এরিক মারিয়া রেমার্ক একজন বিশ্ববিখ্যাত জার্মান ঔপন্যাসিক। তার সাড়া জাগানো উপন্যাস অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট পড়েনি, এমন পাঠক খুব কমই আছে। যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী জীবনে সাধারণ মানুষ ও সৈনিকের মনে চলতে থাকা টানাপোড়েন সম্ভবত রেমার্কের চেয়ে কেউ ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। যুদ্ধের সময় মানুষের বিরহগাথা ও তার পরবর্তী বিভীষিকাময় পরিস্থিতি প্রাণ পেয়েছে তার কলমের কালিতে। তার বইগুলো বেদনাবিধুর, কাব্যময় ভাষায় দেশ-বিদেশের আনাচে-কানাচে মানুষের অন্তর ছুঁয়ে গেছে। খোদ পিতৃভূমিতে অচ্ছুৎ থাকলেও তার লেখাকে বরণ করে নিয়েছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ।
জার্মানির ওসনাব্রুক শহরে ১৮৯৮ সালের ২২ জুন, এক রোমান ক্যাথলিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এরিক। পেশায় বই-বাঁধাইকারী বাবা পিটার ফ্রানয রেমার্ক, মা আনা মারিয়া। তিন সন্তানের পরিবারে একমাত্র ছেলে রেমার্ক, বড় বোন আর্না ও ছোট বোন এলফ্রিদ। ভাগ্যান্বেষণের তাগিদে গরীব ঘরে জন্ম নেয়া রেমার্ককে শৈশবে এগারোবার বাড়ি বদলাতে হয়েছে। তিনি ইউনিভার্সিটি অভ মানস্টারে যোগ দেন। শিক্ষক হবার প্রবল বাসনা ছিল মনে। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে আর তা হয়ে ওঠেনি।
রণাঙ্গনে পদার্পণ
অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সমর্থনে জার্মানি জড়িয়ে পড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। পিতৃভূমির ডাকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য হন মাত্র ১৮ বছর বয়সে। ১২ জুন, ১৯১৭ তারিখে তাকে বদলি করা হয় পশ্চিম রণাঙ্গনের সেকেন্ড কোম্পানিতে। ২৬ জুন কিশোর রেমার্ককে পাঠানো হয় ১৫তম রিজার্ভ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের সেকেন্ড কোম্পানিতে। তিনি সেখানে টরহাউট ও হাউথালস্ট শহরের ট্রেঞ্চ যুদ্ধে অংশ নেন। প্রত্যক্ষ করেন মানুষের নির্মমতা, যুদ্ধের দামামা আর আহতের আর্তনাদ।
তার কপালেও দুর্ঘটনা ঘটতে বেশিদিন লাগেনি। ১৯১৭ সালের জুলাইয়ের ৩১ তারিখে শেলের শ্র্যাপনেল ছুটে এসে আঘাত হানে তার বাম পা, ডান হাত আর ঘাড়ে। খুব দ্রুত যুদ্ধের ময়দান থেকে তাকে সরিয়ে জার্মানির এক মিলিটারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। যুদ্ধের বাকি সময়টা সেখানেই কাটিয়েছেন ভগ্নশরীর পুনরুদ্ধারের কাজে।
একজন ভগ্ন মানুষের সংগ্রাম
যুদ্ধশেষে অসুস্থ ও পঙ্গু অবস্থায় বাড়ি ফিরলেন ঠিকই, কিন্তু ফিরল না মনের শান্তি। চারদিকে ধ্বংসযজ্ঞ ছাড়া আর কিছু দেখার নেই। সেনাবাহিনী থেকেও অবসর নিয়েছেন ততদিনে। এসময়ে একটা কথা না বললেই নয়, জন্মসূত্রে নাম এরিক পল রেমার্ক হলেও ১৯১৮ সালে মায়ের মৃত্যুর পরের বছর নিজের নাম বদলে রাখেন এরিক মারিয়া রেমার্ক। মায়ের শেষকৃত্যটা দেখতে পারেননি তিনি, তখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
