রুত ইতালি লকডাউন করে দেওয়া হয়েছে। তারপরেও দেখা গেছে, ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। জেনিফার বলছেন, এর কারণ, ইতালিতে খানিকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। তবে এই তথ্য জানা থাকার ফলে অন্যান্য দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে আমাদের করণীয় কী, সে ব্যাপারে একটা ধারণা আমরা পেয়েছি। সোশ্যাল ডিসটেন্সিং মেনে চলা, জনসমাগম বন্ধ করে দেওয়া হলে আমরা হয়তো ‘ফ্ল্যাটেন দ্য কার্ভ’ অর্জন করতে পারব। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ইতালির গবেষণা থেকে আঁচ করা গেলেও, যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশাল দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার ঠিক কেমন হবে—এ নিয়ে সরাসরি কিছু বলার উপায় নেই।
তবে বয়ষ্ক মানুষের হার বেশি থাকলেই যে কোনো দেশে করোনাভাইরাস তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়বে, এমন নয়। এর বাস্তব উদাহরণ জাপান। জাপানের জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ মানুষের বয়স ৬৫ বেশি। অথচ এখন পর্যন্ত জাপানে আক্রান্ত হয়েছেন মাত্র ১,০০৭ জন ও মারা গেছেন ৩৫ জন। দেখা যাচ্ছে, ইতালির তুলনায় বয়ষ্ক মানুষের সংখ্যা ৫ শতাংশ বেশি হওয়ার পরেও জাপানে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম। সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।
এর পেছনে আছে মাত্র তিনটি জিনিস। এক, দ্রুত টেস্টিং। দুই, আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপরে কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ। এবং তিন, যথাসম্ভব সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মেনে চলা।
জেনিফার বলেছেন, তারপরও বয়ষ্কদের ব্যাপারে আমাদের মনযোগী হতে হবে। প্রয়োজনে, সম্ভব হলে তরুণদের থেকে বয়ষ্কদের আলাদা করে ফেলতে হবে। যদিও এটি বাস্তব কোনো সমাধান না। তবে বাস্তবে একটা কাজ করা হয়তো সম্ভব। কোন এলাকাগুলোতে বয়ষ্ক মানুষ বেশি আছে, সেটা দেখতে হবে। সেসব এলাকায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হতে না দেওয়ার ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
প্রিয় পাঠক, চলুন শেষের আগে, ইতালির ঘটনার প্রেক্ষাপট থেকে বাংলাদেশের দিকে একটু তাকানো যাক। আমাদের দেশের শহরগুলোতেও প্রায় প্রতিটি ঘরেই কি ৬৫ এর বেশি বয়সী মানুষ নেই? আমরাও কি তাদের মতো বাবা-মা, এমনকি দাদা-দাদী বা নানা-নানীর সঙ্গে থাকছি না? গ্রামের কথা তো আর আলাদা করে বলার দরকারও নেই।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ২ জন মারা গেছেন বলে জানা গেছে। দুজনই বয়ষ্ক। আক্রান্ত হয়েছেন ২৪ জন (২১ মার্চ পর্যন্ত)। আর, বাংলাদেশ কতটা ঘনবসতির দেশ, সেটি আমরা সবাই জানি। এছাড়াও, এতদিনেও যথেষ্ট পরিমাণ (সন্দেহ আছে, এমন যথাসম্ভব সবাইকে) টেস্টিং আমরা করতে পারিনি।
এই মুহূর্তে আমাদের সামনে একটিই উপায় আছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যথাসম্ভব রোধ করার। সোশ্যাল ডিসটেন্সিং। এবং হোম কোয়ারেন্টিন। আপনি আক্রান্ত হলে যেমন বাইরে গেলে ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা আছে, তেমনি আক্রান্ত না হলে বাইরে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর, বাস্তব উদাহরণ থেকে এখন আমরা জানি, আক্রান্ত হলে, বয়সে তরুণ আপনি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও আপনার বাবা-মা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
আমাদের চিকিৎসাক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাই যথাসম্ভব ঝুঁকি নিয়ে আমাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা যেন অকারণে বাইরে ঘোরার মতো নিরর্থক একটি কাজ করে তাদের ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে না দেই।
তাই আসুন, সবাই সাম্প্রতিক উদাহরণ ও বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নেই। ঘরে থাকি। নিরাপদে রাখি পরিবারের সবাইকে।