ধরুন মেক্সিকোর অ্যাজটেক স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ড বনাম আর্জেন্টিনা ম্যাচ চলছে। ম্যারাডোনা বল নিয়ে ইংল্যান্ড রক্ষণ ভেদ করে ছুটে চলেছেন, আর ইংলিশ ডিফেন্স মন্ত্রাহত ফণিনীর মতো চেয়ে দেখছে খুদে যাদুকরের ছুটে চলা। কিন্তু সময়টা ১৯৮৬ নয়। সময়টা এখন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সময় – ২০২২ সাল। এখন ম্যারাডোনা যদি হাত দিয়ে ঐ কুখ্যাত গোল করতেন, তবে কি হতো? ১৯৮৬ বিশ্বকাপে প্রযুক্তি তেমন উন্নত ছিল না। তাই ম্যারাডোনার হাত দিয়ে গোল করার বিষয়টা ধরতে ধরতে ৩-৪ মিনিট লেগে গিয়েছিল। কিন্তু এই যুগে ঐ গোল ধরে ফেলা তো রীতিমত ডালভাত।
তাই আজকের সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং প্রযুক্তির সামনে ম্যারাডোনা কখনোই হাত দিয়ে গোল করে পার পেতেন না। ঐ গোল তো বাতিল করা হতোই, সাথে হাত দিয়ে গোল করার দোষে ম্যারাডোনা লাল কার্ডও পেতে পারতেন। সেক্ষেত্রে ইংল্যান্ড বনাম আর্জেন্টিনা ম্যাচের ভাগ্যই পাল্টে যেত।
তাই প্রযুক্তিকে ফাঁকি দিয়ে নিয়মবহির্ভূত কাজ করে পার পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বর্তমান ফুটবলে খুবই কম। নানা ধরনের যন্ত্র এবং কম্পিউটার খেলার মাঝেই সাহায্য করছে মাঠে থাকা এবং তৃতীয় রেফারিকে। আর ফুটবলে প্রযুক্তির ব্যবহার ও তার অগ্রগতি কিন্তু থেমে নেই। প্রতিনিয়ত নতুন প্রযুক্তি আসার পর সেটা বাজিয়ে দেখা হচ্ছে ফুটবলের মাঠে। বাদ যাচ্ছে না কাতার বিশ্বকাপও। অফসাইডকে আরও পরিষ্কার ও নির্ভুলভাবে ধরার নতুন এক পদ্ধতি বাজিয়ে দেখা হবে এবারের আসরেই।
ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি
২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল ‘ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি’ বা ‘ভিএআর’। ম্যাচের ভিডিও দেখে নতুনভাবে সিদ্ধান্ত নেবার পদ্ধতির ব্যবহার অনেক আগে থেকেই ক্রিকেটে ছিল। রাশিয়া বিশ্বকাপে বাজিয়ে দেখার আগে ইউরোপের বিভিন্ন লিগেও এই ‘ভিএআর’ ব্যবহার করা হয়েছিল। রাশিয়াতে প্রথম ব্যবহার করায় ‘ভিএআর’ দিয়ে যেমন দল উপকৃত হয়েছে, তেমনই কিছু সিদ্ধান্ত ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তবে নতুন এক প্রযুক্তিকে প্রথমেই একেবারে নির্ভুলভাবে প্রযোগ করা যায় না। কারণ কাগজে-কলমে যেভাবে চিন্তা করা হয়, ব্যবহারের সময় ঠিক তেমনভাবে পাওয়া না-ও যেতে পারে। তাই সময়ের সাথে এখন আরও উন্নত হয়েছে ‘ভিএআর’। কাতার বিশ্বকাপে এই প্রযুক্তি অবশ্যই থাকবে। কিন্তু সেটা গত বিশ্বকাপের থেকে আরও উন্নত ও নির্ভুলভাবে তথ্য দেবে বলে আশা রাখছে এবারের আয়োজকেরা।
অ্যাডভান্স কুলিং টেক
কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে প্রথমেই যে সমস্যা সামনে এসেছিল, সেটা হচ্ছে সেখানকার প্রচন্ড গরম আবহাওয়া। এই সমস্যা সমাধানের জন্য এবারের বিশ্বকাপ পিছিয়ে নেওয়া হয়েছে নভেম্বর-ডিসেম্বরে। কারণ এই সময়ে কাতারের আবহাওয়া তুলনামূলক ঠান্ডা থাকে। কিন্তু এই তুলনামূলক ঠান্ডা তো শুধুমাত্র কাতারের বাসিন্দাদের জন্য। এমনিতেই বিশ্বকাপে কাঁপছে পুরো বিশ্ব। আর ম্যাচ মাঠে গড়ালে, স্টেডিয়াম তো ক্রমে ক্রমে তেঁতে উঠবে। সেক্ষেত্রে ইউরোপ থেকে আসা ফুটবলার ও অগণিত সমর্থকেরা স্বস্তিতে বিশ্বকাপ পার করতে পারবে তো?
