শন ম্যাকব্রাইড; নামটা নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র কিংবা মাদার তেরেসার মতো ততটা চর্চিত নয়। তবে আয়ারল্যান্ডের এই গেরিলাযোদ্ধা বিশ্বশান্তির জন্য যা করেছেন, তা কারোর চেয়েই হয়তো কম নয়। যে কারণে একইসাথে দুই মেরুতে থাকা নোবেল শান্তি পুরস্কার ও লেনিন শান্তি পুরস্কার জেতা প্রথম নাম লেখানো ম্যাকব্রাইড প্রথম বিদেশি হিসেবে গলায় ঝুলিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান মেডাল ফর জাস্টিসও।
ম্যাকব্রাইডের জন্ম ১৯০৫ সালে, বাবা মেজর জন ম্যাকব্রাইড আর মা মড গন ছিলেন তখনকার আয়ারল্যান্ডের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত দুই নাম। জন ম্যাকব্রাইড তখন দক্ষিণ আফ্রিকায়, সেখানে থাকা অভিবাসী আইরিশদেরকে একত্র করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছেন বোয়ার যুদ্ধে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যজুড়ে জাতীয়তাবাদীদের নায়ক হয়ে উঠেছেন ম্যাকব্রাইড, সবার মুখে মুখে তার নাম।
অন্যদিকে মড গন পরিচিত হয়ে উঠেছেন আয়ারল্যান্ডের ‘জোয়ান অফ আর্ক’ হিসেবে। আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনে পোস্টিংয়ে থাকা ব্রিটিশ কর্নেলের মেয়ে জন্মসূত্রেই আয়ারল্যান্ডকে আপন করে নিয়েছিলেন, জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ধরেই নিয়েছেন ব্রিটেনের দখলদারিত্ব থেকে আয়ারল্যান্ডের মুক্তি। অনিন্দ্যসুন্দরী মডের প্রেমে পড়েছিলেন কবি ইয়েটসও, যার অনেকগুলো কবিতাতেই মড আর তার রিপাবলিকান কাজকর্ম উঠে এসেছে বার বার।
মড গন আর জন ম্যাকব্রাইড বিয়ে করেছিলেন প্যারিসে, ১৯০৪ সালে। ঠিক এক বছর পর শন ম্যাকব্রাইডের জন্মের পর পরই দুজনের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। শন ম্যাকব্রাইড থাকা শুরু করেন প্যারিসে, মায়ের সাথে। মড গনের প্যারিসের বাসভবন তখন হয়ে উঠেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা জাতীয়তাবাদী নেতা-কর্মীদের আলোচনাকেন্দ্র হিসেবে। ব্রিটেনের কূটনীতিক হিসেবে কাজ করা আইরিশ জাতীয়তাবাদী নেতা রজার ক্যাসেমেন্ট, যাকে পরে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, প্রায়ই যেতেন সেখানে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর অক্সফোর্ডে পড়তে আসা জওহরলাল নেহরুও পা রেখেছেন সেখানে। মিশর আর মরক্কোর নেতারাও ভিড় জমাতেন মডের বাসায়; আলোচনার বিষয় ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি, রাজনৈতিক বন্দী আর ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সময় বালক ম্যাকব্রাইড ছিলেন এক জেসুইট বোর্ডিং স্কুলে। আয়ারল্যান্ডের খোঁজ-খবর না নেওয়া ম্যাকব্রাইডের কাছে ১৯১৬ সালে আয়ারল্যান্ডে শুরু হওয়া জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের খবর এসেছিল অপ্রত্যাশিতভাবেই। মেজর জন ম্যাকব্রাইডকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো। এরপর মড গন সিদ্ধান্ত নিলেন ছেলেকে নিয়ে ফিরে যাবেন আয়ারল্যান্ডে, সরাসরি সেখান থেকেই নেতৃত্ব দেবেন, বিদেশ থেকে নয়। তবে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় তা সম্ভব ছিল না। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ১৪ বছর বয়সী ম্যাকব্রাইড মায়ের সাথে পাড়ি জমালেন আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনে, সেখানে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো আরেক স্কুলে।
গেরিলাযোদ্ধার উত্থান
