দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বর্তমান করোনা পরিস্থিতিকে সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক এবং মানবিক সংকট হিসেবে উল্লেখ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব। করোনার ভয়াবহতার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, এটি সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে এবং এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কবে নাগাদ সম্ভব হবে, সেটি এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। স্বাভাবিকভাবেই মনে হচ্ছে ভ্যাকসিন ছাড়া করোনার নির্মূল করা সম্ভব নয়। ভ্যাকসিন নিয়ে আশার আলো দেখা দিয়েছে বেশ কয়েকটি গবেষণাগার থেকে, যেগুলোর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। সেসব আলোর মুখ দেখতে এখনো দেরি। এই আশা নিরাশার মাঝে মাঝে কেমন আছেন আমাদের বাংলাদেশের কৃষকেরা?
ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের স্বাস্থ্য সংকট থেকে বিশাল অর্থনৈতিক সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা থেকে দেখা দিতে পারে অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্য সংকট এবং দুর্ভিক্ষ। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য করোনা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে খাদ্য সংকট দেখা দিলে।
আমাদের দেশ বিশ্বের সর্বোচ্চ চাল উৎপাদনকারী দেশের মাঝে চতুর্থ অবস্থানে অবস্থান করছে। অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সময়টা ধানের জন্য অন্যতম অনুকূল আবহাওয়াতে থাকে। মার্চ থেকে মে মাসের মাঝে পাকা ধানে সোনালি হয়ে যায় পুরো হাওর অঞ্চল, এই সময়টা দক্ষিণাঞ্চল থেকে ধান কাটার জন্য লোক নিয়োগ করা হয়। এবার করোনা পরিস্থিতে লকডাউনের কারণে যাতায়াত ব্যবস্থা বন্ধ থাকাতে নিয়োগকৃত শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে পারেননি, তাতে ধান নষ্ট হয়ে যাবার একটা আশঙ্কা ছিল। পরে সরকারি ব্যবস্থাপনায় শ্রমিক প্রয়োজনের আবেদনের ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বোরো ধান কাটতে চলনবিল অঞ্চলে কুষ্টিয়া, রাজশাহী, গাইবান্ধা সহ প্রায় ১৭টি জেলা থেকে প্রায় ১৪ হাজার শ্রমিক আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সামাজিক দূরত্ব এবং নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন মেনে এ সকল শ্রমিকদের দিয়ে ধান কাটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শ্রমিকদের চলাচল এবং স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এই সকল শ্রমিকের নদীর ধারে অস্থায়ী বসবাসের জায়গা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে এবং নিজেদের রান্নাবান্না করে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। বোরো ধানের মৌসুমে এই ধান যেন নষ্ট না হয়, তার জন্য সরকারি সকল মহল থেকে প্রয়োজনীয় প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
গত এপ্রিল মাসের শুরুতে সরকারি এক সভায় বোরো এবং আমন ধানের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, যেন কৃষকদের বঞ্চিত না হতে হয়। এছাড়া, সরকার লটারির ভিত্তিতে বিভিন্ন কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ১৮ লক্ষ মেট্রিক টন ধান গম সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে প্রচুর কৃষক লাভবান হবেন। এছাড়া ধান-গম মজুদের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। চলতি করোনা পরিস্থির সাথে বন্যা পরিস্থিতে খাদ্য সংকট যেন দেখা না দেয়, তার জন্য সরকার আগে থেকেই এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে।
করোনাভাইরাসের কারণে বোরো পরবর্তী কৃষিকে ব্যাপক গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এ জন্য আউশ ধান, হাইব্রিড ধান, পাট, শাক-সবজি, ডালজাতীয় শস্য ও ফলমূল আবাদে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। বর্তমান পরিস্থিতি এবং বন্যা পরিস্থিতির অবনতি সবকিছু মিলিয়ে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেবার যে সম্ভাবনা রয়েছে, সে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য গত এপ্রিল-মে থেকে কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ, বাজারজাতকরণ ও বিপণনে গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। করোনার কারণে যেন খাদ্য সংকট না হয়, দেশে যেন দুর্ভিক্ষের মতো কোনো অবস্থা সৃষ্টি না হয়, মানুষ যেন খাদ্যকষ্টে না ভোগে, সেজন্যই এসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি ও কৃষি উদ্যোগে সবচেয়ে বড় অর্থায়ন করে থাকে বাংলাদেশ পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। সংস্থাটির পক্ষ থেকে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে দেশে কৃষিখাতে করোনা পরিস্থিতির সম্ভাব্য পরিস্থিতে নিয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। সেখানে করোনা সংক্রমণের ফলে মার্চ-এপ্রিল মাসের কৃষিখাতের সংকটের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়,
“আগামী জুন থেকে আগস্ট, এ সময়ে কৃষির বিপদের প্রভাব আরও স্পষ্ট হবে। দেশের সামগ্রিক খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর এর প্রভাব পড়তে শুরু করবে। ফলে, সম্ভাব্য ওই প্রভাব মোকাবিলায় সরকারকে এখনই করণীয় ঠিক করতে হবে।”
করোনা পরিস্থিতিতে শাকসবজির বাজারজাতকরণ ও কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, শাকসবজি ও পচনশীল কৃষিপণ্যের চলাচল নির্বিঘ্ন করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত ত্রাণসামগ্রীতে আলু, সবজি, পেঁয়াজ ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কৃষিপণ্যের ভ্রাম্যমাণ বাজার পরিচালনা শুরু করেছে। পাশাপাশি, লকডাউন এলাকার উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্য ঘাটতি এলাকায় প্রেরণের ক্ষেত্রে ট্রাক চলাচলের জন্য জেলা প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। ফলে, শাকসবজির বাজারজাতকরণ কিছুটা সহজতর হয়েছে।
তিনি আরও জানান, আলোচনা সভায় পাওয়া সুপারিশ অনুয়ায়ী বিআরটিসির ট্রাক ব্যবহার, বিদেশে রপ্তানির জন্য কার্গো ভাড়া, দেশের সুপারশপ খোলা রাখার সময়সীমা বাড়ানো এবং সমন্বয়ের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হবে।
সভায় জানানো হয়, বাংলাদেশের জেলাগুলোর মধ্যে মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, ঝিনাইদহ, যশোর, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, বগুড়া, পাবনা, রাজশাহী, গাইবান্ধা, রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, ভোলা ইত্যাদি হচ্ছে সবজির জন্য উদ্বৃত্ত জেলা। এসব জেলা থেকে ট্রাকযোগে শাকসবজি অন্য জেলায় প্রেরণ করা হচ্ছে।
এতসব ব্যবস্থাপনার মাঝেও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। করোনাকালীন পরিস্থির প্রভাব অনেকটা সময় ধরে ভোগাবে বলে ধারণা করছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। তাই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার বিকল্প নেই।