লেখার শুরুতে এই সময়ের সবচেয়ে আনন্দের সংবাদটি জানা যাক। শিশুদের বুকের দুধ পান করানোয় মায়েদের সহায়তা করার ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রথম স্থান অধিকার করেছে বাংলাদেশ! আর এই সাফল্যের নেপথ্যে বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি কাজ করে চলেছে স্কয়ার এর সুপারমম-এর মতো দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো। মায়ের বুকের দুধ পান করার মতো সহজ স্বাভাবিক একটি বিষয় কী অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ, সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ করলে আশা করি এই সংবাদের গুরুত্ব ঠিকভাবে অনুধাবন করা যাবে।
একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হবার সাথে সাথে জন্ম হয় একজন মায়েরও। মায়ের বুকের দুধ পানের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় মা-শিশুর এক অনবদ্য বন্ধন। বুকের দুধ শিশুর জন্য যেমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি একজন মায়ের জন্যও এই অভিজ্ঞতা নজিরবিহীন।
নবজাতক তো বটেই, অন্তত ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের জন্যে মাতৃদুগ্ধের কোনো বিকল্প নেই। সমীক্ষায় দেখা গেছে, মাতৃদুগ্ধ পানে শিশু-মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের সমীক্ষা অনুসারে, যেসব শিশুকে জন্মের এক ঘণ্টা মধ্যে শালদুধ পান করানো হয়, সেসব শিশুর মৃত্যুঝুঁকি ৩১ শতাংশ কম থাকে। যেসব শিশুকে সম্পূর্ণ নিয়ম মেনে মায়ের বুকের দুধ পান করানো হয়, তাদের নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, ক্যান্সার ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। এমনকি জীবনের পরবর্তী পর্যায়গুলোতেও ডায়াবেটিস, ওজনাধিক্য ও কিছু কিছু ক্যান্সারের ঝুঁকি কম থাকে। যে শিশুরা জন্ম পরবর্তী ছয় মাস এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং (শুধুমাত্র বুকের দুধ পান করবে, এমনকি একফোঁটা পানিও পান করবে না) এর মধ্য দিয়ে যায়, তাদের বিভিন্ন ঠান্ডাজনিত রোগ, কণ্ঠনালী ও কানের ইনফেকশনজনিত বিভিন্ন রোগের আশঙ্কা কম হয়। শিশুর মস্তিষ্কের সঠিক বৃদ্ধি ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে মায়ের বুকের দুধে থাকা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান। মজবুত থাকে হাড় ও অস্থির গঠন।
একইভাবে, মায়েদের জন্যও সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো অত্যন্ত উপকারি। স্তন্যদানে মায়েদের জরায়ু, ওভারিয়ান ও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। একইসাথে এই পদ্ধতি অত্যন্ত সাশ্রয়ীও। প্রসব-পরবর্তী অতিরিক্ত ওজন কমানোয় সাহায্য করে স্তন্যদান। বয়সের সাথে সাথে অস্টিওপরোসিস হবার সম্ভাবনা কমে বুকের দুধ দানকারী মায়েদের।
ওয়ার্ল্ড ব্রেস্টফিডিং ট্রেন্ডস ইনিশিয়েটিভ (ডব্লিউবিটিআই)-এর এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ বিশ্বের ৯৮টি দেশের মধ্যে ৯১.৫ স্কোর নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছে শিশুদের বুকের দুধ পান করানোয় মায়েদের সহায়তা করার ক্ষেত্রে। ডব্লিউবিটিআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ‘সবুজ জাতি’র মর্যাদা অর্জন করেছে। ডব্লিউবিটিআইয়ের বৈশ্বিক সমন্বয়ক অরুণ গুপ্তা বলেন, “বাংলাদেশের এ অর্জন ২০০৫ সাল থেকে প্রচেষ্টার ফসল।” ২০১৫ সালে যে স্কোর ছিল বাংলাদেশের ৮৬, আজ তা ৯১.৫।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, নীতিমালা ও কর্মসূচির সূচকে বাংলাদেশ পেয়েছে:
