স্কটিশ গণিতবিদ এরিক টেম্পল বেলের লেখা বিখ্যাত বই Men in Mathematics একটি কালজয়ী সৃষ্টির উদাহরণ। বিখ্যাত সব পুরুষ গণিতবিদ, যাদের হাত ধরে গণিতের গুরুত্বপূর্ণ সব আবিষ্কার হয়েছে, তাদেরকে বেল তার এই বইয়ের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সামনে নিয়ে এসেছেন এবং তাদের কাজগুলোকে তুলে ধরেছেন। জন ন্যাশ, উইলসদের মতো গণিতবিদরা এই বই থেকে গণিত নিয়ে কাজ করার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।
গাউস, অয়লার, রেইম্যন, পয়েনকেয়ার, ইরডস, উইলস, পেরেলমেন প্রমুখ সবাই বিখ্যাত গণিতবিদ। গণিতের বিভিন্ন শাখায় তাদের অবদান অনস্বীকার্য। এখানে একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রত্যেকেই একই লিঙ্গের অধিকারী, অর্থাৎ প্রত্যেকেই পুরুষ। সাধারণ মানুষের কাছে মনে হতে পারে, গণিত নামক বিষয়টি শুধুই পুরুষদের জন্য। মেয়েরা এখানে ভালো করতে পারবে না। আবার অনেকে এক ধাপ বেশী বুঝে মনে করে ফেলতে পারে যে, গণিতের মতো জটিল বিষয় মেয়েদের মাথায় ঢুকবে না, তাই গণিতের মতো মৌলিক বিষয়ের উন্নতি সাধনে এবং নতুন কিছু আবিষ্কার করতে মেয়েদের কথা ভেবে লাভ নেই। এই কথাটি যে কতটুকু ভুল সেটা তুলে ধরার জন্যই আজকের এই লেখা।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, এখনও গণিতের নানা শাখায় পুরুষদের আধিপত্যই বেশী। তাই অনেকের কাছে মনে হতে পারে এই শাখাতে নারী সমাজের কোনো অবদান নেই। নতুন প্রজন্মের কারো মধ্যে যদি এরকম ধারণা থাকে তাহলে তা ভেঙ্গে দেয়ার জন্য এখানে বলে রাখা ভালো, আধুনিক যে বিভিন্ন গাণিতিক তত্ত্ব আমরা ব্যবহার করি সেগুলো প্রমাণ করার পেছনে নারীদের বিশেষ কিছু অবদান আছে। এই অবদান ছড়িয়ে আছে স্পেসের জটিল জ্যামিতি নির্ণয়ে, অ্যাবস্ট্রাক্ট অ্যালজেব্রাতে, ডিসিশন থিওরি, নাম্বর থিওরি এবং মহাকাশ বিজ্ঞানে। এসব শাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার কারণে আধুনিক ক্রিপ্টোগ্রাফি, কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং পদার্থ বিজ্ঞানের উন্নতি সাধন হয়েছে।
আজকে তিনজন এমন নারী গণিতবিদের কথা আলোচনা করা হবে যাদের অবদান গণিতকে শুধু নতুন কিছু দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বরং গাণিতিক জগতে রীতিমত বিপ্লবের সূচনা করেছে। ইতিহাসে অমর এই তিন নারী হচ্ছেন- জুলিয়া রবিনসন, যিনি হিলবার্টের নম্বর থিওরির দশ নম্বর সমস্যা নিয়ে কাজ করেছেন; এমি নয়থার, তিনি অ্যাবস্ট্রাক্ট অ্যালজেব্রা এবং পদার্থবিজ্ঞানে অবদান রেখেছেন, এবং সর্বশেষ এডা লাভলেস, যিনি কিনা কম্পিউটার বিজ্ঞানে অবদান রেখেছেন, বিশেষ করে তাকে বিশ্বের প্রথম প্রোগ্রামার বলা হয়ে থাকে। এই তিন নারী গণিতবিদ সম্পর্কে আজকে আলোচনা করা হবে।
জুলিয়া রবিনসন (জন্ম- ১৯১৯, মৃত্যু- ১৯৮৫)
