Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার: মিশরের নতুন দেবতা (পর্ব ৩)

দ্বিতীয় পর্ব: দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার: এশিয়ায় পদার্পণ

ইসাসের বিজয়ের পর দারিউসের পিছনে না ছুটে আলেকজান্ডার ভূমধ্যসাগরের পূর্বপাশে নজর ফেরালেন। যদিও আলেকজান্ডার শত্রুর শেষ না দেখা পর্যন্ত ছাড়েন না, কিন্তু আলেকজান্ডার দারিউসকে সুযোগ দিলেন অন্য কারণে। ভূমধ্যসাগরে তখন পার্সিয়ান নৌবাহিনী নিয়মিত মহড়া দিচ্ছে, আর এই বাহিনীই আলেকজান্ডারের সাথে মেসিডনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলার জন্য যথেষ্ট। সুতরাং, পেছনে শত্রু রেখে সামনে এগোনো অনুচিৎ বলেই ভূমধ্যসাগরের কোল ঘেঁষে বেড়ে ওঠা শহরগুলোর দিকে নজর দিলেন এশিয়ার নতুন অধিপতি। দামাস্কাস আর বিবলোস সহজেই আলেকজান্ডারের হাতে ধরা দিলো, পার্সিয়ানদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্রোহ করার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। বিবলোস আর সিডন শহর অধিকার করার পর সেখান থেকে জাহাজ নিয়ে টায়ারের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি, আর সেখানেই মুখোমুখি হলেন তখন পর্যন্ত তার সবচেয়ে বড় বাধার।

মূল ভূখণ্ডের আধ মাইল দূরে থাকা এই দ্বীপ শহর অন্য সাধারণ শহরের মতো না। দ্বীপ হওয়ার ফলে এটি অবরোধ করাও সম্ভব নয়, তাছাড়া এর নিজের নৌবাহিনীও কম শক্তিশালী নয়। উত্তর আফ্রিকার কার্থেজ থেকেও তাদের খাবারের যোগান পেতে কোনো সমস্যাই হবে না। ৪০০ বছর আগে আসিরিয়ানরাও টায়ার অবরোধ করার চেষ্টা করে তেমন সুবিধা করতে পারেনি।

আলেকজান্ডার খুব সহজেই টায়ারকে এড়িয়ে যেতে পারতো, কিন্তু পার্সিয়ানরা এই নিরপেক্ষ শহরকে কেন্দ্র করেই নিজেদের নৌ ঘাঁটি তৈরি করতে পারে ভেবে আলেকজান্ডার আর সেই ঝুঁকি নিলেন না। সুতরাং টায়ার অবরোধ করার সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত করে ফেলা হলো। আলেকজান্ডারের বাহিনী আর টায়ারের মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আধা মাইল সাগর। এদিকে টায়ারের নৌবাহিনীর মুখোমুখি হওয়াও আলেকজান্ডারের পক্ষে সম্ভব নয়। টায়ারের কাছে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই টায়ারকেই কাছে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। মাটি, নুড়ি-পাথর জোগাড় করে সাগরের মধ্যে রাস্তা (মোল) বানানো শুরু করলো আলেকজান্ডারের সৈন্যরা।

টায়ার শহরের অবস্থান ও আলেকজান্ডারের মোল; Image Source: Wikimedia Commons

রাস্তার অর্ধেক রাস্তা বানাতেই টায়ারবাসী টের পেল কী ঘটতে চলেছে। সাগর গভীর হওয়া শুরু করতেই মেসিডন বাহিনীর উপর টিরিয়ান্সদের জাহাজ থেকে অঝোর ধারায় তীর আর বিশাল পাথর ছোঁড়া শুরু হলো। এদিকে এই আক্রমণ ঠেকাতে মেসিডনিয়ানরা রাস্তার দুই পাশে বিশাল দুটো কাঠের টাওয়ার বানিয়ে তার মধ্যে তীরন্দাজদেরকে রেখে টিরিয়ান জাহাজগুলোর উপর পাল্টা তীর নিক্ষেপ শুরু করলো। একইসাথে দুই টাওয়ারের মাঝখানে থাকা রাস্তা বানাতে থাকা সৈন্যদের গায়ে যেন তীর-পাথর না লাগে সেজন্য দুই টাওয়ারের উপর থেকে মাঝখানে ধাতুর জালি ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। সবকিছু ঠিকভাবেই চলছিলো, কিন্তু হঠাৎ একদিন অতর্কিত হামলা করে দুটি টাওয়ার পুড়িয়ে দিয়ে আবার নিরাপদ আস্তানায় ফিরে গেল টিরিয়ানরা।

