এন্টার্কটিকার গলন্ত বরফ ও সলিল সমাধি হওয়া পৃথিবীর ভবিষ্যৎ

বরফের চাদরে আচ্ছাদিত এন্টার্কটিকা, পঞ্চম বৃহৎ মহাদেশ। এই মহাদেশটি ধারণ করছে প্রায় ৭ মিলিয়ন ঘনমাইল আয়তনের বরফ যা কিনা পরিমাণে পৃথিবীর মোট বরফের ৯০ শতাংশ। একটু ভেবে দেখুন বিপুল পরিমাণ এই বরফ যদি গলে যায় তাহলে আমাদের বাসযোগ্য এই পৃথিবীর কী অবস্থা হতে পারে? অপ্রিয় হলেও সত্য হলো বৈশ্বিক উষ্ণায়নের দরুণ এন্টার্কটিকার বরফ গলতে শুরু করেছে যা আসন্ন বড় কোনো দুর্যোগের সংকেত দিচ্ছে।

মহাদেশের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বরফের আস্তরণের গড় উচ্চতা ১.৫ মাইল। ৩৫ মিলিয়ন বছর আগেও যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল, Antarctic Glaciation এর ফলে বরফের মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে এন্টার্কটিকা। বিপুল পরিমাণ বরফের উপস্থিতির কারণে এই মহাদেশে কেবলমাত্র ঠাণ্ডা পরিবেশে অভিযোজিত হতে সক্ষম কিছু আদি উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির বসবাসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। মানুষের জন্য এই মহাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস দুরূহ বলা চলে। অতীতে তিমি বা সীল মাছ শিকারের জন্য এন্টার্কটিকার কিছুটা অর্থনৈতিক গুরুত্ব থাকলেও এখন প্রধানত এই মহাদেশ বিজ্ঞানীদের জন্য এক বিশাল বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগার যা তাদেরকে বিশ্বজগতের সামগ্রিক আবহাওয়া ও পরিবেশের পরিবর্তনকে ভাল করে বোঝার সুযোগ দেয়।

এন্টার্কটিকা; Source: Zegrahm

১৯ শতকের শেষভাগ থেকে এখন পর্যন্ত মহাদেশটির তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যার পেছনে কারণ হিসাবে দায়ী করা হয় বায়ুমণ্ডলে অধিক পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড ও মনুষ্যসৃষ্ট নির্গমন গ্যাসের বা গ্রীন হাউজ গ্যাসের উপস্থিতি। বিগত ৩৫ বছরে পৃথিবীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ বলে দাবি করেন বিজ্ঞানীগণ। তারা জানিয়েছেন, ২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৭ বছরের মধ্যে ১৬টি বছরই বেশ উষ্ণ ছিল।

ফলশ্রুতিতে এন্টার্কটিকার বরফ গলছে এবং সেই সাথে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। বিগত শতাব্দীতে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা বেড়েছে প্রায় ৮ ইঞ্চি এবং গত ২০ বছরে উচ্চতা বৃদ্ধির হার গত শতাব্দীর দ্বিগুণ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি মূলত দুইটি কারণের সাথে সম্পৃক্ত; প্রথমত, বরফ ও গ্লেসিয়ার গলে যাওয়া এবং দ্বিতীয়ত, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে পানির প্রসারণ হওয়া যাকে তাপীয় প্রসারণ বলা হয়। গত শতাব্দীতে মোট সমুদ্রপৃষ্ঠের অর্ধেক উচ্চতা বেড়েছে এই তাপীয় সম্প্রসারণের কারণে।

যেহেতু পৃথিবীর আবহাওয়া ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সকলের কাছে স্পষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যতই বলে বেড়ান যে, জলবায়ু পরিবর্তন বা Climate Change নিছক ঘটনা মাত্র, কিন্তু এই বিপজ্জনক পরিস্থিতিকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যেহেতু প্রভাবগুলো সময়ের সাথে আরো স্পষ্ট ও নাটকীয় হয়ে উঠছে, তাই এখন এই সমস্যার সম্মুখীন হতে আমরা বাধ্য হচ্ছি।