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে জার্মান গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্ট ২৩টি নতুন সমস্যা প্রকাশ করেছিলেন। সেই সমস্যাগুলো ছিল অত্যন্ত কঠিন, কিন্তু আগ্রহোদ্দীপক। এই সমস্যাগুলোর সমাধানে অনেক গণিতবিদ এগিয়ে এসেছিলেন এবং সমস্যাগুলোর সমাধান প্রমাণ করে শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করার জন্য একটি অঘোষিত প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন তারা। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে দশম সমস্যা ছিল একটি ডায়োফেন্টাইন সমীকরণের সমাধান যোগ্যতা নিয়ে। ডায়োফেন্টাইন সমীকরণ হচ্ছে এমন একটি সমীকরণ যার সমাধানগুলো হবে পূর্ণসংখ্যায় এবং যার চলকের সাথের গুণাঙ্কটিও হবে একটি পূর্ণসংখ্যা। এখন এমন একটি মেশিনের কথা যদি চিন্তা করি যেটা একটি ডায়োফেন্টাইন সমীকরণ সমাধানযোগ্য কিনা তা বের করবে, তাহলে কেমন হয়? প্রকৃতিতে এমন অনেক গাণিতিক সমীকরণ আছে যেগুলোর সমাধানের জন্য প্রচুর পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন।
এই সমস্যাটি নাড়া দেয় ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিদ জুলিয়া রবিনসনকে। ডেভিস এবং পুটনাম নামক আরও দুজন সহকর্মীর সাথে মিলে এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন জুলিয়া। এবং প্রায় কয়েক দশকের চেষ্টার পর তারা সমস্যাটির সমাধানের একটি উপায় বের করতে সক্ষম হন। ১৯৭০ সালে রাশিয়ান গণিতবিদ উরি মাতিয়াসেভিচ জুলিয়ার উপায় ব্যবহার করে সেই সমস্যার একটি সমাধান দেন। সংখ্যাতত্ত্বে অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী জুলিয়া রবিনসনকে মৌলিক গাণিতিক শাখায় অনবদ্য অবদানের জন্য এখনও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। তার এই অবদানের কারণে একদম Pure Mathemtics এর বেশ কিছু সমস্যার সমাধান প্রকাশ করা গিয়েছে। Mathematical Association of America তে তাকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ বের হয়েছিল- The Autobiography of Julia Robinson।
এমি নয়থার (জন্ম- ১৮৮২, মৃত্যু- ১৯৩৫)
যেকোনো Abstract Math কোর্সে কেউ যদি বসে তাহলে সে এমি নয়থারের নাম অবশ্যই শুনে থাকবে। গণিত নিয়ে তার কাজগুলো পদার্থবিজ্ঞান থেকে শুরু করে আধুনিক বীজগণিতে স্থান পেয়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯১৩ সালে প্রকাশিত Calculus of Variations নিয়ে তার কাজ, যেটা এখন নয়থার থিওরেম নামে পরিচিত, সেটা প্রকাশ পায়। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে এই থিওরেমটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া রিং থিওরিতে তার কাজগুলোকে উচ্চ বীজগাণিতিক শাখায় এখনও উল্লেখ করা হয়।
