সম্প্রতিক একজন রুশ ব্লগার ও আইনজীবী রুশ সরকারবিরোধী কার্যকলাপের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিতি অর্জন করেছেন। পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টিতে (এবং রুশ জনসাধারণের একাংশের চোখে) তিনি একজন ‘মহান গণতন্ত্রকামী নেতা’, রাশিয়ার ‘একমাত্র আশার আলো’। রুশ নিরাপত্তা পরিষদের উপসভাপতি এবং রাশিয়ার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভের মতে, তিনি একজন ‘পলিটিক্যাল স্কাউন্ড্রেল’। মার্কিন পত্রিকা ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ তাকে আখ্যায়িত করেছে ‘যে ব্যক্তিকে ভ্লাদিমির পুতিন সবচেয়ে বেশি ভয় করেন’ (the man Vladimir Putin fears most) হিসেবে। তিনি আলেক্সেই নাভালনি।
আলেক্সেই আনাতোলিয়েভিচ নাভালনি ১৯৭৬ সালের ৪ জুন তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত রুশ সোভিয়েত ফেডারেল প্রজাতন্ত্রের মস্কো প্রদেশের ওদিন্তসোভস্কি জেলার বুতিন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আনাতোলি নাভালনি এবং মা লুদমিলা নাভালনায়া বর্তমানে মস্কো প্রদেশের কোবিয়াকোভো গ্রামে অবস্থিত একটি ঝুড়ি নির্মাণ কারখানার মালিক। নাভালনি নিজেকে জাতিগতভাবে ‘আধা রুশ এবং আধা ইউক্রেনীয়’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মস্কো থেকে প্রায় ১০০ কি.মি. দক্ষিণ–পশ্চিমে অবস্থিত কালুগা প্রদেশের অন্তর্গত ওবিয়ানস্ক শহরে নাভালনি বড় হয়েছেন। অবশ্য তিনি তাঁর গ্রীষ্মকালীন ছুটিগুলো ইউক্রেনে তার দাদীর সঙ্গে কাটাতেন, এবং এর মধ্য দিয়ে তিনি ইউক্রেনীয় ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করেন।
নাভালনি মস্কোয় অবস্থিত ‘রুশ গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে’ আইন নিয়ে অধ্যয়ন করেন এবং ১৯৯৮ সালে সেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ‘রুশ ফেডারেশন সরকারের অধীন অর্থায়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে’ সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। পরবর্তীতে ২০১০ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাট অঙ্গরাজ্যের নিউ হ্যাভেন শহরে অবস্থিত ‘ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে’ অধ্যয়নের জন্য একটি বৃত্তি লাভ করেন এবং সেখান থেকে একটি ‘নন–ডিগ্রি ফেলোশিপ’ অর্জন করেন।
২০০০ সালে নাভালনি রুশ সামাজিক উদারপন্থী ও ইউরোপমুখী রাজনৈতিক দল ‘রুশ সংযুক্ত গণতান্ত্রিক দল ইয়াব্লোকো’য় যোগদান করেন, এবং ২০০১ সালে দলটিতে একজন আনুষ্ঠানিক সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। ২০০২ সালে তিনি ইয়াব্লোকোর মস্কো শাখার আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আইনসভা নির্বাচনের আগে তিনি ইয়াব্লোকোর নির্বাচনী প্রচারণা কার্যক্রমের মস্কো উপবিভাগের প্রধান ছিলেন, কিন্তু এই নির্বাচনে ইয়াব্লোকো রুশ আইনসভা ‘রাষ্ট্রীয় দুমা’র ৪৫০টি আসনের মধ্যে মাত্র ৪টি আসন লাভ করে। ২০০৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি ইয়াব্লোকোর মস্কো শাখার চিফ অফ স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, এবং একই সঙ্গে ২০০৪ সালে তিনি দলটির মস্কো শাখার উপপ্রধানও নিযুক্ত হন।
২০০৫ সালের আগস্টে নাভালনি মস্কোর কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক জেলার সামাজিক পরিষদের সদস্য হন, এবং নভেম্বরে তরুণ রাজনীতিবিদদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে সহায়তার জন্য ‘ইয়ুথ পাবলিক চেম্বার’ নামক সংগঠনটির প্রতিষ্ঠায় তিনি অংশগ্রহণ করেন। একই বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত মস্কো নগর দুমা নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু বিজয় লাভ করতে পারেননি। একই বছর তিনি ‘দা – গণতান্ত্রিক বিকল্প’ নামে তরুণদের জন্য একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই প্রকল্পটি ইয়াব্লোকো বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না। একই সময়ে নাভালনি মস্কোর রাষ্ট্র–নিয়ন্ত্রিত ‘টিভি সেন্টার’ চ্যানেলে টেলিভিশন বিতর্কেরও আয়োজন করেন, কিন্তু এটি আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
২০০৬ সালে নাভালনি তিনি ইয়াব্লোকোর কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন এবং ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ২০০৬ সালে তিনি মস্কো নগর হলে বার্ষিক ‘রুশ মার্চ’ আয়োজনের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন, এবং সে বছর আয়োজিত রুশ মার্চের তিনি ছিলেন একজন উদ্যোক্তা। উল্লেখ্য, ‘রুশ মার্চ’ (রুশ: Русский марш, ‘রুস্কি মার্শ’) ছিল রাশিয়ায় আয়োজিত একটি বার্ষিক রাজনৈতিক সমাবেশ, যেটিতে রুশ উগ্র জাতীয়তাবাদী, বর্ণবাদী, অভিবাসনবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদী, ইহুদিবিদ্বেষী, মুসলিমবিদ্বেষী, ফ্যাসিবাদী ও নাৎসিবাদী রাজনৈতিক সংগঠনগুলো অংশগ্রহণ করত। পরবর্তীতে রুশ সরকার ‘রুশ মার্চ’–এর আয়োজনকে নিষিদ্ধ করে।
২০০৭ সালের ২৩ জুন নাভালনি ‘জনতা’ নামক একটি নতুন রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহণ করেন। এই দলটি নিজেদেরকে ‘গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী’ হিসেবে আখ্যা দেয়, এবং গণতন্ত্রের জন্য লড়াই ও জাতিগত রুশদের অধিকার রক্ষাকে নিজেদের মূল লক্ষ্য হিসেবে বর্ণনা করে। নাভালনির দল ইয়াব্লোকো ছিল যে কোনো ধরনের জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবাদ, ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের বিরোধী, ফলে রুশ মার্চ ও ‘জনতা’ দলের সঙ্গে নাভালনির সংশ্লিষ্টতা ছিল ইয়াব্লোকোর দলীয় আদর্শের পরিপন্থী। এমতাবস্থায় ২০০৭ সালের জুলাইয়ে তিনি ইয়াব্লোকোর মস্কো শাখার উপপ্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তদুপরি, ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে একটি দলীয় অধিবেশনে নাভালনি ইয়াব্লোকোর সভাপতি গ্রিগরি ইয়াভলিনস্কির পদত্যাগের দাবি জানান। এরপর নাভালনিকে ‘জাতীয়তাবাদী কার্যক্রম ও দলের ক্ষতি সাধনে’র দায়ে ইয়াব্লোকো থেকে বহিষ্কার করা হয়।
