জাদুর কথা বলতে গেলেই বাঙালীর মনে যে নামটি অবলীলায় চলে আসে, তিনি হলেন জুয়েল আইচ। ১৯৯২ সালের দিকের ঘটনা। অধ্যাপক আবু সায়ীদ বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্যে বিনোদন অনুষ্ঠান আনন্দমেলা সঞ্চালন করলেন কিছুটা ভিন্নরূপে। পুরো অনুষ্ঠানটি সাজানো হলো শুধুমাত্র জাদুর পরিবেশনায়। নাম দেয়া হলো ‘জুয়েল আইচের জাদু জগৎ’।
হালকা পাতলা শরীরের, মিষ্টি হাসির চেহারার লোকটির বুদ্ধিদীপ্ত চাহনির মাঝে কেমন যেন একটি সরলতা রয়েছে, যা এক নজরেই আকৃষ্ট করে দর্শকদের। হাস্যরস আর মনোরম জাদুর মোহনীয় ছোঁয়া ছিল পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে। অনুষ্ঠানটির শেষ জাদুটির কথা মনে হলে এখনও শিহরিত হয় অনেকে।
জাদু দেখানোর পূর্বে জাদুকর সবাইকে বললেন দুর্বল-চিত্তের মানুষেরা যেন এই জাদু না দেখেন। যারা দেখবেন তারা যেন খুব নিস্তব্ধতার সাথে তার এই শেষ জাদুটি দেখেন। জাদুকক্ষে প্রবেশ করানো হলো বিশাল আকৃতির এক বৈদ্যুতিক করাত। জাদুর মতো একটি বিনোদনের অনুষ্ঠানে দর্শকদের চোখে-মুখে হঠাৎ যেন আতংকের ছাপ। সবার মধ্যে একটি চাপা উত্তেজনা। দর্শকদের কেউ তখনও নিশ্চিত নয়, কী করতে চলেছেন এই জাদুকর?
মঞ্চে উপনীত হলেন জাদুকরের স্ত্রী বিপাশা আইচ স্বয়ং। বিপাশা আইচকে টেবিলের উপর শোয়ানো হলো এবং বৈদ্যুতিক করাত বারবার পরীক্ষা করে দেখা হলো। তখন আর কারো বুঝতে বাকি নেই জুয়েল আইচ তার স্ত্রীকেই দ্বিখণ্ডিত করতে চলেছেন। বৈদ্যুতিক করাত যখন নিচে নামানো হলো তখন বিপাশা কিছুটা চমকে উঠলেন। সাথে সাথে জুয়েল আইচ বিড়বিড় করে যেন কিছু বললেন। আবার বিপাশাকে ঘুম পারিয়ে বৈদ্যুতিক করাতকে নিচে নামানো হলো এবং বিপাশাকে দ্বিখণ্ডিত করা হলো। একটি কাচের আয়না বিপাশার দ্বিখণ্ডিত শরীরের মাঝে প্রবেশ করিয়ে দর্শকদের প্রমাণ দেখানো হল। দর্শকরা উত্তেজনায় তখন আনন্দের চাইতে অনেক বেশি কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন।
এরপর বিপাশার দেহ জোড়া লাগানোর পালা। জাদুকর বারবার হাতের ঘড়ির দিকে সময় দেখতে লাগলেন। বিপাশা জেগে উঠছেন না। জাদুকরের কপালে কিছুটা চিন্তার ঘাম যেন সকলের চোখে পড়লো। জাদুকরের মতো সমস্ত দর্শক অতি উৎকণ্ঠিত, শেষপর্যন্ত উঠবে তো জুয়েল আইচের স্ত্রী? দ্বিখণ্ডিত মানুষ কী আবার জোড়া লাগানো সম্ভব? কিন্তু সকল দর্শকদের হতবাক করে দিয়ে, এবং অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জাগিয়ে তুললেন বিপাশাকে। সেই থেকে সকলের কাছে ভালো লাগা অতিমানবীয় একজন চরিত্র জাদুকর জুয়েল আইচ।
১৯৫২ সালের ১০ এপ্রিল পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার সমুদয়কাঠি গ্রামে জন্ম তার। যৌথ পরিবারে অসংখ্য আত্মীয়স্বজনের সাথে ছোটবেলায় বেড়ে ওঠা। পিতা বি কে আইচ ব্যবসার কাজে পিরোজপুর থাকতেন। মা সূর্য আইচ ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী ও সুগৃহিণী। সংসারের সকল দায়িত্ব একার হাতেই সামাল দিতেন তিনি। নয় ভাই-বোনের মধ্যে পঞ্চম ছিলেন জুয়েল আইচ। সারাদিন হৈ হুল্লোড় আর আনন্দে দিন কাটতো তার। চাচাতো ভাই-বোনদের সাথে খাওয়া দাওয়া, গ্রামের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ানো, সব মিলিয়ে এক দূরন্ত শৈশব কেটেছে জুয়েল আইচের।
