আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি সম্পদশালী রাষ্ট্র হচ্ছে ওমান। প্রবাসীদের কাজের ক্ষেত্রে এই দেশটির নাম বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই শুনে থাকবে। আরব সাগরপাড়ের তেল, পাহাড় আর বালির এই দেশটির আয়তন বাংলাদেশের দ্বিগুণ হলেও জনসংখ্যা মাত্র পঞ্চাশ লাখের মতো।
মধ্যযুগের অনেক ঐতিহাসিক দুর্গ রয়েছে মরুর এই দেশটিতে। মধ্যযুগের শুরুর দিকে নির্মিত বাহলা দুর্গ এর মধ্যে অন্যতম একটি স্থাপনা। এটি ওমানের একমাত্র স্থাপনা, যা ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এর অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য। স্থাপনাটি প্রাচীন হলেও একে নতুন এবং ব্যবহারোপযোগী করে তৈরি করেছিল বনী নাবহান রাজবংশ, যারা ১১৫৪ থেকে ১৬২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০০ বছর ওমানের শাসক ছিল।
ইসলামের প্রাথমিক দিনগুলোতে ওমান শাসিত হতো ইমামদের দ্বারা। ইমামগণ পার্থিব এবং আধ্যাত্মিক উভয় দিকেই জনগণের হর্তাকর্তা ছিলেন। আজ্দ গোত্রে ইয়াহমাদ শাখা নবম শতকে ওমানের ক্ষমতায় আসে। তারা এমন একটি ব্যবস্থা দাঁড় করায়, যেখানে বনী সামা গোত্রের ওলামাগণ ইমামদের নিয়োগ দেন। উল্লেখ্য, ওমানের সবচেয়ে বড় গোত্র ছিলো নিজারী গোত্র, যার সবচেয়ে প্রভাবশালী শাখা ছিলো বনী সামা। ধীরে ধীরে ইমামরাই দেশের হর্তাকর্তা হয়ে ওঠেন। কিন্তু ক্ষমতার অর্ন্তদ্বন্দ্বে ইমামদের শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং দেশে কার্যত কোনো কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না। এ সুযোগে ওমান হস্তগত হয় সেলজুক সাম্রাজ্যের।
মধ্যযুগে আরব অঞ্চলে অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিলো সেলজুকদের। তুর্কী-পারসিয়ান সুন্নী মুসলমান সেলজুকরা পশ্চিমে ইউরোপ থেকে পূর্বে হিন্দুকুশ পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করে। পারস্য উপসাগরের এলাকাগুলো সেলজুকদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। খ্রিষ্টীয় ১১শ ও ১২শ শতকে সেলজুকরা ওমান শাসন করেছে, ১১৫৪ সালে নাবহানদের দ্বারা বিতাড়িত হওয়ার আগ পর্যন্ত।
আরবিতে ‘নাবহান’ শব্দের অর্থ সতর্ক, সচেতন। নাবহান গোত্র একটি অপ্রধান সুন্নী মুসলমান গোত্র, যারা মূলত যাযাবর ব্যবসায়ী ছিল। গোত্রের বিচক্ষণ এবং অভিজ্ঞ কিছু ব্যক্তি ছোট ছোট কাফেলা তৈরি করে আরবের বিভিন্ন অঞ্চল স্কাউট করত এবং বাজার ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে মূল ক্যাম্পে ফিরে আসত। এরপর ব্যবসায়ীরা কিছু দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ত ব্যবসার উদ্দেশ্যে। কোন পণ্য কোথায় ভালো পাওয়া যায়, সেটা তারা জানত এবং সেখান থেকে এনে আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে যোগান দিত। ব্যবসা শেষে তারা আবার তাদের গোত্রের সাথে মিলিত হতো এবং নতুন কোনো জায়গায় চলে যেত।
নাবহানিরা ছিল খুবই বিচক্ষণ, সৎ এবং পরিশ্রমী ব্যবসায়ী। ভবিষ্যৎ হিসাব-নিকাশ এবং ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে তারা খুবই দক্ষ ছিল। ফলে পরবর্তী সময়ে তারা ওমানের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী শাসক হতে পেরেছিল। ব্যবসার সুবিধা বিবেচনা করে তারা দক্ষিণ ওমানে গিয়ে স্থায়ী হয়। একপাশে সাগর, অন্যপাশে সৌদি আরব ও ইয়েমেন, আরেক পাশে রাজধানী মাসকাট থাকায় তারা দোফার নামক প্রদেশে গিয়ে স্থায়ী বসতি তৈরি করে। বর্তমানে দোফার ওমানের বৃহত্তম প্রদেশ। তবে দোফারে স্থায়ী হওয়ার পেছনে মূল কারণ ছিল লোবান। পৃথিবীতে লোবানের প্রধান উৎস ছিলো দোফার এবং মধ্যযুগে লোবানের আকাশচুম্বী চাহিদা ছিল। এই লোবানের একচেটিয়া ব্যবসা করেই বনী নাবহানের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়।