বিষয়টা আয়োজকদের মাথায় আগে থেকেই ছিল। তাই এই সমস্যার সমাধান করেছে ‘অ্যাডভান্স কুলিং টেক’ নামে নতুন এক প্রযুক্তি। এবারে মোট ৯টা স্টেডিয়ামে খেলা হবে। তার ভেতরে ৮টা স্টেডিয়ামে এই প্রযুক্তির ব্যবহার করেছে তারা। ফলে গ্যালারিতে থাকা দু’দলের সমর্থক এবং মাঠে থাকা ফুটবলার – সবার জন্য মাঠের তাপমাত্রা সহনীয় মাত্রা থাকবে। স্টেডিয়াম ৯৭৪ এ তারা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়নি, কারণ স্টেডিয়াম উপকুলের বেশ কাছে। তাই কৃত্রিমভাবে ঠান্ডা করার কোনো প্রয়োজন নেই।
প্রত্যেক স্টেডিয়ামের কাছে একটি করে ষ্টেশন বসিয়েছে তারা। যেখান থেকে পাইপলাইনে নির্দিষ্ট তাপমাত্রার পানি নিয়ে আসা হবে ভেন্যুর কাছে। এবং এই পানিকেই ঠান্ডা বাতাস বানিয়ে পুরো মাঠে ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
স্টেডিয়াম যেন খেলনা
বিশ্বকাপ আয়োজক দেশ প্রায় সময়ই তাদের স্টেডিয়ামকে নতুনভাবে সংস্কার করে। অধিকাংশ সময়ে নতুন স্টেডিয়াম বানানো আবশ্যক হয়ে পরে। কিন্তু বিশ্বকাপের পর সেসব স্টেডিয়াম পরিণতি হয় কী? অনেক সময়ই দেখা যায়, বাড়তি স্টেডিয়ামগুলো হয়ে পরে দেশের বোঝা। সংস্কার ও দেখাশোনার অভাবে সেগুলো ক্রমশ নষ্ট হতে থাকে।
এই সমস্যার কথা ভেবে কাতার এবার অভাবনীয় এক স্টেডিয়াম তৈরি করেছে। ‘স্টেডিয়াম ৯৭৪’ বানানো হয়েছে শিপিং কন্টেইনার এবং স্টিলের ফ্রেম দিয়ে। স্টেডিয়াম পুরো লেগোর মতো। এজন্য বিশ্বকাপ শেষে এই স্টেডিয়ামের নামগন্ধ নাও থাকতে পারে। কারণ লেগোর মতো স্টেডিয়াম ৯৭৪ খুলে নেওয়া যাবে, বহন করা যাবে এবং অন্য কোনো দেশে বা অন্য কোনো স্থানে আবার জোড়া দিয়ে স্টেডিয়াম বানানোও যাবে।
বিশ্বকাপের ইতিহাসে স্টেডিয়াম ৯৭৪-ই প্রথম অস্থায়ী স্টেডিয়াম। যেটা বানানে যেমন কম খরচ হয়েছে, তেমনি সাধারণ কোনো স্টেডিয়ামের থেকে কম ধাতব পদার্থ লেগেছে এই স্টেডিয়ামকে বানাতে। বিশ্বকাপে এই ভেন্যুতে মোট ম্যাচ খেলা হবে ৭টি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন বল
‘আল রিহলা’ নামক এবারের বিশ্বকাপের বল আদতে একটা অভাবনীয় এক প্রযুক্তি। ‘বল টেকনোলজি’ নামের এক পদ্ধতি এই বলের ভেতর থাকার কারণে প্রতি মুহূর্তে ম্যাচের তথ্য ভিএআর রেফারির কাছে পাঠাবে। এই তথ্য বিভিন্ন রকমের হতে পারে। যেহেতু ভেতরে গতি বুঝতে পারার সেন্সর রয়েছে, সেক্ষেত্রে এই সম্প্রকৃত সকল তথ্য মুহূর্তের ভেতর পেয়ে যাবে মাঠের বাইরে বসে থাকা রেফারিরা। এছাড়াও ফিফার নতুন ‘সেমি-অটোমেটেড অফসাইড টেকনোলজি’কে বাস্তবায়ন করতে এই নতুন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন বল বিশেষ ভূমিকা পালন করবে।
সেমি-অটোমেটেড অফসাইড টেকনোলজি
২০১৮ বিশ্বকাপে ‘ভিএআর’কে পরিচিত করানোর পর ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনো জানিয়েছিলেন ‘দ্য ভিশন ২০-২৩’ এর কথা। যেখানে বলা হয়েছিল ‘ভিএআর’কে আরও উন্নত করা এবং ফুটবলকে আরও সঠিক ও নির্ভুল করতে প্রযুক্তির ব্যবহারের কথা। ৯০ মিনিটের ফুটবলে অতিরিক্ত সময় তো আগে থেকেই ছিল। আর এখন যেহেতু রেফারি ভিডিও’র সাহায্যে অফসাইড, গোল বা ফাউলের মতো বিষয়গুলো দেখে, সেটা অবশ্যই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অ্যাডিডাস এবং আরও বেশ কিছু পার্টনার এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাহায্য নিয়ে ফিফা ইতোমধ্যে ‘ভিএআর’কে আরও কার্যকরী করে তুলেছে। আর এবার কাতারে তারা ব্যবহার করতে যাচ্ছে নতুন আরেক প্রযুক্তি: সেমি-অটোমেটেড অফসাইড টেকনোলজি।