ছেলেবেলায় পরীক্ষা পাশের পড়ালেখার চেয়ে জ্ঞানের চর্চা করেছেন অনেক বেশি। দেশ-বিদেশের অনেক বই পড়ার নেশা ছিল ছোটবেলা থেকেই। সৃষ্টিশীল কিছু চোখে পড়লেই দাঁড়িয়ে পড়তেন তা শেখার জন্য। এমন করেই নিজে নিজে ছবি আঁকা শুরু করেন। একসময় কাঠ ও মাটির ভাস্কর্য তৈরি করা হয়ে উঠেছিল তার নেশা।
ছোটবেলায় বাড়িতে গল্প বলার আসর বসতো। আকাশ মেঘ করে ঝুম অন্ধকার নেমে এলে টিমটিমে মাটির কুপিতে আগুন জ্বালিয়ে ঘরের বড়দের নিয়ে বিভিন্ন রাজা-রাণী, দৈত্য, রাক্ষস, ভূত এসবের গল্প শুরু হয়ে যেত। তখন কোমল মনে ঘুরে বেড়াতো রাজপুত্রের ঘোড়ায় চড়ে আকাশে ওড়ার ছবি কিংবা বন্ধ বোতলের ছিপি থেকে বেরিয়ে আসা দৈত্যের ছবি। এসব তার মনে অন্যরকম দাগ ফেলে রাখে, যা ভবিষ্যতে জুয়েল আইচকে জাদুশিল্পী করে গড়ে তুলতে অনেকটাই সাহায্য করে।
একবার তার গ্রামে নৌকায় করে কিছু বেদে আসে। বেদে হলো যারা সাপের বিষ নামায়, সাপের খেলা দেখায়। বেদে দলের অনেকে আবার এসবের পাশাপাশি জাদুর খেলাও দেখাতো। তখন প্রচলিত ছিল বেদেরা নানা ধরনের জাদুমন্ত্র জানে। জাদুর কথা শুনে জুয়েল আইচের ইচ্ছে হলো বেদেদের কাছ থেকে জাদু দেখবেন। কিন্তু তারা এমনিতে তো জাদু দেখাবে না। তাই মাকে অনেক বলে কয়ে রাজি করালেন যেন এক কেজি চালের বিনিময়ে জাদু দেখানোর ব্যবস্থা করেন। সেই জাদু দেখে অবাক বিস্ময়ে মোহিত হয়ে গেলেন তিনি। আপন মনে এক ধরনের নেশা অনুভব করলেন, যেন জাদুবিদ্যা তাকে ডাকছে। এই বিদ্যে তাকে শিখতেই হবে। কিন্তু বেদেদের জরাজীর্ণ, দুঃস্থ জীবনযাত্রা দেখে কিছুটা দমিয়ে গেলেন জুয়েল আইচ। কিন্তু বাসনা মনে রয়ে গিয়েছিল ষোল আনায়।
১৯৬৫ সালের দিকের ঘটনা। পিরোজপুরে আসে বিখ্যাত সার্কাস দল ‘সাধনা লায়ন সার্কাস’। জুয়েল আইচ তখন নবম শ্রেণীর ছাত্র। সার্কাসে জাদু দেখানো হয় জানতে পেরে উপস্থিত হলেন সার্কাস প্রাঙ্গণে। তখন ঐ সার্কাসে জাদু দেখাতেন বাংলাদেশের এক অনন্য জাদুশিল্পী প্রফেসর আবদুর রশিদ। তার নিপুণ হাতের কাজ দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়েন জুয়েল আইচ। অনুষ্ঠানের পর ভয়ে ভয়ে দেখা করলেন জাদুকরের সাথে। আবদুর রশিদ কী এক মোহে জুয়েল আইচকে তার জাদুর বিভিন্ন কৌশল দেখাতে লাগলেন। এত কাছ থেকে জুয়েল আইচের জাদুবিদ্যার হাতেখড়ি সেই প্রথম।
এরপর জাদুসম্রাট পিসি সরকারের (সিনিয়র) কথা জানতে পারলেন। একজন জাদুশিল্পী শুধু জাদু দেখিয়ে দেশবরেণ্য হয়েছেন জানতে পেরে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হলেন। পিসি সরকারের লেখা ‘ম্যাজিকের খেলা’ ও আরেক জাদুশিল্পী আলাদেনের লেখা ‘অভিনব ম্যাজিক’ গ্রন্থ দুটি পড়ে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হলেন তিনি। এরপর শুরু হয় দেশ-বিদেশের জাদুর বই খুঁজে বের করা এবং তা নিয়ে নিয়মিত অনুশীলন করা। মনে মনে যেন জেনে গিয়েছিলেন তাকে ভবিষ্যতে জাদুশিল্পীই হয়ে উঠতে হবে।
