১৯৭৪ সালের ৭ আগস্ট নিউইয়র্কের লোয়ার ম্যানহ্যাটনের রাজপথে হঠাৎ এক পথচারী চিৎকার করে উঠলেন। উত্তেজনায় দু’হাত আকাশের দিকে ইঙ্গিত করে লাফাতে থাকা পথচারীর দিকে সবাই অবাক হয়ে তাকায়। তখনও সূর্যের আলো ভোরের স্নিগ্ধতা ভেদ করে শহর প্রাঙ্গণে ঠিকভাবে পৌঁছাতে পারেনি। রাত্রির শান্তিপূর্ণ নিদ্রাশেষে মানুষ নতুন উদ্যমে কাজের উদ্দেশ্যে মাত্র ঘর থেকে বের হয়েছিলো। তাই আচমকা এই অচেনা পথচারীর বিকট চিৎকারের শব্দে সবাই অবাক হয়ে গেলো।
অনেকেরই নিজেকে সামলে নিতে বেশ সময় লাগলো। অপ্রস্তুত জনগণ যখন রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য পথচারীর ইঙ্গিতানুযায়ী আকাশের দিকে তাকালো তখন কেউ কিছুই দেখতে পেলো না। ভোরের হালকা আলোয় কোনোকিছুই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো না। অনেকে হতাশ হয়ে পাল্টা জিজ্ঞাসা করলো, “ঐদিকে কী দেখেছো? চিৎকার করছো কেন?” পথচারী বেচারা উত্তেজনার বশে সামান্য নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলো। তাই আমতা আমতা করে বললো, “ওই যে! আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছো না? একজন মানুষ আকাশে ভাসছে। ওই যে দেখো ছোট কালো বিন্দুর মতো মানুষটাকে।”
এবার সবাই চোখ কচলে ভালো করে আকাশের দিকে তাকালো। অনেকে চোখের চশমাখানা খুলে রুমাল দিয়ে পরিষ্কার করে ফের চোখে পরে তাকালেন। বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের বিশাল টুইন টাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে সেদিন লোয়ার ম্যানহ্যাটনের সাধারণ জনতা অবলোকন করলো এক ঐতিহাসিক শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য।
প্রায় ১,৩০০ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন দুটি টাওয়ারের এক দালান থেকে আরেক দালান পর্যন্ত বাঁধা এক সরু দড়ির উপর দিব্যি পায়ে হেঁটে পাড়ি দিচ্ছেন এক দুঃসাহসী পদযাত্রী। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা কর্মজীবী মানুষগুলোর চোখে সেই মানুষটিকে সামান্য একটি বিন্দুর মতো দেখাচ্ছিলো। অনেকেই অতি উত্তেজনায় সহ্য করতে না পেরে চোখ নামিয়ে ফেললো। আর বাকিরা এক পলক তাকিয়ে থাকলো আকাশের দিকে। সেখানে মাকড়সার মতো সতর্ক পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে ফরাসী নাগরিক ফিলিপ পেতি।
পেতি পরিচিতি
“শৈশবে আমার যাত্রা শুরু হয় একজন স্বপ্রশিক্ষিত আর্টিস্ট হিসেবে। আমি সরু দড়ির উপর দিয়ে হাঁটতে পছন্দ করি। আমি কখনোই বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন দেখিনি। অবশ্যই আমি শুধু দড়ির উপর হেঁটে বিশ্বজয় করতে পারবো না। বরং একজন সার্কাসের কবি হিসেবে আমি শুধু নিজেকে উপভোগ করতে চেয়েছি। দর্শকদের সামনে নিজের স্বপ্নকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারার মন্ত্রণাই আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।”
ফিলিপ পেতিকে সবাই ‘ফরাসি ডেয়ারডেভিল’ নামে চেনে। ডিসি কমিকসের বিখ্যাত চরিত্র ‘ডেয়ারডেভিল’ এর অনুকরণে তাকে এই উপাধি প্রদান করা হয়। ১৯৪৯ সালের ১৩ আগস্ট ফ্রান্সের নেমো শহরে জন্ম নেন ‘শতাব্দীর সেরা শৈল্পিক অপরাধী’ আখ্যা পাওয়া ফিলিপ পেতি। পেতির পিতা ছিলেন ফরাসি বিমানবাহিনীর একজন গর্বিত পাইলট। তার মা ছিলেন গৃহিণী। মাত্র ৬ বছর বয়সেই পেতি জাদুবিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। জাদুবিদ্যা বা ম্যাজিক কে না ভালোবাসে?
