হুমায়ূন আহমেদ, জনপ্রিয়তার নিরীখে বাংলা সাহিত্যের অবিসংবাদিত সম্রাটের নাম। বাংলাদেশের পাঠবিমুখ জনগোষ্ঠীর মনে বইয়ের প্রতি ভালোবাসার জন্ম দিয়েছেন এই মানুষটিই। তার জাদুকরি লেখনীতে মুগ্ধ হয়েছে দেশের লাখো পাঠক। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনের উপস্থাপন তার লেখা গল্প-উপন্যাসে সবচেয়ে বেশি হলেও, নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্বও করে তার অনেক লেখাই।
হুমায়ূন আহমেদ যেভাবে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছে যেতে পেরেছেন, তা পারেননি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আর কোনো কথাসাহিত্যিকই। শুধু বাংলাদেশই কেন, দেশের সীমানা পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গেও তিনি পেয়েছেন অভূতপূর্ব, অচিন্ত্যনীয় জনপ্রিয়তা। শরৎচন্দ্র পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক।
মূলত উপন্যাসের মাধ্যমে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছালেও, হুমায়ূন আহমেদের পরিচয় কেবল ঔপন্যাসিকের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। উপন্যাসের পাশাপাশি ছোট গল্প তো লিখেছেনই, সেই সাথে আত্মপ্রকাশ করেছেন নাট্যকার, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেও; এবং শিল্প-সংস্কৃতির যে অঙ্গনেই তিনি হাত দিয়েছেন, সেখানেই অনুমিতভাবে সোনা ফলিয়েছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের সিংহভাগ শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের যে সাংস্কৃতিক রুচিবোধ, সেটিও অনেকাংশে গঠন করে দিয়েছেন তিনিই।
হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টিকর্মে মুক্তিযুদ্ধ
বিচিত্র সব বিষয়ে অক্লান্তভাবে লিখে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ, সাজিয়েছেন সৃজনশীলতার পসরা। তাই কোনো নির্দিষ্ট ঘরানার লেখক বা নির্মাতা হিসেবে তাকে নির্দিষ্ট করা অসম্ভব। তবে একটি বিষয় খুব নিয়মিতই, পরম যত্ন ও শ্রদ্ধার সাথে উঠে এসেছে তার সৃষ্টিকর্মে। সেটি হলো একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের সাথে হুমায়ূন আহমেদের ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হুমায়ূন নিজে বন্দি হয়েছিলেন পাকবাহিনীর হাতে, হয়েছিলেন নির্যাতিত। এমনকি তাকে হত্যার জন্য গুলিও চালানো হয়, শেষ পর্যন্ত অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনি। তবে নিজে প্রাণে বাঁচলেও, এই মুক্তিযুদ্ধই তার ও তার পরিবারের এক অপূরণীয় ক্ষতি করে দিয়েছিল। ১৯৭১ সালে পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও হিসেবে কর্মরত অবস্থায় তার বাবা ফয়জুর রহমানকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনারা, যা তার মনে ফেলে গিয়েছিল গভীর ছাপ।
তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টি মাসই তিনি মৃত্যুকে এত কাছ দিয়ে দেখেছেন, অবিরত ভয় ও আতঙ্কের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন যে, পরবর্তী সময়ে বারবার তার সৃষ্টিকর্মে ঘুরেফিরে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের নানা প্রসঙ্গ। এমন নয় যে তিনিই প্রথম মূলধারার গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন, সেটিকে উপজীব্য করে নতুন নতুন সব গল্প-উপন্যাস-নাটক-চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তারপরও তার সৃষ্টিকর্মে মুক্তিযুদ্ধের উপস্থাপন বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। কারণ তিনিই সেই ব্যক্তি, যিনি গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে রূপায়নের গতানুগতিক ধারা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে এসেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধকে নিজের কল্পনার ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছিলেন একদমই সহজ-সরল, কৃত্রিমতাবর্জিত, সাদামাটা অথচ হৃদয়ের ঠিক মধ্যে গিয়ে বেঁধার মতো আঙ্গিকে।
ছোট গল্পে মুক্তিযুদ্ধ