লোবান (Frankincense) একধরনের সুগন্ধি, যা প্রধানত আতর এবং আগরবাতি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অনেকেই পড়ে থাকবেন। মধ্যযুগে এই লোবান নিষিদ্ধ তো নয়ই, বরং ব্যাপক চাহিদার পণ্য ছিল। কারণ ইসলামি শাসনের সূর্য তখন মধ্যগগণে; আতর তথা সুগন্ধির চাহিদা ও প্রসার তখন বিশ্বব্যাপী।
সুগন্ধি তেল হিসেবেও লোবান গাছের নির্যাস ব্যবহৃত হতো, যার চাহিদা ছিলো সার্বজনীন। লোবান তাই অনেক দামি পণ্য হিসেবে পরিগণিত হতো; এমনকি সবচেয়ে উন্নতমানের লোবান সিলভার ও হাজারি উৎপন্ন হতো মূলত দোফারে। নাবহানিরা সোহার বন্দর হয়ে বাহরাইন, বাগদাদ, দামেস্কসহ আরবের লোবানের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। এভাবে বনী নাবহান গোত্র প্রচুর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ করে। বিদেশী শাসনে অসন্তুষ্ট ওমানের জনগণের মধ্যে বনী নাবহান গোত্রের নেতা মুহাম্মদ আল-ফাল্লাহ ১১৫১ সালে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন এবং ১১৫৪ সালে সেলজুকদের বিতাড়িত করে ওমানের শাসনভার হাতে তুলে নেন। তিনি ১১৭৬ সাল পর্যন্ত ওমান শাসন করেন।
নাবহানিদের আগে পর্যন্ত ইমাম খেতাবধারি নামমাত্র শাসক বিদ্যমান ছিল। নাবহানিরা মুলুক বা সুলতান খেতাবে ওমান শাসন করতেন। ১৪০৬ সালে ইমাম মুসা বিন আবু জাফর মারা যাওয়ার পর ইমাম খেতাব তখনকার মতো বিলুপ্ত হয়ে যায়।
নাবহানি শাসকদের রাজধানী ছিল বাহলা, যা মাসকাট বন্দরের খুব কাছেই। ইসলামি যুগের পূর্বে বাহলার ইরানি শাসক ছিলেন তামমাহ, আর তার নামানুসারে বাহলা দুর্গের নাম ছিলো হিস্ন তামমাহ। এখানে উল্লেখ্য, বাহলা দুর্গ প্রথম কে নির্মাণ করেছিল, তার দলিলাদি পাওয়া যায়নি। নাবহান শাসনের আগে বাহলা দুর্গ কাদামাটি এবং অপর্যাপ্ত পাথর দিয়ে তৈরি সাময়িক স্থাপনা হিসেবে ছিল। নাবহানি শাসকরা একে নতুন করে মজবুতভাবে তৈরি করেন। দুর্গের ভেতরে একটি জামে মসজিদ আছে, যার মিহরাবে ১৪ শতকের কথা খোদাই করা আছে। বাকি স্থাপনাগুলো ঠিক কত সালে নির্মাণ বা সংস্কার করা হয়, তার সুনির্দিষ্ট দলিলাদি পাওয়া যায়নি। যেহেতু নাবহানিদের মূল শত্রু ছিল পারস্য উপসাগর পেরিয়ে হামলাকারী হরমুজ সাম্রাজ্য বা সেলজুকরা, তাই নাবহান শাসকদের দেশের বিভিন্ন স্থানে শক্তিশালী দুর্গ নির্মাণ করতে হয়েছিল।
১৫ শতকে এসে নাবহান শাসকদের প্রতিপত্তি কমে যেতে শুরু করে এবং ইমামদের পুনরুত্থান ঘটে। ১৫ শতক হতে ১৭ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ওমানে একজন নির্বাচিত ইমাম এবং একজন নাবহান বংশীয় সুলতান যৌথভাবে ক্ষমতায় থাকেন। ১৫০৭ সালে পর্তুগিজরা মাসকাট, সোহার ও পার্শ্ববর্তী উপকূলীয় এলাকা দখল করে নেয়। এর ফলে নাবহান ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য পারস্য অঞ্চলগুলোতে পাঠাতে সমস্যার সম্মুখীন হতে থাকে এবং পর্তুগীজরা দক্ষিণের সূর বন্দর দখল করে নিলে নাবহান শাসকরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ সুযোগে ১৫২৯ সালে, ইমাম মুহাম্মদ বিন ইসমাইল নাবহানি সুলতান সুলাইমান বিন মুদাফফর রাজনৈতিক ঘোরপ্যাঁচে ক্ষমতাবিহীন নামমাত্র সুলতানে পরিণত হন। কিন্তু ইমামগণের শাসনকার্যে অযোগ্যতার কারণে ওমান খুব দ্রুত পর্তুগিজদের দখলে চলে যায়।
