তা’লা আল বাদরু আলাইনা
মিন ছানি’য়া তিল –ওয়া’দা
ওজাবাশ শুক’রু আলাইনা
মা দা আ লিল্লাহি দা
উপরের লাইনগুলো শোনেনি এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। প্রায় ১,৪০০ বছরেরও বেশি পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী এই গানটি ইসলামি সংস্কৃতির একটি অন্যতম নিদর্শন। এটি ইসলামি গজল বা নাশিদ নামেও পরিচিত। সিরাত ও ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাসুল হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যখন আল্লাহর নির্দেশে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন, তখন মদিনার আনসাররা এই গান গেয়ে তাঁকে নিজেদের মধ্যে বরণ করে নেন।
গান সবসময় মানুষের সংবেদনশীলতার সর্বজনীন অভিব্যক্তি, যা বাদ্যযন্ত্রের শব্দ এবং সুরের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। এটি প্রায়শই ব্যক্তিত্ব, সংস্কৃতি এবং স্বতন্ত্র পরিচয়ের প্রতিফলন।
আরবরা বহু আগে থেকেই গান-বাজনা বা সঙ্গীতচর্চা করত। যদিও সেসময় এটি শিল্পের প্রধান বাহক ছিল না, তথাপি আরবের উকাজ শহরে কবি ও গায়করা একত্রিত হতেন, এবং কবিতা বা গান পরিবেশনের মাধ্যমে তাদের প্রতিভা উপস্থাপন করতেন। মহিলা কবিরা তাদের গান বা কবিতার মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রে যোদ্ধাদের উৎসাহিত করতেন। মূলত, প্রাক-ইসলামী আরবের সঙ্গীতজ্ঞ ব্যক্তি ও কবিরা সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
বর্তমানে আরবি সঙ্গীত তাদের সংস্কৃতির সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং প্রাণবন্ত একটি ঐতিহ্য, যা পূর্ব ও পশ্চিমের বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে ঐতিহাসিক মিথস্ক্রিয়াকেও প্রতিফলিত করে। আরবি সঙ্গীতের ইতিহাসকে কয়েকটি প্রধান যুগে ভাগ করা যায়।
প্রাক-ইসলামি যুগের সঙ্গীত
প্রাক-ইসলামি সময়ে আরবরা নানা ধরনের গান গাইতেন, যেমন- মরুযাত্রীদের গান, ফৌজি গান, ধর্মীয় গান, প্রণয়ের গান ইত্যাদি। জানা যায়, মরুযাত্রীদের গান ‘হুদা’ ছিল আরবদের প্রিয়, এবং সম্ভবত এটাই প্রথম আরবসঙ্গীত। আল-মাসউদীতে এর নাম উল্লেখ রয়েছে। ইতিহাস বলে, আরব গোষ্ঠীগুলোর এক অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুযার-ইবন-মাআদ উট থেকে পড়ে গেলে তার হাত ভেঙে যায়। তখন তিনি তার সুরেলা কণ্ঠে কাঁদতে থাকেন: ইয়া ইয়াদা। ইয়া ইয়াদা! (অর্থাৎ, “ও আমার হাত! ও আমার হাত!”) উটের চলার ছন্দের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তিনি এই কথাগুলো বলেন। আর সেই কান্না থেকেই সৃষ্টি হয় ‘রাজাজ’ ছন্দের, যা সব ধরনের কাব্যছন্দ ও মরুযাত্রীদের গানে ব্যবহৃত হয়।