২০০৮ সালের জুনে নাভালনির ‘জনতা’ দল অন্য দুইটি রুশ জাতীয়তাবাদী দল ‘অবৈধ অভিবাসনবিরোধী আন্দোলন’ এবং ‘বৃহৎ রাশিয়া’ দলের সঙ্গে মিলে ‘রুশ জাতীয় আন্দোলন’ নামক একটি জোট গঠন করে। উল্লেখ্য, ‘অবৈধ অভিবাসনবিরোধী আন্দোলন’ একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী, অভিবাসনবিরোধী, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী ও মুসলিমবিদ্বেষী দল, এবং ‘বৃহৎ রাশিয়া’ একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী দল। নাভালনির লক্ষ্য ছিল উদারপন্থী ও বামপন্থীদের সঙ্গে মিলে ‘সুষ্ঠু নির্বাচনে’র জন্য আন্দোলন করা, এবং এই নির্বাচনে অবশ্যই তার জোট বিজয়ী হবে বলে তিনি মনে করতেন।
২০০৮ সালের আগস্টে বিচ্ছিন্নতাবাদী দক্ষিণ ওসেতিয়ার ওপর জর্জিয়া আক্রমণ শুরু করে এবং দক্ষিণ ওসেতিয়ায় মোতায়েনকৃত কিছু রুশ শান্তিরক্ষী নিহত হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় রুশ–জর্জীয় যুদ্ধ শুরু হয়, এবং রুশ সৈন্যরা পশ্চিমা–সমর্থিত জর্জিয়াকে পরাজিত করে। এসময় নাভালনি জর্জিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রতি তার দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেন। তিনি জর্জীয়দেরকে ‘ইঁদুর’ হিসেবে অভিহিত করেন, এবং মত প্রকাশ করেন যে, রাশিয়ার উচিত জর্জিয়ার ওপর ক্রুজ ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ করা ও রাশিয়া থেকে জর্জীয়দেরকে বহিষ্কার করা। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে নাভালনিকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জর্জীয়দেরকে ‘ইঁদুর’ হিসেবে অভিহিত করার বিষয়ে দুঃখপ্রকাশ করেন, কিন্তু এই বিষয়ে তিনি এখনো আগের মতোই মনোভাব পোষণ করেন বলে জানান।
একই সময়ে নাভালনি রুশ সরকারের অভ্যন্তরে দুর্নীতি নিয়ে নিজস্ব ধাঁচে তদন্ত করতে শুরু করেন। ২০০৮ সালে নাভালনি ৫টি রুশ রাষ্ট্রায়ত্ত তেল ও গ্যাস কোম্পানিতে ৩ লক্ষ রুবল বিনিয়োগ করেন এবং এর মধ্য দিয়ে কোম্পানিগুলোর শেয়ারহোল্ডারে পরিণত হন। এই কোম্পানিগুলো হচ্ছে – রসনেফৎ, গাজপ্রম, গাজপ্রম নেফৎ, লুকওয়েল এবং সুরগুৎনেফতেগাজ। আইন অনুযায়ী, কোম্পানিগুলো তাদের আর্থিক কার্যক্রম স্বচ্ছ রাখতে বাধ্য, কিন্তু এই কোম্পানিগুলোর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এই কোম্পানিগুলোতে শেয়ার ক্রয়ের পেছনে নাভালনির মূল উদ্দেশ্য ছিল এই দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করা।
২০১০ সালের নভেম্বরে নাভালনি রুশ রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ‘ত্রান্সনেফৎ’–এর অডিটিং সংক্রান্ত গোপন নথিপত্র প্রকাশ করেন, এবং তাঁর ব্লগে দাবি করেন যে, ‘পূর্ব সাইবেরিয়া–প্রশান্ত মহাসাগর তেল পাইপলাইন’ নির্মাণের সময় কোম্পানিটির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রায় ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার চুরি করেছে। রুশ সরকার এই অভিযোগ তদন্ত করে, এবং পরবর্তীতে ‘ত্রান্সনেফৎ’ কোম্পানি দাবি করে যে, এই অভিযোগটি মিথ্যা।
২০১০ সালের ডিসেম্বরে নাভালনি ‘রোসপিল’ নামক একটি প্রকল্প সৃষ্টি করেন, এবং এটির উদ্দেশ্য ছিল সরকারি কার্যক্রমে বিদ্যমান দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ড ফাঁস করা। রুশ আইন অনুযায়ী, রুশ সরকার যেসব টেন্ডারের জন্য আবেদন করে, সেগুলোর বিবরণ অনলাইনে প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক। নাভালনির ‘রোসপিল’ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে সংঘটির দুর্নীতিকে ফাঁস করা। ২০১১ সালের মে মাসে নাভালনি ‘রোসইয়ামা’ (‘রুশ গর্ত’) নামক আরেকটি প্রকল্প চালু করেন, এবং এর উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারণের যেকোনো অভিযোগের প্রতি সরকারি প্রতিক্রিয়ার রেকর্ড রাখা।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নাভালনি একটি সাক্ষাৎকারে রাশিয়ার ক্ষমতাসীন দল ‘সংযুক্ত রাশিয়া’কে ‘ঠগ ও চোরের দল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তখন থেকে রুশ বিরোধী দলগুলোর মধ্যে এই শব্দগুচ্ছটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, এবং ‘সংযুক্ত রাশিয়া’ দল সম্পর্কে এই শব্দগুচ্ছটি তারা নিয়মিতভাবে ব্যবহার করে থাকে।
২০১১ সালের আগস্টে নাভালনি রুশ ও হাঙ্গেরীয় সরকারদ্বয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি রিয়েল এস্টেট চুক্তি সংক্রান্ত তথ্য ফাঁস করেন। তাঁর ফাঁসকৃত নথিপত্র অনুযায়ী, হাঙ্গেরীয় সরকার রুশ ধনকুবের ভিক্তর ভেক্সেলবের্গ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বিদেশে অবস্থিত একটি কোম্পানির কাছে ২ কোটি ১০ লক্ষ মার্কিন ডলার মূল্যে মস্কোয় অবস্থিত একটি প্রাক্তন দূতাবাস ভবন বিক্রি করে, এবং এরপর কোম্পানিটি ১১ কোটি ৬০ লক্ষ মার্কিন ডলার মূল্যে সেই ভবনটি রুশ সরকারের কাছে বিক্রি করে। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাঙ্গেরিতে এই চুক্তি সম্পাদনের সঙ্গে জড়িত ৩ জন সরকারি কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়, কিন্তু রুশ সরকার এই দুর্নীতির বিষয়ে কোনো তদন্ত করেছে কিনা, সেটি স্পষ্ট নয়।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে নাভালনি ‘দুর্নীতিবিরোধী ফান্ড’ (রুশ: Фонд борьбы с коррупцией, ‘ফোন্দ বোর্বি কোররুপৎসিয়েই’) নামক একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এটির উদ্দেশ্য ছিল রুশ সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ফাঁস করা। এটি ইউটিউবে রুশ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র প্রকাশ করত, এবং ব্যক্তিগত অনুদানের মাধ্যমে এই সংস্থাটি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করত।