এন্টার্কটিকায় যা ঘটছে তা হলো বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল। এখানে প্রভাব এবং ফলাফল যতটা স্পষ্টভাবে অবলোকন করা যায় তা পৃথিবীর অন্যত্র দেখা যাবে না। সম্প্রতি ১০০ মাইল লম্বা ও ১,০০০ ফুট প্রশস্ত একটি ফাটল ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে Larson C Ice Shelf এর দিকে এবং বিজ্ঞানীগণ অনুমান করছেন অতি শীঘ্রই একটি বিশাল বরফ খণ্ড ফাটলের দরুন মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা হয়ে যাবে। ফাটলে আলাদা হয়ে যাওয়া এই অংশটি Larson C এর মোট বরফের প্রায় ১০ শতাংশ এবং এর ফলে বাকি অংশটুকুও হয়ে পড়বে অস্থিতিশীল।

এন্টার্কটিকার বরফ পৃষ্ঠে ফাটল; Source: Huffingtonpost

এই অঞ্চলটি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও পরিবেশের পরিবর্তনকে রুখতে হলে এন্টার্কটিকাই সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাকৃতিক সম্পদ। এই মহাদেশের বিশাল বরফ আচ্ছাদিত পৃষ্ঠ প্রতিফলক তল হিসাবে কাজ করে। ফলে সূর্যের তাপ প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যায় মহাকাশে। এই ঘটনাটি Albedo effect নামে পরিচিত। এটি পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে আটকা পড়া অবাঞ্ছিত তাপ বর্জনের জন্য অত্যাবশ্যক। তাই বরফের পরিমাণ যত কমে যাচ্ছে প্রতিফলনের হারও তত কমে যাচ্ছে। ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা আরো বাড়ছে। ফলশ্রুতিতে বরফ গলবে আরো বেশি পরিমাণে এবং ফলাফল হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত গ্রীন হাউজ প্রভাব।

এন্টার্কটিকার জীববৈচিত্রের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: পেঙ্গুইন

এই মহাদেশে প্রায় ২০ মিলিয়ন পেঙ্গুইন জোড় বাস করে। কিছু প্রজাতির সংখ্যা অতি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, যেমন অ্যাডেলি প্রজাতি। বরফবেষ্টিত পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম এই প্রজাতির পেঙ্গুইন। বরফের পরিমাণ কমার সাথে সাথে ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে এদের সংখ্যা। তাছাড়াও অন্য প্রজাতি, যেমন এমপেরর পেঙ্গুইনের সংখ্যা এন্টার্কটিকার কিছু অঞ্চলে প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে।

এন্টার্কটিকায় অ্যাডেলি পেঙ্গুইন; Source: Discovering Antarctica

এন্টার্কটিকার পেঙ্গুইন; Source: National Geographic

সামুদ্রিক প্রাণী ক্রিল (Krill) এর উপর প্রভাব

২০০৪ সালে প্রকাশিত ব্রিটিশ আর্কটিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এন্টার্কটিকার সামুদ্রিক প্রাণী ক্রিলের সংখ্যা কমছে। এন্টার্কটিকার খাদ্যচক্রে ক্রিলের গুরুত্ব অনেক। এই প্রজাতির বিলুপ্তির সরাসরি প্রভাব পড়বে তিমি, সীল ও পেঙ্গুইনের উপর যাদের খাদ্যতালিকায় শুরুতেই রয়েছে ক্রিলের অবস্থান। গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, ‘৭০ এর দশক থেকে ক্রিল সংখ্যা প্রায় ৮০% কমে গেছে। ক্রিলের জন্য প্রধান খাদ্য হচ্ছে বরফের নিচে জমে থাকা শৈবাল। এন্টার্কটিক উপদ্বীপ যা ক্রিলের জন্য মূল প্রজনন স্থল, বরফের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় এই প্রজাতি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে যা এন্টার্কটিকার জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।

