[তৃতীয় পর্ব পড়ুন]
১৯২৮ সালে স্ট্যালিন সোভিয়েত অর্থনীতিকে গতিশীল করার জন্য লেনিনের নেওয়া ‘নিউ ইকোনমিক পলিসি’ বা নেপ (১৯২১ সালে গৃহীত) বাতিল ঘোষণা করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নকে কৃষি ও শিল্পে স্বনির্ভর করতে ১৯২৮ সালে স্ট্যালিন প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। লেনিনের নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাতিল করায় পার্টির একাংশ অসন্তুষ্ট হয়। বিরোধিতাকারীদের মধ্যে নিকোলাই বুখারিন ছিলেন সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা। তিনি ছিলেন নিউ ইকোনমিক পলিসির একজন কট্টর সমর্থক। লেনিনের মৃত্যুর পর যখন নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল, তখন নিউ ইকোনমিক পলিসির জন্যই বুখারিন স্ট্যালিনকে সমর্থন করেছিলেন। স্ট্যালিন ‘নিউ ইকোনমিক পলিসি’ বাতিল করলে বুখারিনসহ আরো অনেক নেতা তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ করেন।
বুখারিন কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং প্রাভদা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। নিজের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করায় ১৯২৯ সালের এপ্রিলে উক্ত পদদ্বয় থেকে বুখারিনকে বহিষ্কার করেন স্ট্যালিন। উপরন্তু, ১৯২৯ সালের ১৭ নভেম্বর বুখারিনকে পলিটব্যুরো থেকেও বহিষ্কার করা হয়। কমিউনিস্ট পার্টিতে বুখারিনের উপদলও বেশ শক্তিশালী ছিল এবং ট্রটস্কির সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলাকালে তিনি স্ট্যালিনকে সমর্থন করেছিলেন। তা সত্ত্বেও স্ট্যালিন বুখারিনকে বহিষ্কার করেন। বুখারিনকে বহিষ্কারের মাধ্যমে নিজের সর্বশেষ প্রভাবশালী প্রতিদ্বন্দ্বীকেও সরিয়ে দেন তিনি।
এত বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েও স্ট্যালিন তার সিদ্ধান্তে অবিচল থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত নিউ ইকোনমিক পলিসি বাতিল করে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হাতে নেন। এছাড়া তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের কৃষি ব্যবস্থাকে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এ সময় তার নির্দেশে সোভিয়েত ইউনিয়নে এক বিশাল নির্মাণযজ্ঞ শুরু হয়। তিনি কৃষিতে যান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রচলন করেন, ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
স্ট্যালিন সোভিয়েত কৃষি ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করেন। তিনি যৌথ কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তার নির্দেশে সকল জমি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়। পৃথক চাষাবাদের পরিবর্তে, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন বৃহৎ যৌথ খামার ব্যবস্থা স্থাপন করেন। যৌথ খামারে সকল কৃষক একত্রে জমি চাষ করতে শুরু করে। যৌথ কৃষি ব্যবস্থা অনেকটা জোরপূর্বক করা হয়। অধিকাংশ কৃষকই এই ব্যবস্থায় আসতে চায়নি, কিন্তু সরকারের অত্যাচার ও নির্বাসিত হওয়ার ভয়ে তারা যৌথ খামারে যোগ দিতে বাধ্য হয়। ১৯৩২ সালের মধ্যে ৬২ শতাংশ কৃষক যৌথ খামার ব্যবস্থায় যুক্ত হয় এবং ১৯৩৬ সাল নাগাদ তা ৯০ শতাংশে উন্নীত হয়।
স্ট্যালিন কুলাক বা ধনী কৃষকদের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার পেছনে বৃহত্তম অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেন। রাশিয়ায় অন্তত ৮ একর জমির মালিকানা থাকা কৃষককে বলা হতো কুলাক। তার মতে, ধনী কৃষকরা অবৈধভাবে খাদ্য মজুত করে দুর্ভিক্ষ তৈরির পাঁয়তারা করছিল। তিনি ভাবলেন, কৃষির উৎপাদন বাড়াতে হলে কৃষিকে ধনী কৃষকদের প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে। তিনি দরিদ্র কৃষকদের সমাজতন্ত্রের প্রাণ এবং ধনী কৃষক বা কুলাকদের সমাজতন্ত্রের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করেন।