আলেকজান্ডারের সিজ টাওয়ার; Image Source: The Siege on Tyre

আলেকজান্ডারের আগে অনেকেই টায়ারকেই অবরোধ করার চেষ্টা চালিয়েছেন, কিন্তু টায়ারকে বাগে আনতে পারেনি কেউই। অন্য কেউ হলে অনেক আগেই হাল ছেড়ে দিত, কিন্তু আলেকজান্ডার দমবার পাত্র নন। সৈন্যদেরকে আবার টাওয়ার বানিয়ে আগের মতো কাজ করার নির্দেশ দিয়ে উত্তরের আগেই অধিকৃত হওয়া সিডন থেকে নিজের জাহাজসহ আরো বেশ কিছু জাহাজ তৈরি করে মোট ২০০ জাহাজ নিয়ে ফেরত আসলেন নিজের বাহিনীর কাছে। টায়ারবাসী নিজেদের শহরকে রক্ষা করতে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছিল শহরকে। বাইরের বন্দর অধিকার করতে পারলেও ভেতরের সুরক্ষিত বন্দরে কোনোভাবেই ঢুকতে পারছিল না আলেকজান্ডারের জাহাজগুলো। এদিকে টিরিয়ান্সরাও এবার সাধারণ পাথর বা তীরের বদলে সেগুলোতে আগে আগুন ধরিয়ে ছুঁড়ে দিচ্ছিলো। ফলে মেসিডন বাহিনীর বানানো রাস্তা কিংবা জাহাজ, কোনো পদ্ধতিই কাজ করছিলো না। এদিকে আগুনে তীর আর পাথরের আক্রমণে আগুনে পুড়েই মেসিডনিয়ানরা নাস্তানাবুদ হচ্ছিলো। নয় মাস অবরোধের পর আলেকজান্ডার এবার পুরোদমে আক্রমণ চালানর সিদ্ধান্ত নিলেন। একদিকে রাস্তা বানিয়ে স্থলভাগের সৈন্যদের আক্রমণ, অন্যদিকে বাইরে থেকে জাহাজের পুনঃপুনঃ আক্রমণের কঠিন জবাব দিলেও শেষমেষ হাল ছাড়তে বাধ্য হলো টায়ারবাসী। আলেকজান্ডারের সামনে তার সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জও পদানত হলো।

টায়ার অবরোধ; Artist: André Castaigne

এদিকে টায়ারবাসীর এই ধৃষ্টতা ক্ষমা করলেন না আলেকজান্ডার। ২ হাজার টায়ারবাসীকে তখনই ক্রুশবিদ্ধ করে মেরে ফেলা হলো, বাকি ৩০ হাজার মানুষকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হলো। পুরো শহরকে ঢেলে সাজানো হলো মেসিডনিয়ান পদ্ধতিতে। অদম্য ফিনিশীয় শহর হিসেবে টায়ারের যে মর্যাদা ছিল, তা আলেকজান্ডারের সামনে মুহূর্তেই খসে পড়লো। টায়ারের ভৌগলিক পরিবর্তনও ঘটেছিল। এর আগে কয়েক হাজার বছর ধরে টায়ার একটা দ্বীপ হিসেবেই পরিচিত ছিল। কিন্তু আলেকজান্ডারের রাস্তা বানানোর পর টায়ার পরিণত হলো উপদ্বীপে (Peninsula)। ২,৩০০ বছর পর টায়ার এখনো পর্যন্ত সেই উপদ্বীপই রয়ে গিয়েছে। লেবাননের কোনা ঘেঁষে সমুদ্রের ভিতরে ঢুকে পড়া সেই রাস্তা এখন আরো শক্ত হয়ে স্থায়ীরূপ ধারণ করেছে।

তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। আলেকজান্ডারকে কি টায়ারের এই হত্যাযজ্ঞ কিংবা দাস বানানোর কারণে নৃশংস শাসক হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করা হবে? যদি পূর্বের আসিরিয়ান কিংবা পরের রোমানদের সাথে তুলনা করা হয়, তবে আলেকজান্ডারকে স্বাভাবিক হিসেবেই মনে হবে। অন্যদিকে আলেকজান্ডারের এই হত্যাযজ্ঞ চালানোর পেছনে আরো একটি কারণকে দায়ী করা হয়। আর সেটি হচ্ছে টায়ার সহজে আপোষ মেনে নেয়নি যা তার ধৈর্যকে শেষ সীমানায় নিয়ে গিয়েছে, যেমনটি করেছিল থিবসবাসীরা, এবং তাদেরকেও একই পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল। তবে আলেকজান্ডার একটি কাজ কখনোই করেনি, যা অন্যরা করেছিল, পরাজিতদের শিকলে বেঁধে দীর্ঘপথ রাস্তায় হাঁটানো। 

টায়ারের পতনের পর আলেকজান্ডার দক্ষিণ অভিমুখে যাত্রা শুরু করলেন। দুই মাস ধরে গাজা অবরোধ করে সেটিও দখল করার পর সিনাই মরুভূমি পেরিয়ে মিশরের দিকে যাওয়া শুরু করলেন আলেকজান্ডার। মিশরে থাকা পার্সিয়ান দুর্গের দায়িত্বে থাকা পার্সিয়ান জেনারেল আলেকজান্ডারকে দেখে তৎক্ষণাৎ বশ্যতা স্বীকার করে নিলেন। টায়ারবাসীদের সাথে কী হয়েছে তা খুব ভালো করেই শুনেছেন তিনি, আর তাই কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চাননি তিনি। রাজধানী মেমফিসে ঢুকে দুই বছর পর অবশেষে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পেল মেসিডন বাহিনী।  

মিশরের বিশালত্ব দেখে আলেকজান্ডারের দুরন্ত সৈন্যরাও অবাক না হয়ে পারলো না। খাল-বিল, বিশাল পাথরের চাঁই দিয়ে বানানো বড় বড় স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা রাজপ্রাসাদ, সবই ছিল মেসিডন, গ্রিস আর এশিয়া মাইনরের তুলনায় বিশাল। আলেকজান্ডার মিশর করায়ত্ত্ব করারও দুই হাজার বছরের আগে তৈরি সুউচ্চ পিরামিডের দেখেও বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়লো তারা, সাথে বিশাল স্ফিংক্স তো রয়েছেই।

মিশরের বিশালত্ব দেখে অবাক না হয়ে পারলো না মেসিডোনিয়ানরা; Image Source: BBC

১৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পার্সিয়ানদের অধীনে থাকা মিশরীয় অভিজাতরা আলেকজান্ডারকে গ্রহণ করে নিলো স্বাধীনতা দানকারী হিসেবে। আলেকজান্ডার নতুন ফারাও হিসেবে মিশর অধিগ্রহণ করলেন। মিশরে ফারাওদেরকে অর্ধ-স্বর্গীয় হিসেবে মনে করা হতো। ছোটবেলার মা অলিম্পিয়াসের সেই শিক্ষা আলেকজান্ডারের ধারণাকে আরো বদ্ধমূল করে দিল। আলেকজান্ডার নিজেকে আসলেই স্বর্গীয় বলে মনে করা শুরু করলেন।

মেমফিসে কিছুদিন থাকার পর আলেকজান্ডার তার বাহিনী নিয়ে নীলনদের আশপাশ আবিষ্কার করার জন্য যাত্রা শুরু করলেন। তিনি খেয়াল করেছিলেন যে, নীলনদ দিয়ে মিশরের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ খুব ভালোভাবে হলেও ভূমধ্যসাগর আর মধ্যপ্রাচ্য থেকে মিশর অনেকটাই আলাদা। তাই নতুন একটা শহর পত্তনের জায়গা খুঁজছিলেন তিনি, আর সেটা পেয়েও গেলেন নীল ডেল্টার পশ্চিম প্রান্তরে। আর এই শহরই হয়ে দাঁড়ালো প্রাচীন যুগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে। আলেকজান্ডার নিজের নামে শহরের নামকরণ করলেন আলেকজান্দ্রিয়া আর এটি তৈরির দায়িত্ব দিয়ে গেলেন মিশরীয়দের হাতেই, যার ফলে মিশরীয়দের কাছে আলেকজান্ডারের জনপ্রিয়তা রাতারাতি বেড়ে গেল। আলেকজান্ডারের পর তার সেনাপতি টলেমি আর উত্তরপুরুষরা প্রায় ৩০০ বছর ধরে আলেকজান্দ্রিয়ায় বসে মিশর শাসন করেছেন, খ্রিস্টপূর্ব ৩১ অব্দে রোমানদের হাতে ক্লিওপেট্রার পতনের পর।