চিংড়ির মত দেখতে সামুদ্রিক প্রাণী ক্রিল; Source: Discovering Antarctica

২০১৩ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক দেখিয়েছে যে, পৃথিবীর সমস্ত বরফ গলে গেলে সমুদ্রের উচ্চতা প্রায় ২১৬ ফুট বেড়ে যাবে। ফলে বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর মধ্যে অনেক শহর ডুবে যাবে।

দ্রুত গলে যাওয়া এন্টার্কটিকার বরফ, Source: Yale E360

এশিয়া

৬০ কোটি অধিবাসীর দেশ চীনকে বন্যা পুরোপুরি গ্রাস করবে। ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলের পাশাপাশি পানিতে নিমজ্জিত হবে বাংলাদেশ।

অস্ট্রেলিয়া

অস্ট্রেলিয়া মূলত মরুভূমি। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে মহাদেশটির ভিতরে অভ্যন্তরীণ সমুদ্রের আবির্ভাব ঘটবে। উপকূলের বেশ কিছু দ্বীপের অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে পানির তলায়।

ইউরোপ

লন্ডন, ভেনিস তখন থাকবে শুধু স্মৃতির পাতায়। নেদারল্যান্ডও আত্মসমর্পণ করবে সমুদ্রের কাছে, সাথে ডেনমার্কের অধিকাংশ স্থানই থাকবে পানির নিচে। এদিকে ভূমধ্যসাগরের প্রসারিত পানি ব্ল্যাক ও ক্যাস্পিয়ান সমুদ্রকেও গ্রাস করবে।

আফ্রিকা

অন্যান্য মহাদেশের তুলনায় আফ্রিকার মূল ভূখণ্ড অনেকাংশে এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে, যদিও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে এই অঞ্চলটি কতখানি বসবাসযোগ্য থাকবে তা নিয়ে যথেষ্ট অনিশ্চিত বিজ্ঞানীগণ। মিশর, আলেকজান্দ্রিয়া এবং কায়রোর মতো অঞ্চলও প্লাবিত করবে ভূমধ্যসাগর।

আমেরিকা

আটলান্টিক উপকূল পুরোপুরি বিলুপ্ত হবে। সেই সাথে ফ্লোরিডা ও উপকূলীয় অঞ্চলও। ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকোতে অবস্থিত পাহাড়গুলো পরিণত হবে দ্বীপে। বুয়েন্স আইরেস, উপকূলীয় উরুগুয়ে এবং প্যারাগুয়ের বেশিরভাগ অঞ্চলও তলিয়ে যাবে পানির নিচে।

এজন্যই এন্টার্কটিকা বিশ্বব্যাপী এতটা গুরুত্ব বহন করে। শুধু পরিবেশগত তাৎপর্যের জন্য নয়, বরং আমাদের ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ভর করে এই মহাদেশটির উপর। যদিও কোনো কোনো বিজ্ঞানীর মতে, সমস্ত বরফ গলতে প্রায় ৫,০০০ বছর লাগতে পারে, কিন্তু যে হারে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড জমা হচ্ছে তাতে হয়ত এত দীর্ঘ সময় লাগবে না পৃথিবী বরফশূন্য হতে। তখন হয়তো পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের পরিবর্তে বৃদ্ধি পাবে ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে যে ক্ষতি হয়েছে তা হয়তো প্রতিহত করা সম্ভব নয় কিন্তু এখনো যদি বিশ্বের ক্ষমতাধর নেতাগণ একত্রিত হয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন, তাহলেও হয়তো বিপর্যয়ের মাত্রা অনেকাংশে কমানো সম্ভব হবে।

Featured image: Wallpapers Wide

Related Articles

Exit mobile version