আয়ারল্যান্ডে পা রাখার দুয়েক মাসের মধ্যেই ব্রিটিশ গোয়েন্দারা মডকে গ্রেফতার করলেন কোনো কারণ ছাড়াই। কোনো বিচার ছাড়াই আটকে রাখা হলো কয়েক মাস, সেটিও স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ার পর। এদিকে মায়ের অনুপস্থিতিতে মাকে না জানিয়েই বয়স লুকিয়ে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মিতে যোগ দিলেন ম্যাকব্রাইড। সারা দেশজুড়ে আইআরএ তখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হচ্ছে, মাঝেমধ্যেই ব্রিটিশদের ওপর অতর্কিত গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে তাদের পর্যুদস্ত করছে। ম্যাকব্রাইডের জায়গা হলো ডাবলিন ব্রিগেডের তৃতীয় ব্যাটালিয়নের বি কোম্পানিতে। কোম্পানির প্রায় পুরোটাই শ্রমিকদের নিয়ে গঠিত, ম্যাকব্রাইডের মতো সমাজের অভিজাত শ্রেণির কেউ নেই। তবে ওই সময়ে আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা ছিল তখন পুরোটাই সামরিক সংঘাত-কেন্দ্রিক। রাজনৈতিক বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে তখনও মাথা ঘামানো শুরু করেনি কেউ।
১৯২০ সালের ২১ নভেম্বর, ‘ব্লাডি সানডে’র রাতে আইআরএ-র হাতে খুন হয় ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের ১২ জন সদস্য, আবার তাদের হাতে মারা যায় আইআরএ-র ডাবলিন ব্রিগেডের কমান্ডিং অফিসার। তার কয়েকদিন পরেই ম্যাকব্রাইড কোনোরকমে পালিয়ে বাঁচেন, পরে বুঝতে পারেন তাকে ফেলে রেখেই তার সহযোদ্ধারা পালিয়েছে।
ম্যাকব্রাইডের কাজকর্ম নজর কাড়ে আইআরএ-র গোয়েন্দা প্রধান মাইকেল কলিন্সের। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এক ফরাসি অপরাধী দলের সাথে যোগাযোগ করার জন্য, যারা বিশ্বযুদ্ধের সময় ফেলে দেওয়া অস্ত্র আইআরএ-র কাছে বিক্রি করবে। ম্যাকব্রাইড অপরাধী দলের প্রধানকে নিয়ে, যে একইসাথে একজন ফেরারি আসামী, প্যারিসে যাচ্ছিলেন ট্রেনে চেপে, তখনই পুলিশ এসে ট্রেনে তল্লাশি শুরু করে। ট্রেনের দরজা খুলে রাতের অন্ধকারে চলন্ত ট্রেন থেকেই লাফ দেন দুজনে, তারপর আর কখনও দুজনের দেখা হয়নি।
আয়ারল্যান্ডে তার দায়িত্বে থাকা অঞ্চলে ইংরেজদের অনুগত পুলিশ বাহিনীর জীবন নরক বানিয়ে ছেড়েছিলেন ১৭ বছর বয়সী ম্যাকব্রাইড। তার কাজের জন্য আইআরএ-তে খুব দ্রুত প্রমোশন পাচ্ছিলেন। ১৯২১ সালের অক্টোবরে ইংরেজরা যখন আইআরএ-এর কাছে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানায় তখন আইআরএ-র প্রতিনিধি দলের নেতার দেহরক্ষী হয়ে লন্ডনেও যান তিনি। তবে ম্যাকব্রাইডের এই লাফিয়ে লাফিয়ে পদোন্নতি পাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল তার সামাজিক অবস্থান। ম্যাকব্রাইডের পারিবারিক পরিচয়ের কারণে আইআরএ-র নেতাদের কাছে আলাদা গুরুত্ব পেতেন ম্যাকব্রাইড, তবে এ কারণে সৈনিকদের সাথেও মিশতে কোনোরকম নাক উঁচু ভাব দেখাতেন না তিনি। আর এই দুইয়ের মিশেলেই ম্যাকব্রাইড হয়ে উঠেছিলেন সকলের প্রিয়পাত্র।
দুই বছরের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ব্রিটেন যখন নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড বাদে আয়ারল্যান্ডের বাকি অংশকে (বর্তমান আয়ারল্যান্ড) স্বায়ত্ত্বশাসন দেওয়ার প্রস্তাব করে (যদিও গ্রেট ব্রিটেনের অন্তর্ভুক্ত), তখন ম্যাকব্রাইড এর বিরোধিতা করেন। কারণ ম্যাকব্রাইডের দাবি ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীনতা, কেবল স্বায়ত্ত্বশাসন নয়। ব্রিটেনের এই কূটচালের ফলে আয়ারল্যান্ডজুড়ে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ, এক ভাগ স্বায়ত্ত্বশাসনেই খুশি, অন্য ভাগ চায় সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। যা-ই হোক, এক বছরের গৃহযুদ্ধ শেষে স্বায়ত্ত্বশাসনের পক্ষে থাকা দলই জয়ী হয়, আইরিশ ফ্রি স্টেট হিসেবে আয়ারল্যান্ড গ্রেট ব্রিটেনের অন্তর্ভুক্ত দেশ হিসেবে স্বায়ত্ত্বশাসন লাভ করে। এই সময়টা ম্যাকব্রাইড আটকে ছিলেন কারাগারে।
