তের বছর বয়সী সাধারণ ঘরের এক তরুণী। চোখে বড় স্বপ্ন। নাম মিনা পাল। স্বপ্ন ছিল নায়িকা হবার। চলচ্চিত্র পরিচালক সুভাষ দত্ত তাকে ঢাকা আসতে বলেছেন। বাবা মেয়েকে ট্রেনে উঠিয়ে দিলেন। ট্রেনের চলন্ত গতির সাথে মিনার স্বপ্নগুলোও যেন প্রচণ্ড গতি পায়। হতে পারবে, নাকি পারবে না? সেই দোলাচল! অবশেষে তিনিই হয়ে উঠলেন পূর্ব বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়িকা। তবে মিনা পাল হিসেবে নয়, কবরী হিসেবে।
শ্রীকৃষ্ণদাস ও লাবণ্যপ্রভা পালের কোল জুড়ে ১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই, চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন মিনা পাল। কৃষ্ণদাসের দ্বিতীয় স্ত্রীর দ্বিতীয় মেয়ে। সৎমায়ের দুই মেয়ে, দুই ছেলে। ছোট মায়ের (লাবণ্যপ্রভা) পাঁচ ছেলে, চার মেয়ে। পুরো পরিবারটিই ছিল ভীষণ সংস্কৃতিমনা।
সংস্কৃতিময় পরিবেশে থাকলে মানুষ স্বাভাবিকভাবে সংস্কৃতিমনা হয়েই গড়ে ওঠে। পিতা কৃষ্ণদাস তার সন্তানদের সেই পরিবেশ দিয়েছিলেন। মিনা বাবার উৎসাহে রুনু বিশ্বাসের কাছে নাচ শেখেন। হিন্দু রীতিমতো সন্ধ্যায় সন্তানদের পড়াশোনা শুরুর পূর্বে ভজনকীর্তন গাওয়াতেন। মিনার বড় দুই বোন নাচ করতেন, ছোট ভাই তবলা বাজাতেন। মিনাও নাচে-গানে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। একদিন স্কুলে ‘ক্ষুধা’ নাটকে অভিনয় করার জন্য বলা হলো তাকে। সেটাই প্রথম অভিনয়।
ছোট মঞ্চ থেকে মিনা পালের খুব বেশি সময় লাগেনি সেলুলয়েডের পর্দায় আবির্ভূত হয়ে ঢাকাই চলচ্চিত্রে নিজের জায়গা করে নিতে। ব্যক্তির বিশেষ গুণ কোনো গুণান্বেষী ব্যক্তির চোখে অবশ্যই ধরা দেয়। তেমনি সুভাষ দত্তের কাছে মিনা পালের গুণগুলো ধরা পড়েছিল। সুভাষ তখন তার ‘সুতরাং’ ছবির জন্য ‘জরিনা’ চরিত্রের জন্য একজনকে খুঁজছিলেন, যিনি নায়িকা হবেন স্বয়ং তারই বিপরীতে। ছবির সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহা প্রথম মিনার কথা সুভাষের কাছে বলেন। তখন মিনা ময়মনসিংহসহ দেশের নানা স্থানে মঞ্চে কাজ করতেন। ড. কামালের পাঠানো মিনার কিছু ছবি দেখে সুভাষ দত্ত মিনার মিষ্টি হাসির প্রেমে পড়ে যান। তাকে ‘সুতরাং’ ছবির নায়িকা করা হলো এবং এর মধ্য দিয়ে প্রথম চলচ্চিত্রে পদার্পণ করেন এ গুণী অভিনেত্রী।
১৯৬৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সুতরাং’ ছবিটি দর্শকের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়। সুভাষ দত্ত ছবিতে ‘মিনা’ নাম পরিবর্তন করে ‘কবরী’ নাম দেন। ‘কবরী’ অর্থ খোঁপা। নতুন নামে, নতুন রূপে চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে দেশীয় দর্শকের কাছে কবরী যেন ক্রমেই রোমান্টিকতার নতুন নাম হয়ে ওঠেন।