প্রথমটি হলো প্রাক-ইসলামী যুগ, যা ‘জাহিলিয়ার যুগ’ নামে পরিচিত। এই সময়ের সঙ্গীত সম্পর্কে আমাদের কাছে যত তথ্য আছে, যাকে সহজ ও আদিম বলে বর্ণনা করা হয়েছে, তা নবম শতাব্দী এবং তার পরবর্তী চিন্তাবিদদের কাছ থেকে প্রাপ্ত। প্রাক-ইসলামিক যুগে ৫ম থেকে ৭ম শতাব্দীর মধ্যে আরবি সঙ্গীত বিদ্যমান ছিল বলে জানা যায়। জাহিলিয়া যুগে সঙ্গীত সম্ভবত বিচরণ ও ভ্রমণের গানের সমন্বয়ে গঠিত ছিল, যেখানে সুরের চেয়ে গানের কথাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কাব্যিক ছন্দের জন্য ড্রাম বা উদের সাথে মৌখিক কবিতার আকারে এগুলোর প্রচলন ছিল বলে জানা গেছে। শুধুমাত্র একটি মাকাম বা সুর ব্যবহার করে গাওয়া গানগুলো সহজ ছিল। জানা যায়, ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য এবং অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্যের মতো প্রতিবেশী সংস্কৃতির সাথে আরবের যোগাযোগ ছিল, যা সেই সময়ে এই অঞ্চলে বিকাশ লাভ করেছিল। যাযাবর উপজাতিরাও প্রতিবেশী সমাজে সাংস্কৃতিক বার্তা বহন করে।
দক্ষিণ আরবিয়দের যে নিজস্ব গানের রীতি এবং যন্ত্রও ছিল তা সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তবে সেই রীতিগুলো উত্তরাঞ্চলে এবং ধীরে ধীরে মুসলিম ও আরব ঐতিহ্যেরই অংশ গড়ে ছিল কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। আল-হিজাজের প্রাক-ইসলামি যুগের অধিবাসীরা গান গাওয়ার সময় মূল যন্ত্র হিসেবে খঞ্জনি (দফ), বাঁশি (কাসাবাহ) এবং নল কাঠির বাজনা (মিজমার) ব্যবহার করতেন। তারা চামড়ার তৈরি বীণা (মিজহার) ব্যবহার করতেন। আল-হিরার লাখমিয়রা কাঠের তৈরি পারসীয় বীণা 2022-08-19 10:58:53 ছিল, যা হিজাজিরা ব্যবহার করতেন। জাহিলিয়ার অধিকাংশ পেশাদার গায়কই ছিলেন মহিলা। আল-খানসা ছিলেন হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর সমসাময়িক এবং আরবের মহান মহিলা কবি। প্রাক-ইসলামি যুগের বেশিরভাগ কবিই বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র দিয়ে তাদের গানগুলো গাইত।
ইসলামি যুগের সঙ্গীত
সর্বশেষ নবী ও রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন, এবং ৬২২ সালে ইয়াসরিবে (যা মদিনা নামে অধিক পরিচিত) চলে আসেন। দুই বছরের মধ্যে সমগ্র এলাকার মানুষ ইসলামকে তাদের ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে। এর ফলে ইসলামের বিজয়ের পথ আরও ত্বরান্বিত হয়, যা মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ইন্তেকালের পর তাঁর উত্তরসূরি রাশিদুন খলিফাদের মাধ্যমে এই ধারা অব্যাহত থাকে। তাদের প্রত্যেকে ইসলামি সাম্রাজ্যকে প্রসারিত করেন, এবং ইসলাম ধর্ম বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ইসলাম ধর্মের ঘরানার সাথে সম্পর্কিত সঙ্গীতও একইসাথে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