জাদুতে কিছুটা হাত পাকার পর কিছুটা ভয়ে ভয়ে প্রথম জনসমক্ষে আসলেন পাশের গ্রাম জলাবাড়ি হাটের বাজারে। জাদু দেখার জন্যে অনেক মানুষের জমায়েত হয়েছিল সেদিন। সাথে পেয়েছিলেন অনেক মানুষের হাততালি আর বুক ভরা ভালোবাসা আর আশীর্বাদ। মিষ্টির দোকানের এক দোকানদার জাদু দেখে মুগ্ধ হয়ে জুয়েল আইচ ও তার সহযোগীদের ডেকে তার দোকানে নিয়ে গিয়ে মিষ্টি খাওয়ালেন। হাজার সুখস্মৃতির মাঝে প্রথম জাদু দেখানোর এই স্মৃতির কথা কিছুতেই ভুলতে পারেন না জুয়েল আইচ।
তবে তার এই বর্ণিল জীবনে কিছুটা ছন্দপতন নিয়ে আসে ৭১’এর মুক্তিসংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে জুয়েল আইচের পিরোজপুরের বাড়িতে কিছু দুর্বৃত্ত বাড়ির সকল জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। যে এ কাজটি করেছিল সে ছিল জুয়েল আইচের বন্ধু। বন্ধুর কাছ থেকে এমন ব্যবহার পেয়ে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন সেদিন। দেশের সর্বত্র এ ধরনের আরো ঘটনার খবর শুনে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলেন না। দেশমাতৃকার টানে বাড়ির কাউকে না জানিয়ে পালিয়ে গিয়ে যোগ দিলেন মুক্তিযুদ্ধে। ৯ নম্বর সেক্টরের অন্তর্গত স্বরূপকাঠি এবং ঝালকাঠির সুবিশাল পেয়ারা বাগানের গেরিলা যোদ্ধাদের দলে যোগ দিলেন। তখন স্নাতকের শেষ বৎসরের ছাত্র ছিলেন তিনি।
পেয়ারা বাগানের পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে সরাসরি বেশ কয়েকটি গেরিলা যুদ্ধে জুয়েল আইচ অংশগ্রহণ করেন এবং পরাক্রমের সাথে যুদ্ধ করেন। পেয়ারা বাগান এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের দাপটে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে যায় সেখানকার পাকিস্তানী সৈন্যরা। কিন্তু অনেকদিন ধরে অনাহারে এবং নদীর পানি খেয়ে রক্ত আমাশয় দেখা দেয় তার। ফলে ক্যাম্পের চিকিৎসকেরা তাকে ভারতের নদীয়ায় বাহাদুরপুর শরণার্থী ক্যাম্পে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
এ সময় পুরো রাস্তা পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হয় বলে একসময় তার পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে যায়। বাহাদুরপুর ক্যাম্পে গিয়ে অনেকদিন ধরে তার চিকিৎসা করা হয়। এর মাঝে ক্যাম্পে একটি স্কুল ছিল যেখানে ছোট ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তিনি সেখানকার শিক্ষক হলেন। অস্থিতিশীল পরিবেশে শিক্ষকতার কাজটি ছিল খুব কষ্টসাধ্য ছিল। তখন তিনি পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে সবাইকে জাদু দেখানো শুরু করলেন। খুব অল্প সময়েই তার এই বিদ্যা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ক্যাম্পের চোখে মণি হয়ে উঠেন তিনি। ভারতে থাকাকালীন সময়ে মৃণাল রায়, ও পি আগরওয়াল, মার্কাস, সুবীর সরকারসহ বেশ কয়েকজন জাদুশিল্পীর সাথে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য হয় জুয়েল আইচের।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরে এসে গরীবদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে জুয়েল আইচ গ্রামে চলে যান। এর মধ্যে ১৯৭২ সালে জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
