পৃথিবীর জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা। মেরুতে থাকা বরফ গলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। পৃথিবীজুড়ে বাড়ছে জলবায়ু শরণার্থী। পৃথিবীর জনসংখ্যার বন্টন হিসেব করতে বসলে দেখা যাবে, পুরো বিশ্বের পাঁচভাগের একভাগ বসবাস করে এই দক্ষিণ এশিয়ায়। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঠেকানো না গেলে, দক্ষিণ এশিয়ার এই মানুষগুলোই নাকি হতে চলেছে আগামী বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির এক গবেষণায় জানা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার সিন্ধু আর গঙ্গা এই দুই নদীর অববাহিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। বাংলাদেশ, ভারত আর পাকিস্তানে বছরজুড়ে গড় তাপমাত্রার বিশাল পরিবর্তন এই অঞ্চলকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলতে পারে এমনটাই আশঙ্কা করছেন এই বিজ্ঞানীরা।
পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ততা, ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে কৃত্রিম পানি সংকট আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন পিছু ছাড়ছে না এই অঞ্চলের মানুষের। গত ২০-৩০ বছর ধরে উচ্চ ফলনশীল খাদ্যশস্যের চাষ করা সত্ত্বেও জমিগুলোর উৎপাদনশীলতা ক্রমান্বয়ে কমছে। তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে খাদ্য সংকট। তাহলে কি বাসযোগ্যতা হারাতে চলছে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এই সভ্যতার আবাসভূমি? দক্ষিণ এশিয়াই কি হতে চলেছে আগামী বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবায়ু শরণার্থী শিবির?
ধেয়ে আসছে ‘হিট ওয়েভ’
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বীকার করুন আর না করুন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কিন্তু কোনো কল্পকাহিনী নয়। বরং এটিই আজকের কঠিন বাস্তবতা। তবে দক্ষিণ এশিয়ার এটি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে এই অঞ্চলের অত্যধিক আর্দ্রতার কারণে। মানবদেহের উপর মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা আর আর্দ্রতার সম্মিলিত প্রভাবকে প্রকাশ করা হয় ‘ওয়েট বাল্ব তাপমাত্রা’ নামে। মানুষের দেহে থাকা পানির একটা অংশ ঘাম হিসেবে বের করে দেওয়ার মাধ্যমে দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। মূলত এই ঘাম বাষ্প হয়ে উড়ে যাওয়ার ফলেই মানুষের দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে করে। তবে বাতাসে আর্দ্রতা অত্যধিক হয়ে গেলে, ঘাম আর বাষ্প হয়ে উড়ে যায় না। ফলে অস্বস্তির সৃষ্টি হয়। এই ওয়েট বাল্ব তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেলে মানুষের দেহের এই ব্যবস্থাটি ভেঙে পড়তে পারে। অত্যাধিক গরমের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে দেহের অভ্যন্তরীণ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসমূহ। ওয়েট বাল্ব তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেলে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে হিট স্ট্রোকে। ২০১৫ সালে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে আঘাত হেনেছে ভয়ঙ্কর এক হিট ওয়েভ। ভারত সরকারের বরাত দিয়ে সিএনএন বলছে, ইতিহাসের অন্যতম এই ভয়ংকরতম এই হিট ওয়েভে প্রাণ হারিয়েছে ২,৩৩০ জন।
প্রাণ হারানো এই মানুষদের বেশিরভাগেরই অবস্থান ছিলো দারিদ্র্যসীমার নিচে। ভারতের কোনো কোনো রাজ্যে তাপমাত্রা ছাড়িয়েছে ৪৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস। স্বস্তিতে নেই বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের জনসাধারণও। গ্রীষ্মকাল যেন প্রতি বছর ধীরে ধীরে লম্বা হচ্ছে এসব এলাকায়। সাথে বাড়ছে হিট ওয়েভের আঘাতও। ভারত ছাড়া আর কোনো দেশে হিট ওয়েভ আর হিট স্ট্রোকে প্রতি বছর কত মানুষ মারা যাচ্ছে, এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও সংখ্যাটা নিতান্ত কম নয়, তা নিশ্চিত। দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল অর্থনীতির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ। নিঃসরিত কার্বন মরণছোবল দিচ্ছে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত এই মানুষদের।
উর্বরতা হারাচ্ছে জমি
দক্ষিণ এশিয়ার কৃষিজমিগুলোতে দীর্ঘসময় যাবত একই ধরনের ফসল চাষ হয়ে আসছে। সাধারণত একই ধরনের ফসল দীর্ঘদিন চাষ করার ফলে মাটিতে একটি নির্দিষ্ট উপাদানের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। ফলে উচ্চ ফলনশীল জাতের চাষ বাড়িয়েও এই এলাকার ১.৫ বিলিয়ন মানুষের খাদ্যের চাহিদা বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, খরা আঘাত হানছে এই জনপদের উপর।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের খপ্পরে পড়ে তাই কৃষিজমির উৎপাদনশীলতা যাচ্ছে দিন দিন। প্রতি বছর পৃথিবীজুড়ে যে ২৪ বিলিয়ন টন উর্বর জমি হারিয়ে যাচ্ছে তার বেশিরভাগই এশিয়ার এই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন আর শিল্পায়নের ফলে কৃষিজমির পাশাপাশি ধ্বংস হচ্ছে বনাঞ্চল।
