Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কলকাতার স্টিমার সার্ভিসের ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া রেঙ্গুন

১৮৫০-এর দশকের গোড়ার কথা। লন্ডনের পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর কলকাতায় স্কটিশদের এক ছোট কমিউনিটি ছিল, যারা ক্রমবর্ধমান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণকে কাজে লাগানোর সুযোগ খুঁজছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন উইলিয়াম ম্যাককিনন এবং রবার্ট ম্যাকেঞ্জি, পশ্চিম স্কটল্যান্ডের আর্গাইল কাউন্টি থেকে আসা দুই বন্ধু, যারা ১৮৪০-এর দশকে ভারতে চলে আসেন ভাগ্য ফেরানোর আশায়। বাংলায় দোকান স্থাপন করেন দুজনে মিলে, সেখান থেকে বঙ্গোপসাগরের তীরের বিভিন্ন বন্দরে পণ্য সরবরাহ করতেন। শেষমেশ গড়ে তোলেন ম্যাকিনন, ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোং।

উইলিয়াম ম্যাককিনন; ম্যাকেঞ্জিকে সাথে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন কলকাতা অ্যান্ড বার্মা স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি; Image Source: Wikimedia Commons

১৯৫৩ সালে ব্রিটিশরা বার্মার দক্ষিণ অংশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। সদ্য ত্রিশ পেরোনো এই জুটি এর ফলে বড় সুযোগের গন্ধ পেয়ে যান, যা তাদের কোম্পানিকে পরিণত করে বিরাট এক বহুজাতিক সাম্রাজ্যে। ১৮৬৭ থেকে ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার অফিসার হিসেবে কাজ করা ডেভিড জে মিচেল লিখেছেন,

উপমহাদেশের বাণিজ্যিক সুযোগগুলো কেবল রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণের মাধ্যমেই নয়, জাহাজের মাধ্যমেও বাণিজ্য সম্প্রসারণের উপায় ম্যাককিনন, ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোং-এর কাছে দারুণ সুযোগ মনে হয়েছিল।

রেঙ্গুনের যুদ্ধ (প্রথম অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধ); Image Source: Wikimedia Commons

ইরাবতী মোহনার নিম্নাঞ্চল এবং দক্ষিণ বার্মার উপকূলীয় অঞ্চলগুলো ব্রিটিশদের অধীনে চলে আসার দুই বছরের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতা এবং রেঙ্গুনের মধ্যে একটি নিয়মিত মেইল ​​স্টিমশিপের জন্য দরপত্র আহ্বান করে। স্কটিশ যুগল তাদের বিডের মাধ্যমে এই পুরো সুযোগ লুফে নেয় এবং ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির পূর্বসূরি কলকাতা অ্যান্ড বার্মা স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে।

ক্রমবর্ধমান রেঙ্গুন

কলকাতা অ্যান্ড বার্মা স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি চিঠি এবং ডাক পরিবহনের জন্য স্টিমারের এক ছোট বহর কেনে। কলকাতার সাথে আকিয়াব, রেঙ্গুন এবং মৌলমেইনের সাথে নিয়মিত ডাক পরিবহনের জন্য দুটো জাহাজ কাজ শুরু করে, যারা প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর ডাক পরিবহন করতো।

১৯০৮ সালের রেঙ্গুন, ইরাবতী নদীর তীরে; Image Source: The Print Collector/Print Collector/Getty Images