ইসলামের আগমনের পর হযরত মুহাম্মদ (সা.) মুয়াজ্জিন হিসেবে বিলাল ইবনে রাবাহকে নিযুক্ত করেছিলেন। বিলাল (রা.)-কে এই কাজে বাছাই করার কারণ হলো তাঁর কণ্ঠের সৌন্দর্য, সংগীত এবং শক্তি। তাঁর দেওয়া আযানে ছিল এমন সুর ও স্নিগ্ধতা, যা মনকে গভীর প্রশান্তি দিত। রাসুল (সা.) যখনই কোনো কিছুতে দুঃখ পেতেন, তখন তিনি বিলালকে বলতেন, “হে বিলাল, নামাযের আযানের মাধ্যমে আমাদের অন্তরকে সান্ত্বনা দাও।” যদি বিলাল (রা.) এমন মন্ত্রমুগ্ধ কণ্ঠের অধিকারী না হতেন বা তাঁর আযানের এমন প্রভাব না থাকত, তাহলে হয়তো রাসুল (সা.) অন্য কাউকে মুয়াজ্জিন হিসেবে বেছে নিতেন।
ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআন আরবি ভাষায় নাযিল হতে থাকে। কুরআন তেলাওয়াতের জন্য মাকাম বা সুরের উপর নির্ভর করা হয়, যা একে করেছে সুরেলা ও শ্রুতিমধুর। এর কাব্যিক শ্লোক সুরের মাধ্যমে পড়া হলে তা পাঠক ও শ্রোতার মনে আবেগ ও মুগ্ধতার সৃষ্টি করে। কুরআন তেলাওয়াত, যদিও এটি গান বা সঙ্গীত থেকে কিছুটা আলাদা, তবুও এটি উচ্চারণের জন্য কণ্ঠশক্তি এবং পেশী ব্যবহারের কৌশল প্রয়োজন। আবু মূসা আল-আশআরি (রা) এর তেলাওয়াতের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নবী মুহাম্মদ (সা.) তাঁর প্রশংসা করেন এবং বলেন, “হে আবু মুসা, তেলাওয়াতের জন্য আপনাকে দাউদ (আঃ) এর কণ্ঠস্বর দান করা হয়েছে।” (সহিহ বুখারি ৫০৪৮, মুসলিম ২৩৫)
উমাইয়া এবং আব্বাসীয় খিলাফতের সময় ইসলামি সঙ্গীতের প্রসার ঘটে। অনেক সঙ্গীতজ্ঞ ও গায়কের আবির্ভাবের মাধ্যমে সঙ্গীতের উন্নতি ঘটে। তৎকালে আরব, পারস্য, তুর্কি এবং বাইজেন্টাইনদের মধ্যে আন্তঃসাংস্কৃতিক আদান-প্রদান এবং সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে বাদ্যযন্ত্রের বিকাশ এবং নতুন বাদ্যযন্ত্রের রূপ ও শৈলীর আবির্ভাব ঘটে। ইসলামি সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির ফলে এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপের বৃহৎ অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে সংগীতের ব্যাপক বিনিময় ঘটে, যা আরবি সঙ্গীতে নতুন অধ্যায় যোগ করে।
খলিফা উসমানের (রা.) সময়ে স্বর এবং বাদ্যযন্ত্রর মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষার ব্যাপারটি আরবদের আয়ত্তে চলে আসে। সেই সময় আরবে পেশাদার পুরুষ গায়কদের আবির্ভাব ঘটে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল তুয়াইস (৬৩২-৭১০ খ্রি.)। তার বাড়ি ছিল মদীনায়। মুসলিম গায়কদের প্রথম প্রজন্মের নেতা ছিলেন এই তুয়াইস। তাকে ইসলামি জগতে সঙ্গীতের পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করা হয়। তুয়াইস আরবি সঙ্গীতে মিত্রাক্ষর ছন্দের কবিতার ব্যবহারের সূচনা করেন, এবং তিনিই প্রথম খঞ্জনি নিয়ে আরবি গান গেয়েছিলেন বলে জানা যায়। তার ছাত্রদের মধ্যে বিখ্যাত হলেন ইবনে সুরাইজ (৬৩৪-৭২৬ খ্রি.)। তাকে বিশ্বের সেরা চার মুসলিম গায়কের একজন বলে গণ্য করা হয়। তবে তিনি প্রথমদিকে ক্রীতদাস ছিলেন। তিনিই প্রথম পারসি কর্মীদের হাতে পারসি বীণা দেখেন, এবং তা আরবে প্রচলন করেন। পরে ‘নে’ (লম্বা বাঁশি) নামে এই কাঠের বাঁশিও পারস্যের অনুকরণে চালু হয় আরবে। তুয়াইসের বাকি ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন আল গারীদ, ইবন-মুহরিজ এবং মা’বাদ। গারিদ ছিলেন মূলত ক্রীতদাস। ইবন-মুহরিজ ছিলেন পারসি বংশজাত। তাকে ‘আরবদেশীয় করতালবাদক (সান্নাজ)’ হিসেবে গণ্য করা হতো। আর মা’বাদ পেশাদার চারণকবি হিসেবে সারা আরবে গান গেয়ে বেড়াতেন।