২০১১ সালে নাভালনি নিজেকে একজন ‘জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রী’ হিসেবে বর্ণনা করেন। রুশ নৃগোষ্ঠীগত জাতীয়তাবাদের (ethnic Russian nationalism) প্রতি তিনি মৌন সমর্থন ব্যক্ত করেন। তিনি ‘ককেশাসকে খাওয়ানো বন্ধ করো’ নামক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনটির প্রতিও সমর্থন জানিয়েছেন। এই আন্দোলনটির উদ্দেশ্য হচ্ছে – উত্তর ককেশাসের মুসলিম–অধ্যুষিত ও তুলনামূলকভাবে দরিদ্র প্রজাতন্ত্রগুলোকে রুশ কেন্দ্রীয় সরকার যে বার্ষিক ভর্তুকি প্রদান করে, সেটিকে বন্ধ করা। একই বছরে ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা ‘বিবিসি’কে প্রদত্ত একটি সাক্ষাৎকারে তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদী ‘রুশ মার্চে’ তার অংশগ্রহণকে সমর্থন করেন। একই বছর প্রকাশিত একটি ভিডিওতে তিনি উত্তর ককেশাসের মানুষদেরকে ‘কালো চামড়াবিশিষ্ট’ ও ‘আরশোলা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
অবশ্য এতকিছুর পরেও নাভালনির ‘রুশ জাতীয় আন্দোলন’ জোটটি রাজনৈতিকভাবে বিশেষ সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হয়, এবং ২০১১ সালে নাভালনি নিজেই স্বীকার করেন যে, তাঁর ‘জনতা’ দল নিজেদেরকে একটি কার্যকরী সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত রুশ আইনসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল ‘সংযুক্ত রাশিয়া’ বিজয়ী হয়, কিন্তু বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনয়ন করে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য মস্কোয় প্রায় ৬,০০০ মানুষ জড়ো হয়, এবং এদের মধ্যে নাভালনি ছিলেন একজন। সমাবেশটি থেকে নাভালনিসহ প্রায় ৩০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, এবং নাভালনিকে ১৫ দিনের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। লাতভিয়াভিত্তিক রুশ বেতারকেন্দ্র ‘মস্কোর প্রতিধ্বনি’র প্রধান সম্পাদক আলেক্সেই ভেনেদিক্তভের মতে, নাভালনিকে কারারুদ্ধ করা ছিল রুশ সরকারের জন্য একটি রাজনৈতিক ভুল, কারণ এটি তাকে একজন অনলাইন নেতা থেকে একজন অফলাইন নেতায় রূপান্তরিত করে।
২০ ডিসেম্বর মুক্তি লাভের পর নাভালনি রুশ জনসাধারণকে তদানীন্তন রুশ প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আহ্বান জানান। ২৪ ডিসেম্বর তার নেতৃত্বে প্রায় ৫০,০০০ মানুষ মস্কোয় একটি বিক্ষোভে অংশ নেয়, এবং নাভালনি বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন, ‘এই মুহূর্তে আমি ক্রেমলিন দখল করে নেয়ার মতো পর্যাপ্ত সংখ্যক লোককে দেখতে পাচ্ছি!’
২০১২ সালের প্রথমদিকে নাভালনি একটি ইউক্রেনীয় টেলিভিশন চ্যানেলে সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। এই সাক্ষাৎকারে তিনি মত প্রকাশ করেন যে, রুশ পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ইউক্রেন ও বেলারুশের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে যাওয়া, এবং রুশ, ইউক্রেনীয় ও বেলারুশীয়রা প্রকৃতপক্ষে একই জাতি। অবশ্য এই বক্তব্যের সম্ভাব্য নেতিবাচক রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার কথা বিবেচনা করে একই সাক্ষাৎকারে তিনি উল্লেখ করেন, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ করতে কেউ আগ্রহী নয়।
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নাভালনির ‘দুর্নীতিবিরোধী ফান্ড’ রাশিয়ার চেচেন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি রমজান কাদিরভকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করে, এবং চেচেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি গাড়িবহর ক্রয়ের ক্ষেত্রে বেআইনি পন্থা অবলম্বন করেছে উল্লেখ করে। নাভালনি চেচেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রুসলান আলখানভ, উপ–স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রোমান এদিলভ এবং চেচেন নিলাম কমিশনের উপপ্রধান আলবের্ত গাইসুলতানভকে সরাসরি এই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করেন। চেচেন সরকার এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে এবং কাদিরভ নাভালনিকে ‘রাশিয়ার শত্রুদের প্রতিনিধি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
২০১২ সালের মার্চে ভ্লাদিমির পুতিন তৃতীয় বারের মতো রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন, এবং এরপর নাভালনি মস্কোর পুশকিনস্কায়া স্কয়্যারে একটি সরকারবিরোধী বিক্ষোভ আয়োজন করতে সহযোগিতা করেন। ১৪,০০০ থেকে ২০,০০০ মানুষ এই বিক্ষোভে যোগদান করে। বিক্ষোভের পর পুলিশ নাভালনিকে গ্রেপ্তার করে, কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। ৮ মে পুতিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন, এবং এইদিনও নাভালনি একটি সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন। এসময় তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৫ দিনের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