হুমায়ূন আহমেদের কোন সৃষ্টি সবচেয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে? অবশ্যই উপন্যাস। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের সিংহভাগ জুড়েই বাংলাদেশি সাহিত্য ছিল হুমায়ূনময়। যুগে যুগে তরুণ প্রজন্ম তার উপন্যাস পড়েই বইয়ের প্রতি বুঁদ হয়েছে। আবার যারা তথাকথিত শিক্ষিত নয়, কিংবা পাঠবিমুখ, তারাও তাঁর নাটক-চলচ্চিত্রগুলো কখনো না কখনো অবশ্যই দেখেছে। সে তুলনায় তার ছোট গল্প নিয়ে চর্চা খুব কমই হয়েছে। যাকে বলা হয় ‘আন্ডাররেটেড’, হুমায়ূনীয় ছোট গল্পগুলো যেন ঠিক তা-ই।
অথচ মজার ব্যাপার হলো, হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকর্মকে যারা খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেছেন, তাদের কাছে কিন্তু তার উপন্যাসের চেয়ে ছোট গল্পগুলোই প্রশংসিত হয়েছে বেশি। খুবই ছোট পরিসরে খুব ব্যাপক ও বিস্তৃত বিষয়বস্তুকে যেভাবে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন, যেভাবে অল্প কথায় জীবনবোধের অতলস্পর্শী গভীরতার সন্ধান করেছেন, তার কোনো তুলনা হয় না। অনেক শিল্পবোদ্ধাই হুমায়ূন আহমেদের ছোট গল্পকে তুলনা করেছেন বিশ্বসাহিত্যের ক্লাসিক গল্পগুলোর সঙ্গে। তারা বলেছেন, সাহিত্যমূল্যের দিক থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে হুমায়ূন আহমেদের ছোট গল্প সবদিক থেকেই বিশ্ব সাহিত্যের অন্যান্য গল্পের প্রায় সমকক্ষ।
চঞ্চল কুমার বোস তার পিএইচডি স্বীকৃত বই ‘বাংলাদেশের ছোটগল্পের শিল্পরূপ’-এ হুমায়ূন আহমেদের ছোট গল্প সম্পর্কে বলেছেন,
“তাঁর (হুমায়ূন আহমেদ) শ্রেষ্ঠ গল্প জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আনন্দ-বেদনা, স্বপ্ন ও ব্যর্থতার শব্দরূপ। নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবন, তার বিচিত্র আকাঙ্ক্ষা ও অনুভূতি, প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির নিভৃত উন্মোচন ঘটেছে হুমায়ূন আহমেদের গল্পে। ব্যক্তিজীবনের অম্লমধুর অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ের জীবন যন্ত্রণার অন্তরঙ্গ রূপটিকে সরল বর্ণনার মাধ্যমে তুলে এনেছেন গল্পকার। খণ্ড ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা এক বিপুল জীবনসত্যের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে তাঁর গল্পে। মানুষের ক্ষুদ্র চাওয়া-পাওয়া, সুখ-দুঃখ, মিলন-বিষাদই তাঁর গল্পের উপজীব্য।”
এই মূল্যায়ন থেকেই প্রতীয়মান হয়ে যায় হুমায়ূন আহমেদের ছোট গল্পের স্বরূপ, এবং সেইসাথে তার ছোট গল্পে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়কে উপস্থাপনের বিশেষত্ব। ‘জলিল সাহেবের পিটিশন’, ‘জনক’, ‘নন্দিনী’, ‘শীত’, ‘উনিশ শ’ একাত্তর’, ‘পাপ’ ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ছোট গল্প। এবং প্রতিটি গল্পই ভিন্ন ভিন্ন ঘরানা ও প্রেক্ষাপটের সাক্ষ্য দেয়। নানাভাবে, নানামাত্রিকতায় তিনি আলো ফেলেছেন মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ের ওপর। তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট অনেক হৃদয়বিদারক, মর্মন্তুদ, বিষাদময় ঘটনা।
‘জলিল সাহেবের পিটিশন’ গল্পে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি উত্থাপন করেন জলিল সাহেব নামক এক অসাধারণ চরিত্রের মাধ্যমে, যিনি মুক্তিযুদ্ধে তার দুই সন্তানকে হারান, এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দেশে নিরপরাধ মানুষদের হত্যা করা লোকগুলোকে অবাধে ঘুরে বেড়াতে দেখে তাদের বিচারের দাবিতে গণস্বাক্ষর গ্রহণ করতে শুরু করেন।
‘শীত’ একটি মর্মস্পর্শী, মানবিক আবেদনসম্পন্ন গল্প যেখানে বলা হয়েছে মেছের আলি নামের এক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পিতার বেদনার কথা। শীতের রাতে যন্ত্রণাকাতর সেই পিতা মৃত ছেলের নামের সুবাদে একটি কম্বল প্রত্যাশা করেন। কম্বল পাওয়ার পর সেটিকে এক বিশাল অর্জন মনে করেন তিনি, এবং জীবন দিয়ে তার কম্বলপ্রাপ্তি নিশ্চিত করেছেন বলে ছেলের প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন। একটা সময় পর্যন্ত এই দেশে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার সমাজে কী চরম অবহেলা ও অনুদারতার শিকার হয়েছে, সেটিই ফুটে উঠেছে এই গল্পে।
