একটু ভাবুন, প্রাচীন গ্রীসের দার্শনিকেরা যেখানে ধর্ম, বিজ্ঞান আর দর্শন চর্চায় ব্যস্ত; সেখানে রুটি ও জলপাই খেয়ে বেঁচে থাকা এক দার্শনিক নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছেন কীভাবে ‘মানসিকভাবে সুখ-শান্তিতে থাকা যায়’ তার উপায় বের করতে। একটু পাগলাটে দার্শনিকই বটে!
৩৪১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণ করা এই মহামনিষী ছিলেন এপিকিউরাস। যিনি ছিলেন তার সমসাময়িক সব দার্শনিক থেকে একটু বেশিই আলাদা। বিতর্ক কোনোদিনই তার পিছু ছাড়েনি। তা সত্ত্বেও কোনো বাধা না মানা এই দার্শনিক আজীবন দিক খুঁজে বেড়িয়েছেন সুখকে সংজ্ঞায়িত করতে। উত্তর খুঁজেছেন অনেক প্রশ্নের- মানসিক শান্তি কী, কীভাবে সত্যই সুখী হওয়া যায়, কোন বিষয়গুলো আমাদের অসুখী করে তোলে, আমরা কী আসলেই সুখী? চলুন, জেনে নিই সুখ সম্পর্কিত এসব প্রশ্নের নিরন্তর উত্তর খুঁজে বেড়ানো ব্যতিক্রমী মানুষটি সম্পর্কে।
এপিকিউরাস সম্পর্কে নানা গুজব
এপিকিউরাসের আগে খুব কম দার্শনিকই পুরোদস্তুরভাবে ‘মানসিক সুখ’কে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। এমনকি এর জন্য তিনি একটি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন যাতে করে নিবিড়ভাবে মানসিক সুখে থাকার বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করা যায়। সেখানকার মানুষদের অদ্ভুত সব আচরণের জন্য গুজব রটে, এই স্কুলে হয়তো ‘অবাধ যৌনতা’র চর্চা হতো! এমনকি এই গল্পও চালু হয় যে, ভোগ-বিলাসিতায় বিশ্বাসী এপিকিউরাস শান্তি অনুধাবনের জন্য এত পরিমাণে খেতেন যে, তা হজম করতে তাকে বার দুয়েক বমি করতে হতো! অবাধ যৌনতায় তার জুড়ি মেলা ভার- এমন গল্পও চালু হয়। ব্যক্তি এপিকিউরাস সম্পর্কে এমন নানা গুজব প্রচলিত থাকলেও এগুলোর নেই কোনো সত্যিকারের ভিত্তি। প্রচণ্ড খ্যাতিমান এই দার্শনিককেই কেন্দ্র করে পরবর্তীতে ‘এপিকিউরিয়ান’ বিশেষণটির জন্ম হয়।
এপিকিউরাস প্রবর্তিত ধারণা
প্রচলিত সব গুজবের পুরো বিপরীতই ছিলেন মহান এই মনিষী। তার জীবন ছিল অত্যন্ত সহজ-সরল, কিন্তু একটু অদ্ভুতই। পরিধান করার জন্য তার ছিল মাত্র দুটি কাপড়। রুটি, জলপাই এবং মাঝে মাঝে চিজ খেয়ে জীবন পার করা এই মানুষটির আদৌ ছিল না কোনো বিলাসী জীবন। তাকে অনেকে ‘ভোগ-বিলাসিতার অনন্য উদাহরণ’ হিসেবে উপস্থাপন করলেও আজীবন তিনি শারীরিক ভোগ-বিলাসিতা থেকে অনেক দূরে ছিলেন। ‘আমরা কীভাবে মানসিকভাবে সত্যিকারের সুখী হতে পারি’ সেই সম্পর্কে অনেক বছর ধরে নিবিড়ভাবে গবেষণা করে তিনি শেষপর্যন্ত কিছু সিদ্ধান্তে আসেন। আমাদের ‘মানসিক অসুখের’ মূল কারণ হিসেবে এপিকিউরাস মূলত ‘তিনটি কারণকে’ দায়ী করেন।
আমরা রোমান্টিক ‘সম্পর্কের’ বাইরে জীবনকে ভাবতে পারি না
