সদ্যই কালের গহ্বরে নাম লিখিয়েছে ২০১৮ সাল। বলা বাহুল্য, ঘটনাবহুল এই বছরটিতে রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য ও ক্রীড়াঙ্গন বেশ সরগরম ছিল। কেমন ছিল গেল বছরের সাংস্কৃতিক অঙ্গন, চোখ ধাঁধানো শোবিজ দুনিয়া কী কী নিয়ে চমক নিয়ে দুনিয়াজোড়া মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল; এসব নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন। চলুন দেখে আসা যাক গত বছরের বিনোদন জগতের তুমুল আলোচিত-সমালোচিত কিছু মুহূর্ত।
এক ভিন্ন গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান
গত বছরের জানুয়ারি মাসে, লস অ্যাঞ্জেলসে অনুষ্ঠিত ৭৫ তম গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান সমগ্র পৃথিবীর জন্য বেশ বার্তাবহ ছিল। রবিবার রাতের সেই জমকালো পরিবেশে চিরায়ত দৃশ্য থেকে এক ভিন্ন আবহ নিয়ে এলেন তারকারা। লাল গালিচার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া প্রত্যেকের গায়েই ‘সেলিব্রেটি’ তকমাটি বহু আগে থেকেই ছিল।
তারা সবাই এলেন সম্পূর্ণ কালো গাউন আর স্যুট পরিধান করে। তাদের এই বিশেষ উদ্যোগের পেছনের উদ্দেশ্য ছিল, হলিউড ও এর পরিধি ছাড়িয়ে ঘটে যাওয়া অসংখ্য যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। অন্যায় আর লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার এমন এক অভূতপূর্ব রাতে উপস্থিত ছিলেন অপরাহ উইনফ্রে। গোল্ডেন গ্লোবের এই আসরে, তিনি প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে আজীবন সম্মাননাস্বরূপ Cecil B. DeMille পুরস্কারে ভূষিত হন। তারকাখচিত এই আয়োজনে প্রতিবাদের এহেন অভিনব রূপ দেখে তার আত্মবিশ্বাসী মন্তব্য ছিল,
For too long women have not been heard or believed if they dared to speak their truth to the power of those men…but their time is up. Their time is up!
উইনফ্রের বক্তব্য শেষে উপস্থিত দর্শকবৃন্দ দাঁড়িয়ে সম্মান জানান। টাইমজ আপ নামক এই প্রজেক্টের অধীনে কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়:
- বিভিন্ন হোটেল, ফার্ম, হাসপাতাল, কারখানায় কর্মরত মহিলা পরিচ্ছন্নকর্মী, নার্স, শ্রমিকদের মাঝে যারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন এবং লোকলজ্জার ভয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাতে দ্বিধাবোধ করছেন তাদের সাহায্যার্থে প্রাথমিকভাবে ১৩ মিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল খোলা।
- যেসব প্রতিষ্ঠান তাদের যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব ভূমিকা পালন করে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা (প্রয়োজনে আর্থিক ক্ষতিপূরণ) এবং এসব অপরাধজনক ঘটনা ধামাচাপা দিতে নিরুৎসাহিত করা।
- কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে প্রচার প্রচারণা চালানো।
- সবশেষে, গোল্ডেন গ্লোবের মর্যাদাপূর্ণ লাল গালিচায় হেঁটে যাওয়া প্রত্যেক নারীর প্রতি অনুরোধ যাতে তারা তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড় জোরে’ নীতি অনুসরণ করেন।
সম্পূর্ণ প্রাণীর লোমবিহীন লন্ডন ফ্যাশন সপ্তাহ
সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত ফ্যাশন সপ্তাহের আগে ব্রিটিশ ফ্যাশন কাউন্সিল ও লন্ডন ফ্যাশন উইক কর্তৃপক্ষের যৌথ প্রচেষ্টায় সিদ্ধান্ত হয় যে, ফ্যাশন সপ্তাহটি হতে যাচ্ছে কোনো ধরনের প্রাণীর পশমের (Fur) ব্যবহার ছাড়া।
বৃহৎ পরিসরের কোনো ফ্যাশন সপ্তাহের জন্য এটিই ছিল প্রথম উদাহরণ। যদিও আয়োজক সংস্থার দিক থেকে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা ছিল না, তবুও আশ্চর্যজনকভাবে অংশগ্রহণকারী ৮০টি ফ্যাশন হাউজের নকশাকৃত কোনো পোশাকেই ফারের ব্যবহার ছিল না। দর্শকরা দেখেছিল একেবারেই ভিন্ন ধরনের পোশাকের সংগ্রহ ও প্রদর্শনী।
বক্স অফিস মাতানো ‘ক্রেজি রিচ এশিয়ানস’
সিঙ্গাপুরিয়ান লেখক কেভিন কোয়ানের সর্বাধিক বিক্রিত উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র ক্রেজি রিচ এশিয়ানস ছিল গত বছরের অন্যতম হিট ছবি। হলিউডের সিনেমা পাড়ায় বৈচিত্র্য আনার জন্য এই ছবিটি ছিল এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রয়াস। ১৯৯৩ সালে নির্মিত দ্য জয় লাক ক্লাবের পর দীর্ঘ ২৫ বছর পর হলিউডে আবার কোনো ছবি বানানো হলো, যাতে সব শিল্পীই ছিলেন এশিয়ান।