লাগামহীনভাবে বাড়ছে লবণাক্ততা
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ততা যেন হু হু করে বাড়ছে। মালদ্বীপ, কিরিবাতি, ফিজি, বাংলাদেশ কিংবা ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষেরা যেমন একদিকে জমি হারাচ্ছে, অন্যদিকে বাড়তি লবণাক্ততার করাল গ্রাসে উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে তাদের শেষ সম্বল জমিটুকু।
পানযোগ্য পানির সংকট থেকে শুরু করে জীবনের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে এই মানুষগুলোকে।প্রতিকূল পরিবেশের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকা প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের মাঝে যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরেই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে কলেরা, টাইফয়েড সহ নানা ধরনের পানিবাহিত রোগ। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রাকৃতিক পানির উৎসের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা জীববৈচিত্র্য পড়তে চলেছে হুমকির মুখে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের করা অনুসন্ধানী এক রিপোর্টে উঠে এসেছে, ক্রমবর্ধমান এই লবণাক্ততা বাংলাদেশের ১৫ লাখ মানুষ উপকূলীয় মানুষকে তাদের বাসস্থান থেকে সরে যেতে বাধ্য করেছে, যাদের বেশিরভাগই রাজধানী ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততার নেতিবাচক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে দক্ষিণ এশিয়ার উপকূলীয় এলাকাজুড়ে। দক্ষিণ এশিয়ার উপকূলগুলোতে নিয়মিত বিরতিতে আছড়ে পড়া প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আর সাইক্লোনের পেছনেও দায়ী এই জলবায়ু পরিবর্তন। উপকূলীয় এলাকায় এতসব প্রতিবন্ধকতার সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা দিন দিন দুষ্কর হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশই কি হতে যাচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে জলবায়ু শরণার্থী শিবির?
১৯৫৮ সাল থেকে পৃথিবীতে ‘জলবায়ু শরণার্থী’ শব্দটির বহুল ব্যবহার শুরু হয়। মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে নিজ দেশের ভেতরেই অন্যত্র স্থানান্তরিত জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়। ২০০০ সালের পরবর্তী সময় থেকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সহ নানাবিধ জলবায়ু সমস্যা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে ‘জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যাও। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গণমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর মতে, আগামী ৫০ বছরে সারা পৃথিবীর প্রায় ১৫ মিলিয়ন মানুষ তাদের নিজস্ব বাসস্থান হারাতে যাচ্ছে। পৃথিবীজুড়ে ‘জলবায়ু শরণার্থী’র বেশিরভাগই হতে যাচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে। আর দুঃখজনক হলেও সত্য, এই তালিকায় সবার উপরের নামটি বাংলাদেশের। নিউ ইয়র্ক টাইমসের তৈরি করা এক ভিডিওতে বাংলাদেশের উপর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার প্রভাব।
এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কারা?
পবিবেশ আর জলবায়ুর এই মহাবিপর্যয়ের জন্য ইউরোপ আমেরিকার শিল্পোন্নত দেশগুলোর অত্যধিক মাত্রায় কার্বন ডাইঅক্সাইড সহ গ্রীন হাউজ গ্যাসকেই দায়ী করা হয়ে থাকে।
যদিও উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের দেশগুলোও পিছিয়ে নেই গ্রীন হাউজ গ্যাস নিসঃরণে, তবে এর ফলে ভুক্তভোগী হচ্ছে বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ। যৎসামান্য সাহায্য আর প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরিতেই সীমাবদ্ধ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী দেশগুলোর রাষ্ট্রনায়কেরা। অতি সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্প প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরিয়ে নিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম।
আমাদের কী করণীয়?
একদিকে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে তৈরী হচ্ছে আকস্মিক হিট ওয়েভ, অন্যদিকে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট মহাবিপর্যয় যে শরণার্থী সংকট তৈরি করছে, তা মোকাবেলায় প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে উন্নত দেশগুলোকে।
কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ কমিয়ে আনার জন্য সীমিত করতে হবে কয়লা, তেল কিংবা প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। মনোযোগ দিতে হবে সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি কিংবা জলবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের দিকে। বিনিয়োগ করতে হবে লবণাক্ততা সহিষ্ণু খাদ্যশস্যের জাত উদ্ভাবনের দিকে। বেঁচে থাকার লড়াইটা করতে হবে আমাদের নিজেদেরকেই।