সুপ্রাচীন কাল থেকে মানুষের চিত্তবিনোদনের অন্যতম প্রধান একটি মাধ্যম হলো থিয়েটার বা নাটক। ‘Theatre’ শব্দটি পৃথক পৃথক পদে ব্যবহৃত হয়ে নাট্যশালা, নাটক ও নাটকের সাথে সম্পৃক্ত কাজকর্মকে (অভিনয়, পরিচালনা, প্রযোজনা, নাট্যলিখন ইত্যাদি) বোঝায়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে নাটক বা নাট্যকলার অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
গ্রিকদের দ্বারা উৎপত্তি লাভ করার পরে ধীরে ধীরে নাট্যকলা ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। সময়ের সাথে সাথে নাট্যকলার তত্ত্ব, গঠন, উদ্দেশ্য ও সংবেদনশীলতায় এসেছে প্রভূত পরিবর্তন। উনিশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে শুরু হয় সিনেমা বা চলচ্চিত্রের প্রচলন। মঞ্চে নট-নটীদের চাক্ষুষ অঙ্গচালনা ও সংলাপ সংবহনের স্থান দখল করে বিশাল পর্দা লাগানো প্রেক্ষাগৃহ। মাসের পর মাস ধরে ধারণ করা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিখুঁত কার্যশৈলীর স্থির চিত্রাবলী ত্বরিত প্রক্ষেপণের মাধ্যমে সচল করে তোলা হয় সাদা পর্দায়। বর্তমানে পৃথিবীর দেশে দেশে আলাদা আলাদা সিনেমাশিল্প গড়ে উঠেছে। তবে এতে মঞ্চনাটিকার আবেদন থেমে যায়নি। বরং যুগে যুগে উৎকর্ষ লাভ করা মঞ্চনাট্যের গঠন ও পঠনের তত্ত্বসমূহ ব্যবহার করেই নাট্যকার বা চিত্র পরিচালকগণ উন্নত করেছেন সিনেমাশিল্প। রুচিশীল এবং চিন্তাশীল মানুষদের এখনও মনোরঞ্জন ও চিন্তার খোরাক যুগিয়ে চলেছে মঞ্চনাট্য।
এই মঞ্চনাট্য বা থিয়েটারের এক বিশেষ ধরন হলো এপিক (Epic) থিয়েটার। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে মূলত জার্মান নাট্যকার বার্টল্ট ব্রেশটের (Bertolt Brecht) হাত ধরে এপিক থিয়েটারের জন্ম। ব্রেশটের জন্ম ১০ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৮ জার্মানির আউযবার্গে (Augsburg)। ১৬ বছর বয়স থেকেই তিনি বিভিন্ন সংবাদের ব্যাখ্যা, কবিতা ও ছোট গল্প লিখতেন এবং প্রকাশ করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ম্যাক্স রাইনহার্ট, আরউইন পিসকেটর ও বার্টল্ট ব্রেশটের মতো পরিচালকেরা এপিক থিয়েটারের স্টাইল ও কলাকৌশল জনপ্রিয় করে তোলেন
নৈর্ব্যক্তিকতা (Objectivity) এবং সহানুভূতির (Empathy) অনুপস্থিতি- এই দুই কৌশল ব্যবহার করে গড়ে তোলা হয় এপিক থিয়েটার, যা প্রথাগত ড্রামাটিক বা অ্যারিস্টটলিয়ান থিয়েটারের সম্পূর্ণ বিপরীত। অ্যারিস্টটল তার ‘Poetics’ এ নাটকের কলাকৌশল নিয়ে তার তত্ত্বসমূহ দিয়ে গেছেন, সেসব তত্ত্বকে ভিত্তি করে তৈরি নাটকগুলোকে অ্যারিস্টটলিয়ান বা ড্রামাটিক থিয়েটার বলা হয়। যারা মঞ্চনাটক দেখতে অভ্যস্ত নন, তাদের জন্য এই লেখায় আলোচিত দুই ধরনের থিয়েটারকে (ড্রামাটিক ও এপিক থিয়েটার) সিনেমার উদাহরণ দিলে বুঝতে সহজ হবে।
আগেই বলেছি, মঞ্চনাট্যের গঠন ও পঠনের তত্ত্বসমূহের ব্যবহার সিনেমাতেও করা হয়। ড্রামাটিক থিয়েটার হলো চিরাচরিত বাংলা বা প্রথাগত হিন্দী ছবি। এর থাকবে একটি সোজাসাপ্টা প্লট বা গল্প। প্রথমে কাহিনীর অবতারণা হবে; কাহিনীর প্রেক্ষাপট সম্পর্কিত তথ্য, চরিত্রদের পরিচয় ও মূল কাহিনীতে আসার আগে তাদের পেছনের ইতিহাস উপস্থাপন করা হবে। এই উপস্থাপনা হতে পারে চরিত্রদের পারস্পরিক সংলাপের মাধ্যমে, কোনো একক চরিত্রের অতীত রোমন্থনের মাধ্যমে, ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে অথবা হতে পারে একজন বর্ণনাকারীর ধারাভাষ্যে। এরপর চরিত্রগুলোর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং ধারাবাহিক কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার মধ্য দিয়ে কাহিনী এগোবে কোনো বড়সড় সংঘাতের দিকে।
