বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি শব্দ ‘স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র’। এই স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পীরা শুধু শিল্পীই ছিলেন না, ছিলেন একেকজন মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধে যাবার, যুদ্ধ করবার অনুপ্রেরণাও। তারা গান গাইতেন, সেই গানের ছন্দে-তালে-কথায় বুকে বল পেত বাংলার দামাল সেনারা। শিল্পী আব্দুল জব্বার খানও সেই শিল্পীতালিকারই অন্যতম একজন।
শিল্পী আব্দুল জব্বারের জীবনের গল্প
১৯৩৮ সালের ৭ নভেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন কুষ্টিয়াতে। মায়ের ইচ্ছেতেই গানের জগতে প্রথম পা রাখা। সেই কৈশোর থেকে শুরু, এরপর আর থেমে থাকেনি সঙ্গীতভুবনে তার পথচলা। ছোটবেলায় ক্রিকেট-ফুটবল দুটোতেই বেশ আগ্রহ ছিল। খেলায় জেতার পর দর্শকদের মন মাতাতেন তার দরদী কণ্ঠে গান শুনিয়ে। ১৯৫৬ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার আগ অবধি সঙ্গীতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মেলেনি আব্দুল জব্বারের। পরীক্ষায় পাশ করার পর ওস্তাদ ওসমান গণি ও ওস্তাদ লুৎফর হকের কাছে সঙ্গীতে তালিম নিতে শুরু করেন তিনি। আব্দুল জব্বারের বিশ্বাস ছিল, কারো কণ্ঠে যদি সুর থাকে তবে একদিন না একদিন গান গেয়ে সে নাম করবেই। তার সাথেও তা-ই ঘটেছে। গলায় থাকা সুর তাকে পৌঁছে দিয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গীতজগতে জনপ্রিয়তার শিখরে।
১৯৫৮ সালে প্রথম তালিকাভুক্ত হলেন বেতারে। কবি আজিজুর রহমানের রচনায় বেতারে গাওয়া তার প্রথম গান ছিল ‘হারিয়ে এলাম কোথায় বলো আমার সেই সাথীটিরে’।
এরপর ১৯৬২ সাল থেকে শুরু হলো তার প্লেব্যাক গায়কের ক্যারিয়ার। একের পর এক হিট ও সুপার হিট সিনেমায় আব্দুল জব্বার গান গেয়ে গেলেন এবং ক্রমেই বাড়তে থাকলো তার খ্যাতি। ৬০ ও ৭০-এর দশকের প্লেব্যাক গায়ক বলা হয় আব্দুল জব্বারকে। সংগম (১৯৬৪), নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৯৬৭), উলঝন (১৯৬৭), পীচ ঢালা পথ (১৯৬৮), এতটুকু আশা (১৯৬৮), ঢেউয়ের পর ঢেউ (১৯৬৮), ভানুমতি (১৯৬৯), ক খ গ ঘ ঙ (১৯৭০), দীপ নেভে নাই (১৯৭০), বিনিময় (১৯৭০), জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০), নাচের পুতুল (১৯৭১), মানুষের মন (১৯৭২), স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা (১৯৭৩), ঝড়ের পাখি (১৯৭৩), আলোর মিছিল (১৯৭৪), সূর্যগ্রহণ (১৯৭৬), তুফান (১৯৭৮), অঙ্গার (১৯৭৮), সারেং বৌ (১৯৭৮), সখী তুমি কার (১৯৮০), কলমিলতা (১৯৮১) ইত্যাদি সিনেমায় প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে কাজ করেছেন আব্দুল জব্বার। এতে করে বহুদিন, এমনকি বহু বছর তার একক অ্যালবাম না বেরোলেও, সিনেমার অ্যালবামের অন্যতম আকর্ষণ ছিল তার গানগুলো। ছবি মুক্তি পাবার পরেই মানুষের মুখে মুখে ফিরতো তার গাওয়া ‘ওরে নীল দরিয়া’ কিংবা ‘তুমি কি দেখেছ কভু’ গানগুলো।
মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে তার গাওয়া ‘জয় বাংলার জয়’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘মুজিব বাইয়া যাও রে’, ‘বাংলার স্বাধীনতা আনলো কে’ ইত্যাদি গানের জন্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তিনি হয়ে রয়েছেন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেসময় তিনি হারমোনিয়ামের রীডের ঝঙ্কারে গেয়ে গিয়েছেন এরকম কত না কালজয়ী গান। এই গানগুলো আজও শিরায় শিরায় মজ্জাগত হয়ে জড়িয়ে আছে বাঙালির জীবনের সাথে। শুধু বেতারেই নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণের এই বন্ধুটি হারমোনিয়াম নিয়ে যুদ্ধের সেই থমথমে পরিবেশেও ছুটে ছুটে গিয়েছেন বহু ক্যাম্পে, উদ্দেশ্য একটিই- মুক্তিকামী সেনারা যাতে মনোবল হারিয়ে না ফেলে! নিজের স্থান থেকে নিজের সর্বোচ্চটুকু দেবার জন্য সবসময় তৎপর ছিলেন কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বার। তার আন্তরিক চেষ্টা মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে ফোটাতো হাসি, চোখে জন্ম দিতো হেরে না যাওয়া আশা আর বুকে এনে দিতো স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবার শক্তি। প্রবল অনুপ্রেরণাই ছিলেন তিনি সবার জন্য।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের বিভিন্ন স্থানে গণসংগীত গাওয়ার মাধ্যমে তিনি ১২ লাখ রুপি উপার্জন করেন, এই টাকা তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে না রেখে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ তহবিলে দান করেছিলেন। ভারতে তার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে ১৯৭১ সালে মুম্বাইয়ে বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরিতেও কাজ করে যান আব্দুল জব্বার।
