‘কাজের সময় একটা জিনিসও পাওয়া যায় না’- কথাটি কেউ একবারের জন্যও বলেনি এমন মানুষ হয়তো পাওয়া যাবে না। আপনি জ্যামে পড়ে বাসে বসে আছেন, ভাবলেন বাকি পথটুকু হেঁটে যাবেন। যে-ই না কিছু দূর গিয়েছেন, অমনি বাস আপনাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। কিংবা বিরক্তিতে গুগল ম্যাপ দেখে লেন পরিবর্তন করলেন, করার পর দেখা গেলো সেখানেও জ্যাম। এমন ঘটনা আমাদের জীবনে হরহামেশা ঘটে থাকে, কিন্তু এরও ব্যাখ্যা থাকতে পারে তা কি আপনার মনে হয়েছে কখনও? না হয়ে থাকলে আপনাকে মারফির সূত্রে স্বাগতম!
মারফির সূত্র বলে, “If anything Can go wrong, It will” অর্থাৎ কোনো কিছু ভুল হওয়ার থাকলে, তা অবশ্যই ভুল হবে। কোনো রহস্যময় ক্ষমতায় যে মারফির সূত্র এর অস্তিত্ব প্রমাণ করে তা কিন্তু নয়, বাস্তবে আমরাই একে টিকিয়ে রেখেছি। আমরা সবসময়ই প্রত্যাশা করি যে প্রতিদিনের কাজগুলো যেন আমাদের অনুকূলে থাকে, কিন্তু যখন বাধা বা প্রতিকূলতার সৃষ্টি হয়, আমরা এর কারণ খুঁজি। কিন্তু যতক্ষণ সবকিছু ঠিকঠাক চলে আমরা কি একবারও নিজেকে প্রশ্ন করি? একটি পিচ্ছিল রাস্তা দিয়ে শতবার হাঁটার পর যদি একবার পিছলে পড়ে যাই, তাহলে আমরা বলি, “শুধু আমার সাথেই কি এমন হওয়া লাগে?” অথচ এর আগে এতবার হেঁটে যাওয়া হলো সেই ইতিবাচক দিকটিকে আমরা উপেক্ষা করি।
মারফির সূত্র আমাদের ইতিবাচক দিক থেকে সরে নিয়ে গিয়ে নেতিবাচক দিকে ফেলে দেয়। গণিতের সম্ভাবনার সাহায্য নিয়ে বের করে যে যা হবার তা হবেই!
মারফির সূত্র কিন্তু আসলে সূত্র নয়!
মারফির সূত্রকে সূত্র না বলে দার্শনিক মতবাদ বলা যায়। কিংবা প্রবাদ বা হাইপোথিসিস। এই সূত্রের উপসূত্রও অসংখ্য। খুব পুরোনো নয়, আবার নতুনও নয়। ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড মারফি থেকে এর নামকরণ হলেও এর পূর্বেও অনেক জায়গায় এর উল্লেখ ছিল। জাদুকর এডাম হাল ১৯২৮ সালে তার একটি প্রবন্ধে লেখেন, কোনো জাদুগিরিতে যেগুলো ভুল হওয়ার সেগুলো ভুল হবেই। এছাড়া ব্রিটেনে এটি Sod’s law নামে পরিচিত। তবে ‘মারফির সূত্র’ আলোচিত করে তোলেন ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড মারফি।
ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড মারফি ছিলেন বিমানবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার। ১৯৪৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার মিউরোক (পরবর্তীতে এডওয়ার্ডস নামকরণ করা হয়) এয়ারফোর্স ঘাঁটিতে অফিসাররা একটি পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। পরীক্ষাটি ছিল গ্রাভিটি নিয়ে যে, কোনো পাইলট একেবারে কত অভিকর্ষজ ত্বরণ সামলাতে পারবেন। তাদের ধারণা ছিল, এ থেকে প্রাপ্ত ফলাফল ভবিষ্যতে প্লেনের ডিজাইনে কাজে আসবে।
