শিল্পের জাদুঘরে আমরা সবাইই গেছি। ঘুরে বেড়িয়েছি চিত্রকর্মের গ্যালারিও। একজন শিল্পীর চোখেও হয়ত ছোটবড় সবকিছুকেই শিল্প বলে গণ্য হবে। কিন্তু এমন কোনো স্থান কি আপনার চেনা আছে, যেখানে চোখ মেললেই দেখবেন শুধু চিত্র আর চিত্র, হাতে আঁকা ছবির মেলা, শৈল্পিক ছোঁয়া এখানে ওখানে, চিত্রকর্মই যার আসল পরিচয়? এমন স্বর্গীয় স্থানের খোঁজ মিলবে এই বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডেই, ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যে অবস্থিত এক গ্রাম, রঘুরাজপুরে।
পূর্ব ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের পুরী জেলা একটি জনপ্রিয় শ্রীক্ষেত্র। উপকূলীয় এ জেলার ধর্মীয় সুখ্যাতি বিশ্বজোড়া। জগন্নাথ মন্দির, গুণ্ডিচা মন্দির, ব্রক্ষ্মগিড়ি, শতাব্দী, ভুবনেশ্বরের মতো পবিত্র মন্দির ঘেরা পুরী শহরে মানুষ তীর্থ করতে যায়। সাথে পুরী সমুদ্র সৈকত, বালিঘাই সৈকত, আনন্দবাজার, লোনা পানির চিলকা হ্রদে হয়ে যায় ভ্রমণপিপাসুদের হাওয়া বদল। পরিচিত এসব জায়গা ছাড়াও পুরী থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ভার্গবী নদীর তীরে অবস্থিত গ্রাম রঘুরাজপুর। অজানা এই গ্রাম কেন উল্লেখযোগ্য? কারণ এটি একটি শিল্পগ্রাম। যে গ্রামে সবাই শিল্পী আর ঘরের একেকটি দেয়াল তার ক্যানভাস। রঘুরাজপুর- পট্টচিত্রের এক মায়াবী জগৎ।
গ্রামে প্রবেশ করলেই চোখ শীতল করা সব দৃশ্য ধরা দেব। নারিকেল, তাল, কাঁঠাল আর পানের বরজের সাথে দু’চোখে সবুজ ধানক্ষেত বৈচিত্র্যপূর্ণ শোভা বর্ধন করে। অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দ্বিগুণ বেড়ে যায়, যখন চোখে পড়ে পূর্বপুরুষদের শিল্পের উত্তরাধিকার আঁকিয়েদের হাত থেকে নির্গত শিল্পকলার নিপুণ শিল্পকর্ম কিংবা পট্টচিত্র। এখানে তালপাতার উপর চলে আঁকাআঁকি, প্রস্তরের উপর জন্ম নেয় শিলালিপির ভাস্কর্য। কাষ্ঠশিল্প, কাপড়ের ওপর রঙের খেলা, বাদ যায় না কোনো ধরনের হস্তশিল্পই। গ্রামের প্রাকৃতিক দৃশ্যে হারাবেন, না গ্রামবাসীর ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভায়, দ্বিধায় পড়তে হয়। প্রত্যেকটি ঘর বিভিন্ন চিত্রকর্মে ঠাসা। একেকটা ঘরের দেয়াল যেন একেক কথা বলে। কোনো দেয়াল বলে শ্রীকৃষ্ণের জীবনগাথা, কোথাও হনুমান, কোথাও গণেশ, কোনো দেয়ালেবা রয়েছে রামায়ণের চিত্রাবলী, কোনো দেয়ালে মহাভারত কথা বলে আবার কোথাওবা আঁকা মনোহর সব নকশা।
ছিমছাম ছোট্ট একটি গ্রাম রঘুরাজপুর, এখানে বসবাস প্রায় ১২০টি পরিবারের। বংশানুক্রমিকভাবে প্রাচীন শিল্পকলা গড়ে উঠেছে এই গ্রামে। গ্রামের সকলেই পরিবারসমেত কোনো না কোনোভাবে শিল্পকলার সাথে জড়িত। বেশিরভাগই যে শিল্পকলায় হস্তসিদ্ধ, সেই মহাযজ্ঞের নাম ‘পট্টচিত্র বা পটচিত্র’। দাদা-দাদু, নানা-নানুদের সাথে নাতি নাতনিও হাতে হাত মিলিয়ে ছবি আঁকায়। এ গ্রামের সকলেরই একটাই পেশা, একটাই পরিচিতি- শিল্পী। যে কেউ লেখাপড়া শেষ করে শুরু করে আঁকাআঁকি।