কিন্তু পেতির এদিকে ঝোঁক ছিল ভালোবাসার চেয়েও অধিক। ধীরে ধীরে তিনি সার্কাসের বিভিন্ন কসরতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। পেতির কোমল মনে সার্কাসের নান্দনিক কসরত দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। তাই তিনি খুব দ্রুত জাদুবিদ্যার পাশাপাশি সার্কাসের কসরত আয়ত্ত করার অনুশীলন শুরু করেন। পেতির কোনো প্রশিক্ষক ছিল না। ঘরের টুকিটাকি সরঞ্জাম সাজিয়ে নিজেই স্টুডিও তৈরি করে বিভিন্ন কসরত অনুশীলন করতেন। একসময় তিনি বুঝতে পারলেন, শত শত অনুশীলনে ব্যস্ত থাকার চেয়ে একটি কসরত ভালোভাবে আয়ত্ত করা উত্তম। তাই তিনি উঁচু দড়ির উপর হেঁটে চলার কসরত আয়ত্ত করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্যারিসের রাজপথে দুটো ল্যাম্পপোস্টের মাথায় দড়ি লাগিয়ে পেতি তার প্রথম উন্মুক্ত প্রদর্শনী শুরু করেন। মুদ্রার এপিঠে পেতি এগিয়ে গেলেও, ওদিকে স্কুল কামাইয়ের কারণে তার পড়াশোনায় দিন দিন অবনতি হতে থাকে। ১৮ বছর বয়সে স্কুল কর্তৃপক্ষ পেতিকে বহিষ্কার করে দেয়। এই ঘটনায় পরিবারের সদস্যরা খুব দুঃখ পেলো। পেতি নিজেও খানিকটা হতাশ হয়ে পড়লেন। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও তিনি চারকোণা কাগজ আর কলমের মাঝে নিজের আনন্দ খুঁজে পেতে ব্যর্থ হলেন। তাই পড়াশোনা বাদ দিতে সার্কাসেই নিজের সম্পূর্ণ মনোযোগ দিলেন ফিলিপ পেতি।
টুইন টাওয়ারের হাতছানি
সদ্য পেশাদারী জীবন শুরু করা পেতি স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি সুদীর্ঘ আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের হাজার ফুট উঁচু দালানের উপর নিজের কসরত প্রদর্শন করবেন। তার এই স্বপ্ন দেখানোর পেছনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছে একটি পত্রিকা। চলুন সেই পত্রিকার গল্প পেতির নিজের মুখ থেকেই শোনা যাক,
“আমার কাছে গল্পের এই অংশটুকু রূপকথার মতো। আমি তখন ১৭ বছরের যুবক। সবেমাত্র উন্মুক্ত প্রদর্শনীতে খেলা দেখানো শুরু করেছি। তখন একবার দাঁতে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হওয়ায় আমি শহরের দাঁতের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। সেখানে সিরিয়াল ধরে অপেক্ষারত অবস্থায় পত্রিকা পড়ছিলাম। হঠাৎ পত্রিকার একটি সংবাদে আমার চোখ আটকে গেলো। যুক্তরাষ্ট্রে নাকি হাজার ফুট উচ্চতার দুটি দালান তৈরি করা হচ্ছে। তখনও দালানগুলো তৈরি করা হয়নি। কিন্তু আমি চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, দুটো দালানের মাঝে ঝুলানো সরু দড়ির উপর দিয়ে আমি বিশ্বজয়ীর বেশে দিব্যি হেঁটে যাচ্ছি। আমি তখন স্বপ্নে এতটাই বিভোর ছিলাম যে, দাঁতের ব্যথা ভুলে পত্রিকাখানা জ্যাকেটের ভেতর লুকিয়ে সোজা বাড়ি চলে আসলাম। সেদিন থেকে আমার ভাবনায় শুধু টুইন টাওয়ার।”
স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে নিয়মিত কঠোর অনুশীলন করতে থাকেন পেতি। তখন পর্যন্ত পেতি কখনো ব্যক্তিগত প্রশিক্ষকের সাহায্য নেননি। কিন্তু এবার তিনি চেক সার্কাস শিল্পী রুদি ওমানকোস্কিকে নিজের প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। রুদি নতুন করে গড়ে তুলতে থাকেন পেতিকে। তার নিবিড় তত্ত্বাবধানে স্বপ্নের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকেন পেতি। রুদি পেতিকে টুইন টাওয়ারে ব্যবহারের উপযোগী শক্ত এবং টেকসই বিভিন্ন রকমের দড়ি এবং এর পেছনে অন্তর্নিহিত বিজ্ঞান সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদান করেন।