২০১২ সালের মে মাসে নাভালনি রুশ উপপ্রধানমন্ত্রী ইগর শুভালভকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করেন। তিনি দাবি করেন যে, রুশ ধনকুবের রোমান আব্রামোভিচ ও আলিশের উসমানভ শুভালভের কোম্পানিকে লক্ষ লক্ষ ডলার ‘উৎকোচ’ হিসেবে প্রদান করেছে, এবং তিনি এই অর্থ সরবরাহ সংক্রান্ত নথিপত্রের স্ক্যানকৃত কপি তার ব্লগে প্রকাশ করেন। উসমানভ ও শুভালভ উভয়েই অর্থ লেনদেনের বিষয়টি স্বীকার করেছেন, কিন্তু তাঁদের মতে, এই অর্থ লেনদেন ‘উৎকোচ’ ছিল না, এবং এটি রুশ আইনকে কোনোভাবে লঙ্ঘন করেনি।
২০১২ সালের জুনে নাভালনির সহকর্মীরা ‘জনমৈত্রী’ নামক একটি ‘মধ্যপন্থী’ দল গঠন করে। নাভালনি দলটির প্রতি তার সমর্থন ব্যক্ত করেন, কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে দলটিতে যোগ দেননি। একই বছরের জুলাইয়ে তিনি তার ব্লগে কিছু নথিপত্র প্রকাশ করেন এবং এর মধ্য দিয়ে দাবি করেন যে, রুশ তদন্ত কমিটির প্রধান জেনারেল অফ জাস্টিস আলেক্সান্দর বাস্ত্রিখিনের চেক প্রজাতন্ত্রে একটি ব্যবসা রয়েছে, যেটি তিনি গোপন রেখেছেন।
২০১২ সালের ৩০ জুলাই রুশ তদন্ত কমিটি নাভালনির বিরুদ্ধে দুর্নীতি অভিযোগ আনয়ন করে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে কিরভ প্রদেশের গভর্নর নিকিতা বেলিখের সহকারী হিসেবে কাজ করার সময় নাভালনি রাষ্ট্রায়ত্ত কাঠ কোম্পানি ‘কিরভলেস’ থেকে প্রায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ (বা ১৬ মিলিয়ন) রুবল তছরুপ করেছেন। এসময় নাভালনি মস্কোর বাইরে না যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। ২০১৩ সালের এপ্রিলে কিরভ প্রদেশের রাজধানী কিরভ শহরের একটি আদালতে নাভালনির বিচার আরম্ভ হয়। ১৮ জুলাই আদালতটি নাভালনিকে দুর্নীতির দায়ে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে। কিন্তু একই দিনে রুশ প্রসিকিউটর জেনারেলের কার্যালয় রায়টি আপিল করে, এবং জানায় যে, উচ্চ আদালতের রায় ছাড়া শাস্তিটি কার্যকর হবে না। ফলে ১৯ জুলাই নাভালনি মুক্তি লাভ করেন।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে নাভালনির নামে আরেকটি দুর্নীতির মামলা দায়ের করা হয়, এবং একটি ফরাসি কোম্পানি ও সংশ্লিষ্ট রুশ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতারণা ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে তিনি ও তাঁর ভাই ওলেগ নাভালনি অভিযুক্ত হন। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে নাভালনিকে গৃহবন্দি করা হয়, অবশ্য একই বছরের আগস্টে এটি শিথিল করা হয়।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জনমৈত্রী’ দলটিতে যোগদান করেন, এবং নভেম্বরে দলটির নেতা নির্বাচিত হন। রুশ আইন অনুযায়ী, একই নামের দুইটি রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব থাকা অবৈধ, এবং এজন্য দলটির নিবন্ধন করা সম্ভব হচ্ছিল না। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দলটি নাম পরিবর্তন করে এবং ‘প্রগতি দল’ নাম ধারণ করে। এরপর দলটি নিবন্ধন করতে সক্ষম হয়।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে মস্কোয় মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, এবং নাভালনি ছিলেন এই নির্বাচনের প্রার্থীদের মধ্যে একজন। আরপিআর–পানরাস নামক একটি উদার গণতন্ত্রী দল নাভালনিকে সমর্থন করে, এবং নির্বাচনের জন্য নাভালনির দল প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মেয়র সের্গেই সোবিয়ানিন ৫১.৩৭% ভোট লাভ করে বিজয়ী হন, এবং নাভালনি ২৭.২৪% ভোট লাভ করে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। নাভালনি এই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন এবং এটিকে ‘জাল’ বলে অভিহিত করেন, কিন্তু অধিকাংশ পর্যবেক্ষক নির্বাচন স্বচ্ছ ছিল বলে মত প্রকাশ করেন। নাভালনি মস্কো নগর আদালত ও রুশ সুপ্রিম কোর্টে নির্বাচনের ফলাফল বিষয়ে অভিযোগ করেন, কিন্তু উভয় আদালতই নির্বাচনের ফলাফলকে বৈধ হিসেবে রায় প্রদান করে।
২০১৩ সালের অক্টোবরে মস্কোর বিরিউলিয়োভো জেলায় একজন আজারবাইজানি অভিবাসীর হাতে একজন রুশ নাগরিক খুন হয়, এবং এই প্রেক্ষাপটে সেখানে জাতিগত রুশরা আজারবাইজানি ও অন্যান্য ককেশীয় অভিবাসীদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা শুরু করে। নাভালনি তার ব্লগে এই দাঙ্গাকারীদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং ‘বৈধ ও অবৈধ অবিবাসী হোর্ডে’র বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য তাদের প্রশংসা করেন। তিনি আরো মন্তব্য করেন যে, অভিবাসীরা মস্কোয় অপরাধের হার বৃদ্ধির জন্য দায়ী।
২০১৪ সালে ইউক্রেনে রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। প্রাথমিকভাবে নাভালনি এর বিরোধিতা করেন, এবং রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিন ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য পশ্চিমা বিশ্বকে আহ্বান জানান। কিন্তু পরবর্তীতে এই বিষয়ে নাভালনির মতের পরিবর্তন ঘটে। ২০১৪ সালের অক্টোবরে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি মন্তব্য করেন যে, রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া দখল অবৈধ ছিল, কিন্তু এখন বাস্তবতা হচ্ছে ক্রিমিয়া রাশিয়ার অংশে পরিণত হয়েছে। তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর করবেন কিনা, এই প্রশ্নের উত্তরে নাভালনি মন্তব্য করেন, ‘ক্রিমিয়া কি কোনো ধরনের সসেজ যেটা বারবার হাতবদল করা হবে? আমার সেটা মনে হয় না।’ তার মতে, ক্রিমিয়া আর কখনো ইউক্রেনের অংশ হবে না।