কাহিনীর মধ্যে একধরনের উত্তেজনা তৈরি হবে এবং ধীরে ধীরে এই উত্তেজনা পৌঁছোবে ক্লাইম্যাক্স বা সর্বোচ্চ চূড়ায়। ক্লাইম্যাক্সে মূল চরিত্রের হালে পানি আসবে, অর্থাৎ তার ভাগ্য পরিবর্তন হবে। এরপর ক্রমাগত রহস্যের জট খুলবে, পাপীরা একে একে পরাজিত হবে, নিপীড়িত তার অধিকার আদায়ের পথে এগিয়ে যাবে, ঘটনাবলি এগিয়ে যাবে একরকম সংক্রান্তির দিকে। সবশেষে Catharsis এর মাধ্যমে হবে পরিসমাপ্তি। Catharsis হলো পুঞ্জীভূত আবেগের নিরসন।
উদাহরণস্বরুপ, চিরাচরিত বাংলা ছবির প্রেক্ষাপটে বলা যায়, একজন রিকশাওয়ালা দর্শক যখন দেখে নায়ক নিজেও একজন রিকশাওয়ালা এবং সে নিজ হাতে প্রতিদ্বন্দ্বী অহংকারী ধনী ব্যক্তিকে পরাস্ত করছে, সেই সাথে ধনীর দুলালী নায়িকাকেও বগলদাবা করছে, তখন শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিনিধি এই রিকশাওয়ালাটির মনে ধনিক শ্রেণীর প্রতি জমে থাকা ক্ষোভের প্রশমন ঘটতে থাকে। এর কারণ হলো, ড্রামাটিক থিয়েটারে মানুষ নাটকের সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত করে ফেলে। যেন নায়কের হাত দিয়ে স্বয়ং দর্শক রিকশাওয়ালাই খলনায়ককে শায়েস্তা করছে। এভাবে প্রায় প্রত্যেক দর্শকই নিজেকে কোনো না কোনোভাবে নাটক বা সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলে। এ ধরনের থিয়েটার বা সিনেমা সমাজে কোনো বড় ভূমিকা রাখতে পারে না। কারণ ঐ Catharsis এর মাধ্যমে আবেগের প্রশমন হয়ে যাওয়াতে মানুষের চিন্তাজগতের আলোড়ন স্তিমিত হয়ে যায়, মানব-মানসে তথা সমাজে বৃহত্তর কোনো বিপ্লবী চেতনা বা ভেঙে সাজানোর কোনো তাড়না আসে না।
এবার ফিরে আসি এপিক থিয়েটারের কথায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, যুদ্ধ পরবর্তী মন্দাকালীন সময়ে মধ্যম ও নিম্নশ্রেণীর মানুষের কষ্টভোগ, ১৯৩০ এর ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ এবং মার্ক্সের শিক্ষা- এ সবকিছু দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বার্টল্ট ব্রেশট ও তার সমসাময়িক নাট্যকারগণ এক নতুন ধরনের নাট্যপদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দর্শকদের চিন্তাজগতকে উদ্বুদ্ধ করা এবং আধুনিক যুগে চলমান সামাজিক অবিচার ও অসাম্যের সমালোচনা করতে তাদের সক্ষম করে তোলা। মূলত দুটি উপায়ে এপিক থিয়েটার তা করে থাকে- থিয়েট্রিকালিজম (Theatricalism) ও এলিয়েনেশন (Alienation) বা বিচ্ছিন্নকরণ। থিয়েট্রিকালিজম হলো দর্শককে এ বিষয়ে সচেতন রাখা যে, তারা যা দেখছে তা নিছক থিয়েটার মাত্র। চলমান অভিনয় যে বাস্তব জীবন নয়, সেই বিষয়ে দর্শককে সচেতন রাখা হয়। মঞ্চের সেট অতি সাধারণ রাখা, আলোকসম্পাতের যন্ত্রপাতি অনাবৃত রাখা, নাটকের সমাপ্তি অনির্ধারিত রাখা অথবা বর্ণনাকারীর সরাসরি দর্শককে উদ্দেশ্য করে কথা বলা প্রভৃতি উপায়ে দর্শককে বাস্তব ও নাটকের পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন রাখা হয়। আর এই সচেতনতা জাগিয়ে রাখার মাধ্যমেই দর্শককে অভিনেতাদের সাথে নিজেকে মিলিয়ে ফেলতে বাধা দেওয়া হয়। এভাবে দর্শককে থিয়েটারেরর সাথে সংযুক্ত হতে না দিয়ে বরং বিচ্ছিন্ন (Alienated) রাখা হয়। এর ফলে দর্শক যা দেখছে তাকেই স্বতঃসিদ্ধ ধরে না নিতে পারে না। মঞ্চে অভিনীত সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুগুলোকে সে সমালোচনা করার এবং প্রশ্ন তোলার সুযোগ পায়।