৫০০ টন ওজনের স্টিমার কেপ অব গুড হোপ কলকাতা থেকে রেঙ্গুনে ডাক, পণ্য এবং যাত্রী বহনকারী প্রথম জাহাজ হিসেবে ১৮৫৬ সাল থেকে কাজ শুরু করে। এক বছরের মধ্যেই, ১৮৫৭ সালের ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়। কলম্বো থেকে কলকাতায় ব্রিটিশ সৈন্যদের পরিবহনের জন্য জাহাজটি ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, কেপ অব গুড হোপের সাথে প্রায় একই আকারের ‘বাল্টিক’ নামে আরেকটি স্টিমার কলকাতা-রেঙ্গুন রুটে যুক্ত হয়। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের এই বাণিজ্য খুব দ্রুত বাড়তে থাকে। আটটি ভিন্ন জাহাজ ​পণ্য ​এবং যাত্রী পরিবহন শুরু করে। ফলে গুরুত্বের দিক থেকে রেঙ্গুন উপমহাদেশে কলকাতার পরেই দ্বিতীয় প্রধান শহর হয়ে ওঠে। রবিবার বাদে প্রতিদিন অন্তত একটি জাহাজ রেঙ্গুনে থামতো বলে জানা যায়।

১৮৫২-৫৩ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যখন লোয়ার বার্মাকে সংযুক্ত করে নেয়, তখন রেঙ্গুনের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩০ হাজার। ১৮৮১ সালের মধ্যে সংখ্যাটি ৫ গুণ বেড়ে দেড় লক্ষে দাঁড়ায়। স্টিমার সার্ভিসটির ফলে পণ্য আর শ্রমিক ভিড় জমায় রেঙ্গুনে, শহরটিকে একটি বড় গ্রাম গ্রাম থেকে বাণিজ্যের কেন্দ্রে রূপান্তর করেছ। ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রসের এক গবেষণাপত্রে শিক্ষাবিদ উমাশঙ্কর সিং উল্লেখ করেন,

শহরের কেন্দ্রীয় অংশের বিকাশ করতে দুই দশক (১৮৬২-৭২) সময় লেগে যায়। আর এর সবই হয়েছিল ভারতীয় ঠিকাদারদের মাধ্যমে আমদানি করা ভারতীয় শ্রমিকদের মাধ্যমে। নিম্ন বার্মায় বাণিজ্য ও কৃষির সম্প্রসারণের সাথে সাথে রেঙ্গুনের আকারও দ্রুত বাড়তে থাকে। ভারতের সাথে বার্মার স্টিমশিপ যোগাযোগ প্রবর্তনের ফলে রেঙ্গুনে ভারতীয় অভিবাসীদের আগমন হয় এবং তাদেরকে জায়গা দিতে নতুন আবাসন তৈরি হতে থাকে।

১৯৩৩ সালের রেঙ্গুন বন্দর; Image Source: Hulton Archive/Getty Images)

১৮৬১ সালে ম্যাকিননের প্রতিষ্ঠা করা কলকাতা অ্যান্ড বার্মা স্টিম নেভিগেশন কোম্পানিকে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। কোম্পানিটি ১৮৫৭ সালের যুদ্ধে সাহায্যের জন্য ব্রিটিশ শাসকদের অনুগ্রহ পায় এবং ভারত থেকে অন্যান্য উপনিবেশে সৈন্য পরিবহনের নিয়মিত চুক্তির সুযোগ লাভ করে। স্টিমারগুলো প্রায়ই কলকাতা এবং রেঙ্গুন থেকে ব্রিটিশ সৈন্যদেরকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে নিয়ে যেত। ১৮৬০-এর দশকে মাওরি যুদ্ধের জন্য সুদূর নিউজিল্যান্ড পর্যন্তও সৈন্য পরিবহনের কাজ করেছিল কোম্পানিটি।

১৮৭০-এর দশকে কলকাতা হয়ে ওঠে বিশ্বের অন্যতম প্রধান জাহাজবন্দর। বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে জাহাজ চলাচলের বেশ কিছু নতুন রুট চালু হয়। আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ার এবং কামোর্তা (নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ) হয়ে রেঙ্গুনের উদ্দেশ্যে কলকাতা থেকে সপ্তাহে চারবার জাহাজ ছেড়ে যেত। কলকাতা থেকে রেঙ্গুন হয়ে পেনাং এবং সিঙ্গাপুরের মতো মালয় প্রণালীর বন্দরগুলোতেও একটি পাক্ষিক স্টিমার চলাচল করতো।