অভিনয়শিল্পী হিসেবে স্বকীয়তা ও সহজাত প্রবৃত্তি নায়িকা কবরীকে অন্যদের চেয়ে আলাদা অবস্থান দিয়েছে। কবরীকে মানুষ মনে করত, এই শিল্পী আমার কাছের মানুষ। সিনেমার পর্দায় বাংলাদেশি সাধারণ মেয়ে হিসেবে কবরীকে যেভাবে দেখা যেত, বাস্তবে গ্রামের নারী বা শহরে মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ের চরিত্র ঠিক সেরকম ছিল। তিনি যখন অভিনয় করতেন, তার ঠোঁট, চোখ, কণ্ঠ- সবকিছুই যেন কথা বলত। তখনকার নারীর যে তথাকথিত ইমেজ ছিল; লজ্জাবতী, আকর্ষণীয়, প্রেমিকা- এই সবদিক থেকে কবরী ছিলেন সেরা।
এ গুণী অভিনেত্রী ৫০ বছরের বেশি সময় চলচ্চিত্রে নায়করাজ রাজ্জাক, ফারুক, সোহেল রানা, উজ্জ্বল, জাফর ইকবাল ও বুলবুল আহমেদ প্রমুখ অভিনেতার সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি প্রায় ১৪০টির মতো সিনেমায় অভিনয় করেছেন। বাংলার পাশাপাশি দুটি উর্দু সিনেমাও রয়েছে তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে; জহির রায়হান পরিচালিত ‘বাহানা’ (১৯৬৫) এবং কাজী জহির পরিচালিত ‘মিনা’ (১৯৭০)। পর্দায় তার অসাধারণ উপস্থিতি, মায়াবী চোখ, মাধুর্যময় কণ্ঠস্বর, চঞ্চল স্বভাব, মধুমাখা হাসি বাঙালি সৌন্দর্যের এক স্নিগ্ধ, নিখুঁত মিশ্রণ; যা লাখো দর্শকের মন কাড়ে। কবরী তার ক্যারিয়ারে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘সারেং বৌ’, ‘সুজন সখী’, ‘মাসুদ রানা’, ‘দেবদাস’সহ দর্শক জনপ্রিয় সব সিনেমা উপহার দিয়েছেন।
বাংলা চলচ্চিত্রে সর্বকালের অন্যতম সেরা জুটি হিসেবে ধরা হয় রাজ্জাক-কবরীকে। ১৯৬৮ সালের ‘আবির্ভাব’ সিনেমার মধ্য দিয়ে এ জুটির আবির্ভাব হয়। তাদের জুটি দর্শকমহলে এতটাই প্রাধান্য পেয়েছিল যে কবরী প্রায় পঞ্চাশটির মতো সিনেমায় রাজ্জাকের সাথে অভিনয় করেন। অর্থাৎ রাজ্জাক যদি ‘নায়করাজ’ হন, তবে তখন কবরী নিঃসন্দেহে ছিলেন ‘রানী’। রাজ্জাকের সাথে জুটি বেঁধে ‘ময়নামতি’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘দীপ নেভে নাই’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’ ইত্যাদি জনপ্রিয় ও ব্যবসাসফল সিনেমায় দক্ষ কাজ করেছেন কবরী।
‘রংবাজ’ (১৯৭৩) সিনেমার ‘সে যে কেন এল না, কিছু ভালো লাগে না’ গানটি অপেক্ষার প্রহর গুনে থাকা কত প্রেমিক-প্রেমিকার কণ্ঠে কতবার যে ধ্বনিত হয়েছে, সে হিসেব রাখা মুশকিল। সেই সত্তরের দশক থেকে আজপর্যন্ত ইয়ত্তাহীন ব্যর্থ প্রেমিক-প্রেমিকার মুখে শোনা যায় তিনটি শব্দ, ‘প্রেমের নাম বেদনা’। এ গানও তারই সিনেমার।
রোমান্টিক সিনেমা সর্বদাই দর্শকের কাছে প্রিয়। রাজ্জাক-কবরীর জুটি মূলত রোমান্টিক সিনেমা ‘ময়নামতি’র মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠে। সামাজিক গল্পে অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে এ জুটি যেন তৎকালীন তরুণ-তরুণীর প্রতিনিধিত্ব করত। রূপালি পর্দার বাইরে ব্যক্তিগত জীবনে কবরীর খুব আপন লোক ছিলেন নায়করাজ। ২০১৭ সালে ২১ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন রাজ্জাক। এর পরবর্তী বছর, চিত্রনায়িকা কবরী চলচ্চিত্র শিল্প সমিতির কর্যালয়ে রাজ্জাকের মৃত্যুদিন স্মরণে কেক কাটেন।