স্ট্যালিন এবার কুলাকদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। তিনি ধনী কৃষকদের জমিচ্যুত করতে থাকেন। ১৯৩০ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েক বছরে প্রায় দশ লক্ষ কুলাক পরিবারকে (প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ) নির্বাসিত করা হয়। যারা ধনী কৃষকদের সাহায্যকারী হবে, তাদেরও গুলিবিদ্ধ করা হবে, অথবা নির্বাসনে পাঠানো হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন স্ট্যালিন। তার নির্দেশে ধনী কৃষক ও তাদের সাহায্যকারী অনেককে গুলি করে হত্যা করা হয়, অনেককে কাজাখস্তান ও সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করা হয় এবং একটি অংশকে গুলাগে (শ্রমিক শিবির) পাঠানো হয়।
গুলাগের শ্রমিকদের অধিকাংশই ছিল রাজনৈতিক বন্দি। সেখানকার শ্রমিকদের সাথে দাসদের মতো ব্যবহার করা হতো। গুলাগে শ্রমিকদের দৈনিক চৌদ্দ ঘণ্টার অধিক কাজ করতে বাধ্য করা হতো, কিন্তু তাদেরকে প্রয়োজনের তুলনায় খুব সামান্য পরিমাণ খাদ্য দেওয়া হতো। উপরন্তু, এই শ্রমক্যাম্পগুলোতে ভালো কোনো চিকিৎসাব্যবস্থাও ছিল না। ফলশ্রুতিতে, এসব ক্যাম্পে কাজ করতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ বন্দি নিহত হয়েছে।
প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য ছিল ভারী শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ১৯৩২ সালে নির্ধারিত সময়ের এক বছর আগেই শেষ করা হয়। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ সম্পদের জোগান দিতে নতুন নতুন খননকার্য শুরু হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পেট্রোলিয়াম, লোহা, ইস্পাতসহ অন্যান্য অনেক ধরনের খনিজ সম্পদ উত্তোলন শুরু হয়। খনিজ সম্পদ উত্তোলনের ফলে শিল্পদ্রব্য উৎপাদনে বেশ গতি আসে।
স্ট্যালিনের নির্দেশে পুরো সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে নতুন নতুন শিল্পকারখানা, বাঁধ, রাস্তাঘাট, রেলপথ নির্মিত হয়। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্যে সোভিয়েত কারখানাগুলো ইস্পাত, যন্ত্রপাতি এবং ট্রাক্টরের মতো মৌলিক শিল্প পণ্য তৈরি করে। তার নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্রুতগতিতে শিল্পায়নের দিকে এগিয়ে যায়। সেই সঙ্গে, অনেকগুলো নতুন শহর তৈরি করা হয় এবং গ্রাম থেকে বহু মানুষ শহরে আসতে থাকে।
এ সময় শ্বেত সাগর ও বাল্টিক সাগরকে সংযুক্ত করার জন্য ‘শ্বেত সাগর-বাল্টিক খাল’ তৈরি করা হয়। স্ট্যালিনের নির্দেশে শ্বেত সাগর-বাল্টিক খাল এবং মস্কো মেট্রোসহ অনেক বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়। এই প্রকল্পগুলোর অধিকাংশই জোরপূর্বক শ্রমের মাধ্যমে নির্মিত হয়েছিল। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো লক্ষ লক্ষ বন্দিকে দিয়ে জোরপূর্বক এই কাজগুলো করানো হয়।
শ্বেত সাগর-বাল্টিক খাল নির্মাণ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও স্ট্যালিনের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয় হলেও, এখানে কাজ করা শ্রমিকদের চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। ১৯৩১-৩৩ সালের মধ্যে, মাত্র দুই বছরে ২২৭ কিলোমিটার খাল নির্মাণের সময়, বিভিন্ন কারণে প্রায় ২৫,০০০ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থারও ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এ সময় সাইবেরিয়ার মতো দুর্গম অঞ্চলেও রেললাইন তৈরি করা হয়। সেগুলোও বন্দিদের মাধ্যমে করানো হতো। ১৯৩১ সালে এক বক্তব্যে স্ট্যালিন বলেন, “আমরা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় পঞ্চাশ থেকে একশো বছর পিছিয়ে আছি, দশ বছরের মধ্যে আমাদের এই ব্যবধান দূর করতে হবে।”
স্ট্যালিনের নেতৃত্বে মাত্র ১০-১৫ বছরের মধ্যে, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। মাত্র এক যুগের মধ্যে দেশটি একটি আধুনিক শিল্প খাত তৈরি করে এবং নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষি থেকে শিল্প অর্থনীতিতে পরিণত হয়।