এই প্রযুক্তি মাঠে আলাদা ১২টি ক্যামেরা দিয়ে ম্যাচের বলকে অনুসরণ করবে। এবং এই ক্যামেরাগুলো প্রত্যেকটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এরা মূলত ট্র্যাকিং ক্যামেরা। এছাড়াও ম্যাচে নামা প্রত্যেক খেলোয়াড়ের শরীরে ২৭টি জায়গায় বসানো ডেটা পয়েন্ট প্রতি সেকেন্ডে ৫০ বার জানিয়ে দেবে খেলোয়াড়ের যথাযত পজিশন। এই ডেটা পয়েন্টগুলো, তথা হিউম্যান স্কেলেটন ডেটা অফসাইড ধরতে আরও নিখুঁতভাবে রেফারিকে সহায়তা করবে।
যদিও হিউম্যান স্কেলেটন ডেটার পাশাপাশি বিশ্বকাপের বলও বলে দেবে অফসাইডের কথা। কারণ বলের একদম মাঝে রয়েছে সেন্সর। এবং এই সেন্সর ভিডিও অপারেশন রুমে প্রতি সেকেন্ডে ৫০০ বার বল থেকে পাওয়া ডেটা পাঠিয়ে দেবে।
এই সকল প্রকার তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজে নিজেই অফসাইডের সংকেত পাঠিয়ে দিতে সক্ষম। এবং এই বিশ্লেষণ হবে খুবই অল্প সময়ের মাঝে। কারণ মাঠে থাকা কোনো খেলোয়াড় অফসাইডে গিয়ে গোলমুখে শট নিয়ে বা অফসাইড থেকে বল রিসিভ করলে সাথেসাথে সেটার সংকেত পৌঁছে যাবে ভিডিও অপারেশন রুমে। এরপর সেখানে থাকা রেফারি এই পাঠানো সংকেত নিজে হাতে একবার পরখ করে দেখবেন। এবং তিনি নিশ্চিত করার পর, সংকেত পৌঁছে যাবে মাঠে থাকা রেফারির কাছে। তিনি তখন দ্বিতীয়বার ভাবনাচিন্তা না করে এবং ‘ভিএআর’ রিপ্লাই না দেখেই অফসাইড সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারবেন।
এমনিতে অফসাইড হলে এখন ভিডিও দেখে তারপর সিদ্ধান্তে আসতে হয়। আবার অনেক সময় সেটা সঠিকও হয় না। কিন্তু এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সিন্ধান্ত যেমন হবে নির্ভুল, তেমনই সময়ও বাঁচবে। এছাড়াও মাঠে ঘটা অফসাইডের সংকেত চলে আসবে থিডি অ্যানিমেশন ভিডিওতে। যাতে করে আরও সঠিকভাবে অফসাইড সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব।
তবে এই প্রযুক্তি যেহেতু প্রথমবার ফুটবলে ব্যবহার করা হচ্ছে। এজন্য ফিফা চাচ্ছে না, একদম প্রথমেই সবকিছু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে ছেড়ে না দিতে। এজন্যই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অফসাইডের সংকেত দিতে সেটা ভিডিও অপারেশন রুমে একবার হাতে-কলমে দেখে নিয়ে তারপর মাঠে থাকা রেফারির কাছে পাঠানো হবে। এজন্য এই প্রযুক্তির নাম দেওয়া হয়েছে ‘সেমি অটোমেটেড।’
আর এই লেখাটা যতক্ষণে পড়ছেন, নিঃসন্দেহে আয়োজনের প্রথম ম্যাচেই দেখে ফেলেছেন এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা।
বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা
কাতারে থাকবে জন্মগতভাবে দেখতে না পাওয়া মানুষদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। ‘বোনোক্লে’ নামক নতুন একটি যন্ত্র ডিজিটাল কন্টেন্টকে ব্রেইল মেসেজে রূপান্তর করতে সক্ষম। ঠিক নিজের চোখ দিয়ে না হলেও কাতার বিশ্বকাপ উপভোগ করতে এখন কেউ পিছিয়ে নেই।
—
এই বিশ্বকাপ কাতারে আয়োজন করা নিয়ে নানা মুনির নানা মত ছিল। কাতারের আবহাওয়া, অসময়ে বিশ্বকাপ আয়োজন, কাতারের মুসলিম আচার-আচারণ ও অনেক নিষেধাজ্ঞা নিয়ে অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন ছিল। তবে কাতার কেমন করেছে, সেটা জানা যাবে বিশ্বকাপের পর্দা উঠতেই। কিন্তু এই বিশ্বকাপ যে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে নতুন এক দিগন্ত খুলে দিচ্ছে, সেটা বলাই বাহুল্য।