কবরীর দীর্ঘ অভিনয় জীবনে চারটি চলচ্চিত্র খুব উল্লেখযোগ্য। প্রথম, ‘সুতরাং’ ছবির মাধ্যমে তিনি রোমান্টিকতার নতুন নাম হয়ে ওঠেন। এর মাধ্যমে তিনি পরিচিতি পান ‘মিষ্টি মেয়ে’ হিসেবে। দ্বিতীয়, ‘রংবাজ’ সিনেমায় রাজ্জাক- কবরীর জুটি দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। তৃতীয়, ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’কে ধরা হয়ে থাকে কবরীর ‘কবরী’ হয়ে ওঠার পেছনের কারণ। চতুর্থ, ফারুকের সাথে অভিনীত ‘সুজন সখী’ ছবিকে বাংলা ভাষার অন্যতম রোমান্টিক পিস হিসেবে ধরা হয়।
কবরীর হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্রে অনেক নতুন নায়কের আগমন ঘটে, যারা পরে অনেকে তারকাখ্যাতি পেয়েছেন। রূপালি পর্দায় অভিনয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও সক্রিয় ছিলেন কবরী।
কবরীর নামানুসারে রয়েছে একটি রাস্তাও। তার অভিনীত সিনেমা ‘কখগঘঙ’-এর শ্যুটিং হয়েছিল চুয়াডাঙ্গায়। কাহিনীর প্রযোজনে সিনেমাটির বড় অংশ ধারণ করা হয়েছিল ছবিটির সহ-চিত্রগ্রাহক তোক মিয়ার বাড়ি। এ বাড়ির সামনের রাস্তাটিই পরে মানুষ ‘কবরী রোড’ বলে ডাকা শুরু করে। পরে ২০১৭ সালে পৌরসভা এ সড়কের প্রশাসনিক স্বীকৃতি দেয়।
তার সাফল্যের ঝুড়িতে রয়েছে অনেক পুরস্কার। তিনি দুবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। ‘লালন ফকির’, ‘সুজন সখী’,’ সারেং বৌ’, ‘দুই জীবন’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রের জন্য পেয়েছেন বাচসাস (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি) পুরস্কার। কবরী অভিনীত ‘সুতরাং’ বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সম্মাননা লাভ করে। ১৯৫৫ সালে ফ্রাংকফুর্ট চলচ্চিত্র উৎসবে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার পায় ছবিটি।
অভিনয়ে যেমন সাফল্য পেয়েছেন, তেমনি তিনি চলচ্চিত্র পরিচালনায়ও সাফল্যের মুখ দেখেছেন। তার ২০০৬ সালে পরিচালিত সিনেমা ‘আয়না’ নির্মাণের মধ্য দিয়ে তা প্রকাশ পায়। এছাড়া তার পরিচালিত ‘এই তুমি সেই তুমি’ চলচ্চিত্রের কাজ প্রায় শেষের পথে থাকলেও ছবিটির শেষ দেখে যেতে পারেননি।
বর্তমান বৈশ্বিক মহামারি করোনার কাছে হেরে যান কিংবদন্তি অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী (৭০)। ১৭ এপ্রিল ২০২১, ঢাকার শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অবশেষে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
তিনি চলে গেছেন, তবে তার স্মৃতি অমলিন। প্রেমজাগানিয়া কবরী সবার হৃদয় জুড়ে আছেন। তার সংবেদনশীল মন, মানবিক আচরণ, রাজনৈতিক সচেতনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ঋজু ব্যক্তিত্ব- সবকিছুই মুগ্ধকর। তার অভিনীত ‘মাসুদ রানা ‘সিনেমার সেই গানটিই তার স্মৃতিরক্ষায় সত্যি হয়ে থাকবে,
“তুলির ছোঁয়ায় এঁকে যাব,
ভাবনাগুলো রেখে যাব,
মনের রঙে রাঙাব,
বনের ঘুম ভাঙাব।।”