মুক্তির প্রথম সপ্তাহান্তে এটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই আয় করে ২৫.২ মিলিয়ন ডলার এবং পৃথিবীজুড়ে সামগ্রিক আয় ছিল ২৩৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। হলিউডের এশিয়ান ও এশিয়ান-অ্যামেরিকান শিল্পীদের প্রতিভাকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার ক্ষেত্রে ছবিটির ভূমিকার জন্য সমালোচক মহলে ছবিটি ভূয়সী প্রশংসিত হয়, বিশেষত বড় পর্দায় ভৌগলিক বৈষম্য (শ্যুটিং স্পট নির্বাচনের প্রেক্ষিতে) যখন বেশ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল।
বালকৃষ্ণ দোশির পুরস্কারপ্রাপ্তি
স্থপতি ও শিক্ষক বালকৃষ্ণ দোশি তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কৃত হন প্রিটজকার পুরষ্কারে। গত বছরের মে মাসে টরোন্টোর আগা খান জাদুঘরে, স্থাপত্যকলার নোবেল খ্যাত এই পুরস্কার আনুষ্ঠানিকভাবে তার হাতে তুলে দেওয়া হয়। তিনি মূলত স্বল্পমূল্যে ঘর নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি একজন স্থপতি, নগর পরিকল্পনাবিদ ও শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
স্থাপত্যের সর্বোচ্চ সম্মাননা (প্রিটজকার প্রাইজ) প্রদানকারী সংস্থা হায়েট ফাউন্ডেশন, দোশির কাজকে ব্যাখ্যা করেছে, “poetic and functional” বলে। প্রাচ্যের স্থাপত্যশৈলীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ দোশির কাজ নিছক কোনো নকশাই নয়, বরং তা ভারতে বসবাসকারী দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও ভূমিকা রেখেছে। ভারতের ইন্দোরে তার আইডিয়ায় বাস্তবায়িত প্রজেক্ট ‘অরণ্য’ ৮০ হাজার মানুষের বাসস্থানের সুব্যবস্থা করেছে, যাদের অধিকাংশই স্বল্প আয়ের। প্রাপ্তির এমন সাড়া জাগানিয়া সংবাদে দোশির অনুভূতি ছিল অবশ্য বেশ সাদামাটা। পুরস্কার পাওয়ার খবর শুনে তিনি বলেন,
মূলত কাজ করে যেতে চেয়েছি নিঃস্ব মানুষের জন্য। যাদের কিছু নেই তাদেরকে একান্ত নিজস্ব কোনো কিছুর অনুভূতি দিতে চেয়েছি। একটি সুন্দর থাকার জায়গা স্বীয় জীবনের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি। যাদের মাথা গোজার ঠাঁই ছিল না তারা আজ নিজেদের বাসস্থানের মালিকানা দাবী করতে সক্ষম। গত ৬০ বছর ধরে আমি ভারতের গ্রাম্য অঞ্চলগুলোতে ঘুরে বেরিয়েছি, কম খরচে মানুষের থাকার জায়গা নিয়ে বহু ভেবেছি আর দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে বারবার শঙ্কিত হয়ে উঠেছি। আমার দীর্ঘদিনের প্রয়াস সফল হয়েছে এবং আমরা আজ গর্ব করে বলতেই পারি যে, আমরাই ভারত। যে কাজ আমাকে এই সম্মাননা এনে দিয়েছে তা আমার নিজ জীবনেরই গল্প। প্রতিনিয়ত ভাঙা, গড়া, পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিজেকে নিয়ে যাওয়া। কীভাবে স্থাপত্য মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে সেই প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণেই রত ছিলাম আমি এতদিন, যার স্বীকৃতি আজ মিলেছে। এই প্রাপ্তি আমার ও ভারতের প্রত্যেক নাগরিকের।
ওবামা দম্পতির পোর্ট্রেটের আনুষ্ঠানিক উন্মোচন
গত বছরের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪ তম রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ও ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামার প্রতিকৃতি উন্মোচন করে স্মিথসোনিয়ানস ন্যাশনাল গ্যালারি অভ পোর্ট্রেট। বারাক ওবামার প্রতিকৃতিতে তাকে দেখা যায় অত্যন্ত কারুকাজ করা একটি চেয়ারে বসে থাকতে। পটভূমিতে ছিল প্রস্ফুটিত জেসমিন, আফ্রিকান ব্লু লিলি ও শিকাগোর বিখ্যাত ক্রাইস্যান্থেমাম ফুল।
ফার্স্ট লেডির পোর্ট্রেটে তাকে দেখা যায় গাউন পরিহিত অবস্থায়। ফ্রেমে ছিল আসমানি রঙের ছোঁয়া। মিশেলের গাউনে ছিল কিছু জ্যামিতিক নকশা, যা দিয়ে বোঝানো হচ্ছিল কিছু অ্যাবসট্রাকশন।
এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই গ্যালারিতে স্থান পায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কোনো কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি ও ফার্স্ট লেডির পোর্ট্রেট এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, দুটি ছবির শিল্পীও ছিলেন আফ্রিকান-আমেরিকান!