জানা যায়, ১০ম শতাব্দীতে, জগন্নাথ মন্দির স্থাপনকাল থেকেই স্থায়ী হয়েছে এখানকার বাসিন্দারা। সে তখন থেকেই তারা তালপাতায় কিংবা পাথরে খোদাই করে চিত্রকল্প করে, পুরুষেরা তসর সিল্ক কাপড়ে অঙ্কণ করে, ঘরের মেয়েরা রঙ বেরঙের কাগজের মুখোশ বানায়, কাঠ দিয়ে খেলনা ইত্যাদি তৈরি করে আসছে। ঠিক কবে থেকে এই শিল্পের জন্ম, তা জানা যায় না, তবে বছরের পর বছর বংশানুক্রমিকভাবে চলছে শিল্পের বিকাশ।
‘পট্টচিত্র’ একটি সংস্কৃত শব্দ। ‘পট্ট’ অর্থ বস্ত্র এবং ‘চিত্র’ অর্থ ছবি। পটচিত্র হলো কাপড়ে আঁকা ছবি। ধারণা করা হয়, এর উৎপত্তি দ্বাদশ শতাব্দীতে। পুরীতে রথযাত্রা এবং দেবতার স্নানযাত্রা দু’টি প্রধান উৎসব বলে গণ্য করা হয়। লোককথা আছে যে, স্নানযাত্রায় একশো আট ঘড়া পানিতে স্নান করে অসুস্থ হয়ে পড়েন জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রা। তখন তাঁরা ভক্তদের দর্শন দেন না। আবার রথযাত্রায় তিন ভাইবোন মাসির বাড়ি যাওয়ায় তখনো মন্দিরে থাকা হয় না তাদের। তাই এসময়, সাধারণ মানুষের দর্শনের জন্য দেবতাদের পরিধেয় বস্ত্রের উপর প্রতিটিতে এই তিন ভাইবোনের ছবি আঁকার প্রচলন শুরু হয়। ধীরে ধীরে এই শিল্পীদের নাম হয় পটুয়া এবং কাপড়ের আঁকা চিত্রের নাম হয় পটচিত্র।
তসর, সুতি কাপড়ে পটচিত্র আঁকা হয়। প্রথমে কাপড়টিকে তেঁতুলের বীজ দিয়ে তৈরী আঠার প্রলেপ দেওয়া হয়, যার রং সাদা। তারপর কয়লা বা পেন্সিল দিয়ে আঁকা হয় এবং প্রাকৃতিক রঙ দিয়ে রঙিন ছবি ফুটে ওঠে। ছবি আঁকা সম্পন্ন হওয়ার পর একে টেকসই করার জন্য কাঠকয়লার আগুনের উপর টেম্পারিং করা হয় এবং বার্ণিশ পৃষ্ঠ প্রলেপও প্রয়োগ করা হয়, যার ফলে ছবিটি উজ্জ্বল একটি ‘ফিনিশিং’ পায়।
তালপাতাতেও অঙ্কিত হয় চিত্র। প্রথমে নিম ও হলুদের পানিতে তালপাতা চুবিয়ে শুকানো হয়। এতে করে পোকাদের থেকে রক্ষা করা হয় পাতাকে। এরপর সরু কোনো এক লোহার পেনসিলের মাধ্যমে পাতায় মনের মতো ছবি আঁকে শিল্পীরা। যখন আঁকা শেষ হলো, কাজলের কালি এবং গাছের আঠা মেশানো এক তরল, কাপড়ে ঢেলে চিত্রটির উপর ঘষলেই চিত্রটি ফুটে উঠবে প্রাকৃতিক কালো কালিতে। জাদুর মতোই পট্টচিত্র ভেসে উঠবে যেন।
এ গেলো ঐতিহ্যবাহী শিল্পকর্ম। এছাড়া আরও শিল্পকর্মের ক্যানভাস হিসেবে পরিচিত নারকেলের ছোবরা, সুপারি, কাঁচের বোতল ইত্যাদি। যে নারকেলের ছোবরা আমরা ফেলে দেই, সেই ফেলনা বস্তুটি দিয়ে শিল্পীর হাতে গড়ে ওঠে ঘোড়া, হরিণ, গাছ, বাবুই পাখির বাসা ইত্যাদি। নারকেলের মালাতেও আঁকা হয় ঐতিহ্যবাহী বা আধুনিক নকশা। সুপারির উপরও নানা নকশা করা হয়। কাঁচের বোতলে শোভা পায় নিত্য-নতুন চিত্র।
পট্টচিত্র অন্যান্য সকল চিত্রাঙ্কণের মধ্যে অন্যতম, কেননা প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরী হাতে বানানো সব রঙ ব্যবহার করা হয়ে পটে। পট্টচিত্র অঙ্কণে সাদা-কালো এবং তিনটি মৌলিক রঙ (লাল, হলুদ, নীল) ব্যবহার করা হয়। শাঁখের গুঁড়ো করে তৈরি হয় সাদা রঙ, চোখের কাজল থেকে আসে কালো আর লাল পাওয়া যায় সিঁদুর থেকে। বাকি রঙ বানাতে বিচিত্র রঙের পাথর গুঁড়ো করা হয়। শাকসবজি থেকেও রঙ বানায় অনেকে। শুকনো কঞ্চির সাথে পশুর নরম লোম দিয়ে বানানো হয় তুলি। পূর্বে সম্পূর্ণ নিজ হাতে কোনো প্রকার আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্য ছাড়া আঁকা হত কল্পনা করে, কিন্তু এখন স্কেল, কম্পাস জাতীয় সরঞ্জামের ব্যবহার দেখা যায়। একেকটি ছবি আঁকতে এক থেকে দেড় সপ্তাহ লেগে যেতে পারে।