একই সাক্ষাৎকারে তিনি পুনরায় তার মত ব্যক্ত করেন যে, রুশ ও ইউক্রেনীয়রা কার্যত ‘একই জাতি’। তিনি এটিও উল্লেখ করেন যে, তিনি জানেন তাঁর এই মতামত ইউক্রেনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু এটিই বাস্তবতা। অবশ্য তার মতে, রুশ সরকারের উচিত পূর্ব ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধে রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন প্রদান থেকে বিরত থাকা। তিনি মত প্রকাশ করেন যে, রাশিয়ার জন্য ইউক্রেনের তুলনায় অভিবাসনের ইস্যুটি ১০০ গুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে মধ্য এশীয় রাষ্ট্রগুলো থেকে আগত অভিবাসীরা ভিসা ছাড়াই রাশিয়ায় প্রবেশ করার সুযোগ লাভ করে। নাভালনি এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং মন্তব্য করেন যে, রাশিয়ার উচিত এই সুযোগ বন্ধ করে দেয়া।
২০১৪ সালের নভেম্বরে নাভালনির ‘প্রগতি দল’ অন্যান্য উদারপন্থী দলগুলোর সঙ্গে একটি জোট গঠনের জন্য আলোচনা শুরু করে। একই বছরের ডিসেম্বরে নাভালনি ও তার ভাই ওলেগ প্রত্যেকেই মানি লন্ডারিংয়ের দায়ে সাড়ে ৩ বছরের কারাদন্ডে দণ্ডিত হন, কিন্তু নাভালনির শাস্তি স্থগিত রাখা হয়। ২০১৫ সালের প্রথমদিকে নাভালনির ‘প্রগতি দল’ অন্য ৪টি দলের সঙ্গে মিলে একটি জোট গঠন করে। কিন্তু একই বছরে রাশিয়ার কস্ত্রোমা প্রদেশে অনুষ্ঠিত একটি নির্বাচনে জোটটি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়, এবং জোট গঠনের মাধ্যমে নাভালনির ক্ষমতা অর্জনের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে মস্কোয় রাশিয়ার বৃহত্তম মসজিদ ‘মস্কো ক্যাথেড্রাল মসজিদ’ উদ্বোধন করা হয়। নাভালনি এর বিরোধিতা করেন এবং মন্তব্য করেন যে, যেখানে ব্রিটেনে মসজিদ নির্মাণের অনুমতি প্রদান স্থগিত রাখা হচ্ছে এবং সুইজারল্যান্ডে মিনার নির্মাণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে, সেখানে রাশিয়ার এরকম ‘মুসলিম তোষণ’ নীতি দুঃখজনক। একই বছরের সেপ্টেম্বরে রাশিয়া সিরীয় গৃহযুদ্ধে সিরীয় সরকারের পক্ষে সামরিক হস্তক্ষেপ করে। নাভালনি এটিরও বিরোধিতা করেন এবং মন্তব্য করেন যে, রাশিয়ার উচিত সিরিয়ার মতো ‘দূরবর্তী রাষ্ট্র’কে সহায়তা করার পরিবর্তে সেই অর্থ রাশিয়ার অভ্যন্তরে ব্যয় করা।
২০১৫ সালের অক্টোবরে ২০১৩ সালে আনীত মানি লন্ডারিংয়ের মামলার প্রেক্ষাপটে আদালত নাভালনিকে ৪৪ লক্ষ (বা ৪.৪ মিলিয়ন) রুবল জরিমানা প্রদানের নির্দেশ দেয়। নাভালনি ২৯ লক্ষ রুবল জরিমানা প্রদান করেন, কিন্তু জরিমানার বাকি অর্থ প্রদান করেননি। তিনি তার বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগগুলোকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, এবং রুশ সরকার তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনেছে বলে অভিযোগ করেছেন।
২০১৬ সালের নভেম্বরে রুশ সুপ্রিম কোর্ট কিরভলেস দুর্নীতি মামলায় কিরভ জেলা আদালত নাভালনিকে যে শাস্তি প্রদান করেছিল সেটিকে বাতিল করে দেয়, এবং মামলাটি পুনরায় তদন্ত করে দেখার জন্য আদালতটিকে নির্দেশ দেয়। একই বছরের ডিসেম্বরে নাভালনি ঘোষণা করেন যে, তিনি ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিতব্য রুশ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। ২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কিরভ জেলা আদালত কিরভলেস দুর্নীতি মামলায় নাভালনিকে প্রদত্ত শাস্তি (৫ বছরের কারাদণ্ড) বহাল রাখে, কিন্তু শাস্তিটি স্থগিত রাখা হয়। এই মামলাটি নাভালনির রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
২০১৭ সালের মার্চে নাভালনি ‘সে তোমাদের জন্য দিমন নয়’ নামক একটি তদন্তমূলক প্রামাণ্যচিত্র প্রকাশ করেন, এবং এতে তিনি অভিযোগ করেন যে, রুশ প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ ১২০ কোটি (বা ১.২ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার পরিমাণ অর্থ সরকারি কোষাগার থেকে হস্তগত করেছেন। রুশ সরকার একে প্রাথমিকভাবে পুরোপুরি উপেক্ষা করে। এরপর ২৬ মার্চ নাভালনি রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে দুর্নীতিবিরোধী বিক্ষোভের আয়োজন করেন। কিছু কিছু শহরে বিক্ষোভের অনুমতি দেয়া হয়েছিল, কিন্তু মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গসহ অন্যান্য শহরে বিক্ষোভের অনুমতি দেয়া হয় নি। ফলে মস্কোয় নাভালনিসহ ৫০০ বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৭ মার্চ অবৈধ বিক্ষোভ আয়োজনের কারণে নাভালনিকে ২০,০০০ রুবল জরিমানা করা হয়, এবং গ্রেপ্তারের সময় পুলিশকে বাধা প্রদানের জন্য ১৫ দিনের কারাদন্ড প্রদান করা হয়।
২০১৭ সালের ২৭ এপ্রিল একদল ব্যক্তি নাভালনির মুখে অ্যান্টিসেপ্টিক রং ছিটিয়ে দেয়, এবং এই আক্রমণের জন্য নাভালনি রুশ সরকারকে দায়ী করেন। একই বছরের জুনে অবৈধভাবে বিক্ষোভ আয়োজনের অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়, এবং ৩০ দিনের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। একই বছরে নাভালনির চিফ অফ স্টাফ লিওনিদ ভলকভ জানান যে, নাভালনির দল রাশিয়া সমকামী বিয়ের বৈধতা প্রদানের পক্ষে। এর মধ্য দিয়ে নাভালনির দল রুশ সরকারের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করে, কারণ রুশ সরকার সাধারণভাবে সমকামিতার বিরোধিতা করে এসেছে এবং ২০২০ সালে রুশ সংবিধানে আনুষ্ঠানিকভাবে সমকামী বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে হয়েছে।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে রুশ কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন নাভালনির পূর্ববর্তী অপরাধমূলক কর্মকান্ডের জন্য তাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করে। নাভালনি ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে রুশ সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়ে আপিল করেন, কিন্তু তার আপিল খারিজ করে দেয়া হয়। এরপর নাভালনি রুশ জনসাধারণকে নির্বাচন বয়কট করার আহ্বান জানান এবং ২৮ জানুয়ারি বিক্ষোভের আয়োজন করেন। বিক্ষোভকালে নাভালনিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে, কিন্তু সেই দিনই তাকে মুক্তি প্রদান করা হয়।