কিন্তু প্রশিক্ষণ পর্বের পর পরই টুইন টাওয়ার জয়ে বের হওয়া বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। তাই রুদির অনুরোধে ফিলিপ পেতি প্যারিসে টুইন টাওয়ার পূর্ববর্তী মহড়া প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। ১৯৭১ সালে প্যারিসের বিখ্যাত নটরডেম ক্যাথিড্রালের সুউচ্চ টাওয়ারের মধ্যবর্তী স্থানে দড়ি সংযোজন করে নিজের কসরত প্রদর্শন করেন তিনি। ১৯৭৩ সালে পুনরায় মাঠে নামেন তিনি। সেবার অস্ট্রেলিয়ার সিডনি হার্বার ব্রিজের দুটি স্তম্ভের মাঝের দূরত্ব দড়ির উপর হেঁটে পাড়ি দেন তিনি।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, হাজার কল্পনায় আচ্ছাদিত টুইন টাওয়ার তখনও নির্মাণাধীন ছিল। পুরো দালান তৈরির কাজের সিংহভাগ শেষ হয়ে গেলেও উপর তলার বেশ কিছু অবকাঠামোর কাজ তখনও বাকি ছিল। এই সময়টাকে কাজে লাগানোর জন্য পেতি টুইন টাওয়ার সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা শুরু করেন। শুরু হয় স্বপ্নের সুপরিকল্পিত নকশা অঙ্কনের কাজ।
নিবিড় পর্যবেক্ষণ শুরু
“যে মুহূর্তে আমি লোয়ার ম্যানহ্যাটনের রাজপথে গিয়ে পৌঁছালাম, সেই মুহূর্তে বুঝতে পারলাম সেদিন পত্রিকায় যা দেখেছি তা শুধু স্বপ্ন নয়! কিন্তু সাথে সাথে আমার মনের মাঝে আশঙ্কা এসে ভর করলো। আমি এত উচ্চতায় কখনোই কসরত প্রদর্শন করিনি। চেষ্টা করতেই ভয় হচ্ছিলো। চেষ্টা করা তো দূরে থাক, প্রায় ডজন খানেক ভারী সরঞ্জাম বহন করে এই সর্বোচ্চ তলায় পৌঁছে সবকিছু ঠিক করাটাও বেশ বিপদজনক কাজ ছিল। কিন্তু আমার ভেতরে অদ্ভুত একটি অনুভূতি কাজ করছিলো। কে যেন বলছিলো, তুমি পারবেই।”
১৯৭৩ সালে ফ্রান্স ত্যাগ করে পেতি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে রওনা হন। নিউইয়র্কে পৌঁছেই কাজে লেগে গেলেন। মাঝে মাঝে পর্যটক কিংবা সাংবাদিক হিসেবে ঢুকে পড়তেন নির্মাণাধীন টুইন টাওয়ারের ভেতর। কখনো কখনো নিজেকে রাজমিস্ত্রীর সজ্জায় বদলে নিতেন। একটি অধরা স্বপ্নকে জয় করার আত্মবিশ্বাস নিয়ে টুইন টাওয়ারের প্রতিটি কোণা পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন এবং ছবি তুলতে থাকেন। ধরা পড়লে নির্ঘাত জেলের ঘানি টানতে হবে জেনেও তিনি পিছু হটেন নি।
কিন্তু একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে চরম দুর্ঘটনার শিকার হন পেতি। টুইন টাওয়ারের ছাদে হেঁটে পর্যবেক্ষণরত অবস্থায় তিনি অসতর্কতাবশর একটি পেরেকের উপর পা ফেলে বসেন। মুহূর্তের মধ্যে পেরেকখানা পেতির পায়ের তালুতে গেঁথে গেলো। মারাত্মকভাবে জখম পেতিকে তাৎক্ষণিকভাবে স্থাপনা থেকে সরিয়ে হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। এবার প্রায় ধরা পড়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু সহকর্মীদের বিচক্ষণতায় এবার রক্ষা পান তিনি। কিন্তু সামান্য জখমে দমে যাওয়ার পাত্র নন তিনি। এবার ক্রাচে ভর করে পুনরায় টুইন টাওয়ারে প্রবেশ করলেন এর দুদিন পরেই।
তবে একদিন পেতি ঠিকই ধরা পড়ে গেলেন। দক্ষিণ টাওয়ারের ৮২ তলায় অবস্থিত নিউইয়র্ক স্ট্যাট ইনস্যুরেন্সের কর্মকর্তা বেরি গ্রিনহাউস তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলতে সক্ষম হন। জনাব বেরি পেতিকে দেখেই চিনে ফেললেন। ঘটনাক্রমে তিনি প্যারিসে থাকা অবস্থায় পেতির প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন। এই ঘটনা পেতির জন্য শাপে বর হয়ে এলো। সবকিছু শোনার পর তিনি পেতিকে সাহায্য করতে চাইলেন। এর মাধ্যমে পেতি একজন গুপ্তচর পেয়ে গেলেন।