সাঈদ ইবন-মিসজ্জাহ ছিলেন মক্কার প্রথম এবং সম্ভবত উমাইয়া যুগের সেরা গায়ক, যিনি সিরিয়া ও পারস্যেও গান গাইতেন। তিনিই প্রথম বাইজান্টাইন এবং পারসি গান অনুবাদ করে আরবি গানে রূপান্তরিত করেন। তিনি আরবি সঙ্গীতকে নিয়মে বাধার চেষ্টা করেন এবং ধ্রুপদী আরবি সঙ্গীতের প্রচলন করেন।
তখনকার দিনের নামী গায়িকাদের মধ্যে ছিলেন জামিলা (মৃত্যু ৭২০ খ্রি.)। তিনি মদীনার ক্রীতদাস ছিলেন। তাকে প্রথম যুগের সংগীত সম্রাজ্ঞী বলে গণ্য করা হতো। তার বাড়িতে মক্কা এবং মদীনার শীর্ষস্থানীয় সুরকার ও সংগীতজ্ঞদের আসর বসত। এদের অনেকেই ছিলেন তার ছাত্রছাত্রী। তাদের মধ্যে যে বিখ্যাত ব্যক্তি তার বাড়িতে প্রায়শই আসতেন, তিনি হলেন ‘প্রেমের কবি’ উমর ইবন-আবি-রবীআহ্। মক্কাগামী এক তীর্থযাত্রীর দলের নেত্রী হওয়ার পর জামিলা খ্যাতির চূড়ায় ওঠে। এই দলে কবি, গায়ক, গায়িকা, সুরকার, বন্ধুবান্ধব ও গুণমুগ্ধরা ছিলেন। এই দলের প্রত্যেকেই ছিলেন সুন্দর, জাঁকজমক ও সুসজ্জিত পোশাক পরিহিত।
তখনকার দিনে অভিজাত মহিলারা বাড়িতে মাঝেমধ্যে গানবাজনার আসর বসাতেন। সেই সময়কার আরেক প্রিয় বাদ্যযন্ত্র ছিল ‘মিজাফা’। খ্রিস্টানদের প্রার্থনাসঙ্গীত গাওয়ার বাদ্যযন্ত্রের মতো ছিল এই বাজনা। অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ছিল বাঁশি (কাসাবা), নলকাঠি (মিজমার), শিঙ্গা, চারচৌকা খঞ্জনি (মহিলারা এই বাদ্যযন্ত্র খুবই পছন্দ করতেন), ড্রাম (তবলা), শক্ত কাঠ কিংবা হাতির দাঁতের তৈরি ছোট করতাল বিশেষ (সুনুজ)। উমাইয়া আমলে কবিতা গানে রূপান্তরিত করা হতো। মক্কায় হজের সময় সারা বিশ্বের খ্যাতনামা ব্যক্তিরা একত্রিত হতেন। সেখানে আল-হিজাজের গায়ক এবং বাজিয়েরা নিজেদের প্রতিভা জাহির করার সুযোগ পেতেন। এভাবে মক্কা, এবং বিশেষত মদীনা, উমাইয়া সাম্রাজ্যের গানের আঁতুড়ঘর হয়ে ওঠে।
সঙ্গীতের ক্ষেত্রে আইনবিশারদদের অসম্মতি দামাস্কাসে কিছুটা প্রভাব ফেললেও পরবর্তীকালে বাগদাদে এর কোনো কার্যকারিতা ছিল না বললেই চলে। উমাইয়া বংশের খিলাফত শেষ হওয়ার পর শুরু হয় আব্বাসীয় বংশের খিলাফত, যেখানে সঙ্গীতচর্চা আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের খিলাফতের কেন্দ্র বাগদাদ (৭৬২ সাল) এবং বিশেষ করে খলিফা হারুন আর-রশিদের শাসনামলে ও তার পুত্র আল-মামুনের শাসনামল পর্যন্ত, ৮১৩-৮৩৩ সালের মধ্যে সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটে। এই সময় বাইত আল-হিকমা (জ্ঞানের ঘর) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই সাথে সমস্ত গ্রীক লেখা আরবিতে অনুবাদ করার জন্য একটি উদ্যোগ নেয়া হয়। খলিফার দরবারের