শিক্ষকতার শুরুর দিকে সমুদয়কাঠি উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তার শিক্ষকতার জনপ্রিয়তা অল্প সময়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। দূর দূরান্ত থেকে স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তি হতে থাকে। ধীরে ধীরে স্কুলে পাবলিক লাইব্রেরি গড়ে তুললেন। এছাড়াও খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে উজাড় করে দিলেন। মাত্র তিন বছরের মধ্যে তাকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেয়া হয়।
শিক্ষকতার পাশাপাশি জুয়েল আইচের জাদুর অনুশীলনীও চলতে থাকে পুরোদমে। কিন্তু জাদুর যন্ত্রপাতি ও অনুশীলনীর জন্যে তার একটি নিরিবিলি জায়গার প্রয়োজন ছিল। তার এক স্থানীয় বন্ধু নিটুল কর বন্ধুর জন্য বাড়ির একটি অংশ ব্যবহার করতে দিলেন। তখন জুয়েল আইচের জাদু প্রদর্শনী, গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনীর যাবতীয় উপকরণ ঐ বাসাতেই রাখা ছিল। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটল আরেক দুর্ঘটনা। স্থানীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাতের আঁধারে কিছু দুর্বৃত্ত নিটুলের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে যায় বাড়িঘরসহ জুয়েল আইচের যাবতীয় জিনিসপত্র। এতে অসম্ভব ভেঙ্গে পড়েন জুয়েল আইচ। শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দিয়ে পুনরায় জাদুর সরঞ্জাম তৈরির কাজে লেগে পড়েন তিনি।
এদিকে এই ঘটনা যে দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হয়ে গিয়েছিল তা ছিল জুয়েল আইচের একেবারেই অজানা। খবর পেয়ে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কয়েকবার চিঠি লিখেন জুয়েল আইচকে ঢাকায় আসার জন্যে। প্রথমে তেমন একটা ইচ্ছে না থাকলেও পরবর্তীতে স্থানীয়দের পরামর্শে ঢাকা যান। ১৯৭৭ সালের ঈদের ‘আনন্দ মেলা’ জুযেল আইচের জাদু দিয়ে শুরু হয়। এরপর বেশ কয়েকবার বিটিভিতে জাদু প্রদর্শন করেন।
খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে তার খ্যাতি। ১৯৮০ সালে প্রথম বিদেশে জাদু প্রদর্শনের আমন্ত্রণ পান। সোসাইটি অফ আমেরিকান ম্যাজিশিয়ানসের আমন্ত্রণে ১৯৮১ সালের ২৮ জুন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেবছর ৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে তার প্রথম জাদু প্রদর্শন করেন। এরপর থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। জাদুশিল্পী হিসেবে বহুবার আমেরিকা, কানাডা, চীন, জাপান, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, হংকং, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর কোরিয়া, কুয়েত, কাতার, আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, বাহরাইন, ইরাক, সুইডেন, ভারত, নেপালসহ বহু দেশে জাদু প্রদর্শনী করেছেন তিনি।