দলটি Gee Whiz নামক রকেট স্লেড ব্যবহার করে বিমান দুর্ঘটনার পরিস্থিতি নকলের চেষ্টা করছিলো। অর্ধ মাইল ট্রাকে স্লেডটির গতি ছিল প্রায় ২০০ মাইল/ঘন্টা। সমস্যা হলো, একজন ব্যক্তি কতটুকু গ্রাভিটির ধাক্কা সামলাতে পারবে তা জানার জন্য একজন প্রকৃত ব্যক্তির প্রয়োজন ছিলো। এই কাজে এগিয়ে আসেন সাহসী কর্নেল জন পল স্টাপ। তিনি পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক। কয়েকমাসের এই যাত্রায় তিনি একাধিকবার তার শরীরের হাড় ভাঙেন। যেদিন মারফির সূত্রের জন্ম, সেদিন নিয়ে কয়েকটি গল্প রয়েছে। তবে সবচেয়ে কাছাকাছি এবং গ্রহণযোগ্য গল্পটি বলা হবে এখন।
এডওয়ার্ড মারফিকে কোনো স্লেজ রাইড করতে হয়নি। তখন কিছু সেন্সর তৈরি করা হয় যেগুলোর সাহায্যে সেই গ্রাভিটির ধাক্কা মাপা যায়। সেন্সর লাগিয়ে যখন প্রথম পরীক্ষা করা হলো তখন রিডিং আসলো শূন্য। মারফি চেক করে দেখলেন সবগুলো সেন্সর ভুলভাবে লাগানো। তার সহকারীর উপর এই সেন্সর লাগানোর দায়িত্ব ছিল। তখন মারফি বললেন, “যদি একটি কাজ করার দুটি উপায় থাকে, এবং এক উপায়ে করলে সেটি ভুল হবে, এই লোক অবশ্যই সেই উপায়েই করবে!”
এর কিছু সময় পরেই ক্যাপ্টেন মারফি রাইট এয়ারফিল্ডে চলে যান, কিন্তু হাস্যরসাত্মক ও প্রত্যুৎপন্নমতি ড. স্টাপ মারফির কথায় একটি ভিন্ন চেতনা খুঁজে পেলেন। পরবর্তীতে এক প্রেস কনফারেন্সে তিনি বলেন, মারফির সূত্র সম্পর্কে সজাগ থাকার কারণে রকেট স্লেজ দলটিকে কোনো বিপদের সম্মুখীন হতে হয়নি। তিনি আরও বুঝিয়ে বলেন, যা ভুল হবার তা ভুল হবেই!
এরপর এটি সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং ১৯৭০ দশকে এর উপর একটি বইও লেখা হয়। এরপর থেকে মারফির সূত্রে আরও বিভিন্ন ধারণা যোগ করে একে বর্ধিত করা হয়।
যেভাবে মারফির সূত্র সার্বজনীন হলো
মারফির সূত্র জনপ্রিয়তা লাভ করার পেছনে কারণ কী? রকেট স্লেজের সেন্সরগুলোর দুটি কানেক্টর ছিল। অর্থাৎ ৫০ শতাংশ সম্ভাবনা ছিল ঠিকভাবে লাগানোর। কিন্তু ভুলকে বড় করে কেন দেখা হলো? সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা হচ্ছে, আমরা যাকে বলি, ‘অদৃষ্টের পরিণতি’।
‘ভাগ্যে যা লেখা আছে তা-ই হবে, ভাগ্যের কাছে আমাদের সবকিছু ক্ষমতাহীন’ । এই চিন্তাধারা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু ভাগ্যের লিখনের সাথে সাংঘর্ষিক একটি ব্যাপার হচ্ছে আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা। অর্থাৎ আমরা যা-ই করি না কেন, আমাদের প্রতিটি কাজ এবং তার ফলাফল আমরা নিজেরাই বয়ে আনি। এই দুটি ব্যাপারকে যদি আমরা একসাথে জুড়ে দেই, তাহলে মারফির সূত্রের একটি ব্যাখ্যা দাঁড়ায়। এই সূত্র বলে, যা ভুল করার তা আমরা বার বার করবো। কিন্তু এই ভুল করার ইচ্ছাটা কিন্তু নিজেদের থেকেই আসে। অপরপক্ষে, মারফির সুত্র বলে দেয় আমরা নিজেদের উপর কতটা নিয়ন্ত্রণহীন। সবচেয়ে দীর্ঘ জ্যামে পড়লে আমরা নিজেদের ভাগ্যকে দোষারোপ করি।