অবশ্য রুশ জনসাধারণ নাভালনির নির্বাচন বর্জনের ডাকে খুব বেশি সাড়া দিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না। ২০১৮ সালের মার্চে যথারীতি রুশ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, এবং ৬৭.৫৪% ভোটার এই নির্বাচনে ভোট প্রদান করে। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন বিজয়ী হন। পুতিনের শপথ গ্রহণের দুই দিন আগে ৫ মে নাভালনি পুতিনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের আয়োজন করে। বিক্ষোভ চলাকালে নাভালনিসহ ১,৬০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, এবং ১৫ মে অবৈধ বিক্ষোভ আয়োজনের জন্য নাভালনিকে ৩০ দিনের কারাদন্ড প্রদান করা হয়। ১৯ মে নাভালনির ‘প্রগতি দল’ তাদের নাম পরিবর্তন করে, এবং দলটির নতুন নামকরণ করা হয় ‘ভবিষ্যতের রাশিয়া’।
২০১৮ সালের আগস্টে নাভালনি অভিযোগ করেন যে, রুশ ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান জেনারেল ভিক্তর জলোতভ তাঁর বাহিনীর জন্য সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২ কোটি ৯০ লক্ষ (বা ২৯ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার চুরি করেছেন। ক্ষিপ্ত জলোতভ এই অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং নাভালনিকে তার সঙ্গে একটি ডুয়েল লড়ার জন্য আহ্বান জানান। একই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর আরেকটি অবৈধ বিক্ষোভ আয়োজনের দায়ে তাকে ২০ দিনের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
২০১৮ সালে ইউক্রেনীর সরকারের উদ্যোগে ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স ধর্মীয় নেতারা রুশ অর্থোডক্স চার্চ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্নতা ঘোষণা করেন এবং স্বতন্ত্র ‘ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স চার্চ’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এর মধ্য দিয়ে তিন শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ইউক্রেনীয়দের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জীবনের ওপর চলে আসা রুশ নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটে। এর প্রতিক্রিয়ায় নাভালনি টুইট করেন যে, ‘যেটা সৃষ্টি করতে কয়েক শতাব্দী লেগেছিল, পুতিন এবং তার গর্দভরা চার বছরে সেটি ধ্বংস করেছে… পুতিন রুশ বিশ্বের শত্রু!’
২০১৯ সালের মস্কো নগর দুমা নির্বাচনে নাভালনি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থন করেন, কিন্তু এদের মধ্যে অনেককেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয় নি। এর ফলে মস্কোয় তীব্র বিক্ষোভ দেখা দেয়। নাভালনি এই বিক্ষোভের একজন অন্যতম সংগঠক ছিলেন, ফলে জুলাইয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১০ দিনের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। এর পরপরই তাকে পুনরায় ৩০ দিনের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সংযুক্ত রাশিয়া দল বিজয় অর্জন করে।
২০২০ সালের জুনে নাভালনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্ণবাদের বিরুদ্ধে চলমান ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। এটি ছিল নাভালনির নিজস্ব কার্যকলাপের পরিপন্থী, কারণ নিজের দেশ রাশিয়ায় তিনি বরাবরই ককেশীয় ও মধ্য এশীয়দের প্রতি বর্ণবাদকে সমর্থন করে এসেছেন।
২০২০ সালের ২৫ জুন থেকে ১ জুলাই রুশ সংবিধান পরিবর্তনের জন্য রাশিয়ায় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এই পরিবর্তনগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল: পুতিনকে ২০২৪ সালের পর আরো দুইবার নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান করা, রাশিয়াকে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে (welfare state) পরিণত করা, সমকামী বিয়ে নিষিদ্ধ করা এবং আন্তর্জাতিক আইনের ওপর রুশ আইনের প্রাধান্য ঘোষণা করা। নাভালনি এটিকে একটি ‘অভ্যুত্থান’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং গণভোট বয়কট করার জন্য রুশ জনসাধারণকে আহ্বান জানান। কিন্তু তার এই আহ্বান বিশেষ প্রভাব ফেলেনি। ৬৭.৮৮% রুশ ভোটার এই গণভোটে ভোট প্রদান করে, এবং তাদের মধ্যে ৭৮.৫৬% সংবিধান পরিবর্তনের পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু গণভোটের ফল প্রকাশের পর নাভালনি এই ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং একে ‘মিথ্যা’ হিসেবে আখ্যা দেন।
২০২০ সালের জুলাইয়ে রাশিয়ার খাবারভস্ক সীমান্ত প্রদেশের গভর্নর সের্গেই ফুরগালকে খুনের দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়। ফুরগাল উগ্র রুশ জাতীয়তাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী দল ‘এলডিপিআর’–এর সদস্য, এবং তার সমর্থকরা তার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু করে। ক্রমশ সাইবেরিয়া ও দূরপ্রাচ্যের অন্যান্য শহরে এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। নাভালনি এই বিক্ষোভের প্রতি তার সমর্থন ঘোষণা করেন, এবং মন্তব্য করেন যে, ‘পুতিন ব্যক্তিগতভাবে – এবং পুতিনের পুতুলরা যারা দূরপ্রাচ্য চালায় – খাবারভস্ক অঞ্চল ও এর অধিবাসীদের ঘৃণা করে, কারণ তারা বারবার সেখানে নির্বাচনে পরাজিত হয়।’