জুন ২৫, ১৯১৯ তারিখে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন মাঝারি গ্রেড পেয়ে। ১লা আগস্ট, ১৯১৯-এ একটা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক পদে যোগ দেন। কিন্তু থিতু হতে পারেননি সেখানে। একঘেয়ে কাজে বিরক্ত হয়েই ১৯২০ সালের নভেম্বরে চাকরিতে ইস্তফা দেন। রেমার্ক তার জীবনে নানা ধরনের পেশার সাথে সংযুক্ত ছিলেন। অভাবের সময় পেটের দায়ে কখনো ফল বিক্রেতা হয়েছেন, আবার কখনো লাইব্রেরিয়ান, তো কখনো ব্যবসায়ী কিংবা সাংবাদিক, কেরানি অথবা সম্পাদকের কাজ করেছেন।
সাফল্যের দেখা
লেখালেখিতে রেমার্কের হাতেখড়ি হয় ষোল বছর বয়সেই। তখন লিখতেন প্রবন্ধ, কবিতা। সেসময়ে একটা উপন্যাস অসমাপ্ত অবস্থায় রেখে দিয়েছিলেন। পরে শেষ করেন, যা ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয় দ্য ড্রিম রুম নামে।
১৯২৭ সালে স্পোর্ট ইম বাইল্ড পত্রিকায় চাকরিরত অবস্থায় তিনি স্টেশন অ্যাট হরাইজন লেখা শুরু করেন। তবে সেটি বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে।
যুদ্ধের অভিজ্ঞতার আলোকে রেমার্ক স্পোর্ট ইম বাইল্ডে অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট লেখা শুরু করেন। ১৯২৯ সালে এটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হলে চারদিকে হৈ-চৈ পড়ে যায়, কাঁপিয়ে দেয় প্রথমে দেশ ও পরে গোটা বিশ্বকে। জার্মানিতে বিক্রি হয় প্রায় ১.২ মিলিয়ন কপি। একই বছর প্রকাশিত হয় ইংরেজি ভাষাতেও। রেমার্ক রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান, হাতে অর্থ আসতে থাকে চারপাশ থেকে। তবে নিজের দেশে তাকে হতে হয়েছে রাজনৈতিক বিরোধিতার মুখোমুখি, সরকারের ভেতর ও বাইরে থেকে ছুটে আসে সমালোচনা ও হুমকি-ধামকি।
এরিক মারিয়া রেমার্ক তার লেখক জীবনে অনেকগুলো যুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস রচনা করলেও প্রথমটির জনপ্রিয়তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি তার লেখা আর কোনো বই-ই। তার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আলোচিত তিনটি উপন্যাস হচ্ছে- অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট, দ্য রোড ব্যাক ও থ্রি কমরেডস।
অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট
অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে ফুটে উঠেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা। বইটির মুখ্য চরিত্রের নামও পল, পল বোমার। যার মাঝে আমরা লেখকের ছায়া দেখতে পাই, লেখার সময় রেমার্ক নিজেকেই বসিয়ে দিয়েছিলেন পল বোমারের জায়গায়। কেনই বা দেবেন না, বোমার তো তারই প্রতিচ্ছবি।
কিশোর বোমার একা আসেনি মরণযুদ্ধে। সাথে এসেছে তার সহপাঠি ক্রপ, লিয়ার, ডেটারিং, কেমেরিখ, জাদেন, বেহম, হাই ও মুলার। সবার বয়স আঠারো-ঊনিশের ঘরে। তবে পল সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ অপেক্ষাকৃত বয়স্ক স্ট্যানিলাস কাটজিন্সকি ওরফে কাটের সাথে। সাথে। আগে এদের কেউ ছিল চাষী, কেউ ছাত্র, আবার কেউ নেহাত শ্রমিক। যুদ্ধ সবাইকে নিয়ে এসেছে এক কাতারে।