১৯৩২ সালে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় এবং দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনেকাংশে সফল হয়। এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন কৃষি ও শিল্পে অনেকটা স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। যদিও দেশের কৃষিতে ভুল নীতির ফলে কয়েকটি অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তবুও সফলতা হিসেবে সমগ্র দেশজুড়ে বহু ক্ষুদ্র ও বৃহৎ শিল্প গড়ে ওঠে।
এ সময় স্ট্যালিনের পারিবারিক জীবনে এক ধাক্কা লাগে। ১৯৩২ সালে স্ট্যালিনের দ্বিতীয় স্ত্রী নাদেজদা আত্মহত্যা করেন। তবে পারিবারিক জীবনে খুব বেশি উৎসাহী ছিলেন না তিনি। প্রথম স্ত্রী সানিদজে ছিল তার সত্যিকারের ভালোবাসা। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, সানিদজেকে অকালে হারানোর পর স্ট্যালিনের ব্যক্তিগত জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। পরবর্তী জীবনে স্ট্যালিন অনেক নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ালেও, কাউকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসেননি। এমনকি, প্রথম স্ত্রীকে হারানোর পর পরিবারের প্রতি অনেকাংশেই উদাসীন হয়ে পড়েন তিনি।
প্রথম সন্তান ইয়াকভের সঙ্গেও তার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল না। স্ট্যালিনের সঙ্গে বিবাদের জেরে ইয়াকভ একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে। দ্বিতীয় স্ত্রী নাদেজদার সঙ্গেও স্ট্যালিনের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল না। তাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। অনেক নারীর সঙ্গে স্ট্যালিনের মেলামেশা নাদেজদা সহ্য করতে পারতেন না। এর জের ধরেই নাদেজদা আত্মহত্যা করেন। নাদেজদা যখন আত্মহত্যা করেন, তখন তিনি দুই সন্তান রেখে যান। প্রথম সন্তান ভ্যাসিলির বয়স তখন প্রায় বারো বছর এবং দ্বিতীয় সন্তান স্বেতলানার বয়স প্রায় সাত বছর। তাদের একজন পালিত সন্তানও ছিল। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, স্ট্যালিনের আরো কয়েকজন অবৈধ সন্তান ছিল।
পারিবারিক জীবনে স্ট্যালিন যেমন সুখী ছিলেন না, তেমনি খুব বেশি আগ্রহীও ছিলেন না। স্ট্যালিনের সমগ্র চিন্তা-ভাবনা, উৎসাহ-উদ্দীপনা আবর্তিত হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরেই। ফলে, নাদেজদার মৃত্যু তার জীবনে বড় কোনো প্রভাব ফেলেনি। তিনি যথারীতি পার্টি ও দেশের কাজে লেগে থাকেন।
স্ট্যালিন শুধুমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয় শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, সমাজ, দর্শন ও শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন করেন। স্ট্যালিনের নির্দেশে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়, ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি ঘটে। সেই সঙ্গে, বিজ্ঞানের উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে সাংস্কৃতিক বিপ্লব সূচনা করেন।
স্ট্যালিন সংস্কৃতিচর্চার জন্য চলচ্চিত্রের ব্যাপক প্রসার ঘটান। তিনি চলচ্চিত্রকে শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম মনে করতেন। তার মতে, চলচ্চিত্র গণ-আন্দোলন বিকাশের সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত মাধ্যম। নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগেও সোভিয়েত ইউনিয়নে অনেকগুলো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। স্ট্যালিনের আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রথম সবাক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এ সময় বিভিন্ন শিক্ষামূলক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। তার নির্দেশে অক্টোবর বিপ্লব, গৃহযুদ্ধ ও লেনিনকে নিয়ে অনেকগুলো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। তিনি নিজেও চলচ্চিত্র দেখতে বেশ পছন্দ করতেন। এছাড়া তিনি নাটকের উন্নয়নেও ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। এসব আলোকিত দিকের পাশাপাশি স্ট্যালিন যুগে অন্ধকার দিক বেশ ভয়ঙ্কর ছিল।
