ইউক্রেনে আক্রমণের মধ্য দিয়ে পূর্ব ইউরোপের দেশটির সাথে রাশিয়ার যুদ্ধ বেধে যাওয়ার ঘটনা কোনো নতুন খবর নয়। চায়ের আসর থেকে শুরু করে পত্রিকার প্রথম পাতা– সবখানেই এই যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন খবর প্রকাশিত হচ্ছে, যেগুলো পাঠকেরা আগ্রহভরে পাঠ করছেন। তবে শুধু ইউক্রেনের সাথে সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়লেও পুতিনকে এক বহুমাত্রিক রণক্ষেত্রে জোটবদ্ধ শত্রুদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আরও পরিষ্কার করে বললে, ইউক্রেন সামরিকভাবে রুশ সৈন্যদের প্রতিহত করলেও আমেরিকা ও তার ইউরোপীয় মিত্রদেশগুলো তথা পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার বিরুদ্ধে এক ‘অলিখিত যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছে, যে যুদ্ধের প্রকৃতি বিবেচনায় একে ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।’ খোদ ফরাসি অর্থমন্ত্রী ব্রুনো লা মায়ার বলেই দিয়েছেন, “আমরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিকভাবে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছি। এই যুদ্ধে রুশ অর্থনীতির পতন ঘটবে।“
অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে এমন একটি উপায়, যার দ্বারা কোনো রাষ্ট্রের আচরণ সংযত করা সম্ভব। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন হচ্ছে এমন একটি ঘটনা, যে ঘটনায় পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো দাবি করছে যে রাশিয়া আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছে। রাশিয়া একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। সামরিক প্রযুক্তিগত দিক থেকে রাশিয়াকে যেকোনো দেশই সমীহ করতে বাধ্য। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রাশিয়ার পাশে চীন ও ইরানের মতো মিত্রদেশ আছে। সুতরাং এমন একটি দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাওয়ার বিশাল সম্ভাবনা আছে। তাই পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার বিরুদ্ধে এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়ার কথা ভাবছিল, যার দ্বারা সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক সংঘাতে না জড়িয়েও দেশটির ‘উদ্ধত আচরণ’ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এজন্য পশ্চিমা বিশ্বের হাতে সবচেয়ে মোক্ষম হাতিয়ার ছিল অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, এবং তারা সেটিই প্রয়োগ করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রদানের মাধ্যমে কি রাশিয়াকে আটকানো সম্ভব?
যদি স্বল্পমেয়াদের কথা বিবেচনায় নেয়া যায়, তাহলে বলতে হবে- যে উদ্দেশ্যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, সেই উদ্দেশ্য সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ রুশ-ইউক্রেন সংঘাতে রাশিয়া এখন এমন এক অবস্থানে আছে যে, পুতিন কোনোভাবেই ইউক্রেন থেকে তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করবেন না। এই অবস্থায় রুশ সেনাবাহিনী রণক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নেয়া মানে পরাজয় স্বীকার করা, ইউক্রেন হাতছাড়া হয়ে যাওয়া। আরেকটি কারণ হচ্ছে- যখন যুদ্ধে কোনো কম শক্তিশালী দেশের হাতে পরাজয় ঘটে, তখন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন নেতা বেকায়দায় পড়ে যান, প্রায় সবক্ষেত্রে ক্ষমতাচ্যুত হন। জাতীয় নিরাপত্তা অক্ষুণ্ণ রাখতে ইউক্রেনকে আমেরিকার প্রভাবমুক্ত রাখা রাশিয়ার জন্য খুবই জরুরি। যেকোনো যুদ্ধ শুরু করার আগে সার্বিকভাবে পরিকল্পনা করা হয়, পুতিনও অবশ্যই যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে আগেই ভেবে রেখেছেন। সুতরাং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রদানের ফলে রাশিয়া চলমান যুদ্ধ থেকে সরে এসে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়ার জন্য পশ্চিমা বিশ্বের সাথে আলোচনার টেবিলে বসবে– এটা প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি বলে ধরে নেয়া যায়।
অনেক বিশেষজ্ঞ এটা মনে করেন, পশ্চিমা বিশ্বের দ্বারা আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রদানের কারণ হলো দীর্ঘমেয়াদে যেন রাশিয়ার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এটা নিশ্চিত করা। অর্থাৎ সম্প্রতি যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, সেগুলো যে ইউক্রেনের আগ্রাসন থেকে রাশিয়াকে সরিয়ে আনতে পারবে না, এটা পশ্চিমা বিশ্ব ভালোভাবেই অবগত আছে। কিন্তু তারা চায়- যদি ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার সংঘাত দীর্ঘমেয়াদি রূপ লাভ করে, তাহলে একসময় যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করতে রাশিয়া অক্ষম হয়ে যাবে। কারণ নিষেধাজ্ঞার ফলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এতে রাশিয়ার সামরিক বাজেটে ঘাটতির সৃষ্টি হবে। যুদ্ধের জন্য যেহেতু প্রতিদিন বড় অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয়, ভগ্নদশাপ্রাপ্ত অর্থনীতি নিয়ে পুতিন কতদিন যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। কিন্তু যদি রাশিয়া কোনোভাবে নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটিয়ে অর্থনীতি পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন, তাহলে নিষেধাজ্ঞার পেছনে যে উদ্দেশ্য ছিল, তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। ইতিহাসে দেখা গিয়েছে, যেসব দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে, সেসব দেশ দীর্ঘমেয়াদে বিকল্প পন্থা বের করে ফেলেছে।
রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের একটি বিশেষ দিক হচ্ছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা যতগুলো সংগঠন কিংবা দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তার মধ্যে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনার পরিমাণ ছিল খুবই কম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রদানের ঘটনা ছিল আরও বিরল। কিন্তু এবার আমেরিকা ও ইংল্যান্ড রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ মূল ব্যাংকগুলোর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করায় দেশটির মুদ্রা ‘রুবল’ এর মান পড়ে যাচ্ছে, ফলে দেখা দিয়েছে মুদ্রাস্ফীতি। মুদ্রাস্ফীতি ঠেকাতে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ায় ব্যাংকটির যে অ্যাকাউন্টগুলো ছিল, সেগুলো ব্যবহার করাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এছাড়া রাশিয়ার মোট রিজার্ভের প্রায় বিশ শতাংশ স্বর্ণ হিসেবে সংরক্ষিত আছে। আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলেও আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণ বিক্রয় করার মাধ্যমে ‘হার্ড কারেন্সি’ সংগ্রহ করতে পারবে না, ফলে রুবলের পতন ঠেকানোও সম্ভব হবে না।
এখনও পশ্চিমা বিশ্ব ‘সেকেন্ডারি নিষেধাজ্ঞা’ জারি করেনি, যেটি এর আগে ইরানের বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা সময়ের ব্যাপার। এই নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলে যেসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এখনও রাশিয়ায় তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তারা অতিসত্বর আমেরিকার ‘কালো তালিকা’য় নিজেদের নাম দেখতে পাবে। অর্থাৎ হয় রাশিয়া, নয়তো আমেরিকা ও ইউরোপ– তাদেরকে যেকোনো একটা বেছে নিতে হবে। যেহেতু আমেরিকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বিতাড়িত হলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে টিকে থাকা সম্ভব নয়, তাই প্রতিষ্ঠানগুলো এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর কোনোভাবেই রাশিয়ায় নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। ইতোমধ্যে ম্যাকডোনাল্ডস, কোকাকোলা, স্যামসাং, টমি হিলফিগার ইত্যাদি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান রাশিয়া থেকে তাদের সমস্ত ব্যবসায়িক কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে। সামনের দিনগুলোতে রাশিয়ায় বৈদেশিক বিনিয়োগ একেবারে কমে আসবে, অসংখ্য মানুষ কর্মসংস্থান হারাবে।
অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রদানের ফলে শুধু রাশিয়াই যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এমনটা কিন্তু নয়। অনেক বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে ‘দুমুখো তলোয়ার’। যে দেশ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে, দিনশেষে এর নেতিবাচক প্রভাব তার উপরেও পড়ে। ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। ইউক্রেনে হামলার পর পরই আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেলে অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়ে যায়, অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। রাশিয়া থেকে হঠাৎ তেলের যোগান বন্ধ হয়ে গেলে ইউরোপে অচলাবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। পৃথিবীতে মোট যে পরিমাণ তামা উত্তোলন করা হয় খনি থেকে, তার এক-চতুর্থাংশ উত্তোলিত হয় রাশিয়ায়। মোট উৎপাদিত গমের বিশ শতাংশের যোগানদাতা হচ্ছে রাশিয়া। এছাড়া দেশটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অ্যালুমিনিয়াম ও নিকেল রপ্তানি করে। আন্তর্জাতিক বাজারে নিষেধাজ্ঞার কারণে এসবের যোগান বন্ধ হয়ে গেলে এসবের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। রাশিয়া আবার বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক পণ্য আমদানি করে থাকে। নিষেধাজ্ঞার কারণে অনেক দেশ তাদের বাজার হারাবে, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ঘাটতির সৃষ্টি হবে।
ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমেনি, ভেনেজুয়েলার নিকোলাস মাদুরো, কিংবা উত্তর কোরিয়ার কিম জং-উন– সবার দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হলেও তারা বছরের পর বছর ধরে ঠিকই টিকে আছেন। অথচ যখন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়েছিল, তখন সবাই বলেছিল এই দেশগুলো নিষেধাজ্ঞার গ্যাড়াকলে পড়ে পাঁচ বছরও টিকে থাকতে পারবে না। ইরানের তেল রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করলেও তেহরান ঠিকই বিকল্প উপায় বের করে ফেলেছে। চীনের সাথে ইরানের চুক্তি অনুযায়ী ইরান আগামী পঁচিশ বছর চীনে তেল রপ্তানি করবে, অপরদিকে চীন ইরানের অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিলিয়ন ডলার ব্যয় করবে। রাশিয়া যদি রুবলের মান ধরে রাখতে পারে, বৈদেশিক বাণিজ্যের বিকল্প পথ বের করে ফেলতে পারে, দেশীয় বিনিয়োগের মাধ্যমে বৈদেশিক নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে পারে, তাহলে দীর্ঘমেয়াদেও এই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। উল্টো যদি ইউরোপের দেশগুলো তেল ও গ্যাসের জন্য রাশিয়ার বিকল্প কোনো উৎস খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে গিয়ে সংকটের সৃষ্টি হবে।