রেঙ্গুনের গভর্নমেন্ট হাউজ; Image Source: Inside Asia Tours

বার্মার ভারতীয়রা

ভাগ্য ফেরানোর আশায় আর পরিবহন ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় ভারতীয়রা দলে দলে বার্মায় পাড়ি জমায়। এদিকে বার্মা ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের অংশ থাকায় ভারতীয়দের জন্য বিধিনিষেধও ছিল কম।

ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিতে শূন্যপদ দেখা দেওয়ায় সেই সুযোগ হাতছাড়া করেনি বাঙালিরা। মাইকেল অ্যাডাসের লেখা The Burma Delta: Economic Development and Social Change on an Asian Rice Frontier, 1852-1941 বই অনুসারে, ১৮৮১ সালে বার্মার ভারতীয় জনসংখ্যার ৩০ শতাংশই ছিল বাঙালি।

১৯০৯ সালে ব্রিটিশ ভারতের মানচিত্র; Image Source: Inside Asia Tours

উমা শঙ্কর সিংও তার গবেষণাপত্রে যোগ করেছেন, বার্মায় যাওয়া ৪০ শতাংশ বাঙালি অভিবাসী ছিলেন মূলত চট্টগ্রামের। কলকাতা থেকে আকিয়াব পর্যন্ত যে স্টিমারটি চট্টগ্রামে থামতো, চট্টগ্রামের বাঙালি অভিবাসীদের মধ্যে সেটি বেশ জনপ্রিয় ছিল। স্টিমারটি কক্সবাজার থেকে বার্মায় ঢোকার আগপর্যন্ত বর্তমান বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ছোট বন্দরে থামতো।

বার্মায় ভারতীয় অভিবাসীদের চাহিদা এতটাই বেশি ছিল যে, মাদ্রাজ এবং বিশাখাপাটনামের মতো জায়গা থেকে স্টিমার সার্ভিস চালু করা হয়। ব্রিটিশরা শাসকরা ভারতীয় অভিবাসীদের বার্মায় পরিবহনের জন্য শিপিং কোম্পানিগুলোকে ভর্তুকি দেওয়া শুরু করেছিল। যার ফলাফল, উনবিংশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দীতে যেতে না যেতেই রেঙ্গুনের জনসংখ্যার প্রায় ৫০ ভাগ ছিল ভারতীয়রা, যাদের অনেকেই বার্মার বিভিন্ন প্রান্তে সুপ্রতিষ্ঠিত। অ্যাডাসের তথ্যানুযায়ী, উনিশ শতকের শেষদিকে, বার্মায় ৬০ শতাংশেরও বেশি ভারতীয় অভিবাসী ছিলেন মাদ্রাজ থেকে আগত।

যুগের পরিসমাপ্তি

বিংশ শতাব্দীতেও কলকাতা-রেঙ্গুন স্টিমার সার্ভিসকে গুরুত্ব দিতে থাকে ব্রিটিশরা। যদিও বৈশ্বিক নৌ-পরিবহন শিল্প মন্দার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি রেঙ্গুন-কলকাতা রুটে লাভের মুখ দেখছিল। ১৯৩০ সালের মধ্যে দুই শহরের মধ্যে সপ্তাহে ১০টি স্টিমার চলাচল করতো। সে সময়ের সংবাদপত্রগুলোতেও দেখা যায়, স্টিমারগুলো তাদের সময়ানুবর্তিতার জন্য পরিচিত ছিল। কলকাতা থেকে রেঙ্গুনে যেতে দুই দিন সময় লাগতো, তারপর আড়াই দিনের মধ্যে কার্গো লোড এবং আনলোড করে পুনরায় কলকাতায় ফিরে আসতো।