প্রেম, ভালোবাসা বা রোমান্স শব্দগুলো ছাড়া আমরা জীবন কল্পনা করতে পারি না। এপিকিউরাস এই প্রেম-ভালোবাসার সাথে মানসিক সুখ বা শান্তির একটি বৈরিতা দেখিয়েছেন। তার মতে, প্রণয়ঘটিত সম্পর্কগুলোতে সবসময় হিংসা, স্বার্থপরতা, ভুল বোঝার সুযোগ থাকে, যার ফলে আমরা শারীরিক সুখ পেলেও একটি সময়ে মানসিকভাবে অশান্ত হয়ে পড়ি। এপিকিউরাস বলেন, রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা খুব বেশি প্রত্যাশা করি, যা কখনোই ‘পূর্ণ’ হবার নয়। তিনি এই ‘আবেগতাড়িত’ সম্পর্কের বদলে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ সম্পর্কের কথা বলেন। বিনয়, সহযোগিতাপূর্ণ বন্ধুত্বই মানসিক শান্তি আনতে পারে এবং একটি ‘সামাজিক সহাবস্থানের জায়গা’ তৈরি করে। কিন্তু আমাদের সমস্যা হলো, অনেক বেশি প্রত্যাশা ও চাহিদার কারণে এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জায়গাটি আমরা নষ্ট করে ফেলি। নানা চাহিদার মাধ্যমে আমরা সামাজিক সম্পর্কগুলোও অনেক বেশি জটিল করে ফেলি। প্রত্যাশাগুলো রয়ে যায় অধরা; সৃষ্টি হয় অশান্তির।
আমাদের কাছে ‘অর্থই’ সবার উপরে
নানা কিছু কেনার ইচ্ছা, একটি ভালো ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটে চলা, টাকা-পয়সার পেছনে নিরন্তর দৌড়ানো; এগুলো মানসিকভাবে আমাদের প্রতিনিয়ত অসুখী করে তোলে। কর্মক্ষেত্রে হিংসা, কুৎসা রটানো, অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা- এগুলো আমাদের মনের ওপর সবসময় একটা বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। এগুলো থেকে দূরে থাকতে এপিকিউরাস একাকী বা ‘ছোট দল’ হিসেবে কাজ করার কথা বলেন। যখন হিংসার বদলে সবার মধ্যে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ আচরণ কাজ করে, তখনই কেবল মানসিক শান্তি অনুভব করা যায়। কেননা, মানসিক শান্তির ক্ষেত্রে অর্থ বা টাকাকড়িই জীবনের সব কিছু নয়; আত্মতৃপ্তিই অনেক বড় কিছু।
আমরা প্রচণ্ড রকমের ভোগ-বিলাসিতা প্রিয়
কে না চায় বিত্ত-বৈভব? একটি বিলাসবহুল বাড়ি, সজ্জিত কক্ষ, পাশে নৈসর্গিক সব দৃশ্য! আমরা চাই খুব সহজেই সবকিছু হাসিল করতে। এপিকিউরাস আমাদের এই ‘অদম্য আকাঙ্ক্ষা’কে অসুখী হওয়ার পেছনে দায়ী করেন। ভোগ-বিলাসিতা আমাদের সুখী করে বলে মনে হলেও অধিকাংশ সময়ে এগুলো থাকে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে আমাদের মনের মধ্যে তৈরি হয় ‘না পাওয়ার শূন্যতা’, যা মূলত আমাদের অসুখী করে তোলে।
এপিকিউরাস প্রবর্তিত সমাধান
এপিকিউরাস বলেন, শান্তি একটি মানসিক প্রক্রিয়া। পার্থিব বিলাসিতা আমাদের সাময়িক স্বস্তি দিলেও এটি কখনোই আমাদের মানসিক শান্তি দিতে পারে না। এই বিত্ত-বৈভব হারানোর ভয় কাজ করে সবসময়। আমরা মানসিক সুখ বা শান্তি থেকে অনেক দূরে সরে যাই।
তাহলে আমরা কীভাবে খুঁজে পেতে পারি মানসিক শান্তি? এপিকিউরাস সুখী হবার জন্য আমাদের কিছু মানসিক পরিবর্তনের কথা বলেন।