মুক্তি পাবার পর ডাবলিনের ইউনিভার্সিটি কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন ম্যাকব্রাইড, বিয়েও করে ফেলেন তার চেয়ে চার বছর বড় কিন্তু একই রাজনৈতিক মতাদর্শের ক্যাটালিনা বুলফিনকে। শ্বশুরও ছিলেন বিখ্যাত আইরিশ জাতীয়তাবাদী প্রকাশক-লেখক উইলিয়াম বুলফিন।
এরপরের সময়টুকু ইউরোপের বিভিন্ন শহরে কাটাতে থাকেন ম্যাকব্রাইড, ১৯২৭ সালে ডাবলিনে ফিরে আইআরএ-এর ইন্টেলিজেন্স বিভাগের ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগপর্যন্ত লন্ডন ও প্যারিসে কাজ করেন সাংবাদিক হিসেবে। পরবর্তীতে আইআরএ-এর ডকুমেন্টস থেকে জানা যায়, আইআরএ-এর অন্যতম প্রধান অর্থদাতা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন; এবং ব্রিটেনে সোভিয়েতদের গুপ্তচর হয়ে কাজ করতেন ম্যাকব্রাইড! রয়্যাল নেভি ও রয়্যাল এয়ারফোর্সের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মডেল-ডায়াগ্রাম, এমনকি শত্রুদের সাবমেরিন শনাক্তের জন্য সোনারের মডেলও অত্যন্ত সুকৌশলে পাচার করেছিলেন তিনি, যেখানে তার ছদ্মনাম ছিল জেমস। ব্রিটেনে সোভিয়েতদের জাল নোটের অপারেশন সম্পর্কেও জানতেন তিনি।
ডাবলিনে ফেরার কিছুদিন পরেই এক আইরিশ নেতাকে হত্যার সাথে সম্পর্কিত অভিযোগে গ্রেপ্তার হন ম্যাকব্রাইড। তবে শক্ত অ্যালিবাই থাকায় অন্য আরেক অভিযোগে তাকে আরও বেশ কয়েকদিন জেলে আটকে রাখা হয়। এদিকে আইআরএ বিভিন্ন দল-উপদলে ভাগ হয়ে যায়, ম্যাকব্রাইড নিজেই শুরু করেন ‘ফ্রি আয়ারল্যান্ড’ আন্দোলন, তবে আইআরএ-র সাথে এই দলকেও বেআইনি হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। নিরাপত্তা বাহিনীর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠেন ম্যাকব্রাইড।
১৯৩৬ সালে আইআরএ-র চিফ অফ স্টাফকে গ্রেপ্তার করে জেলে পুরে দেওয়া হয়, তার স্থলাভিষিক্ত করার জন্য ডাকা হয় ম্যাকব্রাইডকে। ততদিনে আইআরএ বহু দল-উপদলে বিভক্ত, নিজেদের মধ্যেই শুরু হয়েছে ঝামেলা-বিবাদ। এদের মধ্যেই একদল ব্রিটেনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দেয়, ম্যাকব্রাইড তাতে রাজি হননি। কারণ ততদিনে আয়ারল্যান্ডের সংবিধান রচনার কাজ শুরু হয়েছে, ব্রিটিশরা আয়ারল্যান্ড থেকে গভর্নর জেনারেল পদ সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সাথে ব্রিটেনের রাজাকে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার বদলে কেবল নামধারী পদে বসিয়ে আয়ারল্যান্ডের রাষ্ট্রপ্রধানকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, আয়ারল্যান্ডের পরিপূর্ণ সার্বভৌমত্বের পথে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল, ফলে ম্যাকব্রাইড আবার নতুন করে সহিংস পথে আগাতে রাজি ছিলেন না।