কাট তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী। ডেটারিং আগের জীবনে ছিল চাষী, মাথায় যুদ্ধের চেয়ে বউ আর জমি নিয়ে চিন্তা ঘোরে বেশি। প্রাক্তন তালার কারিগর জাদেন, ‘নররাক্ষস’ নামে পরিচিত সবার কাছে, খেতে পারে পেট ফাটিয়ে। অ্যালবার্ট ক্রপের মাথা খুব পরিষ্কার। মুলার সারাক্ষণ বইপত্র নিয়ে ঘোরে সাথে, যুদ্ধ শেষ হলেই পরীক্ষা দেবে। যুদ্ধে আসার আগে হাই গর্ত খুঁড়ে কাঠকয়লা তুলে বিক্রি করত। এই ছা-পোষা সাধারণ মানুষগুলোই ভাগ্যের অভিশাপে হয়ে যায় সৈনিক।
রণদামামা মানুষকে কীভাবে বদলে দেয়, বানিয়ে দেয় স্বার্থপর আর অসহায়, খাদ্য ও নিরাপদ আশ্রয়ের অভাবে জমে থাকা ক্ষোভ যেন পিছু ছাড়ে না মৃত্যু পর্যন্ত, বন্ধুকে বানিয়ে দেয় লোভী আর পাপী। অস্ত্রের ঝনঝনানি আর রক্তের মাঝে হারিয়ে যায় মানবতাবোধ। কিশোর যোদ্ধাদের চোখে নিষ্ঠুরতা শতগুণ বেশি হয়ে ধরা দেয়, ভুলিয়ে দেয় ফেলে আসা স্বাভাবিক জীবনের কথা, শেষ করে দেয় ভবিষ্যতের ছবি আঁকার ক্ষমতা। চারপাশে শুধুই মৃত্যুর আনাগোনা। সেখানে নেই ভবিষ্যৎ, নেই আনন্দ, নেই বেঁচে থাকার আশ্বাস।
পলের চোখের সামনে একে একে মৃত্যুবরণ করেছে তার বন্ধুরা। একসময় হেরে যেতে হয় তাকেও। আর এখানেই রেমার্কের সাবলীল, কিন্তু অসাধারণ বর্ণনা স্তব্ধ করে দেয় পাঠককে। মনে করিয়ে দেয়, মৃত্যু যেমন আছে, তেমনি আছে হাসি-কান্না, আছে নতুন দিনের সম্ভাবনাও-
অসম্ভব শান্ত একটা দিন। ঝকঝকে নীল আকাশ, মাঝে মাঝে সাদার ছোপ। বাতাস বইছে মৃদুমৃদু। ঘাসের ডগার শিশিরবিন্দু এখনো শুকোয়নি। লাল লাল ফুলগুলোর ওপর ছোটাছুটি করছে দুটো রঙিন প্রজাপতি। নির্মল বাতাস, বারুদের গন্ধ নেই, গোলার গর্জন নেই। চারদিকে এমন নিঃশব্দ যে একটা মাত্র লাইনে শেষ হয়েছে আর্মি রিপোর্ট: ‘পশ্চিম রণাঙ্গন সম্পূর্ণ শান্ত’ (All Quiet On The Western Front)। গাছটার নিচে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে পল, যেন ঘুমিয়ে আছে। ওকে যখন ওল্টানো হলো, দেখা গেল মুখে তখনও হাসি লেগে আছে এক টুকরো। যেন কোনো কষ্টই পায়নি ও। যেন জেনেই গেছে, সব শেষ হতে চলেছে।
দ্য রোড ব্যাক
দু’বছর পর ১৯৩১ সালে আসে এ বইয়ের সিক্যুয়েল, দ্য রোড ব্যাক। যুদ্ধফেরত সৈনিকদের নিয়ে লেখা হয়েছিল বইটি। তবে সিক্যুয়েল হলেও জাদেন ছাড়া অন্য কোনো চরিত্রের সরাসরি দেখা পাবে না পাঠক।
প্রায় চার বছর পর যুদ্ধ শেষে পরাস্ত জার্মান বাহিনীর সৈনিক আর্নস্ট ও তার বন্ধুরা-ফার্দিনান্দ, উল্ফ, বেথক, ব্রেয়ার, কোসল- ফিরে এল দেশে। রেমার্কের ভাষায়-
পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে নোংরা, বিবর্ণ ইউনিফর্ম পরা একদল সৈন্য। স্টিলের হেলমেটের তলায় বহুদিনের বেড়ে ওঠা দাড়িওয়ালা মুখগুলো সব ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, বিপন্ন, ক্ষুধাপীড়িত, কষ্টে–যন্ত্রণায় বিপর্যস্ত; আতঙ্ক, সাহসিকতা এবং মৃত্যু তাতে যোগ করেছে নতুন অভিব্যক্তি। নিঃশব্দে মার্চ করে যাচ্ছে তারা; নিঃশব্দে, যেমন মার্চ করেছে বহু পথ ধরে, ট্রাকে বসে পাড়ি দিয়েছে অনেক পথ, লুকিয়ে থেকেছে বহুবার ডাগ–আউটে, শেলের আক্রমণ থেকে পালাতে আশ্রয় নিছে কত গর্তে। বিনা বাক্যব্যয়ে এখন ঘরের পথ ধরে ফিরে যাচ্ছে তারা শান্তির ভেতরে। বিনা বাক্যব্যয়ে। নিঃশব্দে।
ফেরার পর সবাই দেখল, ফ্রন্টে কাটানো কয়েকটি বছর ওদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে সমাজ থেকে, জন্ম দিয়েছে এক দুরতিক্রম্য দূরত্বের। যে সমাজকে রক্ষা করবার জন্য লড়েছে, সেই সমাজই ভুলে গেছে তাদের। দীর্ঘদিন ঘরের বাইরে থাকায় ঘরে ফিরেও যেন ফেরা হয় না ক্লান্ত যোদ্ধাদের। মিশতে পারে না সবার সাথে, খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে বারে বারে। পেছন পেছন তেড়ে আসে ভয়াবহ যুদ্ধের স্মৃতি, এত শান্তি তাদের মনে জন্ম দেয় উৎকণ্ঠার, অনিশ্চয়তার।
যুদ্ধফেরত সৈনিকদের নিয়ে অদ্যাবধি রচিত সবচেয়ে শক্তিশালী উপন্যাস দ্য রোড ব্যাক।
থ্রি কমরেডস
রেমার্কের আরেকটি সাড়া জাগানো বই হচ্ছে থ্রি কমরেডস। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় এটি। রবার্ট লোকাম্প, অটো কোস্টার, গোটফ্রিড লেনৎজ নামের তিন বন্ধুর বন্ধুত্বের গল্প। একইসাথে ভালোবাসার গল্পও। তাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী কার্ল নামের এক রেসিং কার।
কাহিনী এগিয়ে যায় রবার্টের ভাষায়। যুদ্ধ থেকে ফিরে গ্যারেজ নিয়ে ভালোই ছিল তারা। এর মধ্যেই প্রেম এলো রবার্টের জীবনে। প্যাট্রিসিয়া হলম্যান। এর মধ্যে অস্থির রাজনীতির বলি হলো লেনৎজ। এদিকে বেড়াতে গিয়ে প্যাট্রিসিয়ার ধরা পড়ল কঠিন অসুখ। কাশির সাথে উঠে আসছে রক্ত। স্থানীয় ডাক্তার চিকিৎসায় অপারগ হলে দুশো চল্লিশ কিলোমিটার দূর শহরে থাকা ডাক্তারকে দরকার হয়। খবর পেয়ে সেই ডাক্তারকে খুঁজে বের করে কার্লে চড়ে রওয়ানা করে কস্টার।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানির পথ, সেকালের সব থেকে দ্রুতগতি সম্পন্ন গাড়িরও অতটা পাড়ি দিতে অন্তত তিন ঘণ্টা লাগবে। এদিকে মরণাপন্ন প্যাট্রিসিয়া। বন্ধু কস্টার বলেছে, দু’ঘণ্টার মধ্যে ডাক্তারকে নিয়ে পৌঁছাবে, যে করেই হোক।
এর পরের অংশটুকু রবার্টের জবানিতে শোনা যাক-
‘আর স্থির থাকতে পারছি না আমি। বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। চারদিক কুয়াশাচ্ছন্ন। সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে এখান থেকেও। গাছের পাতা থেকে গড়িয়ে পড়ছে শিশিরবিন্দু। কোনো এক ইঞ্জিনের অস্পষ্ট শব্দ ভেসে আসছে দক্ষিণ দিকের দিগন্তের বাইরে থেকে। আমি জানি, আমাদের জন্য এগিয়ে আসছে সাহায্যের হাত, অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে, এবড়োখেবড়ো পথ ধরে; তীব্র উজ্জ্বল আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে হেডলাইট থেকে; রাস্তার সাথে ঘষা খেয়ে টায়ার থেকে শব্দ বেরুচ্ছে হুইসেলের মতো, স্টিয়ারিং ধরে আছে দৃঢ়, অবিচল দু‘টি হাত, অন্ধকারে ঠাণ্ডা ও নিশ্চিত দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে দু‘টি চোখ- আমার বন্ধুর চোখ, আমার শুভাকাঙ্খীর চোখ।…’