তিনি প্রথমেই বলেন ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সামাজিক সহাবস্থানের’ কথা। একই উদ্দেশ্য থেকে কিছু বন্ধু একই সাথে বসবাস করবে, যাদের মধ্যে সম্পর্ক এবং যোগাযোগ থাকবে অত্যন্ত দৃঢ়। তিনি এথেন্সের বাইরে তার বন্ধুদের নিয়ে আলাদা বসবাসের জন্য একটি জায়গা কেনেন। তাদের সবারই ছিল নিজেদের কক্ষ, যেখানে তারা পড়াশোনার জন্য পেত প্রচুর সময়। সকলে মিলেমিশে খাওয়ার জন্য ছিল আলাদা কক্ষ। তারা প্রত্যেকেই ছিল প্রচণ্ড সহানুভূতিশীল এবং তাদের মাঝে যোগাযোগও ছিল বেশ ভালো রকমের। তারা তাদের চিন্তা-ভাবনাগুলো বিনিময় করত সবসময়। শিশুদের দেখভালের জন্য ছিল আলাদা ব্যবস্থা। ‘কমিউন’ ধারণাটির একটি বাস্তব রূপ সম্পর্কে বোঝা যায় এপিকিউরাসের এই ব্যবস্থা থেকে।
সেখানে কেউ বাইরের কারো জন্য কাজ করত না। নিজেদের কাজগুলো তারা নিজেরাই করত। কেউ রান্না করত, কেউ ফসল ফলাতো, আবার কেউ আসবাবপত্র বানাত। এভাবে প্রত্যেকে কাজগুলো ভাগ করে নিয়েছিল। তাদের কারোর হয়তো অনেক টাকা পয়সা ছিল না কিন্তু সবাই অনেক বেশি সুখী জীবন যাপন করত।
সেখানে বসবাসকারী সবাই যুক্তি, বিশ্লেষণ ও উপলব্ধির দ্বারা মানসিক শান্তি খুঁজতে সচেষ্ট ছিল। এমনকি মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে তারা একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে মেডিটেশন করত। এই আত্মনিয়ন্ত্রণ ছিল পুরোপুরি ‘দর্শন’ কেন্দ্রিক। এভাবে কঠিন সাধনার মাধ্যমে তারা মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখত।
এপিকিউরাসের জনপ্রিয়তা
এপিকিউরাসের এই সাধনা ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলগুলোতে। হাজার হাজার অনুসারী সৃষ্টি হয় এই মহামনিষীর। তৈরি হয় ‘এপিকিউরান’ সমাজের, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রায় পুরো পৃথিবীজুড়ে বিস্তৃত হয়েছিল। পরবর্তীতে পঞ্চম খ্রিস্টাব্দে রক্ষণশীল চার্চের অনুশাসনে কিছুটা ভাটা পড়ে এই সমাজে। কিছুটা বিবর্তিত হয়ে এই সমাজের অনেকে যোগ দিলেন বিভিন্ন ‘মঠে’। পরবর্তীতে কার্ল মার্ক্সের মতো মানুষের থিসিসের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন এই এপিকিউরাস।
এপিকিউরাস ও আজকের দুনিয়া
আজকের এই ভোগবাদী দুনিয়ায় এপিকিউরাস এক স্মরণীয় নাম। এই জটিল, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় যেখানে একটু শান্তির খোঁজে মানুষের নাভিশ্বাস ছোটে, সেখানে এপিকিউরাসের সাধনালব্ধ জ্ঞান পুরোপুরি সফল। প্রেম, সামাজিক অবস্থান, বিলাসিতার মতো প্রলোভন থেকে আমরা আজও মুক্ত নই। আমরা কী চাই, কেন চাই এসব প্রশ্নের উত্তর আজও আমাদের অজানা। আমাদের মন কখনোই নির্লিপ্ত নয়। কিন্তু এপিকিউরাস আমাদের এই অস্থির মনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটি ‘সামাজিক পরিবর্তনের’ কথা বলেন। যা আমাদের কখনোই সুখী করতে পারবে না তার পেছনে ছুটতে ছুটতে যদি আমরা নিঃশেষ হয়ে যাই, তাহলে কী-ইবা পেলাম জীবনে! আমাদেরকে মানসিক শান্তির পথ দেখাবে এমন দর্শন চর্চাই হয়তো আনতে পারে আমাদের জীবনে নতুন এক পরিবর্তন।
ফিচার ইমেজ: theguardian.com