বিশ্ব জুড়ে এখন করোনাভাইরাসের প্রচণ্ড দাপট, যা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। এর প্রভাবে কুপোকাত হচ্ছে একের পর এক দেশ। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৮৮টি দেশে সর্বমোট ২,১৯,৩৩১ জন মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন যাদের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ৮৯৬৯ জন (১৯ মার্চ ২০২০ সকাল ১০:৩৮ মিনিট পর্যন্ত)। আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিও করোনার ছোবল থেকে রেহাই পায়নি। এখন পর্যন্ত দেশে ১৪ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে।
প্রতিনিয়ত বাড়ছে আক্রান্ত দেশ এবং মানুষের সংখ্যা। ফলে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন মানুষজন, বাঁচার উপায় খুঁজছেন হন্যে হয়ে। এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে কোনো ভ্যাক্সিন আবিষ্কার না হওয়ায় সচেতনতাই এ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সব ধরনের গণমাধ্যম করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মানুষজনকে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা, বাইরে থেকে ঘরে ফেরার পর ভালোভাবে হাত ধোয়া, এবং সর্বোপরি জমায়েত এড়িয়ে চলাসহ বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে প্রতিনিয়ত তাঁদেরকে সচেতন করছেন।
এই ডামাডোলে ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার’ শব্দটি খুব শোনা যাচ্ছে। আক্রান্ত দেশগুলোতে মানুষজন হন্যে হয়ে এটি কিনছেন। দোকানগুলো প্রায় হ্যান্ড স্যানিটাইজার শূন্য। মানুষজন ভাবছে, হাত ভাইরাস মুক্ত করতে স্যানিটাইজার ব্যবহারই একমাত্র উপায়। কিন্তু আসলেই কি তাই? করোনাভাইরাস প্রতিরোধে হ্যান্ড স্যানিটাইজার কতটা কার্যকর? সাবান কি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর? সাবান না হ্যান্ড স্যানিটাইজার, কোনটি বেশি কার্যকর? এসব প্রশ্নেরই উত্তর মিলবে এই লেখায়।
প্রথমেই আসা যাক হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রসঙ্গে। হ্যান্ড স্যানিটাইজার হচ্ছে জীবাণুনাশক এমন একটি মিশ্রণ যার মূল উপাদান হচ্ছে অ্যালকোহল। অ্যালকোহল হিসেবে সাধারণত ইথাইল অ্যালকোহল অথবা আইসো প্রোপাইল অ্যালকোহল ব্যবহার করা হয় যা প্রায় ৭০% এর কাছাকাছি ঘনমাত্রায় বিদ্যমান থাকে। স্যানিটাইজার তরল, অর্ধ তরল জেলসহ বিভিন্ন রূপে তৈরি করা গেলেও জেল রূপেই বেশি দেখা যায়। এতে গ্লিসারিন, সুগন্ধি প্রভৃতি যোগ করে ব্যবহার উপযোগী করা হয়ে থাকে।
কীভাবে কাজ করে
হ্যান্ড স্যানিটাইজার ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া উভয়ের বিরুদ্ধে কাজ করলেও এখানে আমরা শুধু করোনাভাইরাস এর ব্যাপারে আলোচনা করব। তার আগে করোনাভাইরাসের অভ্যন্তরীণ গঠন জেনে নেওয়া যাক। করোনাভাইরাসের অভ্যন্তরে নিউক্লিক এসিড হিসেবে থাকে RNA, যেটিকে চতুর্দিক হতে ঘিরে রাখে একটি প্রোটিন আবরণ। সম্পূর্ণ প্রোটিন আবরণ আবার লিপোপ্রোটিন নির্মিত আরেকটি আবরণে আবৃত থাকে যাকে বলে এনভেলাপ। অ্যালকোহল ভাইরাসের এই এনভেলাপ এবং প্রোটিনকে ভেঙে দেয়। ফলে ভাইরাস মারা যায় বা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। ফলে এর রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। তবে মনে রাখতে হবে, যেকোনো হ্যান্ড স্যানিটাইজারকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভালো কাজ করতে হলে অবশ্যই এতে ৬০% এর বেশি পরিমাণ অ্যালকোহল থাকতে হবে।
সাবান কীভাবে কাজ করে?