- জাতীয় নীতি, কর্মসূচি ও সমন্বয়ে – ৭,
- শিশুবান্ধব হাসপাতালের উদ্যোগে – ৮,
- আন্তর্জাতিক কোড বাস্তবায়নে – ৯,
- মাতৃত্ব সুরক্ষায় – ৮.৫,
- স্বাস্থ্য ও পুষ্টি যত্নের পদ্ধতিতে – ৯,
- মায়েদের সহায়তা এবং কমিউনিটি সম্পৃক্ততায় – ১০,
- তথ্য সহায়তায় – ১০,
- নবজাতককে খাওয়ানো ও এইচআইভিতে – ১০,
- জরুরি অবস্থায় নবজাতককে খাওয়ানোয় – ১০ এবং
- পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নে – ১০
এখানেই শেষ নয়৷ সূচকে জন্মের পরপর বুকের দুধ খাওয়ানোয় বাংলাদেশের স্কোর ৬৯, এবং একাধারে প্রথম ছয় মাসে বুকের দুধ খাওয়ানোয় স্কোর ৬৫। বাংলাদেশ ব্রেস্টফিডিং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন এস কে রায় এ বিষয়ে বলেছেন, “স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় ক্রমাগতভাবে বুকের দুধ খাওয়ানোর কার্যক্রমকে জোরদার করেছে।”
সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের সহজাত প্রবৃত্তি। একান্ত জটিল কোনো সমস্যা না হলে বাংলাদেশের মায়েরা সরাসরি বুকের দুধ খাওয়ানোর পন্থাই অবলম্বন করেন। কিন্তু চাকরিজীবী মায়েদের ক্ষেত্রে ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি পার হলে কিছুটা জটিল হয়ে পরে কাজটি। এছাড়াও, গৃহিণী মায়েদেরও দৈনন্দিন নানা কাজে বাইরে বেরুতে হয়, নানান ব্যস্ততা থাকেই, যা এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশে মায়েদের শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোতে উৎসাহ দিতে কাজ করে চলেছে এমন ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে সবার আগে আসবে স্কয়ারের ‘সুপারমম’-এর নাম। অনেক মায়েরাই শিশুর বয়স ৬ মাস হয়ে গেলে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দেন ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে। এছাড়াও, নানা সমস্যা ও অজ্ঞতায় মায়েরা এ কাজ করে থাকেন। ‘সুপারমম’ মায়েদের বা সমগ্র সমাজেই শিশুর মাতৃদুগ্ধ পান বিষয়ক অজ্ঞতা বা কুসংস্কার কাটানোর চেষ্টা করে গেছে। সেই সাথে supermombd.com ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নারীদের ও মায়েদের প্রজনন ও শিশু বিষয়ক নানান তথ্য-সহায়তা প্রদান করে থাকে। এখানে নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের নানা সমস্যার প্রতিকার ও চিকিৎসকের সহায়তা, গর্ভাবস্থায় মায়ের যত্ন, শিশুর জন্ম পরবর্তী নানা বয়সে নানা ধাপে প্রয়োজনীয় সকল তথ্য ও কনসাল্টেশনের সাহায্য পাওয়া যায়।
‘সুপারমম’ এর একটি উদ্যোগ বিশেষভাবে প্রশংসা কুড়িয়েছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায়। ১০,০০০-এরও বেশি মায়েরা ‘সুপারমম’ এর ‘ব্রেস্টফিডিং, ডায়াপার চেঞ্জিং কর্নারের’ সেবা ও সুবিধা গ্রহণ করেছেন। সাথে ছিল ফ্রি ডাক্তারি পরামর্শের ব্যবস্থাও। সকলের সাধুবাদ কুড়িয়েছে এই অনন্য প্রচেষ্টা। এই উদ্যোগ শুধু ওই কিছু মায়েদের বা শিশুদের উপকারই করেনি, মায়েদের বুকের দুধ খাওয়ানো যে লজ্জার নয়, বরং মহৎ ও গর্বের তাকেও সম্মান জানিয়েছে, রুখে দাঁড়িয়েছে সমাজের ট্যাবুর বিরুদ্ধে।
এভাবেই যদি দেশের দায়িত্বশীল নানা পর্যায় থেকে সবাই এগিয়ে আসতে পারেন, তাহলেই সবার ছোট ছোট উদ্যোগ একসাথে গড়ে তুলবে একটি শিশু ও মাতৃবান্ধব সমাজ ও ভবিষ্যত। ভালো থাকুক মায়েরা, আনন্দে-হাসিতে ভরে উঠুক ছোট্ট শিশুদের জীবন। শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোতে আরও শত বছর প্রথম স্থানে থাকুক আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।