এদিকে ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই ম্যাকব্রাইড তার আইন বিষয়ক পড়াশোনা আবারও শুরু করেন, যা থেমে গিয়েছিল রাজনীতিতে পুরোদস্তুর জড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে। ১৯৩৭ সালে আয়ারল্যান্ডের সংবিধান কার্যকর হয়, সে বছরই ব্যারিস্টারি পাশ করেন ম্যাকব্রাইড, আইআরএ ছেড়ে আয়ারল্যান্ডের বারে যোগ দেন উকিল হিসেবে। কয়েক বছরের মধ্যেই অত্যন্ত সফল আইনজীবী হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ে তোলেন ম্যাকব্রাইড, হয়ে যান সিনিয়র কাউন্সেল। আইআরএ ছেড়ে চলে আসলেও আইআরএ-কে ভুলে যাননি ম্যাকব্রাইড, কারণ তখনও তার একমাত্র লক্ষ্য আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা, সেজন্য যা যা করা প্রয়োজন মনে করতেন, তার সবটুকুই নিজের সাধ্যমতো করতেন। আইনজীবী থাকার সময়েই আইআরএ সদস্যদের মামলায় আইনজীবী হিসেবে লড়তেন তিনি, বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে প্রাণেও বাঁচিয়েছেন তিনি। তবে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যার অভিযোগে আইআরএ-র চিফ অফ স্টাফ চার্লি কেরিন্সকে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি আঙুলের ছাপের শক্ত প্রমাণ থাকায়। ১৯৪৬ সালে আয়ারল্যান্ডের জেলখানায় এক রিপাবলিকান মারা যাওয়ায় আয়ারল্যান্ডের আদালতকে রীতিমতো লজ্জার সাগরে ভাসান, আদালতকে বাধ্য করেন জেলখানার অমানবিক নির্যাতনকে স্বীকার করতে।
আইন থেকে রাজনীতিতে
১৯৪৬ সালে ম্যাকব্রাইড গঠন করেন রিপাবলিকানদের সমাজপন্থী ধারার রাজনৈতিক দল ক্ল্যান না পোব্লাকটা, যার অর্থ ‘রিপাবলিকের সন্তানরা’। তিনি আশা করেছিলেন ফিয়ান্না ফেলকে সরিয়ে ক্ল্যান না পোব্লাকটাই হবে আয়ারল্যান্ডের প্রধান রাজনৈতিক দল। সে আশা দেখিয়ে ডাবলিন কাউন্টির নিম্নসভার জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিতও হন। তবে ১৯৪৮-এর জাতীয় নির্বাচনে মাত্র ১০টি আসন পায় তার দল। ফলে ফাইন গল, লেবার পার্টি, ন্যাশনাল লেবার পার্টিসহ অন্য কিছু স্বতন্ত্র দলের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে প্রথম আন্তঃদলীয় সরকার ঘোষণা করে। ফিনা গল তখন প্রধান দল, তার নেতা রবার্ট মুলাকি। তবে আয়ারল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের সময় আইরিশ ফ্রি স্টেট সরকারের একজন ছিলেন মুলাকি, সে সময় প্রায় ৭৭ জন রিপাবলিকানকে ফাঁসি দেওয়ার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি। ফলে ম্যাকব্রাইডসহ সাবেক অনেক রিপাবলিকানই কখনো মুলাকিকে ক্ষমা করেননি। অন্যান্য দলের সমর্থন পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দলের আরেক সদস্য জন কস্টেলোর হাতে ছেড়ে দেন মুলাকি। ম্যাকব্রাইডকে নির্বাচিত করা হয় পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে।
১৯৪৯ সালে আয়ারল্যান্ডকে রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা করা অর্থাৎ, আয়ারল্যান্ডের সাথে অন্যান্য দেশের সম্পর্ক রক্ষার পরিপূর্ণ ভার ব্রিটেনের রাজার কাছ থেকে আয়ারল্যান্ডের রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এটি আইনসভায় পাশ করার পেছনের অন্যতম কারিগর ছিলেন ম্যাকব্রাইড। দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই বহির্বিশ্বে আয়ারল্যান্ডের অস্তিত্ব জানান দিতে একের পর এক পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জর্জরিত ইউরোপে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য কাউন্সিল অফ ইউরোপে ইউরোপিয়ান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটস প্রণয়নে প্রধান দায়িত্ব ছিল তার কাঁধে। ১৯৫০ সালে কাউন্সিল অফ ইউরোপের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন, একইসাথে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কো-অপারেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। স্নায়ুযুদ্ধের সময় ন্যাটোতে আয়ারল্যান্ডকে যোগদান থেকেও বিরত রেখেছিলেন এই ম্যাকব্রাইড।