১৯৮৬ সালের ২৬শে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের খোলা মঞ্চে হাজার হাজার মানুষের সামনে জাদু দেখান বিশ্বনন্দিত এই জাদুকর। একবার লন্ডনে তার জন্যে আয়োজন করা হলো এক অদ্ভুত পরীক্ষা। ১৯৮৮ সালের ১৮ আগস্ট লন্ডনে একদল সাংবাদিক এবং পাঁচ শতাধিক দর্শকের সামনে জুয়েল আইচের চোখ চিকিৎসক দিয়ে ভালো করে বেঁধে দেয়া হলো। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় তিনি লুকিয়ে রাখা গাড়ির চাবি খুঁজে বের করলেন।
শুধু চাবি খোঁজায় নয়, অনেকগুলো গাড়ির মধ্যে নির্দিষ্ট চাবি খুঁজে নিয়ে সেই গাড়ি লন্ডনের ব্যস্ত রাস্তায় চালিয়ে, ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে আবার আগের জায়গায় ফিরে এলেন। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে নিশ্চিত করলেন ব্যান্ডেজের কোনো প্রকার ব্যত্যয় ঘটেনি। যেভাবে বাঁধা হয়েছিল ঠিক সেভাবেই রয়েছে। তার এই অসাধারণ কীর্তি দেখে সকলে ধন্য ধন্য করতে লাগলেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তার স্ত্রী বিপাশা আইচ এবং একমাত্র মেয়ে খেয়া আইচ। জাদুশিল্পের পাশাপাশি শিক্ষকতার ওপর এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওপর ঢাকাতে আর চলচ্চিত্র তৈরির ওপরে যুক্তরাষ্ট্রের হলিউড ফিল্ম স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেন। আছে অসংখ্য দেশী-বিদেশী বইয়ের সংগ্রহশালা।
তিনি ইউনিসেফের পক্ষে শিশুদের জন্য জনমত ও সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে নিয়মিত কাজ করছেন। এসবের পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখিও করেন। তার লেখা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশিত হয়। এছাড়াও নিজের জীবনের উপর ‘অন্তরালের আমি’ নামে একটি আত্মজীবনীমূলক বই লিখেছেন। জাদুশিল্পে আকাশছোঁয়া সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ কিংবদন্তি এ জাদুশিল্পী দেশ-বিদেশে অসংখ্য পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন। জাদুশিল্পে অসামান্য কীর্তির জন্য পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক।
জুয়েল আইচের অনেক গুণের মধ্যে আরেকটি উল্লেখযোগ্য গুণ হলো তার সুরেলা বাঁশি। জাদুর মতোই মোহ ছড়ায় জুয়েল আইচের বাঁশি বাজানো। জাদু প্রদর্শনের সাথে সাথে মোহনীয় বাঁশির সুরে হারিয়ে যাওয়া যেন একটু বাড়তি পাওনা। ছোটবেলায় প্রতিবেশী নিতাই কৈবর্তের কাছে বাঁশির হাতেখড়ি। বন্ধুর হাতে বাঁশির মোহনীয় সুরে মোহিত জুয়েল আইচ নিজের অজান্তেই বাঁশির প্রেমে পড়ে যান। পরবর্তীতে ওস্তাদ আবদুর রহমানের কাছে অনেকদিন শেখেন। পণ্ডিত হরিপ্রসাদ এবং পণ্ডিত রবিশঙ্করের সাথে বেশ ভালো সখ্যতা গড়ে ওঠে জুয়েল আইচের। বাঁশি বাজানোর সুবিধার জন্যে নিজেই একটি বাঁশি তৈরি করলেন যার নাম দিলেন ‘জুয়েল বাঁশি’।
জুয়েল আইচ শুধু একজন জাদুকরই নন, তিনি একাধারে মুক্তিযোদ্ধা, সুবক্তা, বাঁশি বাদক, চিত্রশিল্পী, চিত্রকর, লেখক এমন অসংখ্য গুণের অধিকারী। এত গুণ থাকা স্বত্বেও তার চরিত্রে কোনোপ্রকার অহংকার নেই। জাদুশিল্পে তার অসামান্য কীর্তির জন্যে শুধু দেশেই নয়, পুরো বিশ্বে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করে চলেছেন এই সদা হাস্যোজ্জল এ মানুষটি।
ফিচার ইমেজ- youtube.com