“তুমি কি দেখেছ কভু, জীবনের পরাজয়? দুখের দহনে করুণ রোদনে, তিলে তিলে তার ক্ষয়। তিলে তিলে তার ক্ষয়”
‘এতটুকু আশা’ সিনেমায় ভরাট কণ্ঠে গাওয়া এই গানটির জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত ও আদৃত বাংলাদেশের মানুষের কাছে। বিবেকবোধের কাছে গভীর প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়ানো এই গানটি যেন মরমে প্রবেশ করে জাগিয়ে তোলে ভেতো বাঙালির সুপ্ত বিবেককে। “স্বার্থের টানে প্রিয়জন কেন দূরে দূরে সরে যায়?”, এ যেন আধুনিকতার প্রতি ধাবমান আপনজনকে আকুল আবেগে শুধানো। উত্তর পাই বা না পাই, প্রশ্নগুলো রয়ে যায় সকল শ্রোতার মনের গভীরে। “পিচঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি, তার সাথে এই মনটারে বেঁধে রেখেছি”- তরুণ রাজ্জাক পিচঢালা পথে হেঁটে যেতে যেতে পথের প্রতি যে ভালোবাসা প্রকাশ করেন, তা তো আব্দুল জব্বারেরই কণ্ঠে।
জীবনের একমাত্র একক অ্যালবাম
‘কোথায় আমার নীল দরিয়া’ তার জীবনের প্রথম ও শেষ একক অ্যালবাম। এটি প্রকাশ পায় ২০১৭ সালে। অ্যালবামটি প্রকাশ হওয়ার ব্যাপারটি তাকে আনন্দে উদ্বেলিত করে তোলে। এ নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এভাবেই তার তৃপ্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন,
“এটি আমার প্রথম অ্যালবাম। এ অ্যালবামটি করতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। গানগুলোর কথা অসাধারণ। এর মধ্যে মা, মাটি, দেশ, ধর্ম, সমাজ সবই আছে। আশা করছি, দেশের ও দেশের বাইরের অগণিত ভক্ত-শ্রোতাদের কাছে অ্যালবামটি জনপ্রিয়তা পাবে।”
প্রথমে অ্যালবামটির নাম ‘মা আমার মসজিদ আমার’ রাখার কথা ভাবা হলেও, ‘ওরে নীল দরিয়া’ খ্যাত আব্দুল জব্বারের অ্যালবামের নামেও বহাল রইলো তার প্রিয় নীল দরিয়া। এটির কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিলো ২০০৮ সালেই, কিন্তু কিছু জটিলতার কারণে তখন সেটি মুক্তি পায়নি। শেষমেশ অনলাইনে ব্যাপক জনপ্রিয়তার মধ্য দিয়ে সুরের জগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে যোগ দিলো ‘কোথায় আমার নীল দরিয়া’ অ্যালবামটি। এতে ৯টি মৌলিক গান রয়েছে, সবগুলোই গীতিকার আমিরুল ইসলাম রচিত। এই অ্যালবাম বের করার ক্ষেত্রে আমিরুল ইসলাম সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করেছেন। এর সুরকার হিসেবে রয়েছেন গোলাম সারোয়ার। ভিন্নমাত্রিক আবেগের সমন্বয়ে তৈরি এই অ্যালবামে শ্রোতারা পাবেন দেশপ্রেম-মানবপ্রেম-বিরহ-প্রকৃতি এসব কিছুই। এই অ্যালবামের উল্লেখযোগ্য গানগুলো হচ্ছে,
- আমি আপন ঘরের জানলাম না খবর
- মা আমার মসজিদ
- এখানে আমার পদ্মা মেঘনা
- প্রেমের বিষকাঁটা
- নয়নে মেখো না কাজল
- আমাকে তোমাদের ভালো না লাগলেও
- আমি দুঃখকে বলেছি
শেষ দিনগুলোয় কেমন ছিলেন তিনি?
বাঁচার ইচ্ছে ছিল প্রবল, অসুস্থতা থেকে মুক্তি পেয়ে আরো কিছুদিন বাঁচার বড় সাধ ছিল তার। পূরণ হলো না সেই শেষ সাধটুকুও, কারণ আর্থিক অসচ্ছলতা। সরকারি অনুদান পাবার পরও বড় অঙ্কের টাকা বাকি থেকে যায় তার চিকিৎসায়। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,
“যখন আমি লাইফ সাপোর্টে থাকব, তখন সবাই আমাকে দেখতে আসবেন। মারা গেলে শহীদ মিনারে নিয়ে যাবেন। আমার এ সব কিছুর দরকার নাই। আমি আরও কিছুদিন বাঁচতে চাই”
২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট সকালে ঢাকায় অবস্থিত বিএসএমএমইউ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই আশাবাদী মানুষটি। দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুখে ভুগছিলেন, দুটো কিডনিই কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলায় তার শরীরে আরো নানা অসুস্থতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। রোগের সাথে লড়াই করতে করতে শেষমেশ ওপারে চলে গেলেন একসময়ের জনপ্রিয় প্লেব্যাক গায়ক আব্দুল জব্বার।