নয়থারের কাজগুলো কোনো প্রাকৃতিক বিষয়ের আসল রূপ বোঝার জন্য কোনো গাণিতিক হিসাবের সাহায্য নেয়া হলে, সেখানে ব্যবহার করা হয়। তার কাজ ব্যবহার করে ওই বিষয়ের গভীরতা খুব সহজেই অনুধাবন করা যায়। ১৯৩৫ সালে বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন নিউইয়র্ক টাইমসকে একটি চিঠি লিখেন। সেখানে তিনি বলেন যে এখন (১৯৩৫) পর্যন্ত বেঁচে আছে এমন গণিতবিদদের মধ্যে নয়থার হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সৃজনশীল জিনিয়াস। যখন থেকে মেয়েদের পড়াশোনা উচ্চশিক্ষার গণ্ডিতে প্রবেশ করেছে, ততদিন থেকে আজ পর্যন্ত (১৯৩৫) বিজ্ঞান এবং গণিতে নয়থারের অবদান সবচেয়ে বেশী।
এডা লাভলেস (জন্ম- ১৮১৫, মৃত্যু- ১৮৫২)
কম্পিউটারের জনক (মতান্তরে) চার্লস ব্যাবেজ, যিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের প্রফেসর ছিলেন, ১৮৪২ সালে তুরিন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি লেকচার দেন। লেকচারের বিষয়বস্তু ছিল Analytical Engine, অর্থাৎ এমন একটি যন্ত্র যেটা গণনা করতে পারবে। তার বক্তব্য তত্ত্বের পর্যায়ে ছিল। এরপর আরেক গণিতবিদ লুইগি মেনাব্রিয়া সেই লেকচার ফ্রেঞ্চ ভাষায় প্রতিলিপি করেন। সেখান থেকে এডা লাভলেস সেই লেকচার নোট ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। কিন্তু সেই অনুবাদের সাথে সাথে ব্যাবেজের কাজকে আরও অনেক দূর উন্নত করেন এবং একটি মেশিন ডিজাইন করেন। ১৮৪৩ সালে তিনি একটি পেপার বের করেন এ নিয়ে এবং সাথে সাথে নিজের একটি নোট সেখানে সংযোজন করেন যেখানে মেশিন ব্যবহার করে বার্নোলি নম্বর গণনা করার একটি এলগরিদম লেখা ছিল, যেটা ছিল প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রাম। অর্থাৎ, ব্যাবেজের গাণিতিক ইঞ্জিনকে আরও উন্নত করেন এডা লাভলেস। এডা লাভলেসের এই কাজ পরবর্তীতে কম্পিউটার এবং প্রযুক্তিতে বিরাট সাফল্য বয়ে নিয়ে আসে। যদিও চার্লস ব্যাবেজ কখনও এই বিষয়ে কৃতজ্ঞ স্বীকার করেননি, তবে এটা সত্যি যে এডার করা ইংরেজি অনুবাদ পড়ে ব্যাবেজ তাকে সেই কাজটিকে আরও উন্নত কীভাবে করা যায় সেই বিষয়ে কাজ করার জন্য এডাকে অনুরোধ করেছিলেন।
উপরের আলোচনা থেকে একটি কথা স্পষ্ট যে এত গভীর সব অবদান থাকার পরও পুরুষদের সামনে পুরোপুরি অজ্ঞাত থেকে যায় নারীরা। তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা সাধারণ মানুষের সামনে উঠে আসে না। সেই জন্য বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রায় সমান সমান নারী-পুরুষ জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও মেয়েরা গণিত শাখায় অবদান রাখতে পারছে না এবং এই বিষয়ে পড়াশোনার জন্য এগিয়ে আসছে না। এর কারণ হচ্ছে তাদের সামনে এই বিষয়ে ভালো করার কোনো উদাহরণ নেই, এমনকি কোনো প্রণোদনাও নেই। অথচ ইতিহাস ঘাটলেই এরকম উদাহরণ অনেক পাওয়া যায় যেখানে দেখা যায় নারীদের অবদানের কথা। এ মানুষদের সামনে আনতে পারলে, তাদের সম্পর্কে কথা বলতে পারলে, পরিচয় করিয়ে দিতে পারলে হয়তো সমাজে গণিত বিষয়ে মেয়েদের যে ভয় এবং পিছিয়ে পড়া, সেটা অনেকাংশে কমিয়ে আনা যেতে পারে।
ফিচার ইমেজ সোর্স: Collage made by Soumik