পট্টচিত্রের বিষয় সাধারণত হিন্দু ধর্মীয় রসপুরাণ, পৌরাণিক কাহিনী এবং লোককথা নির্ভর। অর্থাৎ, জগন্নাথ, শ্রীকৃষ্ণ, রাবণ, রামায়ণ, মহাভারত, উড়িষ্যার আরাধ্য দেবী ভুয়াসুনি, পাশাপাশি আছেন আরও গোপীনাথ, লক্ষ্মীনারায়ণ, গৌরাঙ্গ, রাধামোহন প্রভৃতি ঠাকুর-দেবতা। মৌলিক ও ঐতিহাসিক ধর্মীয় সংস্কৃতির সাথে আজকের যুগের অনেকেই পরিচত নয়। তাই হাতে এঁকে গল্পের মতো একের পর এক দেব-দেবীর কাহিনী বিচিত্র রঙে নতুন মাত্রা দেন তারা। এতে করে ছবি দেখতে যেমন আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, তেমনি ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতি সম্পর্কে জানাও হয়ে যায় ফাঁকে ফাঁকে। এছাড়াও, সকল রকম ক্রেতাদের চাহিদার ওপর নির্ভর করে সমসাময়িক ভিন্ন বিষয়েও ছবি এঁকে থাকেন তারা। ফুল, পাতা, পাখি, গ্রামীন দৃশ্য কিংবা লোকাচারবিদ্যার গল্পে রাজা-রানীও থাকে চিত্রের বিষয়। প্রচলিত লোকগল্প, আদিবাসী চিত্রসহ নিত্য-নতুন ছবির পসরা সাজায় শিল্পীরা।
কলা ভাস্কর্যের পীঠস্থান রঘুরাজপুর। কেন্দ্রীয় সরকারের পর্যটন বিভাগ রঘুরাজপুর গ্রামকে এক অনন্য সম্মানে আখ্যায়িত করেছে। ইন্টার- ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর আর্ট অ্যান্ড কালচারাল হেরিটেজ, ১৯৯৮ সালে রঘুরাজপুরের উপর একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করে। এরপর ২০০০ সালে উড়্যিষা রাজ্যের প্রথম ‘হেরিটেজ ভিলেজ’ নামে ঘোষিত হয় রঘুরাজপুর।
বিশ্বের বহু পর্যটক এখন রঘুরাজপুর ভ্রমণ করছে পট্টচিত্র খরিদ করার জন্য। কেউ হয়ত ডজনখানেক করে ফরমাশ করে যাচ্ছে। পুরীযাত্রায় রঘুরাজপুরকেও সকলে যোগ করে নিচ্ছে ভ্রমণের তালিকায়। দিল্লী, কলকাতা, মুম্বাই এর যেকোনো উৎসব-মেলাতেই এখন রঘুরাজপুরের শিল্পীরা এক বাক্যে আমন্ত্রিত। দেশীয় সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় বিশ্বাসকে ছড়িয়ে দিতে তারা এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করছে।
এই গ্রাম নিয়ে ড. সুজিতকুমার বিশ্বাসের রচিত সনেট-
“পুরীর সমুদ্র পারে-ছোট একখানি
গ্রাম! কতই চিত্র যে, ঘেরা চারিধারে
সুনিপুণ, সুদর্শন; প্রতি ঘরে ঘরে-
পটচিত্র এঁকে চলে সমুদয় গুণী।
প্রতি ঘরে, প্রতি জনে, পট-তুলি রঙে-
গড়ে চলে কথামালা; নিপুণ মায়ায়
জগতের সব ছবি চোখেতে হারায়;
আজিকে খেতাব পেল আপনার ঢঙে।
দুঃখ আছে, কান্না আছে, অনন্ত বিলাপ!
তবু সবে হাসি মুখে, করে প্রাণ দান-
সবে কত মিলেমিশে; ভুলে অভিশাপ,
আঁখিপাত ভরাইছে জীবন মহান!
‘মহাপাত্র’ গ্রামটিতে আজ কত সুর;
চিত্রপটে খ্যাতি পেল রঘুরাজপুর।”