১৯৫১ সালে পুনরায় ক্ল্যান না পোব্লাক্টা থেকে নির্বাচিত হন তিনি, তবে তার দল মাত্র দুটি আসনে জয়লাভ করে। পরবর্তী দুই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও ম্যাকব্রাইড নির্বাচিত হননি। দেশীয় রাজনীতিতে ক্রমেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলা ম্যাকব্রাইড একপর্যায়ে রাজনীতি থেকে অবসর নেন এবং দলকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। তার পরবর্তী লক্ষ্য আন্তর্জাতিক শান্তি।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং মানবাধিকার
ইউরোপিয়ান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটস স্বাক্ষরিত হওয়ার পর পরই ম্যাকব্রাইড বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার আন্দোলন নিয়ে পুরোদমে নেমে পড়ার চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। ১৯৫৯ সালে যখন ইউরোপিয়ান কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন ম্যাকব্রাইডই প্রথম অভিযোগ দায়ের করেন। ১৯৫৮ সালে গ্রিসের সরকার ম্যাকব্রাইডকে অনুরোধ করেন সাইপ্রাসের জাতীয়তাবাদী নেতা আর্চবিশপ মাকারিওসকে ব্রিটিশরা সিচেলস দ্বীপে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। ব্রিটেনের এই মামলাকে উড়িয়ে দেন ম্যাকব্রাইড এবং তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য করেন। পরবর্তীতে দুজনের মধ্যে বেশ ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
ম্যাকব্রাইডের পরবর্তী লক্ষ্য দক্ষিণ আফ্রিকা, বোয়ার যুদ্ধে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জন ম্যাকব্রাইডের অবদান স্মরণ করে তাকে সসম্মানে বরণ করে নেয় দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার। দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রেপ্তারকৃত থাকা রাজনৈতিক বন্দীদের কারণ জানতে চান ম্যাকব্রাইড, এবং তার চাপে অনেক বন্দীকে ছেড়েও দেয় সরকার। সেখানে গিয়ে ম্যাকব্রাইড বুঝতে পারেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশেও বাইরের দেশগুলোর প্রভাব কেমন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এক ব্রিটিশ আইনজীবী পিটার বেনেনসনকে সাথে নিয়ে ম্যাকব্রাইড ১৯৬২ সালে গঠন করেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, যার প্রধান লক্ষ্য সারাবিশ্বের কারাবন্দীদের অধিকার আদায়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ধীরে ধীরে আলোর মুখ দেখছিল, যার অন্যতম কারণ ম্যাকব্রাইডের আইনি, কূটনৈতিক, আপোষ করার দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা। খুব দ্রুতই বিচারহীন গ্রেপ্তার, কারাবন্দীত্ব এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রধানতম প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায় অ্যামনেস্টি। ১৯৬১ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ম্যাকব্রাইড, আয়ারল্যান্ডের দায়িত্বে থাকেন মৃত্যুর আগপর্যন্ত।
১৯৬৩ সালে ম্যাকব্রাইডকে নিয়োগ দেওয়া হয় জেনেভা-কেন্দ্রিক ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অফ জুরিস্টসের সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে, যার প্রদান কাজ ছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করা। স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ে আইসিজে-কে দেখা হতো পশ্চিমাপন্থী দল হিসেবে, যারা পশ্চিমাপন্থী দেশের তুলনায় সোভিয়েতপন্থী দেশগুলোর মানবাধিকার নিয়ে বেশি চিন্তিত ছিল, পরবর্তীতে জানা যায় এর অর্থায়নের বেশ কিছু অংশের ভাগীদার ছিল সিআইএ।