‘নন্দিনী’ আরো একটি গল্প, যেখানে প্রতিফলিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের বিমূর্ত রূপ। এই গল্পে বলা হয়েছে নন্দিনী নামক এক ভাগ্যাহতা হিন্দু নারীর কথা, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথমে যার বাবাকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, এবং নিরুপায় হয়ে যে রাজাকারকে সে বিয়ে করে, পরবর্তী সময়ে তারও মৃত্যু হয় মুক্তিবাহিনীর হাতে।
আবার ‘জনক’-এ উঠে এসেছে মুক্তিযোদ্ধা মতির কথা, যে যুদ্ধের পর বিজয়ী বেশে ফিরে আসে নিজ ডেরায়, এবং এক রাতে দুই মাস এগারো দিন বয়সী পুত্রকে কোলে নিয়ে শোনাতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতার কাহিনী। অবুঝ শিশুকে সে বলে সেই সহযোদ্ধা, অকুতোভয় মনু ভাইয়ের কাহিনী, যার নামানুসারে সে নিজের পুত্রের নামও রেখেছে মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন।
‘পাপ’ গল্পে বর্ণিত হয়েছে যুদ্ধের ভয়াবহতার আখ্যান। দেখানো হয়েছে একটি যুদ্ধে কীভাবে পাপের চাষ হতে থাকে, এবং আপাত সাধারণ-নিরীহ মানুষদেরও স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেচনাবোধের কবর রচনা করে, তাদেরকে মানুষের বাসভূমি থেকে হিংস্র পশুর চারণক্ষেত্রে নিয়ে ফেলে। কিংবা এটিকে মনঃবিশ্লেষণের একটি কাল্পনিক রূপও বলা যেতে পারে, যেখানে দেখানো হয়েছে বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার জন্য মানুষ নিশ্চিত পাপ জেনেও তা করতে বাধ্য হয়।
‘উনিশ শ’ একাত্তর’ গল্পে খুব স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে পাকিস্তানিদের কাপুরুষতার চিত্র। পাকবাহিনী একটি গ্রামে হানা দিয়ে শুরুতে খুব হম্বিতম্বি করতে থাকে। গ্রামের এক স্কুল শিক্ষক, আজিজ মাস্টার তাদের কাছে গেলে, পাকিস্তানি মেজর তাকে খুব অপমান করতে থাকে, এবং এক পর্যায়ে তাকে নগ্ন হতেও বাধ্য করে। কিন্তু সেই আজিজ মাস্টারই যখন মৃত্যুভয়ে শঙ্কিত না হয়ে মেজরের গায়ে থুথু ফেলে, মেজর নিজেই শঙ্কিত হয়ে যায়, তার দলকে নিয়ে তৎক্ষণাৎ ওই গ্রাম ত্যাগ করে। অর্থাৎ যতক্ষণ ওই মেজর ভাবছিল মুক্তিবাহিনী তাদের কোনো ক্ষতি করবে না, ততক্ষণ সে খুব দাপট দেখাচ্ছিল। কিন্তু আজিজ মাস্টার একটু দুঃসাহস দেখাতেই মুক্তিবাহিনীর ভয়ে মেজর ভয় পেয়ে দলবল নিয়ে পালিয়ে যায়।
উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস নিয়ে বোধহয় নতুন করে খুব বেশি কিছু বলার দরকার নেই। কারণ সাহিত্যের এই শাখাটিতেই তিনি সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন করেছেন। মৃত্যুর সাত বছর পেরিয়ে গেলেও তিনিই প্রতি বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় সর্বাধিক বই বিক্রিত লেখক, এবং তার সিংহভাগ বইয়ের প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম (অন্যপ্রকাশ) জানিয়েছেন যে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ক্রয়ের প্রতিই পাঠকদের ঝোঁক সবচেয়ে বেশি। তিনি আরো বলেন, বাজারে কাটতির দিক থেকে হুমায়ূন আহমেদের জায়গা নেবার মতো কোনো লেখক এখনো বাংলাদেশে নেই।
ঔপন্যাসিক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৭২ সালে, অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পরের বছর। সে বছর ঢাকা থেকে বের হয় ‘নন্দিত নরক’ নামক উপন্যাসটি, এবং বের হওয়ার সাথে সাথেই সেটি বাঙালি মধ্যবিত্ত পাঠকদের মন জয় করে নেয়। সেই যে তিনি এই বিশেষ শ্রেণির পাঠকদের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন, তারপর আর কখনোই, মৃত্যুর পর তো নয়ই এমনকি ব্যক্তিজীবনের সর্বোচ্চ বিতর্কিত সময়ও, তিনি স্থানচ্যুত হননি। সে যা-ই হোক, ‘নন্দিত নরক’ উপন্যাসটির মূল অনুরাগী ছিলেন সে সময়কার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা, যাদের কাছে এটিকে একদমই নতুন এক ধরনের উপন্যাস মনে হয়। যে ধরনের উপন্যাস তারা আগে কখনো পড়েনি। তাদের কল্যাণে রাতারাতি ‘নন্দিত নরক’ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
শুধু তরুণ প্রজন্মই নয়, ‘নন্দিত নরকে’ ছুঁয়ে গিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আহমদ শরীফেরও মন। তিনি এই উপন্যাসের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছিলেন, বাংলা সাহিত্যে একজন শক্তিশালী ঔপন্যাসিকের আবির্ভাব ঘটেছে। উপন্যাসটি বই আকারে প্রকাশের সময় তিনি ভূমিকায় লিখেছিলেন:
“মাসিক ‘মুখপত্রে’র প্রথম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যায় গল্পের নাম নন্দিত নরকে দেখেই আকৃষ্ট হলাম। কেননা ঐ নামের মধ্যেই যেন একটি জীবনদৃষ্টি, একটি অভিনব রুচি, চেতনার একটি নতুন আকাশ উঁকি দিচ্ছিল। … পড়তে শুরু করলাম ঐ নামের মোহেই। পড়ে অভিভূত হলাম। গল্পে সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছি একজন সূক্ষ্মদর্শী শিল্পীর, একজন কুশলী স্রষ্টার পাকা হাত। বাঙলা সাহিত্যক্ষেত্রে এক সুনিপুণ শিল্পীর, এক দক্ষ রূপকারের, এক প্রজ্ঞাবান দ্রষ্টার জন্মলগ্ন যেন অনুভব করলাম।”
‘নন্দিত নরকে’-র রেশ কাটতে না কাটতেই ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় হুমায়ূন আহমেদের আরো একটি উপন্যাস, ‘শঙ্খনীল কারাগার’। ‘নন্দিত নরকে’-র মতো এই উপন্যাসের ভাষাও ছিল সহজ-সরল, স্বচ্ছন্দ ও গতিময়। তদুপরি গল্প বলার অসাধারণ এক সম্মোহনী শক্তি ছিল তার মধ্যে। এছাড়াও তার উপন্যাসের কিছু স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ছিল; যেমন: কাহিনী বর্ণনায় সবসময় একটা টানটান উত্তেজনার আমেজ বজায় রাখা, ঘটনার বিন্যাসকে কৌতূহলজাগানিয়া করে তোলা, বৈচিত্র্যময় অথচ বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র সৃষ্টি এবং সহজ-সরল ভাষ্যে গভীর অন্তর্দৃষ্টি। এসবের সুবাদে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি খ্যাতির শীর্ষাসনে অধিষ্ঠিত হন।
সমসাময়িক ও প্রাসঙ্গিক আরো নানা বিষয়ের পাশাপাশি, মুক্তিযুদ্ধও বারবার ঘুরেফিরে এসেছে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসে। মূলত তিনি এমন একটি কালের মানুষদের নিয়ে গল্প বাঁধতেন, যাদের জীবনের সাথে মুক্তিযুদ্ধের সংযোগ ছিল অনিবার্য। ফলে তার উপন্যাসেও খুব স্বাভাবিক ও অনাড়ম্বরভাবেই বারবার উঠে আসত মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখ। তবে যদি জানতে চাওয়া হয় হুমায়ূন আহমেদ তার কোনো উপন্যাসগুলোতে সচেতনভাবেই মুক্তিযুদ্ধকে কাহিনীর মূল হাতিয়ার করতে চেয়েছেন, সেক্ষেত্রে উঠে আসবে আটটি উপন্যাসের নাম।
সেগুলো হলো: ‘শ্যামল ছায়া’, ‘নির্বাসন’, ‘সৌরভ’, ‘১৯৭১’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘সূর্যের দিন’, ‘অনিল বাগচীর একদিন’ ও ‘জোছনা ও জননীর গল্প’। এই উপন্যাসগুলোতে হুমায়ূন আহমেদ একাত্তরের রক্তাক্ত সময়ের সমাজচিত্র এমনভাবে তুলে ধরেছেন যে, সেখানে থেকে কেবল যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের ছবিই নয়, একই সাথে প্রত্যক্ষ করা যায় স্বপ্নময় ও নতুন মূল্যবোধের সাহসী ও প্রতিবাদী মানুষের মুখচ্ছবিও।
মুক্তিযুদ্ধকে হুমায়ূন আহমেদ খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন, এবং যখনই তিনি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস লিখতে বসেছেন, সেখানে তার নিজের সেই অভিজ্ঞতাগুলোর সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তবু যেন শুরুর দিকে তিনি নিজের লেখায় সন্তুষ্টি পাচ্ছিলেন না। নিজের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে হয়ে পড়েছিলেন সন্দিহান। তাই তো ‘মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসসমগ্র’-এর প্রসঙ্গ কথায় তিনি লিখেছিলেন:
“মুক্তিযুদ্ধকে আমি দেখেছি যুবকের চোখে এবং দেখেছি খুব কাছ থেকে। জীবন এবং মৃত্যুকে এত ঘনিষ্ঠভাবে কখনো দেখব ভাবিনি। কত বিচিত্র আবেগ, কত বিচিত্র অনুভূতি! অথচ লেখায় আসছে না। যেন মুক্তিযুদ্ধ আমার আড়ালেই ঘটে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আমার প্রথম লেখাটি লেখা হয় মুক্তিযুদ্ধের চার বছর পর। নাম ‘শ্যামল ছায়া’। একটি ছোট গল্প যা থেকে পরে ‘শ্যামল ছায়া’ নামে একটি উপন্যাস লিখি। একদল মুক্তিযোদ্ধা একটা থানা আক্রমণ করতে যাচ্ছে। এক রাতের কাহিনী। উপন্যাস হিসেবে হয়তোবা উৎরে যায় কিন্তু আমার মন ভরল না।
মনে হলো আমি পারছি না। স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো বিশাল ব্যাপার ধরার মতো ক্ষমতাই হয়তোবা আমার নেই। মন খারাপ হয়ে গেল। অনেকবার চেষ্টা করলাম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখতে—পারলাম না। কেন লিখতে পারলাম না সেও এক রহস্য। দশ বছর পর লিখলাম সৌরভ—মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঢাকা নগরীর মানুষের জীবনচর্যার গল্প। আমার কাছে মনে হলো অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর কিছুটা সৌরভে ধরা পড়েছে। খানিকটা আত্মবিশ্বাস ফিরে এলো।”
হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘শ্যামল ছায়া’ ও ‘আগুনের পরশমণি’ নিয়ে পরবর্তী সময়ে তিনি নিজে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন (অনিল বাগচীর একদিন নিয়েও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, কিন্তু সেটির নির্মাতা ছিলেন মোরশেদুল ইসলাম)। তাই ‘মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস’ অংশের আলোচনা তার বাকি ছ’টি উপন্যাসেই সীমাবদ্ধ রাখছি।
শুরু করা যাক ‘নির্বাসন’ দিয়ে। এটি যতটা না মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস, তারচেয়েও বেশি প্রেমের উপন্যাস। অনেকে আবার এটিকে সামাজিক জীবনঘনিষ্ঠ উপন্যাস হিসেবেও অভিহিত করতে পারেন। এই উপন্যাসের কাহিনী জরীর বিয়েকে কেন্দ্র করে। জরীর বিয়ের একদম প্রথম প্রহর থেকে শেষ পর্যন্ত এই উপন্যাসের ব্যাপ্তি। তাহলে এখানে মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা কী? সরাসরি হয়তো ভূমিকা নেই, কিন্তু আড়াল থেকে মুক্তিযুদ্ধই নিয়ন্ত্রণ করেছে উপন্যাসের কাহিনী।
যার সাথে জরীর বিয়ে হচ্ছে, তাকে সে ভালোবাসে না। সে ভালোবাসে আরেক যুবককে, তার চাচাতো ভাই আনিসকে। জরী আর আনিসের সম্পর্ককে সবাই মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু মাঝে বাধ সেধেছে মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল আনিস, এবং এতটাই বাজেভাবে আহত হয়ে ফিরেছে যে, তার বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এমন অবস্থায় তো আর তার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব না। তাই সে একটি ঘরে পঙ্গু হয়ে শুয়ে আছে, আর তার উপস্থিতিতেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তার ভালোবাসার মানুষটির। একটি যুদ্ধ কীভাবে প্রেম ও পূর্ণতাকে পর্যদুস্ত করে দিতে পারে, সেটিই দেখানো হয়েছে এই উপন্যাসে। সুতরাং এক শ্রেণির পাঠক এটিকে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃতি দিক বা না দিক, মুক্তিযুদ্ধের পরিণতিতে বলীয়ান এই উপন্যাসকে অগ্রাহ্য করারও উপায় নেই।
‘সৌরভ’-এ হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন এমন একদল মানুষের কথা, যারা যুদ্ধে যেতে পারেনি। তিনি বলেছেন শফিক নামের একজন খোঁড়া বাড়িওয়ালার কথা, যে মুক্তিযুদ্ধের সময়েও তার বাড়ি ও ভাড়াটিয়াদের নিয়ে দিব্যি আছে। যুদ্ধ নিয়ে অন্যদের চেয়ে তার ভয়ভীতি অনেকটাই কম, কারণটা তার শারীরিক ত্রুটি। তার বিশ্বাস, তার মতো একজন মানুষকে পাকসেনারা ঘাঁটাবে না।
কিন্তু এটুকু শুধুই মানুষটির মনস্তত্ত্বের উপরিতল, অর্থাৎ দৃশ্যমান অংশের বক্তব্য। ভেতরে ভেতরে সে-ও কিন্তু উদগ্রীব হয়ে আছে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। যুদ্ধে সে যেতে পারছে না, ঘরে বসে আছে, কিন্তু তার শরীর, মন, সমস্ত ইন্দ্রিয় পড়ে আছে যুদ্ধের ময়দানে। হুমায়ূন আহমেদ নিজেই চরিত্রটির ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, “সে হয়তো সরাসরি যোদ্ধা নয়, কিন্তু মানসিকভাবে সে অবশ্যই একজন যোদ্ধা।” এমন মনঃবিশ্লেষণের পাশাপাশি বিষণ্ণতা, যুদ্ধকালীন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুঃখবোধ—এসবের সন্নিবেশে এটিও হুমায়ূন আহমেদের একদম ভিন্নধর্মী একটি উপন্যাস।
‘১৯৭১’ উপন্যাসটিকে অনেকটা ‘উনিশ শ’ একাত্তর’ গল্পেরই সম্প্রসারিত সংস্করণ বলা যেতে পারে। তবে এটিও ঠিক যে এই উপন্যাসের কাহিনী আরো বেশি বিস্তৃত, এবং এখানে গল্পের চেয়ে আরো অনেক বেশি চরিত্রের সম্মিলনও ঘটেছে। এ উপন্যাসে রয়েছে বৃদ্ধ মীর আলী, তার ছেলে বদিউজ্জামান, জয়নাল মিয়া, আজিজ মাস্টার, ইমাম সাহেব ইত্যাদি চরিত্রকে। তবে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায় পাক সেনাবাহিনীর মেজর ও তার বাঙালি সাগরেদ রফিককে।