এবার আসা যাক সাবানের প্রসঙ্গে। সাবানের মূল উপাদান হচ্ছে সোডিয়াম স্টিয়ারেট বা পটাশিয়াম স্টিয়ারেট যেটি ফ্যাটি এসিডের সোডিয়াম অথবা পটাশিয়াম লবণ। এই সোডিয়াম বা পটাশিয়াম স্টিয়ারেটের অণুতে দুটি প্রান্ত রয়েছে- হাইড্রোফিলিক প্রান্ত এবং লিপোফিলিক প্রান্ত। হাইড্রোফিলিক প্রান্ত পানির প্রতি এবং লিপোফিলিক প্রান্ত লিপিডের প্রতি আকৃষ্ট হয়। আমাদের ত্বকে এবং হাতে তৈলাক্ত পদার্থের আবরণ থাকে। এই তৈলাক্ত পদার্থে করোনাভাইরাস এসে আটকে থাকে এবং হাত থেকে চোখ- নাক-মুখে ছড়ায়। যখন আমরা সাবান দিয়ে হাত ধুই, তখন সাবানের অসংখ্য অণু তার লিপোফিলিক প্রান্ত দিয়ে ভাইরাসের লিপিড নির্মিত এনভেলাপকে চারদিক হতে ঘিরে ফেলে।
এরপর যখন আমরা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলি তখন হাইড্রোফিলিক প্রান্ত পানিতে দ্রবীভূত হয়ে সম্পূর্ণ ভাইরাস কণাটিকে পানিতে দ্রবীভূত করে। পরবর্তীতে ভাইরাস কণাটি পানির সাথে চলে গিয়ে হাত ভাইরাস মুক্ত হয়। এছাড়া সাবান হাতের তৈলাক্ত আবরণকে দূরীভূত করে হাতে ভাইরাস আশ্রয়ের সম্ভাবনাও কমিয়ে দেয়। তবে হাত ধোয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই ২০/৩০ সেকেন্ড ধরে হাতে সাবান রেখে ভালোভাবে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে হবে এবং পর্যাপ্ত পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
কোনটি বেশি কার্যকর?
করোনাভাইরাসের এই মহামারীতে আমাদের দেশ তো বটেই, ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতেও এখন হ্যান্ড স্যানিটাইজারের অভাব দেখা দিচ্ছে। দোকান কিংবা সুপার মার্কেটগুলোতে পাওয়াই যাচ্ছে না! ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার’ শব্দটি শুনতেও স্মার্ট এবং আধুনিক! তাই মানুষজন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে! ভাবছে, হাত ভাইরাস মুক্ত রাখতে এর কোনো বিকল্প নেই! অথচ ধারণাটি ভুল।
হ্যান্ড সানিটাইজার ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে ঠিক, কিন্তু সাবানের মতো এতটা কার্যকরভাবে নয়। হ্যান্ড স্যানিটাইজার ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করলেও সব ভাইরাসকেই নিষ্ক্রিয় করতে পারে না। ফলে অনেক ভাইরাস হাতে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অপরদিকে সাবান বেশিরভাগ ভাইরাসকে হাত থেকে পানির সাহায্যে দূরীভূত করে দেয় বলে হাতে ভাইরাসের পরিমাণ অনেক কমে যায়। কিছু থেকে গেলেও তার পরিমাণ নগণ্য।
ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার কখনো সাবানের বিকল্প হতে পারে না। তাই বিশেষজ্ঞগণও বাইরে থেকে ঘরে আসার পর হাত ধুতে বলছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার আমরা কখন ব্যবহার করব? বিষেশজ্ঞগণ বলছেন, যখন আমরা বাইরে থাকব এবং হাত ধোয়ার মতো অবস্থা থাকবে না তখন হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা উচিত।
যেমন ধরুন, আপনি ট্রেনে ভ্রমণ করছেন কিংবা ডাক্তার হলে হাসপাতালের ওয়ার্ডে রোগী দেখছেন। এমতাবস্থায় সাবান এবং পানি দুটো একসাথে না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আবার প্রতি রোগী দেখার পর বার বার হাত ধোয়াও বিরক্তিকর। তাই এরকম পরিস্থিতিতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করাই বেশি বাস্তবসম্মত। তবে একটা সময় গিয়ে আপনাকে হাত ধুতেই হবে। তাহলেই কেবল ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকা সম্ভবপর হবে বলে আশা করা যায়।
করোনাভাইরাস হতে বেঁচে থাকতে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার কোনো বিকল্প নেই। তাই বার বার হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন, নিরাপদ ও সুস্থ থাকুন।