আলেকজান্দ্রিয়া নির্মাণের আদেশ দিচ্ছেন আলেকজান্ডার; Placido Costanzi

নতুন রাজধানীর সীমানা নির্ধারণের পর আলেকজান্ডার তার বাহিনী চললেন মিশরের দক্ষিণ প্রান্তে থাকা সিওয়াহ-এর দিকে, যেখানে রয়েছে দেবতা আমুন-এর মন্দির। নীলনদ থেকে ২০০ মাইল দক্ষিণে থাকা এই মরূদ্যানের মাঝখানে থাকা বিশাল মরুভূমি আলেকজান্ডার আর তার বাহিনীর সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ালো। সৈন্যরা যেতে না চাইলেও আলেকজান্ডারের মায়ের সেই বাণী আলেকজান্ডারকে ঠেলে নিয়ে গেল সিওয়াহ-এর দিকে। তীর-বল্লমের চেয়েও বেশি যন্ত্রণাদায়ক মরুভূমির তীব্র তাপমাত্রা টের পেল মেসিডন বাহিনী। তবুও একরকম বাধ্য হয়েই যেতে হলো তাদেরকে। সিওয়াহয়ে পৌঁছানোর পর ২-৩ দিন একাধারে পানি পান করে আর বিশ্রাম নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছিল তারা। আলেকজান্ডার এই ফাঁকে আমুনের মন্দিরে ঢুকে পড়লেন।

আলেকজান্ডারের সাথে মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা হলো। তারপর আলেকজান্ডার মন্দির থেকে বের হয়ে আসলেন। আলেকজান্ডার সরাসরি কাউকে কিছু না বললেও আলেকজান্ডারের সৈন্যদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়োলো যে, আলেকজান্ডার ৩টি জিনিস জানতে পেরেছেন। একটি হলো আলেকজান্ডার মিশরীয়দের তৎকালীন সময়ের প্রধান দেবতা আমুন-এর সন্তান। দ্বিতীয়টি হলো, আলেকজান্ডার যে সমগ্র এশিয়ার রাজা হবেন তা তার ভাগ্যে লেখা হয়ে গেছে। আর তৃতীয়টি হলো, আলেকজান্ডারকে অবশ্যই পূর্বের শেষ প্রান্তের সাগর পর্যন্ত দখল করে সেখানে আমুনের জন্য উৎসর্গ করতে হবে।

সিওয়াহ মরূদ্যানে আমুনের মন্দির; Image Source: Egypt Tour Plus

সিওয়াহ-এর এই দিনের পর আলেকজান্ডারের চরিত্রে বেশ বড় পরিবর্তন আসলো। আলেকজান্ডার নিজেকে নিয়ে আরো বেশি গর্ববোধ করতে শুরু করলেন, অন্যদিকে পারমেনিয়নের মতো অভিজ্ঞ আর দক্ষ সেনাপতিদের পরামর্শ শোনা কমিয়ে দিলেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া শুরু করলেন নিজ থেকেই।

মেমফিসে ফিরে আসার পর আলেকজান্ডার আর তার বাহিনী বেশ বড়সড় বিশ্রাম নিয়ে আবারো নতুন অভিযানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। সিরিয়ার দামেস্কে পৌঁছানোর পর মেসিডন বাহিনী আবারো তৈরি হতে থাকলো যুদ্ধের জন্য। পরবর্তী শিকার ফেলে আসা দারিউস আর তার বিশাল পারস্য সাম্রাজ্য।

চতুর্থ পর্ব: দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার: প্রাচ্যের প্রাচুর্য

Related Articles