মে মাসের ১ তারিখ নীলগঞ্জ গ্রামে পাক মিলিটারি আসে এবং বেশ কিছু হিন্দুকে হত্যা করে। এরপর একে একে গ্রামের বিভিন্ন মানুষকে ধরে নিয়ে আসতে থাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানার জন্য যে গ্রামের পাশের বনে মুক্তিবাহিনী লুকিয়ে আছে কি না, আর যদি থাকে তাহলে তারা সংখ্যায় কত। ক্রমশ মেজর কর্তৃক বন্দিদের উপর নিষ্ঠুরতার চিত্র প্রতীয়মান হতে থাকে, এবং যুদ্ধ, বাংলার মানুষ, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন বিষয়ে মেজর তার নিজস্ব তত্ত্ব কপচাতে থাকে, যা মূলত ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে অধিকাংশ পাকিস্তানি হানাদারদের অভিমত।
তবে মেজরের চেয়েও আরো চমকপ্রদ চরিত্র রফিক, যে কাহিনীর শেষ পর্যায়ে মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে মেজরের মুখোমুখি হয়, যা মেজরের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। এই ঘটনার মাধ্যমে রূপকভাবে হলেও পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে বাঙালির বীরত্বপূর্ণ অবস্থানের চিত্রই প্রতিফলিত হয়েছে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস এই উপন্যাসটি সম্পর্কে লিখেছেন,
“নিরীহ বিবরণমূলক, সংলাপ প্রধান ১৯৭১ নামের উপনাসটি শুধু রফিকের আত্মদানের জন্যই মহত্তর উপন্যাসে রূপান্তরিত হয়ে গেল।”
তবে হুমায়ূন আহমেদের এই উপন্যাস কিংবা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আরো বিভিন্ন রচনা নিয়ে সাধারণ পাঠকদের একটি অভিযোগ রয়েছে যে, যেকোনো দেশদ্রোহী, একাত্তরে যারা বিবেচিত ছিল রাজাকার কিংবা শান্তিবাহিনীর লোক হিসেবে, তাদের প্রতিও তিনি মমত্ব দেখিয়েছেন। যেমন এই উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে এসে তিনি তা দেখিয়েছেন রফিক চরিত্রটির প্রতি। কেন এমনটি করেছেন তিনি? সে উত্তর হুমায়ূন আহমেদ নিজেই দিয়েছিলেন ইমদাদুল হক মিলনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে:
“মানুষের দু’টি দিক আছে। অন্ধকার দিকও আছে, আলোকিত দিকও আছে। মানুষের আলোকিত দিক নিয়ে কাজ করার একটা আনন্দ আছে। আলোর স্পর্শটা শরীরের দিক থেকে বোঝা যায়। মানুষের অন্ধকার দিক নিয়ে কেউ যখন কাজ করে, সে ওই অন্ধকার দিকের স্পর্শটা শরীরে কিন্তু অনুভব করে। আমি মনে হয় এই স্পর্শ এড়ানোর জন্যই বেশির ভাগ সময় আলোকিত অংশ নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি। আমার নিজের ভেতরেই তো অন্ধকার আছে, বাড়তি অন্ধকার স্পর্শ করব কেন? বরং আলো স্পর্শ করি, অন্ধকারটা কমাই। এটি একটি কারণ হতে পারে।”
‘সূর্যের দিন’ হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কিশোর উপন্যাস। এখানে তিনি দেখিয়েছেন কয়েকজন কিশোরকে, যারা ‘ভয়াল ছয়’ নামে একটি দল তৈরি করে এবং তাদের ইচ্ছা ছিল আফ্রিকার অরণ্যে যাবে অ্যাডভেঞ্চারের সন্ধানে। কিন্তু এমন সময়ই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এসে পাল্টে দেয় এই কিশোরদের চিন্তাজগত। তারা দুর্ধর্ষ অপারেশনে যায় ঠিকই, তবে তা আফ্রিকার গহীন অরণ্যের বদলে পূর্ব বাংলার মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া পাকিস্তানি নরপিশাচদের বিরুদ্ধে। তাদের মনে ছিল একটিই স্বপ্ন –
“অন্ধকার রজনী শেষে তারা আনবে একটি সূর্যের দিন।”
উপন্যাসটি কিশোর-উপযোগী বিষয় ও ভাবনা থেকে রচিত হলেও, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নময় আকাঙ্ক্ষার চমৎকার রূপায়ণ ঘটেছে। সেইসাথে উপন্যাসটি ধারণ করেছে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকের সেই আলোড়িত সময়কে, যখন ঢাকা শহরের জনজীবনে বিরাজ করছিল আতঙ্কময় অবস্থা, গুলি ও কারফিউ, এবং শহর ছেড়ে দলে দলে মানুষ রওনা দিচ্ছিল আপাত নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণটিও উঠে এসেছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণভাবে।