কিন্তু ভাগ্য আর সহায় হয় না। মারা যায় প্যাট্রিসিয়া। মৃত প্রেমিকাকে বাহুবন্ধনে জড়িয়ে সারারাত বসে থাকে রবার্ট। দিনের আলো উঁকি দিচ্ছে তখন বাইরে।
পাঠকের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে কি আসবে না?
১৯৩১ সালে দ্য রোড ব্যাক লেখা শেষ করে তিনি সুইজারল্যান্ডের পোর্তো রোঙ্কোতে একটা বাড়ি কেনেন। ইচ্ছে ছিল, সেখানে থাকবেন, আর মাঝেসাঝে ফ্রান্সে। তখন তার অর্থবিত্তের কমতি ছিল না বই লেখার সুবাদে।
পিতৃভূমির শত্রু, ধরণীমাতার মিত্র
মার্চ ১৯৩৩-এ হিটলার ক্ষমতা দখল করে নেয়। রেমার্কের লেখাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় দেশ জুড়ে। লাইব্রেরি থেকে সরিয়ে ফেলা হয় তার লেখা সমস্ত বই, বিক্রি কিংবা প্রকাশ করার উপরও নেমে আসে খড়গ। ১৯৩৩ সালের ১০ মে, রেমার্ক ছাড়াও খ্যাতনামা বহু লেখকের বই পুড়িয়ে ফেলা হয়। যাদের মধ্যে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, হেলেন কেলার, জ্যাক লন্ডন, থমাস ম্যান, এইচজি ওয়েলস উল্লেখযোগ্য।
রেমার্কের ফরাসি রক্ত আর ক্যাথলিক মনোভাবের জন্যও নাৎসিরা তাকে আক্রমণ করে। এমনকি সরকারপক্ষ দাবি করে যে, রেমার্ক নাকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশই নেননি। হিটলারের উত্থান, পার্টি-বিরোধীদের বিরুদ্ধে নেওয়া নিষ্ঠুর পদক্ষেপ ও রাজনৈতিক হিংস্রতা তাকে ভেতরে ভেতরে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে। দেশ ছেড়ে যান তিনি। আশ্রয় নেন পোর্তো রোঙ্কো-তে কেনা সেই বাড়িতে। ১৯৩৮ সালে রেমার্কের জার্মান নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার প্রাক্কালে স্ত্রীকে নিয়ে তিনি সুইজারল্যান্ড ত্যাগ করেন আমেরিকার উদ্দেশে। নাৎসি পার্টি প্রতিশোধ নেবার জন্য তার বোন এলফ্রিদকে গ্রেফতার করে। ১৯৪৩ সালে হিটলারকে গালি দেবার বানোয়াট অভিযোগে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। রেমার্ক তখন লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন আমেরিকার মাটিতে।
১৯৪৭ সালে তাকে আমেরিকার নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। তবে একসময় আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব ও আগ্রাসী আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রকে বিদায় জানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ফিরে আসেন সুইজারল্যান্ডে।
ব্যক্তিগত জীবন
