ওরিওলা ওলুওয়াসি, বয়স ৩২ বছর। নাইজেরিয়ার বাণিজ্যিক কেন্দ্র লাগোসের নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যে তার বসবাস। চার সন্তানের জননী তিনি। হাঁটছেন দেশটির আরেক শহর আজিগানলির ব্যস্ততম সড়ক দিয়ে। রাস্তার দু’পাশে তার তীক্ষ্ণ নজর।
হাঁটতে হাঁটতে প্লাস্টিকের পরিত্যক্ত বোতল কুড়োচ্ছেন ওরিওলা। কখনো রাস্তার ধারে বিভিন্ন ক্যাফেটেরিয়া, আবার কখনো খুচরা পণ্যের দোকান থেকেও বোতল সংগ্রহ করছেন তিনি। তার এই কাজ বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। কেননা আর্থিকভাবে তিনি ততটা স্বচ্ছল না হলেও, বোতল সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহের কথা নয় তার!
কারণটি জানা গেল সন্ধ্যাবেলায়। ওরিওলা ওলুওয়াসি তার সংগৃহীত বোতল নিয়ে ‘মরিতজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’-এ যান এবং সেখানকার কর্তৃপক্ষকে সেগুলো বুঝিয়ে দেন। মূলত এই বোতলই তার ৮ বছর বয়সী কন্যা রেবেকার স্কুলের টিউশন ফি। তবে একদিনের সংগৃহীত বোতলে অবশ্য কন্যার টিউশন ফি-এর পুরোটা পরিশোধ করা যায়নি। এটি ডাউন পেমেন্ট হিসেবে গৃহীত হয়েছে। বাকি টিউশন ফি ধীরে ধীরে এই প্লাস্টিকের বোতলের মাধ্যমেই পরিশোধ করতে পারবেন তিনি।
পেশায় ওরিওলা ওলুওয়াসি নাইজেরিয়ার বাণিজ্যিক রাজধানী লাগসের একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। গাড়ির ইঞ্জিনের তেল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। সংসারের একমাত্র আয়ের উৎসও তিনি। কিন্তু কন্যা রেবেকার স্কুলের বার্ষিক টিউশন ফি ১৮,০০০ নাইরা (বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৪,২০০ টাকা), যা তার মতো নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্যের পক্ষে পরিশোধ করা কষ্টকর। তার মতো অভিভাবকের জন্য স্কুলটির এই উদ্যোগ অভিনব ও কল্যাণকর। তিনি বলেন,
যখন নতুন কোনো বর্ষ হাজির হয়, তখন আমাদের খানিকটা দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়। টাকা-পয়সার হিসেব মেলানো বেশ জটিল হয়ে পড়ে। অনেক জটিলতার মধ্যেও আমরা আমাদের সন্তানদের যত্নে রাখতে চাই। সেদিক থেকে এই পদক্ষেপ আমাদের জন্য বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
টিউশন ফি হিসেবে প্লাস্টিকের বোতল
এই উদ্যোগ খুব বেশি দিন আগের নয়। সম্প্রতি রেবেকার স্কুল ‘মরিতজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’ ও বেসরকারি সংস্থা ‘আফ্রিকান ক্লিনআপ ইনিশিয়েটিভ (এসিআই)’-এর মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুসারে, ঐ সংস্থাটি এসব প্লাস্টিকের বোতল গ্রহণ করে এবং বিনিময়ে তারা স্কুলের শিক্ষার্থীদের আর্থিক অনুদান প্রদান করে। ফলে অভিভাবকরা প্লাস্টিকের পরিত্যক্ত বোতল দিয়েই তাদের সন্তানদের টিউশন ফি পরিশোধ করতে পারেন।
এই পদ্ধতিকে তারা নাম দিয়েছেন ‘পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে পরিশোধ’। ‘আফ্রিকান ক্লিনআপ ইনিশিয়েটিভ (এসিআই)’ দেশটির যেসব অঞ্চলে তুলনামূলক নিম্নবিত্তদের বসবাস, সেসব অঞ্চলের স্কুলসমূহে এই সেবা চালু করেছেন। যাতে করে উক্ত শহর পরিচ্ছন্ন হয়, পাশাপাশি তাদের ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনাও অব্যাহত থাকে। ওরিওলা ওলুওয়াসি প্রতিমাসে দুবার তার মেয়েকে দেখতে স্কুলে যান এবং এ সময় সেখানে তিনি ব্যাগভর্তি প্লাস্টিকের বোতল নিয়ে যান।
