‘ভাইকিংস’ টিভি সিরিজের সুবাদে ইন্টারনেট জগতে ভাইকিংরা এখন আমাদের পরিচিত মুখ। সিরিজের বিভিন্ন পর্বে পর্বে ভাইকিংদের অপার সাহসিকতার স্বরূপ আমরা দেখতে পাই তাদের পরের ভূমিতে দখল, লুটপাট চালানোর দুঃসাহসিক অভিযানের মাধ্যমে। যদিও ভাইকিংরা অদম্য সাহস আর ইচ্ছাশক্তি নিয়ে অভিযান চালানোয় পটু ছিল, তবে একবার তারা সেই সময়ের অন্যতম সমৃদ্ধ নগরী রোমে অভিযান চালাতে গিয়ে ভুল করে অন্য শহর লুনা দখল করে ফেলেছিল! আমরা আমাদের আজকের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব ভাইকিংদের ‘ভুল রোম’ বিজয় করার রোমাঞ্চকর কাহিনীতেই।
বিয়র্ন আয়রনসাইড ছিলেন কুখ্যাত ভাইকিং যোদ্ধা এবং সুইডেন ও ডেনমার্কের রাজা রাগনার লোথব্রকের ছেলে। তাকে অনেকে সুইডেনের মুনশো সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতাও বলে থাকেন। যদিও বিয়র্ন তখন তার ক্ষমতার শিখরে ছিলেন, কিন্তু অর্জনের দিক দিয়ে তাকে একপ্রকার তার বাবার ছায়া হয়ে থাকতে হয়েছিল, যা কোনো বীর যোদ্ধার জন্য বেমানান। তার বাবা ফ্রান্স, ইতালি এবং ইংল্যান্ডের বিস্তৃত অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে প্রচুর লুটপাট করেছিলেন, বিশেষ করে প্যারিসে দখলদারিত্ব চালিয়ে প্রায় ৭,০০০ পাউন্ডের মতো স্বর্ণ-রূপা লুট করেছিলেন। এসব অর্জন তাকে প্রাচীন বীর যোদ্ধাদের হল অব ফেমে স্থান করে দিয়েছিল।
তাই নিজের মাথার উপর থেকে বাবার ছায়া সরিয়ে দিতে এবং বীর যোদ্ধাদের কাতারে নিজের নাম লেখাতে বিয়র্ন আয়রনসাইড সিদ্ধান্ত নিলেন তখনকার দিনের অন্যতম শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ নগরী রোমে অভিযান চালানোর। সিদ্ধান্ত মোতাবেক আজ থেকে প্রায় সাড়ে এগারোশ বছর আগে, ৮৫৯ সালে, আয়রনসাইড এবং হ্যাস্টেইনের নেতৃত্বে ৬২টি জাহাজের বিশাল বহর নিয়ে ভাইকিংরা ভূমধ্যসাগরের দিকে যাত্রা শুরু করে। যাত্রাপথে তারা আইবেরিয়ান উপকূল, জিব্রাল্টার এবং দক্ষিণ ফ্রান্সে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় ও লুটপাট চালায়। শীতকাল ফ্রান্সে কাটিয়ে তারা ইতালির উত্তর দিকের শহর পিসা, ফ্লোরেন্স এবং ফিসোল আক্রমণ করতে করতে লুনা শহরের কাছে পৌঁছায়। স্বর্ণের ছাদসহ অনেকগুলো গির্জা দেখে ভাইকিংরা ভেবেছিল যে তারা রোম শহরে পৌঁছে গেছে!
শহরের প্রাচীরের কাছে পৌঁছানোর পর পরই তারা শহর অবরোধ শুরু করে, যদিও অনেকদিন অবরোধ করেও কোনো কুলকিনারা করতে পারেনি। এমতাবস্থায় অনেকদিন অতিবাহিত হবার পর বিয়র্ন এবং হ্যাস্টেইন একটি ধূর্ত পরিকল্পনা করেন। তারা লুনা শহরের বিশপের কাছে দূত পাঠান এই বলে যে তাদের নেতা মারা গিয়েছেন, কিন্তু মারা যাবার পূর্বে তার শেষ ইচ্ছে ছিল খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়া, এবং গির্জার কাছের পবিত্র মাটিতে সমাহিত হওয়া।
এই অনুরোধ শুনে শহরের বিশপ তাদেরকে কিছুতেই খালি হাতে ফেরত পাঠাতে পারলেন না। তিনি কয়েকজন রক্ষীসহ ভাইকিং নেতার লাশ নিয়ে শহরে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। পরিকল্পনানুসারে অল্প কয়েকজন ভাইকিং যোদ্ধা, যারা তাদের কাপড়ের নিচে তলোয়ার লুকিয়ে রেখেছিল, হ্যাস্টেইনের কফিন নিয়ে শহরে প্রবেশ করে। শহরের প্রবেশ করা মাত্রই হ্যাস্টেইন কফিন থেকে লাফ দিয়ে নেমে পুরোহিতদের অবাক করে দেয় এবং সাথে সাথে সব পুরোহিতকে হত্যা করে। এরপর সে ও তার সঙ্গী ভাইকিংরা গেটের রক্ষীদের হত্যা করে বিয়র্নের বহরকে শহরে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে শহরের সকল প্রতিরোধ চুরমার করে ভাইকিংরা শহরের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। হ্যাস্টেইন শহরের বাসিন্দাদের তার সামনে নতজানু হয়ে তাকে ‘রোমের বৈধ শাসক’ হিসেবে সম্মান জানাতে বলেন। কেউ কিছু বলার সাহস করেনি, শুধুমাত্র একজন ছাড়া; তিনি হ্যাস্টেইনের কাছে ব্যাখ্যা করে বললেন শহরটি রোম নয়, লুনা। রোম এখান থেকে প্রায় ২৫০ মাইল দূরে। এ কথা শুনে রাগান্বিত বিয়র্ন এবং হ্যাস্টেইন শহরের বাসিন্দাদের কঠিন শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করে- শহরের সকল পুরুষকে হত্যা করে এবং নারী ও শিশুদের দাস হিসেবে নিয়ে নেয়।
ফিরতি পথে দুঃখভারাক্রান্ত ভাইকিং যোদ্ধাদের মোকাবেলা করতে হয় আন্দালুসিয়ার মুসলিম বাহিনীকে, যারা বিয়র্ন এবং হ্যাস্টেইনের বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করছিল। আন্দালুসিয়ার মুসলিম বাহিনীর সাথে ভাইকিংদের এই যুদ্ধ ছিল তাদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো। কেননা, এই যুদ্ধ তাদের জন্য করুণ পরিণতি বয়ে এনেছিল। মুসলিম বাহিনীর সাথে যুদ্ধে ভাইকিংরা তাদের ৬২টি জাহাজের মধ্যে ৪২টিই হারিয়েছিল। ২০টি জাহাজ অক্ষত অবস্থায় নিয়ে তারা কোনোরকমে পালাতে সক্ষম হয়।