২০২০ সালের ২০ আগস্ট বিমানযোগে রাশিয়ার তমস্ক থেকে মস্কো যাওয়ার পথে নাভালনি গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন, এবং বিমানটি জরুরি ভিত্তিতে ওমস্কে অবতরণ করে। তাকে ওমস্কের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং তিনি কোমায় আছেন বলে জানানো হয়। ২৪ আগস্ট তাঁকে সেখান থেকে জার্মানির বার্লিনে প্রেরণ করা হয় এবং সেখানকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২ সেপ্টেম্বর জার্মান সরকার দাবি করে যে, নাভালনিকে ‘নোভিচক’ নামক একটি রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে খুন করার চেষ্টা করা হয়েছে। অবশ্য ৭ সেপ্টেম্বর নাভালনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
জার্মানি ও অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্র অভিযোগ করে যে, নাভালনির বিষপ্রয়োগের সঙ্গে রুশ সরকার জড়িত। রুশ সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করে, এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর কাছে প্রমাণ দাবি করে, কিন্তু জার্মানি (ও পরবর্তীতে ফ্রান্স) রাশিয়ার নিকট এই বিষয়ে তাদের প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণ হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। নাভালনি ব্যক্তিগতভাবে এই বিষপ্রয়োগের জন্য পুতিন এবং রুশ অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা ‘এফএসবি’কে দায়ী করেছেন, অন্যদিকে, পুতিন এই অভিযোগ অস্বীকারপূর্বক মন্তব্য করেছেন যে, রুশ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাউকে সরিয়ে দিতে চাইলে তারা সেই কাজটি সম্পন্ন করতে সক্ষম।
২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি নাভালনি রাশিয়ায় প্রত্যাবর্তন করেন, এবং মস্কোয় অবতরণের পরপরই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০১৪ সালে নাভালনিকে মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় সাড়ে ৩ বছরের কারাদন্ড প্রদান করা হয়, কিন্তু শাস্তিটি স্থগিত রাখা হয়েছিল এবং নাভালনি জামিনে ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে বিদেশে গমন করে তিনি আইন ভঙ্গ করেছেন, এই অভিযোগে তাকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কারাদন্ড প্রদান করা হয়।
এর প্রত্যুত্তরে নাভালনি তার ইউটিউব চ্যানেলে ‘পুতিনের প্রাসাদ’ নামক একটি তদন্তমূলক প্রামাণ্যচিত্র প্রকাশ করেন। এই প্রামাণ্যচিত্রে অভিযোগ করা হয় যে, ক্রাসনোদার প্রদেশের গেলেন্দঝিক শহরে অবস্থিত একটি প্রাসাদ পুতিনের মালিকানাধীন, এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ১৩৫ কোটি (বা ১.৩৫ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ তছরুপ করে পুতিন এই প্রাসাদটি ক্রয় করেছেন। এক সপ্তাহের মধ্যেই কয়েক কোটি মানুষ এই ভিডিওটি দেখে, কিন্তু রুশ বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘লেভাদা কেন্দ্র’ কর্তৃক পরিচালিত একটি জরিপ অনুযায়ী, রুশ জনসাধারণের মাত্র ১৭% এই প্রামাণ্যচিত্রটিতে দাবিকৃত তথ্য বিশ্বাস করে। পরবর্তীতে রুশ ধনকুবের আর্কাদি রোতেনবের্গ জানিয়েছেন যে, ‘প্রাসাদ’টি প্রকৃতপক্ষে তার।
২৩ জানুয়ারি নাভালনিকে গ্রেপ্তারের পরিপ্রেক্ষিতে তার সমর্থকরা রাশিয়া জুড়ে বিক্ষোভ করে। ৩১ জানুয়ারি এবং ২ ফেব্রুয়ারি এই পুনরায় বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে ২ ফেব্রুয়ারি আদালত নাভালনিকে মানি লন্ডারিং মামলায় পূর্বে প্রদত্ত সাড়ে তিন বছরের কারাদণ্ড কার্যকর করার জন্য রায় দেয়। কিন্তু ইতোমধ্যেই নাভালনি এই মামলার জন্য বছরখানেক গৃহবন্দি অবস্থায় কাটিয়েছেন, সুতরাং তাকে আড়াই বছর কারাদন্ড ভোগ করতে হবে।
ব্যক্তিগত জীবনে নাভালনি বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক। তার স্ত্রী ইউলিয়া নাভালনায়া তার রাজনৈতিক সহকর্মী, এবং সম্প্রতি নাভালনিকে কারাদন্ড প্রদানের পর তিনি জার্মানিতে চলে গেছেন। নাভালনির ২০ বছর বয়সী মেয়ে দারিয়া নাভালনায়া বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছে, এবং ১৩ বছর বয়সী ছেলে জাখার নাভালনি বর্তমানে মায়ের সঙ্গে জার্মানিতে অবস্থান করছে।
নাভালনির রাজনৈতিক জীবন অত্যন্ত বিচিত্র। নিজেকে তিনি বর্ণনা করেছেন ‘জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রী’ হিসেবে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি রুশ জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছিলেন, কিন্তু বর্তমানে তিনি রুশ উদারপন্থীদের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছেন এবং তার ‘ভবিষ্যতের রাশিয়া’ দলটির ইশতেহার পশ্চিমাপন্থী, ইউরোপমুখী ও উদারপন্থী। তাদের ইশতেহার অনুযায়ী, দলটি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন ঘটাবে এবং ইরান, সিরিয়া ও ভেনেজুয়েলার মতো ‘উচ্ছৃঙ্খল’ রাষ্ট্রগুলোকে সহায়তা প্রদান বন্ধ করবে।
কিন্তু নাভালনি কি প্রকৃতপক্ষেই একজন উদারপন্থীতে পরিণত হয়েছেন? একজন উগ্র জাতীয়তাবাদী ও বর্ণবাদীর পক্ষে কি উদার গণতন্ত্রীতে রূপান্তরিত হওয়া সম্ভব? পশ্চিমা বিশ্লেষকদের অনেকেরই ধারণা, নাভালনির রাজনৈতিক বিশ্বাসে পরিবর্তন এসেছে, এবং এখন নাভালনি মূলত একজন পশ্চিমাপন্থী গণতন্ত্রী।