তবে অ্যামনেস্টির মাধ্যমে একদম নিরপেক্ষ অবস্থা বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন ম্যাকব্রাইড, যেটি আইসিজে-তে সম্ভব ছিল না। ফলে দুই পক্ষের সাথেই বাদানুবাদ শুরু হয় ম্যাকব্রাইডের। ১৯৬৩ সালে চীনের তিব্বত দখলের নিন্দা জানানোর পর যে মার্কিন প্রতিনিধিরা খুশি হয়েছিল, সেই তাদের মুখেই ঝামা ঘষে দেন ম্যাকব্রাইড ভিয়েতনাম যুদ্ধের সমালোচনা করে। ১৯৬৯ সালে ম্যাকব্রাইড স্বয়ং উত্তর ভিয়েতনাম পরিদর্শন করেন এবং মার্কিন বাহিনীর হাতে বেসামরিক মানুষের হতাহতের পরিমাণ দেখে হতবাক হয়ে যান। আসার সময় মার্কিনদের তৈরি বোমার অংশও নিয়ে আসেন ম্যাকব্রাইড এর প্রমাণ হিসেবে।
পরবর্তী বছরগুলোতে ম্যাকব্রাইড বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, চালান অনুসন্ধান। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলেন সম্ভবত ইরানে। ইরানের শাহের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তিনি স্বীকার করেন যে ইরানে বন্দীদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়, তবে তা অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে, ব্রিটিশ ও মার্কিন উপদেষ্টাদের নির্দেশনায়। পরবর্তীতে সাক্ষাৎকারের সরকারি সংস্করণেও ম্যাকব্রাইড নির্যাতনের কথা খুঁজে পান, যেখানে কেবল ব্রিটিশ ও মার্কিনদের বদলে ‘বৈদেশিক’ পরামর্শদাতা লেখা হয়েছিল। ইরানের বিপ্লবের কথা শুনে ম্যাকব্রাইড ততটা অবাক হননি। আয়াতোল্লাহ খোমেনির শাসনকালে চলা নির্যাতনের নিন্দা করলেও তিনি একে পশ্চিমা-সমর্থিত শাহের সরকারের কার্যক্রমের ফলাফল হিসেবেই মনে করতেন।
তার কাজের জন্যই ১৭৯৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার এবং ১৯৭৭ সালে লেনিন শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন ম্যাকব্রাইড, স্নায়ুযুদ্ধের দুই মেরুতে থাকা দুই মহাশক্তিধর দেশের উভয়ের কাছ থেকেই সম্মান কুড়ানো ব্যক্তি ম্যাকব্রাইড, আরেকজন লিনাস পাউলিং।
১৯৭৬ সাল। জীবনের ৭২ বছর কেটে গেছে, তার স্ত্রী, ছেলে, মা– সবাই পরলোকগমন করেছেন। একজন সাধারণ মানুষের কাছে অবসর নেওয়াই স্বাভাবিক। তবে ম্যাকব্রাইড সেই ধাতুতে গড়া ছিলেন না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন, দুই পরাশক্তির পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে মাথা ঘামানো শুরু করলেন তিনি, তখন তিনি ইন্টারন্যাশনাল পিস ব্যুরোর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকা বিভিন্ন অস্ত্র নির্মাণকারী কোম্পানির সমালোচনা করলেন, একইভাবে তার সমালোচনার শিকার হলো আফগানিস্তানের সোভিয়েত দখলদারিত্ব এবং পোল্যান্ডের সামরিক আইন। আশির দশকের প্রথমে গঠিত হওয়া লেবাননে ইসরায়েলি হামলা এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থী ক্যাম্পে ইসরায়েলিদের হত্যাযজ্ঞ নিয়েও আন্তর্জাতিক কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।
৮৩ বছর বয়সে ডাবলিনে মারা যান ম্যাকব্রাইড। এই বিশাল জীবনে কী না করেছেন! গেরিলা যোদ্ধা, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, মানবাধিকার কর্মী, শান্তিদূত। লক্ষ্যের তালিকাতেও রয়েছে রাজবন্দীদের অধিকার ও মানবাধিকার রক্ষা, ঔপনিবেশিক দেশগুলোর মুক্তি, আয়ারল্যান্ডের একতা এবং নিরস্ত্রীকরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়েও শন ম্যাকব্রাইড কি অনুচ্চারিতই থেকে যাবেন?