বেতন পরিশোধের বিষয়টি নির্ভর করে তিনি কী পরিমাণ বোতল জমা দিতে পারলেন তার উপর। প্রতি ২০০ কেজি বোতলের বিনিময়ে ৪,০০০ নাইরা বেতন পরিশোধ হয়, যেখানে তার প্রতি সেমিস্টারে টিউশন ফি পরিশোধ করতে হয় ৭,৫০০ নাইরা। অর্থাৎ তাকে প্রতি ৬ মাসের জন্য প্রায় ৪০০ কেজি বোতল জমা দিতে হয়। তিনি বলেন,
গত বছর স্কুলের একজন শিক্ষক আমাকে এই উদ্যোগটির ব্যাপারে জানায়। আমি সহসাই এই সুযোগটি গ্রহণ করি। কেননা এটি একটি ব্যাতিক্রমী উদ্যোগ, যা আমার উপর অর্থনৈতিক চাপ অনেকাংশে কমিয়ে আনে।
তিনি আরও বলেন,
এই সুবিধা গ্রহণের ফলে আমি আমার কন্যার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ অন্যভাবে খরচ করতে পারি। যেমন- আমি ওর জন্য নতুন স্কুল ব্যাগ, জুতা ও বই কিনতে পেরেছি।
২০১৭ সালের ওশান অ্যাটলাসের রিপোর্ট অনুসারে, নাইজেরিয়া প্লাস্টিক দূষণে সারা বিশ্বে ১১ নম্বর অবস্থানে রয়েছে; যা দেশটির পরিবেশ ও নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভয়াবহ হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। স্থানীয় একটি মিডিয়ার পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রতি বছর দেশটির শুধুমাত্র লাগোস শহরেই ৪,৫০,০০০ মেগা টন প্লাস্টিক পণ্য আবর্জনায় পরিণত হয়। এসব প্লাস্টিক পণ্য সহজে পচনশীল না হওয়ায় এই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ‘আফ্রিকান ক্লিনআপ ইনিশিয়েটিভ (এসিআই)’ এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আলেকজান্ডার আখিংবে বলেন,
‘পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে পরিশোধ’ কার্যক্রম নাইজেরিয়াকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে নিয়ে আসতে পারে। ফলে এটি একটি জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম।
এখন পর্যন্ত লাগোস শহরের পাঁচটি স্কুলে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এতে প্রায় ১,০০০ শিক্ষার্থী প্লাস্টিকের বোতলের বিনিময়ে স্কুলের টিউশন ফি পরিশোধ করতে পারছেন। সংস্থাটি দ্রুত তাদের এই কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করতে চান। আলেকজান্ডার আখিংবে বলেন,
আমরা পিছিয়ে পড়া প্রদেশসমূহকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। এই কার্যক্রমের ফলে নাইজেরিয়া সম্ভাব্য জলবায়ু বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে এবং দেশের শিক্ষাব্যবস্থা দ্রুত অগ্রগতির দিকে যাবে। যে সকল অভিভাবক অর্থের অভাবে তাদের সন্তানদের স্কুলে প্রেরণ করতেন না, তারাও প্লাস্টিকের বোতলের মাধ্যমে স্কুলের ফি পরিশোধের সুযোগকে গ্রহণ করবে এবং তাদের সন্তানদেরকে স্কুলে প্রেরণ করবে। এর ফলে তাদের উপার্জিত অর্থ সংসারের অন্যান্য চাহিদা মেটাতে ব্যয় করতে পারবে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, নাইজেরিয়া সারা বিশ্বের কাছে দরিদ্রতার রাজধানী হিসেবে খেতাব পেয়েছে। দেশটির প্রায় ২০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে অর্ধেকের দৈনিক গড় আয় ১৫০ টাকা বা তার নিচে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশটির প্রাথমিক শিক্ষা খাতের উপরেও।