১৯০০ সালের রেঙ্গুনের প্রাণকেন্দ্র মার্চেন্ট স্ট্রিট; Image Source: Getty Images

ব্রিটেন থেকে বার্মার মধ্যে ডাক যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল স্টিমার। বার্মায় পাঠানো ডাক ​​জাহাজে করে বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) পাঠানোর পর সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতায় পাঠানো হতো। রেঙ্গুনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া ফেরিতে ডাকগুলো উঠিয়ে দেওয়ার জন্য সেগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হতো ডায়ামন্ড হার্বারে। ১৯৪২ সালে বার্মায় জাপানের আক্রমণের আগপর্যন্ত এই ব্যবস্থা চালু ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারত ও বার্মা যথাক্রমে ১৯৪৭ এবং ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর স্টিমার সার্ভিসটি পুনরায় চালু করা হয়। পঞ্চাশের দশক থেকে ব্রিটেন থেকে বার্মায় ডাক পৌঁছানোর জন্য এয়ারমেইল ব্যবহার শুরু হয়, এবং তারপর থেকেই ডাকবহনকারী ​​স্টিমারটি অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে শুরু করে।

কলকাতা-রেঙ্গুন ফেরি স্টিমার সার্ভিস ঠিক কবে বন্ধ হয়েছে সে বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। রেঙ্গুনে (বর্তমানে ইয়াঙ্গুন) ওয়াইএমসিএ-র একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীর মতে, তিনি ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ফেরিতে করে কলকাতায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন। প্রচুরসংখ্যক ভারতীয় অভিবাসী শ্রমিকরা ডেকে করে যেতেন, অন্যদিকে ব্রিটিশ কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ীরা তাদের কাজে প্রথম শ্রেণির কেবিন ব্যবহার করতেন।

১৯০০ সালে রেঙ্গুন রেলওয়ে স্টেশন; ১৮৭৭ সালে ব্রিটিশরা রেলওয়ে স্থাপন করলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিদের সুবিধার ভয়ে ১৯৪৩ সালে ইংরেজরা ধ্বংস করে দেয়; Image Source: Wikimedia Commons

অশোক কুমার এবং মধুবালা অভিনয় করা ১৯৫৮ সালের চলচ্চিত্র হাওড়া ব্রিজে দেখা যায়, চলচ্চিত্রের দুই নায়ক রেঙ্গুন থেকে কলকাতায় যাচ্ছেন। চলচ্চিত্রটির একটি দৃশ্যে দেখা যায়, অশোক কুমার যখন ডায়মন্ড হারবারে জাহাজ থেকে নামছেন, সেই জাহাজটির গায়ে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির চিহ্ন ছিল। এ থেকে প্রমাণ হয় পঞ্চাশের দশকের শেষ পর্যন্ত স্টিমার সার্ভিসটি নিয়মিতভাবেই চালু ছিল।

১৯৬২ সালে বার্মিজ নেতা জেনারেল নে উইন ভারতীয়দের দেশ থেকে বহিষ্কার করার পর ফেরি সার্ভিসটি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। ষাটের দশকে প্রায় ৩ লক্ষ ভারতীয়কে বার্মা থেকে বের করে দেওয়া হয়। বার্মিজ সরকার কেবল চায়ের দোকানদার, পানের দোকানদার এবং নাপিতদেরকে রেহাই দিয়েছিল। এই ভারতীয়দেরকে সরিয়ে নিতে ভারত সরকার বিশেষ ফেরি ও বিমানের ব্যবস্থা করে। এবং এভাবেই অবসান হয় প্রায় একশ বছর ধরে চলা দুই অঞ্চলের যোগাযোগের মূল মাধ্যমের।

This article is in Bengali. It is about the British Indian Steam Navigation Company.

References:
1. How a steamer service from Calcutta transformed Rangoon from an overgrown village to a boomtown - Ajay Kamalakaran - Scroll.in

Related Articles