১৬২৪ সালে ইয়ারুবা শাসক নাসির বিন মুরশিদ পর্তুগিজদের কাছ থেকে ওমান দখল করে নেন। বনী নাবহান গোত্র এরপর বনী রাওয়াহাহ এবং বনী রিয়াম গোত্রের সাথে একীভূত হয়ে যায় এবং সম্মিলিত গোত্রের নাম হয় ‘বনী রিয়াম’, যার তামিমাহ বা প্রধান ছিল বনী নাবহান গোত্রের। ইয়ারুবা শাসনামলে তারা পর্বতবেষ্টিত জাবাল আল-আখদার রাজ্য গড়ে তোলে এবং ওখানেই বসবাস করতে থাকে। এরপর ১৯৫৪ সালে ব্রিটিশদের মদদে ওমানের সুলতান সাইদ বিন তৈমুরের বিরুদ্ধে নির্বাচিত ইমাম গালিব আলহানির গৃহযুদ্ধ বাঁধে। এ যুদ্ধে অন্যান্য আরব দেশের পাশাপাশি বনী রিয়ামের শেখ সুলাইমান বিন হিমইয়ার আল-নাবহানি ইমামদের পক্ষ নিয়ে ১৯৫৬-৫৭ সালে জাবাল আল-আখদারের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সৌদি আরবে নির্বাসিত হন এবং ১৯৯৮ সালে মারা যান।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইয়ারুবা গোত্র আদি বনী নাবহানের একটি শাখা গোত্র এবং ইয়ারুবা শাসকগণ পরবর্তীতে ইমাম খেতাব নিয়ে ওমান শাসন করেন। নাবহানিরা ইবাদিজম নামক ধর্মদর্শনের অনুসারী ছিলেন, যা এখনো ওমানের মূল ধর্মদর্শন।
এ তো গেল নাবহান শাসনের ইতিহাস, এবার আসা যাক তাদের অনন্য স্থাপনা বাহলা দুর্গে। ১৭ শতকের শুরুতে পর্তুগিজদের হামলায় বাহলা দুর্গ প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। জাবাল আখদার যুদ্ধে স্থানীয় ওমানিরা যারা ইমামের পক্ষে ছিল, তারা এই দুর্গে ঘাঁটি করে এবং ১৯৫৭ সালে ব্রিটিশ বিমানের বোমা হামলায় দুর্গটি প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ফলস্বরূপ, ১৯৭০ এর দশকে দুর্গটি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। তখন ১২ বছরের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে দুর্গটির স্থাপনাগুলো পুনরুদ্ধারকার্য সম্ভব হয়।
বাহলা দুর্গ তৈরি করা হয় মূলত যাবরিন নামক মরুদ্যান এবং সিরিয়া ও ইরাকের লোবান বাণিজ্যপথকে রক্ষার জন্য। জাবাল আখদার পর্বতের পাদদেশে বড় পাথুরে দেয়াল দিয়ে ঘেরা দুর্গটির আয়তন ৮ বর্গ মাইল। দুর্গটির সীমানা সংলগ্ন বিভিন্ন উচ্চতার অনেকগুলো টাওয়ার রয়েছে, যার প্রত্যেকটিতেই সরু চেরা জানালা বা ঘুলঘুলি আছে। এগুলো থেকে আক্রমণকারীদের উপর গলিত সীসা ঢেলে দেয়া হতো। বাহলা দুর্গে চারটি গোলাকৃতি মিনার রয়েছে, যেখান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা যেত।
দুর্গটি প্রধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত। আল-কাসাবাহ দুর্গের সবচেয়ে পুরাতন অংশ, যা মধ্যযুগের প্রাথমিক পর্যায়ে নির্মিত। বাইতুল হাদিত অংশটি ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত সবচেয়ে সুরক্ষিত অংশ এবং বাইতুল জাবাল অংশটি পাহাড় সংলগ্ন, যা সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত।
দুর্গের নিচে বিশাল ভাঁড়ার বা শস্যাগার রয়েছে, যেখানে যাবরিন মরুদ্যান থেকে খেজুর এনে মজুত করে রাখা হতো। এখানে অনেকগুলো ঘর-বাড়ির সাথে দুটি প্রাচীন মসজিদও রয়েছে। মরুঝড় ও বৃষ্টিপাতে ক্ষতিগ্রস্ত দুর্গটিকে ২০০৪ সালে ইউনেস্কো ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
পর্যটকের জন্য উন্মুক্ত ওমানের রাজধানী মাসকাট থেকে গাড়িতে দু’ঘণ্টার পথ বাহলা দুর্গের ভেতর মরুদ্যানটি ফালাজ সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে সারা বছরই সবুজ থাকে।
মরুভূমিতে অবস্থিত পাহাড় সংলগ্ন দুর্গের ভেতর চিরসবুজ মরুদ্যান এই চারটির কালের সাক্ষী বাহলা দুর্গকে অনন্য এবং অতুলনীয় করে রেখেছে।