ইউনেসেফের তথ্য মতে, নাইজেরিয়ার প্রায় দেড় কোটি শিশু প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে; যা একটি জাতির জন্য আশঙ্কাজনক। তবে আলেকজান্ডার আখিংবের বিশ্বাস, তাদের এই কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে দেশটির প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্কট ও প্লাস্টিক দূষণ উভয়ই একসাথে মোকাবেলা করা যাবে।
একটি দরিদ্রবান্ধব কার্যক্রম
নাইজেরিয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম প্লাস্টিকের বোতল সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করে ‘উইসাইকেলস’ নামের একটি সামাজিক সংগঠন। তারা মূলত নাইজেরিয়ার প্লাস্টিক দূষণ কমিয়ে আনার জন্য এই কার্যক্রম হাতে নিয়েছিল। কিন্তু ‘আফ্রিকান ক্লিনআপ ইনিশিয়েটিভ (এসিআই)’ তাদের সাথে যুক্ত হওয়ায় সংগঠনটির কার্যক্রম আরও প্রসারিত হয়েছে। বর্তমানে তারা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করছেন। ‘উইসাইকেলস’ বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত বোতলগুলোকে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলে। আলেকজান্ডার আখিংবে বলেন,
কোনো অঞ্চলে আমরা এই কার্যক্রম শুরু করার আগে খেয়াল করি সেখানে ‘উইসাইকেলস’ এর মতো বোতল পুনর্ব্যবহারযোগ্য করার কোনো প্রতিষ্ঠান আছে কি না। আমরা সেভাবেই আমাদের পরিকল্পনা প্রণয়ন করি। প্রতি মাসে দুবার আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানসমূহে জমাকৃত বোতল সেখানে পাঠাই। তারা আমাদের প্রতি কেজি প্লাস্টিকের বোতল যথাযথ দামে কিনে নেয়।
সমগ্র বিশ্ব যখন জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিতে রয়েছে, তখনই নাইজেরিয়ার মাধ্যমে দেখা মিললো এমন দারুণ উদ্যোগের। নাইজেরিয়ার প্রখ্যাত চিন্তাবিদ লেসাইল অ্যাদোগেইম এই কার্যক্রমকে সময় উপযোগী ও ‘দরিদ্রবান্ধব কার্যক্রম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন,
এটি একইসাথে একটি পরিবেশবান্ধব ও অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় উদ্যোগ। নাইজেরিয়ায় পুনর্ব্যবহারযোগ্য শিল্পের যত বিকাশ ঘটবে, দেশটির জন্য তা ততই মঙ্গল বয়ে আনবে।
আমাদের দেশেও প্লাস্টিকের বোতল পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলার জন্য বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। পুরাতন ঢাকায় এমন অনেক প্রতিষ্ঠান চোখে পড়ে। সাধারণত পথশিশুরা এই বোতল সংগ্রহের কাজে যুক্ত। তারা নাম মাত্র টাকার বিনিময়ে এই কাজ করে। অনেক সময় দু’বেলা খাবারের খরচও তারা যোগাড় করতে পারে না। স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্য তো তাদের নেই-ই। অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও প্লাস্টিক বোতলের বিনিময়ে শিক্ষার এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আমাদের দেশেও একই পন্থায় বা নিজস্ব কোনো মডেলে এমন উদ্যোগ কি দরকার বলে মনে করেন না, প্রিয় পাঠক?