স্ট্যালিনের আমলে কমিউনিস্টদের ধর্মবিরোধিতা ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পায়। অনেক ধর্মীয় স্থাপনা ভেঙে দেওয়া হয়। ১৯৩১ সালে মস্কোর এক বিখ্যাত ক্যাথেড্রাল ভেঙে ফেলে কমিউনিস্টরা।
১৯৩২-৩৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতিতে এক বিরাট ধাক্কা লাগে। এ সময় বেশ কয়েকটি অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে আনুমানিক পঞ্চাশ থেকে সত্তর লক্ষ মানুষ মারা যায়। ইউক্রেন, উত্তর ককেশাস, ও কাজাখস্তানে দুর্ভিক্ষ খুবই মারাত্মক রূপ ধারণ করে। মানুষের মধ্যে সামান্য একটু খাদ্যের জন্য হাহাকার লেগে যায়। দুর্ভিক্ষ সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নেয় ইউক্রেনে।
এই দুর্ভিক্ষের জন্য স্ট্যালিনের ভুল নীতিকে দায়ী করা হয়। গ্রামে যৌথ খামারে উৎপন্ন খাদ্য শস্যের অধিকাংশই শহরের শ্রমিকদের জন্য নিয়ে যাওয়া হতো এবং একটি অংশ বিদেশে রপ্তানি করা হতো। কৃষিদ্রব্যের রপ্তানি হওয়া অর্থ দিয়েই সোভিয়েত ইউনিয়ন বিদেশ থেকে শিল্প সামগ্রী নিয়ে আসে। ফলে সোভিয়েত সরকার খাদ্যের মজুদ বাড়াতে ব্যর্থ হয়।
একই সময়ে প্রাকৃতিক ও আবহাওয়ার কারণে খাদ্য শস্যের উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যায়। ফলশ্রুতিতে, বেশ কয়েকটি অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দুর্ভিক্ষ কবলিত এলাকায় সোভিয়েত সরকার প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী দিতেও ব্যর্থ হয়। সময়মতো পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ দিতে পারলে এত মানুষকে মরতে হতো না। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, ইউক্রেনের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবের ফলে ইচ্ছে করেই সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য পাঠানো হয়নি। যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত ১৯৩৩ সালের শেষের দিকে উৎপাদন আবারো বৃদ্ধি পায়, ফলে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্ত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন।
১৯৩৩ সালে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন স্ট্যালিন। এই পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। কিছুদিন আগে দুর্ভিক্ষ দেখা দেওয়ায় জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের দিকে গুরুত্বারোপ করা হয়। তাই এটি আবাসন সম্প্রসারণ এবং ভোগ্যপণ্যের উৎপাদনের উপর জোর দেয়। তবে দ্রুত পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য এই পরিকল্পনা বারবার সংশোধন করা হয়। পরবর্তী কয়েক বছরের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তনের ফলে স্ট্যালিন বুঝতে পারেন একটি বড় যুদ্ধ আসন্ন। এই আশঙ্কায় তিনি পরবর্তীতে অস্ত্র উৎপাদনের উপর জোর দেন।
স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্রমেই উন্নয়নের দিকে যেতে থাকে। সেই সঙ্গে তার নির্দেশে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক বা কমিন্টার্নের কার্যক্রমও বৃদ্ধি পায়। ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাপী স্ট্যালিন ও কমিউনিজমের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। রুশ বিপ্লবের পর থেকেই ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ ধনতান্ত্রিক পশ্চিমা দেশগুলো কমিউনিজম এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধিতা করে আসছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং কমিউনিজমের এমন উত্থানে পশ্চিমা দেশগুলো বিচলিত হয়ে পড়ে।