মারফির সূত্র কিন্তু কোনো কিছু প্রমাণ করে না। একে একটি সাধারণ মতবাদ বা প্রবাদ বলা যায়। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, কোন খারাপ বা ভুল কিছু যখন ঘটে, তখন প্রকৃতির আরও কিছু বিষয় জড়িত থাকে। রুডিয়ার্ড কিপলিং বলেছিলেন, তুমি যতবারই একটি পাউরুটি ফেল না কেন, মাখন মাখা অংশটি সর্বদা মাটিতে লাগবে। এখানে একটা বিষয় হচ্ছে, মাখন মাখা অংশটি অপর অংশের চেয়ে সামান্য হলেও ভারি। আমরা যখন উপর থেকে ফেলবো তখন গ্রাভিটির কারণে ভারি অংশটিই কিন্তু নিচের দিকে থাকবে। কিন্তু এর বিপরীতও হতে পারে, তখন শুধু আমাদের সঠিক কারণটি বের করতে হবে ভাগ্যের উপর ছেড়ে না দিয়ে।
মারফির সূত্রের সাথে তাপগতিবিদ্যার সম্পর্ক
আমাদের প্রকৃতির নিয়ম আসলে মারফির সূত্রকে সমর্থন করে। তাপগতিবিদ্যায় এনট্রপি বা শক্তির বিশৃঙ্খলার একটি সূত্র রয়েছে। একে তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রও বলে। সূত্রটি হলো,
“বাইরের শক্তির সাহায্য ছাড়া কোনো স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের পক্ষে নিম্ন তাপমাত্রার কোনো বস্তু হতে উচ্চ তাপমাত্রার কোনো বস্তুতে তাপের স্থানান্তর সম্ভব নয়”
– ক্লসিয়াস
এ সূত্র ধারণা দেয় কীভাবে শক্তি এক রুপ থেকে অন্য রুপে রুপান্তরিত হয়, আর এখানেই সৃষ্টি হয় জটিলতা। আমরা কখনও এমন কিছু তৈরি করতে পারবো না যেখানে শতভাগ ইনপুট দিলে শতভাগ আউটপুট পাওয়া যাবে। অর্থাৎ কিছু শক্তি আমরা হারাবোই। এ থেকে একটি ধারণা তৈরি হয় যে, পৃথিবীর সব ব্যবস্থাতেই শক্তির বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, যা প্রতিনিয়ত হচ্ছে। এটি এড়ানোর উপায় নেই। মারফির সূত্রের গাণিতিক বিশ্লেষণও করেছেন ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার জোয়েল পেল। তার ফর্মুলা মারফির সূত্রজড়িত ঘটনা ঘটার সম্ভাব্যতা অনুমান করে।
কোনো সিস্টেম বা ব্যবস্থাই ত্রুটিমুক্ত নয়, তা ব্যর্থ হতে পারে। এর অর্থ সেটি পুনরায় করতে হবে, বার বার ভুল হলেও এগিয়ে যেতে হবে। মারফির সূত্র শুধু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেই নয়, সকল ইঞ্জিনিয়ার, কম্পিউটার প্রোগ্রামার এবং বিজ্ঞানীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
কিছু মজার মারফির সূত্র
১. কোথাও যাওয়ার সময় সবকিছু দেখে নিলেও মনে হয় যে কিছু নেয়া হয়নি, পৌঁছানোর পরই তা মনে পড়ে।
২. যখনই কাউকে দেখিয়ে কোন কাজ করতে যাবেন তাতে কিছু গরমিল হবেই।
৩. আমি যা ভেবে রাখি কখনোই তা হয় না।
৪. এক সমস্যার সমাধান করলে আরেকটা বের হয়।
৫. যদি কোনো ভুল নিজে থেকে না-ও হয়, অন্য কেউ এসে তা করে দিয়ে যাবে।
মানুষ সবসময় শতভাগ সঠিক কাজ করতে পারে না। তার কিছ ভুল হয়ই। মারফির সূত্রের প্রভাব আমাদের দৈনন্দিন জীবনে থাকলেও সবসময় চেষ্টা করতে হবে সেটার পেছনের কারণ খোঁজার এবং ব্যাখ্যা করার। ভাগ্যকে দোষারোপ করলে হতাশা বাড়ে, তাই বাড়াতে হবে আত্মবিশ্বাস এবং নেতিবাচক দিকের চেয়ে ইতিবাচক দিকগুলোকে বড় করে দেখতে হবে। যা ভুল হওয়ার তা তো হলো, এরপর যেন আর না হয়!