১৯২৫ সালে রেমার্ক বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন অভিনেত্রী ইলসে জুট্টা জাম্বোনার সাথে। তবে সে সংসার সুখের হয়নি। দু’পক্ষেই ছিল অবিশ্বাস আর মন কষাকষি। ১৯৩০ সালে বিচ্ছেদ হয়ে যায় তাদের। তবে অদ্ভুত বিষয়, রেমার্ক ’৩৩ সালে জার্মানি ছাড়বার সময় জুট্টাও ছিলেন তার সাথে। ১৯৩৮ সালে তারা আবার বিয়ে করেন। রেমার্কের সাথে সাথে আমেরিকার নাগরিকত্ব পান তিনিও। তবে সংসারের দুর্ভাগ্য কাটেনি। ১৯৫৭ সালের ২০ মে, আবারও বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে তাদের। এবার চিরতরের জন্য।
ইলসে মারা যান ’৭৫ সালের ২৫ জুন।
জীবনে অনেক নামীদামি অভিনেত্রীদের সাথে প্রণয়ে জড়িয়েছেন রেমার্ক। তাদের মধ্যে অস্ট্রিয়ান অভিনেত্রী হেডি লামার, ডলোরেস ডেল রিও আর মার্লিন ডিয়েট্রিচ উল্লেখযোগ্য। ডিয়েট্রিচের সাথে মন দেওয়া-নেওয়া শুরু হয়েছিল সেই ১৯৩৭ সালেই। ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখা হয়েছিল দুজনের। তাদের সম্পর্ক চলতে থাকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত।
১৯৫৮ সালে রেমার্ক আরেক অভিনেত্রী পলেট গডার্ডকে বিয়ে করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থেকেছেন তার সাথেই।
রূপালী পর্দা জয়
১৯৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পায় তার রচিত অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র। পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন লুইস মাইলস্টোন। সেরা চলচ্চিত্র ও সেরা পরিচালক- এই দুটি ক্যাটাগরিতে জিতে নেয় অস্কার। এছাড়া জিতে নেয় আরও অনেকগুলো সম্মানজনক পুরস্কার।
১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয় অ্যা টাইম টু লাভ অ্যান্ড অ্যা টাইম টু ডাই, যা ১৯৫৮ সালে চলচ্চিত্রে রূপ দেন পরিচালক ডগলাস সার্ক। চলচ্চিত্রটিতে আর্নস্টের ভূমিকায় অভিনয় করেন অভিনেতা জন গেভিন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, চলচ্চিত্রটিতে সামান্য সময়ের জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন খোদ রেমার্কও।
প্রেম করায় মশগুল রেমার্ক-ডিয়েট্রিচ একে অন্যকে চিঠি লিখতেন প্রায়ই। তাদের বেশ কিছু চিঠি টেল মি ইউ লাভ মি নামের একটি বইয়ে প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে।
কালজয়ী ঔপন্যাসিকের বিদায়
সুইজারল্যান্ডের শহর লোকার্নো-তে ১৯৭০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে রেমার্ক মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। তাকে সমাধিস্থ করা হয় রোঙ্কো সেমেট্রিতে।
এরিক মারিয়া রেমার্ক তার বিখ্যাত উপন্যাস দ্য ব্ল্যাক অবিলিস্ক-এ বলেছিলেন,
“একজন মানুষের মৃত্যু একটি ট্র্যাজেডি, কিন্তু অসংখ্য মানুষের মৃত্যু একটি পরিসংখ্যান।”
আজকের দিনেও তার এই কথাটি প্রযোজ্য। যতদিন পৃথিবীতে যুদ্ধ-বিগ্রহ আর মানুষের নিজেকে হারিয়ে খোঁজার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে, ততদিন বেঁচে থাকবেন এরিক মারিয়া রেমার্ক। আর যুগে যুগে মানুষ স্মরণ করে যাবে বিশ্বযুদ্ধ নামের মানবতা হারাবার নিষ্ঠুর গল্প।