‘অনিল বাগচীর একদিন’ হুমায়ূন আহমেদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস। এই উপন্যাসটি অনিল বাগচী নামক এক হিন্দু যুবককে কেন্দ্র করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে সে প্রচণ্ড আতঙ্কগ্রস্ত, নিরাপত্তাহীন ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় ঢাকার একটি মেসবাড়িতে অবস্থান করছিল। জীবিকার তাগিদে দেশের এমন উত্তাল সময়েও তাকে নিয়মিত অফিসে যেতে হচ্ছিল; তা-ও আবার যে অফিসটি এক অবাঙালি বিহারীর মালিকানাধীন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খুব সামান্য সব ঘটনায়ও ভয়ে আধমরা হয়ে যেত অনিল। যেমন ঘরে একা থাকা অবস্থায় দরজায় সাধারণ টোকা পড়লেও গলা শুকিয়ে যেত তার। অথচ সেই অনিলের মধ্যেই আমূল পরিবর্তন ঘটে মেসের এক প্রতিবেশী গফুর সাহেবের কাছে হঠাৎ একদিন একটি খোলা চিঠি আসার পর। সেই চিঠিতে অনিলের জন্য অপেক্ষা করে ছিল ভয়াবহ একটি দুঃসংবাদ। সেই দুঃসংবাদ শোনার পর আকস্মিকভাবেই দুঃসাহসী হয়ে ওঠে সে। রাস্তায় মিলিটারিদের চেকপোস্টসহ সকল ধরনের বিপদকে তোয়াক্কা না করে সে রওনা হয় নিজ গ্রামের উদ্দেশে। এবং এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট না থাকা যুবকটিই প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করার বদলে, সত্য আর ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াবার জন্য আঁকড়ে ধরে প্রিয় বাবার বলা কথামালা।
সবশেষে বলতে হয় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে আলোচিত সৃষ্টিকর্ম ‘জোছনা ও জননীর গল্প’-এর কথা। সামগ্রিক আঙ্গিকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার স্বপ্ন দীর্ঘদিন ধরে মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলেন লেখক, যেটি হবে তাঁর সাহিত্যজীবনের ‘ম্যাগনাম ওপাস’। এবং সেই স্বপ্নেরই বাস্তব বহিঃপ্রকাশ ছিল তাঁর মহাকাব্যিক ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসটি।
২০০৪-এ প্রকাশিত হয় এই উপন্যাসের কলেবর ছিল পাঁচ শতাধিক, যার পুরোটা জুড়ে আছে একাত্তরের পটভূমি, এর অনশ্বর অগ্নি ও উত্তাপ। উপন্যাসটি সম্পর্কে লেখক তার পূর্বকথায় বলেছিলেন:
“উপন্যাসে বর্ণিত প্রায় সব ঘটনাই সত্যি। কিছু নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। কিছু অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে ধার নেয়া। প্রকাশিত হবার আগেই এ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি অনেককে পড়িয়েছি। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি (এই প্রজন্মের পাঠকদের কথা বলছি) তারা পড়ার পর বলেছে উপন্যাসের অনেক ঘটনাই তাদের কাছে কাল্পনিক বলে মনে হচ্ছে, এরকমও কি হয়? তাদের কাছে আমার একটাই কথা—সে বড় অদ্ভুত সময় ছিল। স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের মিশ্র এক জগৎ। সবই বাস্তব, আবার সবই অবাস্তব। আমি সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর সুররিয়েলিস্টিক সময় পার করে এসেছি। তার খানিকটাও যদি ধরে থাকতে পারি, তাহলেই আমার মানবজীবন ধন্য।”
বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক আহমেদ মাওলা এই উপন্যাসটি সম্পর্কে বলেছেন:
“জোছনা ও জননীর গল্প হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী উপন্যাস। প্রচুর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে, ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে তিনি সুবৃহৎ উপন্যাসটি রচনা করেন। এ-উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ তিনটি কাজ করেছেন। এক. তাঁর নিজের ভাষায় দেশমাতৃকার ঋণশোধ করেছেন। দুই. মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটি সফল উপন্যাস লিখেছেন। তিন. মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি দূর করেছেন।”
প্রথমেই যদি আমরা বলতে চাই দেশমাতৃকার ঋণশোধ করার বিষয়টি, এটি ছিল পুরোপুরি হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। তিনি যদি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন বিশাল পরিসরের একটি উপন্যাস না-ও লিখতেন, তবু ঔপন্যাসিক হিসেবে তার উজ্জ্বলতা এতটুকু ম্লান হতো না। কিন্তু তার নিজেরই বিভিন্ন আত্মজৈবনিক রচনা ও সাক্ষাৎকারে আমরা দেখেছি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন একটি উপন্যাস রচনার কী তীব্র ক্ষুধা তিনি লালন করতেন নিজের মনের ভিতর। তাই শেষ পর্যন্ত তিনি যে এই উপন্যাসটি লিখতে পেরেছেন, তার মাধ্যমে লেখক হিসেবে নিঃসন্দেহে তিনি প্রচণ্ড রকমের মানসিক সন্তুষ্টি লাভ করেছেন। এবং বলাই বাহুল্য, এ উপন্যাস তাকে লেখক হিসেবে এক নতুন উচ্চতায় উন্নীত হতেও সাহায্য করেছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সফল