সঙ্গীতশিল্পী ইসহাক আল-মাওসিলি একজন সঙ্গীতশিল্পীর ভরণ-পোষণ করতেন যার নাম ছিল জিরিয়াব। একসময় সঙ্গীতে জিরিয়াব তার ওস্তাদ আল-মাওসিলিকে ছাড়িয়ে যান এবং তাকে আন্দালুসিয়ায় নির্বাসিত করা হয়। জিরিয়াব ৮২২ সালে কর্ডোবায় আসেন, এবং সাথে তার সঙ্গীতের তালিম নিয়ে আসেন। দ্বিতীয় আবদ-আল-রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় জিরিয়াব কর্ডোবায় একটি সঙ্গীত শিক্ষাকেন্দ্র খোলেন। এই শিক্ষাকেন্দ্র আন্দালুসিয়ার সংগীতের প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। সেভিল, টলেডো, ভ্যালেন্সিয়া এবং গ্রানাডায় এরকম আরো শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে ওঠে। তিনি স্পেনের ঈগলের বাঁকা নখরের মতো বীণা প্রভৃতির তার তোলার জন্য হাতির দাঁতের নির্মিত যন্ত্রের পরিবর্তে কাঠের যন্ত্র তৈরি করেন। তিনি বীণায় পঞ্চম একটি তারও সংযোজন করেন। ২৪টি স্কেলসহ আন্দালুসিয়ান নুবাহ, আন্দালুসিয়ান মিউজিক্যাল মেটা-স্ট্রাকচার তৈরির কৃতিত্বও তাকে দেওয়া হয়।
এই বংশের আল মাহদী তার দরবারে মক্কার সিয়াত (৭৩৯-৭৮৫ খ্রি.) ও তার ছাত্র ইব্রাহীম আল মাওসিলিকে (৭৪২-৮০৮ খ্রি.) আমন্ত্রণ জানানম এবং নানাভাবে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। পরে তাঁর ছাত্র ইব্রাহীম শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রধান ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
হারুন আর-রশীদের একজন আশ্রিত ব্যক্তি ছিলেন মুখারিক (মৃত্যু ৮৪৫ খ্রি.)। তিনি ছিলেন ইব্রাহীমের ছাত্র। শিশুবয়সে তাকে কাঁদতে দেখে, তার মিষ্টি ও জোরালো কন্ঠস্বর শুনে এক মহিলা সঙ্গীতশিল্পী মুখারিককে কিনে নেন। পরে হারুন আর-রশীদ তাকে মুক্ত করেন আর তার পাশের আসনে বসার অধিকার দিয়ে তাকে সম্মানিত করেন। এক সন্ধ্যায় টাইগ্রিস নদীর তীরে বেড়াতে বেড়াতে তিনি গান গাইতে থাকেন। তার কন্ঠস্বর এতই মধুর ছিল যে সেই অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পীর গান শোনার জন্য বাগদাদের রাস্তায় মানুষের ভিড় জমে যায় ৷
খলিফা হারুন আর-রশীদের রাজদরবারে বিজ্ঞান ও শিল্পকলার মতো সঙ্গীত ও গীতিকাব্য উভয়েরই পৃষ্ঠপোষকতা হতো। আর এ কারণে সেই দরবারটি একঝাঁক সঙ্গীতজ্ঞের মিলনকেন্দ্র হয়ে ওঠে। বেতনভোগী সঙ্গীতজ্ঞদের পাশাপাশি পুরুষ ও মহিলা ক্রীতদাসরা রাজদরবারের সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশ নিত এবং বিস্ময়কর ছোট ছোট কাহিনী শোনাত। এগুলোই পরে ‘অ্যারাবিয়ান নাইটস’-এর পাতায় জায়গা করে নেয়।
আরবের মুসলিম এবং ইহুদি উভয়ের দ্বারা সাংস্কৃতিক অগ্রগতি এবং শিল্পকলার সমৃদ্ধি ঘটে। সঙ্গীতের এই শৈলীতে ইহুদিদের অবদানও ছিল অনস্বীকার্য, এবং আরব দেশগুলোর ইহুদিরা সঙ্গীতকে প্রতিটি উপায়ে তাদের নিজস্ব সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করেছিল। এছাড়া, আরব দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গীতজ্ঞও ইহুদি ছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যের মিজরাহি এবং সেফার্ডিক ইহুদি প্রার্থনাগুলোতে প্রতিটি শাব্বাত দল আলাদা মাকাম বা সুর ব্যবহার করে প্রার্থনা পরিচালনা করে। একটি নির্দিষ্ট মাকামে ব্যবহৃত সুরের উদ্দেশ্য হলো পুরো প্রার্থনাগৃহ জুড়ে পাঠকের মানসিক প্রশান্তি দেওয়া।