কিন্তু নাভালনির দলের ইশতেহারে যেসব প্রকল্পের উল্লেখ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান প্রকল্প হচ্ছে মধ্য এশিয়ার নাগরিকদের ভিসা ব্যতীত রাশিয়ায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করা। নাভালনি যে তীব্র বর্ণবাদী, অভিবাসনবিরোধী ও মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য অতীতে প্রদান করেছেন, সেগুলোর সঙ্গে পশ্চিমাদের ‘উদার গণতন্ত্রে’র সাদৃশ্য নেই, বরং হাঙ্গেরির ‘ফিদেসজ’ বা জার্মানির ‘এএফডি’র মতো উগ্র ডানপন্থী দলগুলোর রাজনৈতিক প্রকল্পের সঙ্গে সেগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ। তদুপরি, নাভালনি পুতিনের বিরোধী, কিন্তু জর্জিয়া ও মলদোভায় রুশ–সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী রাষ্ট্রগুলোকে এবং রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া দখলকে তিনি সুস্পষ্টভাবে সমর্থন করেছেন। নাভালনি দনবাস ও সিরিয়ায় রুশ হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছেন, কিন্তু এই বিরোধিতা কোনো নৈতিক বা আদর্শিক বিবেচনা থেকে উদ্ভূত হয়নি, বরং এর মূল কারণ অর্থনৈতিক।
পশ্চিমা বিশ্ব বরাবরই রুশ জাতীয়তাবাদকে ভীতির চোখে দেখে এসেছে, কারণ রুশ জাতীয়তাবাদীরা প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের হারানো সকল ভূমি পুনরুদ্ধারে বিশ্বাসী এবং তারা কট্টরভাবে পশ্চিমাবিরোধী। কিন্তু স্পষ্টভাবে জাতীয়তাবাদী ও বর্ণবাদী মনোভাব প্রকাশ করা নাভালনিকে পশ্চিমা বিশ্ব বরাবরই সমর্থন দিয়ে এসেছে। নাভালনিকে প্রতিবার গ্রেপ্তারের পর তারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে, এবং সম্প্রতি নাভালনির বিষপ্রয়োগের ঘটনাকে কেন্দ্র করেও তারা রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্র নাভালনিকে নৈতিক ও প্রচারণামূলক সমর্থন যোগাচ্ছে, এবং নাভালনিকে তারা আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে বলেও অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। প্রশ্ন হলো, পশ্চিমা বিশ্ব কেন পুতিনের মতো একজন বাস্তববাদী ও ইউরেশিয়ানিস্টের পরিবর্তে নাভালনির মতো জাতীয়তাবাদীকে রাশিয়ার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে ইচ্ছুক?
এই প্রশ্নটির উত্তর খুবই জটিল হতে পারে। সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা যেটি, সেটি হচ্ছে, পশ্চিমা বিশ্ব প্রকৃতপক্ষে নাভালনিকে রাশিয়ার ক্ষমতায় দেখতে আগ্রহী নয়। তারা নাভালনিকে সমর্থন দিচ্ছে, যাতে নাভালনি রাশিয়ার অভ্যন্তরে গোলযোগ সৃষ্টি করে রুশ সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে পারে, এবং এর ফলে রুশ সরকার যেন পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার পরিবর্তে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে বাধ্য হয়। রাশিয়া যদি ১৯৯০–এর দশকের মতো রাজনৈতিক অরাজকতায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী একচ্ছত্র পশ্চিমা আধিপত্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা সহজতর হবে।
রুশ সরকার নাভালনিকে পশ্চিমাপন্থী হিসেবে বিবেচনা করে, এবং রুশ রাষ্ট্রপতির মুখপাত্র দিমিত্রি পেশকভ খোলাখুলিভাবে নাভালনিকে ‘সিআইএ এজেন্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। নাভালনি এক বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন, তার মেয়েও যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়ন করে, এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো তাকে প্রথম থেকেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, কোনো রকম আনুষ্ঠানিক পেশার সঙ্গে জড়িত না থাকা সত্ত্বেও নাভালনির আপাতদৃষ্টিতে অর্থের কোনো অভাব নেই। তার এই অর্থের উৎস কী? তাহলে কি নাভালনি সত্যিই একজন সিআইএ এজেন্ট? সঠিক প্রমাণ ছাড়া এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা কঠিন।
আবার কিছু কিছু বিশ্লেষক সম্পূর্ণ উল্টো একটি তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। মার্কিন ম্যাগাজিন ‘দ্য ন্যাশনাল ইন্টারেস্টে’ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, নাভালনি প্রকৃতপক্ষে রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিনেরই একজন চর, এবং তাকে ব্যবহার করে একটি ‘কৃত্রিম বিরোধী দল’ সৃষ্টি করে পুতিন রাশিয়ার প্রকৃত বিরোধী দলগুলোকে পঙ্গু করে রাখছেন। নাভালনিকে দুবার কারাদন্ড প্রদানের পরও সেগুলো স্থগিত রাখা, নাভালনির ‘অজ্ঞাত’ উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থ, রুশ রাষ্ট্রায়ত্ত চ্যানেলে নাভালনির অনুষ্ঠান সম্প্রচার এবং এরকম বিভিন্ন কারণকে তারা এই তত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু এই তত্ত্বটির পক্ষেও পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই।
নাভালনির প্রকৃত উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, বর্তমানে তিনি রাশিয়ার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। নাভালনির সমর্থকদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, কিন্তু এদের একটি বড় অংশ তরুণ, এবং এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রুশ বিশ্লেষক লিওনিদ রাগোজিনের মতে, নাভালনি কার্যত রাশিয়ার সকল বিরোধী দলীয় নেতাকে অপসারিত করেছেন, এবং নাভালনির কর্তৃত্ববাদী কার্যক্রম তাকে ভবিষ্যতে ‘দ্বিতীয় পুতিন’–এ রূপান্তরিত করে ফেলতে পারে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, নাভালনিকে গ্রেপ্তারের প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি রাশিয়ায় যে বিক্ষোভ হয়েছে, তাতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, কিন্তু এদের মধ্যে কমিউনিস্ট দলীয় নেতা থেকে শুরু করে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা যেমন রয়েছে, তেমনি সমকামী অধিকারকর্মী থেকে চেচেন জাতিভুক্ত মানুষও রয়েছে। অর্থাৎ, রুশ রাজনীতিতে নাভালনি এক বিচিত্র পরিস্থিতির অবতারণা করেছেন। শেষ পর্যন্ত রুশ রাজনীতির এই বর্ণচোরা উল্কার পরিণতি কেমন হয়, সেটিই এখন দেখার বিষয়।