উপন্যাসের কথা যদি বলতে হয়, তাহলে অন্য লেখকদের উদাহরণ দেয়ার বদলে আমরা হুমায়ূন আহমেদেরই বাকি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাসগুলোর কথা আনতে পারি। সেগুলোর কোনোটিই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ চিত্রকে তুলে ধরতে পারেনি। কারণ ছোট কলেবরের রচনায় কেবল মুক্তিযুদ্ধের খণ্ডচিত্রই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। তাই মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা তুলে ধরতে তাঁকে এমন বিশাল ক্যানভাসের একটি উপন্যাসই লিখতে হতো। শেষ পর্যন্ত ধৈর্যচ্যুতি না ঘটিয়ে সে কাজটিও তিনি করে দেখিয়েছেন।
আবার এই উপন্যাসে তিনি এমন অনেক বিষয় ও চরিত্রেরও অবতারণা ঘটিয়েছেন, যা ইতোপূর্বে কেউ সেভাবে করেনি। যেমন তিনি বলেছেন হাছুইন্নাদের মতো অমিতসাহসী, অকুতোভয় বীরদের কথা। একাত্তরের নয় মাস দেশের আনাচে কানাচে অসংখ্য হাছুইন্নারা অসম বীরত্বে যুদ্ধ করে গেছে, যাদের খোঁজ কেঊ রাখেনি, যাদের গল্পটা কেউ শুনতে চায়নি। তাদের গল্পটা হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন। আবার খুবই কৌশলতার সাথে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ১৫ খণ্ড দলিলপত্রের অংশবিশেষও তুলে এনেছেন এই বইতে। ২৫শে মার্চ পরবর্তী পাকিস্তানিদের নৃশংস বীভৎসতার অনেক অনুষঙ্গই তিনি তুলে এনেছেন, যেগুলো সম্পর্কেও এই উপন্যাস পাঠের আগে অধিকাংশ পাঠকই জ্ঞাত ছিল না।
তবে হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে বড় সার্থকতা হলো, এই বিশালাকার একটি উপন্যাস রচনা করতে গিয়ে, এবং নানা সত্য ঘটনা ও ইতিহাসকে আশ্রয় করতে গিয়েও, তিনি খেই হারাননি। তার যে আকর্ষণীয় ও মনোগ্রাহী লিখনশৈলীর সবাই ভক্ত, সেটির সাথেও তিনি বিন্দুমাত্র আপোষ করেননি। তাই তো ইতিহাসের সত্যানুসন্ধান থাকলেও উপন্যাসটির কাঠামো ছিল এমন যা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
শেষ কথা
কোনো দেশ বা সময়কালের ইতিহাস ভালোভাবে জানার জন্য সবচেয়ে উপকারী হতে পারে নন-ফিকশনধর্মী বই। কারণ নন-ফিকশনেই সম্ভাব্য সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতার সাথে ইতিহাসকে উপস্থাপন করা হয়, সেই সাথে ঐতিহাসিক নানা ঘটনার নির্মোহ বিশ্লেষণও করা হয়। কিন্তু এ কথা তেতো হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে নন-ফিকশন ঘরানার বইয়ের চর্চা নেই বললেই চলে। এমনিতেই দেশে বইপড়ুয়ার সংখ্যাই অতি নগণ্য। তারপরও অল্প যে কিছু মানুষ বই পড়ে, তাদেরও বেশিরভাগেরই ঝোঁক কেবল ফিকশনাল বই তথা গল্প-উপন্যাস প্রভৃতির দিকেই। ফলে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্প-উপন্যাসের গুরুত্ব অপরিসীম।
একথা বলছি না যে ইতিহাসের পাঠটুকু আমাদের পাঠকেরা কেবল গল্প-উপন্যাস থেকেই নিক। কিন্তু গল্প-উপন্যাস থেকে ইতিহাসের প্রাথমিক হাতেখড়িটা তো হতেই পারে। গল্প-উপন্যাসে উঠে আসা মুক্তিযুদ্ধের নানা চিত্র থেকে তারা মুক্তিযুদ্ধকে আরো বিশদভাবে জানার আগ্রহ তো পেতেই পারে। সেদিক থেকে তুলনা করলে গল্প-উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের উপস্থাপন খুবই জরুরি।
এবং আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে, আমাদের দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় যে সাহিত্যিক, অর্থাৎ হুমায়ূন আহমেদ, তিনি তার ছোট গল্প ও উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধকে পরম মমতায় জায়গা দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নতুন প্রজন্মের আগ্রহ জন্মানোর যে কথা বলছিলাম, হুমায়ূন আহমেদের ছোট গল্প ও উপন্যাস থেকেও তা খুবই সম্ভব। এখন নতুন প্রজন্মের অংশীদার হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো, কেবল হুমায়ূন আহমেদের নির্দিষ্ট ঘরানার কিছু লেখাতেই নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ না রেখে, তার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখাগুলোকেও আরো গুরুত্বের সাথে পাঠ করা, এবং অন্যদেরকেও সে ব্যাপারে উৎসাহিত করা।
বই ও সিনেমা সম্পর্কিত চমৎকার সব রিভিউ আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
হুমায়ুন আহমেদের বইগুলো পড়তে ঘুরে আসতে পারেন এই লিঙ্কেঃ