ভাইমার প্রজাতন্ত্রী (Weimar Republic) জার্মানির বার্লিনে বামপন্থী থিয়েটার ও ক্যাবারেগুলোতে এপিক থিয়েটারের নাট্যশৈলী সমৃদ্ধি লাভ করে। ১৯৩৩ সালে হিটলারের উত্থানে জার্মান জাতীয় জীবনে দুর্বিষহ হয়ে ওঠা ভাইমার প্রজাতন্ত্র উৎপাটিত হয়। স্বৈরশাসক হিটলার এপিক থিয়েটারের টুঁটি চেপে ধরেন। হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর গ্রেফতার ও নিপীড়ন এড়াতে ব্রেশটসহ আরও অনেক এপিক থিয়েটার চর্চাকারী নাট্যকার আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও ইউরোপের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়েন। সেই সাথে ছড়িয়ে পড়ে এপিক থিয়েটারও।
বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর সিনেমা তথা আধুনিক অনেক সিনেমায় ব্রেশটের এপিক থিয়েটারের নীতি ও পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কিছু সিনেমার নাম হলো ‘The 3 Penny Opera’ (1931), ‘Monsieur Verdoux’ (1947), ‘Death by Hanging’ (1968), ‘Artist in the Circus Dome: Clueless’ (1969), ‘Pierrot Le Fou’ (1965), ‘Katzelmacher’ (1969) ইত্যাদি। সিনেমাগুলোর নাম বা উৎস দেখলেই বোঝা যায় যে, এপিক থিয়েটার ছড়িয়ে পড়েছিল ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে। এশিয়াতেও কিন্তু এর প্রভাবের কমতি নেই। বাংলা সিনেমার জ্বলজ্বলে নক্ষত্র ঋতিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬০) এপিক থিয়েটারের এক অনবদ্য উদাহরণ।
একদম কাছাকাছি সময়ের একটি উদাহরণ দিতে গেলে এই বছরের শুরুতে বলিউডে মুক্তি পাওয়া ছবি ‘Why Cheat India’ (2019) এর উদাহরণ দেওয়া যায়। ইমরান হাশমী প্রযোজিত ও অভিনীত এবং সৌমিক সেন পরিচালিত ছবিটিতে তুলে ধরা হয়েছে ভারতজুড়ে চলমান প্রশ্নফাঁস ব্যবসা, প্রক্সি আডমিশন টেস্ট সিন্ডিকেট ও এর সাথে জড়িত অপরাধীদের প্রশাসনের নাগালের বাইরে থাকার কথা। সেই সাথে কীভাবে দেশ ধীরে ধীরে এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা দর্শকের চিন্তা-চেতনাকে প্রবলভাবে নাড়া দিতে বাধ্য। ছবিটির শেষে দর্শকের অন্তরে তীব্র অতৃপ্তি জাগবে। দর্শক অবশ্যই ভাবতে বাধ্য হবে যে, বিচার, টাকার খেলা, প্রহসন এসব তো চলতেই থাকে। অপরাধীরা সাজাপ্রাপ্ত হয়, আবার শিক গলে বেরিয়েও আসে। কিন্তু ‘স্ক্যাম’ কি থেমে থাকে, নাকি আরও বড় হয়? কীভাবেই বা তা হয়? আলোচনা থেমে গেলেই কি প্রক্রিয়া থেমে যায়? বলা বাহুল্য, বিষয়টি আমাদের দেশের জন্যও প্রচন্ড প্রাসঙ্গিক।
ব্রেশট বিশ্বাস করতেন, দর্শকের শুধু আবেগ নয়, চিন্তাকেও নাড়া দেয়া সম্ভব। সেটাই তিনি করে গেছেন। দর্শকের মনকে না ছুঁয়ে তিনি মাথাকে ছুঁতে চেয়েছেন। তিনি জানতেন, আবেগ দিয়ে পরিবর্তন আসে না, আসে বরং যুক্তি, চিন্তা ও উত্থিত অমীমাংসিত প্রশ্ন দিয়ে। আর তাই নিজ মেধা, মনন ও দায়িত্ববোধকে কাজে লাগিয়ে তিনি আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন এক বিশেষ ধরনের থিয়েটার, এপিক থিয়েটার।