এছাড়া বহু মুসলিম দার্শনিক ও চিকিৎসকও সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। ইবনে-আবি-উসাইবিয়া উল্লেখ করেছেন, আল-রাজি সঙ্গীতের উপর একটি বই রচনা করেছেন। বিশিষ্ট বীণাবাদক আল-ফারাবি ছিলেন মধ্যযুগে সঙ্গীততত্ত্বের ওপর সবচেয়ে বড় লেখক। ইউক্লিডের হারিয়ে যাওয়া বেশ কিছু বইয়ের উপর টীকাসহ তিনটি বই লেখেন, যেখানে তার মৌলিক চিন্তাভাবনার পরিচয় ফুটে উঠেছে। এগুলোর মধ্যে কিতাব আল-মুসীকি আল-কবীর হলো প্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রচলিত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বই। তার রচিত ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদকৃত ‘ইহসা আল-উলুম’ সঙ্গীত সম্পর্কে বেশ জনপ্রিয় একটি বই। বিজ্ঞানের সংক্ষিপ্ত সারমূলক তার এই বই পশ্চিমা দুনিয়ায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। তার বইগুলো ছাড়াও ইবনে সীনা ও ইবনে রুশদের বইগুলোও ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল, এবং তা পশ্চিম ইউরোপের পাঠ্যবইতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ইবনে সীনা তার লেখা ‘আল-শিফা’তে সঙ্গীত-সংক্রান্ত আগেকার লেখাগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত রূপ দিয়েছিলেন। আল-সামা (গান ও বাজনা)-র সমর্থনে ইমাম আল-গাজ্জালী যে বই লিখেছিলেন, তার কারণেই সঙ্গীত সুফি সম্প্রদায়ের নিকট এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে।
পণ্ডিত ইসহাক আল-কিন্দি (৮০১-৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ) গ্রীক সঙ্গীতের নিয়মনীতিগুলো অনুবাদ করেন। তিনি সঙ্গীত তত্ত্বের উপর ১৫টি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। ‘মুসিকা’ শব্দটি প্রথমবারের মতো আরবি ভাষায় ব্যবহৃত হয়েছিল। নবম এবং দশম শতাব্দীতে পণ্ডিতরা কবিতা এবং সঙ্গীতের প্রথম বিশ্বকোষ সংকলন করেন। আবু নাসর আল ফারাবি (৮৭০-৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ) নামে একজন পদার্থবিদ সঙ্গীতের একটি বই প্রকাশ করেন যেখানে তিনি মাকামের বিশুদ্ধ আরবিয টোন বা স্বর সিস্টেম নথিভুক্ত করেছেন, যা আজও আরবি সঙ্গীতে ব্যবহৃত হয়।
তারিক ইবনে জিয়াদ ৭১১ সালে স্পেন (আরবি নাম আন্দালুসিয়া) জয় করেন। এরই মাধ্যমে স্পেনে ৮০০ বছরের ইসলামী শাসন শুরু হয়। প্রাচ্যের সঙ্গীতকে স্পেনে পরিচিত ও জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে আরো যাদের কৃতিত্ব রয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আবুল কাসিম এবং আব্বাস ইবনে ফিরনাস।
১৩শ শতাব্দীতে, সাফি আল-দিন আল-উরমাউই (১২১৬-১২৯৪ খ্রিষ্টাব্দ) জ্যামিতিক স্বরলিপি ব্যবহার করে ছন্দের জন্য বাদ্যযন্ত্রের স্বরলিপি তৈরি করেন, যা ২০ শতকের শেষের দিকে পশ্চিমা বিশ্বে দেখা যায়। পরবর্তীতে ১৩শ থেকে ২০শ শতকের গোড়ার দিকে বিশাল অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের সাথে সাথে অটোমান সঙ্গীত বাইজেন্টাইন, আর্মেনিয়ান, আরবি এবং ফার্সি সঙ্গীত দ্বারা প্রভাবিত হয়। ইসলামি অটোমান সাম্রাজ্যের বিশালতা এবং এর মধ্যে বাণিজ্যপথের কারণে এটি ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়।
১৪৯২ সালে খ্রিস্টান রাজা ফার্দিনান্দ এবং রানী ইসাবেলা ইহুদিদের সম্পূর্ণরূপে স্পেন থেকে বিতাড়িত করেন, যেমনটি পরবর্তীতে মুসলমানরাও হয়। এই অঞ্চলের সঙ্গীতও মানুষের সাথে সাথে উত্তর আফ্রিকার মরক্কো, আলজিয়ার্স এবং তিউনিসিয়ার দিকে চলে যায়। এছাড়া বলকান রাষ্ট্রসমূহ, তুরস্ক এবং ইসরায়েলেও ভ্রমণ করে।
এই সময় থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত তেমন কোনো নথি দেখা যায় না। পরবর্তী সময় হলো পশ্চিমা সঙ্গীতের সাথে সংযোগ, যা সংগীতশৈলীকে সংজ্ঞায়িত এবং স্পষ্ট করার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে। এতে আংশিকভাবে সেই সময়ের আরব জাতীয়তাবাদের বিকাশকে সংজ্ঞাকারী হিসাবে এবং আংশিকভাবে পশ্চিমা সঙ্গীতের সাথে অনিবার্য সংঘর্ষকে প্রতিহত করাকে ফুটিয়ে তোলে। ১৯ শতকের শেষের দিকে শুরু হওয়া সেই প্রভাবগুলোর অধীনে এবং আরও অনেক কিছুর অধীনে সঙ্গীত বিকশিত হয় এবং বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়।
ফলশ্রুতিতে, আরব দেশগুলোর সীমানার দিকে তাকালে যেমন আমরা আজ তাদের চিনি, আমরা দেখতে পাই যে আরবি, তুর্কি, আর্মেনিয়ান এবং বাইজেন্টাইন সঙ্গীতে সুরের জন্য মাকাম এবং তালের জন্য দুম্বেক (Dumbek) পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আরবি সঙ্গীত সম্পর্কে মৌলিক রচনার মূল পাণ্ডুলিপিগুলি হারিয়ে গেছে। স্বরলিপি এবং তার দুটি মৌলিক উপাদান নাগাম (সুরের রীতি) ও ইকা (ছন্দযুক্ত ধরন)-সহ আরবি সঙ্গীত মুখে মুখেই প্রচারিত হয়েছে, আর তা শেষ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কায়রো মিউজিক কনফারেন্স এবং অন্য অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সমস্ত মাকামের একটি সম্পূর্ণ তালিকা খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এখনকার আরবি সঙ্গীত ছন্দের দিক থেকে সমৃদ্ধ হলেও সুরের বৈচিত্র্যের অভাব খুবই প্রকট। আরবের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্পর্কে খুবই অল্প যে কয়েকটি লেখা এখনও টিকে আছে, তা আরবভাষীরা বিশ্লেষণ করতে অক্ষম। এসব লেখার অনেক শব্দ প্রাচীন পারস্য ও ভারতীয় ভাষা থেকে এসেছিল বিধায় তারা সেসব গানের ছন্দের প্রাচীন অর্থ ও পরিভাষা পুরোপুরি বুঝতে পারেন না।