পেতি একবার বেশ মজার একটি কাজ করে বসলেন। পুরো ভবনটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে তিনি একটি হেলিকপ্টার ভাড়া করে ফেললেন। হেলিকপ্টারে উড়ে তিনি উপর থেকে টুইন টাওয়ার পর্যবেক্ষণ করলেন। সব ধরনের পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ শেষে তিনি প্রশিক্ষক রুদির সাহায্যে চূড়ান্ত পরিকল্পনা তৈরি করেন। ঠিক করা হয়, আগস্টের ৭ তারিখে তিনি সেই অবিস্মরণীয় যাত্রা শুরু করবেন। ততদিনে পেতির পায়ের জখমও সেরে উঠবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ডাক্তার।
নাটকীয় প্রস্তুতি
দেখতে দেখতে জুলাই মাস পার হয়ে আগস্ট এসে পড়লো। পেতি সহকর্মীদের দু’দলে ভাগ করে নিজ নিজ দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। প্রথম দলের দায়িত্ব ছিল উত্তর টাওয়ারের সর্বোচ্চ তলায় পৌঁছে সেখানে একটি মাছ ধরার দড়ির একাংশ বেঁধে অপর অংশ একটি তীরের মাথায় বেঁধে সেটি একটি স্বয়ংক্রিয় ধনুকের সাহায্যে দক্ষিণ টাওয়ারের ছাদে পাঠানো। আর ৪ সদস্যবিশিষ্ট দ্বিতীয় দলের দায়িত্ব ছিল পেতির নেতৃত্বে কসরতের প্রয়োজনীয় দড়ি এবং অন্যান্য সরঞ্জামসহ গোপনে দক্ষিণ টাওয়ারে গ্রিনহাউসের অফিসে পৌঁছে যাওয়া।
৬ আগস্ট সন্ধ্যার একটু পরেই দু’দল যার যার কাজে বেরিয়ে পড়ে। পেতির পরিকল্পনা অনুযায়ী, তারা একে একে সব রক্ষীর নজর এড়িয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু পেতির দলের সদস্যরা ভুল করে ৮২ তলার বদলে সরাসরি ১০৪ তলায় গিয়ে পৌঁছায়। পেতি এই ভুলের কারণে সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। ঠিক তখন ভবনের করিডোরে রক্ষীর পায়ের আওয়াজ শুনে সবাই লুকিয়ে পড়ে। তারা এতটাই ভয়ে পেয়ে গিয়েছিলো যে, সবাই সেখানে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় লুকিয়ে ছিল। শেষপর্যন্ত পেতি একটি কলমের সাহায্যে সামনের হার্ডবোর্ডের দেয়ালে সরু ছিদ্র করে রক্ষীর প্রস্থান সংবাদ নিশ্চিত করলে সবাই বেরিয়ে আসে।
খুব দ্রুত সবাই টাওয়ারের ছাদে পৌঁছে যায়। কিন্তু পেতি ছাদের উপর কোনো তীর খুঁজে পেলেন না। অথচ তার পরিকল্পনা মোতাবেক প্রথম দল অনেক পূর্বেই তীর নিক্ষেপের কাজ করার কথা ছিল। আরো ভালো করে অনুসন্ধানের পর শেষপর্যন্ত ছাদের শেষ মাথায় তীরটি খুঁজে পেলেন। পেতির বুক থেকে যেন ভারী পাথর নেমে গেলো। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
এবার তিনি বেশ মজবুতভাবে দড়ির এক মাথা সেই দড়িতে বেঁধে দিলেন। তার সংকেত পাওয়া মাত্র প্রথম দলের সদস্যরা হাত দিয়ে টেনে সেই দড়িকে অপর টাওয়ার পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। কিন্তু শুধু দুই টাওয়ারের মাথায় দড়ি বাঁধলেই চলবে না। দড়িকে কম্পন থেকে রক্ষা করতে বেশ কয়েকটি সরু তারের সংযোজন করতে হবে। তারগুলো বাঁধার সময় অসতর্কতাবশত পেতির এক সেট পোশাক ছাদ থেকে নিচে পড়ে যায়। কিন্তু পেতি সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করলেন না। যার মাথায় তখন বিশ্বজয়ের নেশা চেপে বসেছে, তার জন্য সামান্য একটি পোশাকের জন্য চিন্তিত হওয়া মানায় না।
শ্বাসরুদ্ধকর সেই মুহূর্ত
৭ আগস্ট ভোরের অপেক্ষায় থাকলেন পেতি। আর কিছুক্ষণ পরই সূর্যের প্রখর আলোয় ঝলমল করে উঠবে নিউইয়র্কের পথঘাট। আর সেই আলোয় ভাস্বর হয়ে বিজয়ী হতে হলে আজ তাকে তার সেরাটুকু দিতে হবে। প্রশিক্ষক রুদির ঠিক করে দেওয়া সময়েই পেতি তার অবিস্মরণীয় হাঁটা শুরু করেন। নিউইয়র্কের প্রথম পথচারীর নজরে পড়ার পর পরই এই সংবাদ বাতাসের বেগে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন দিক থেকে মানুষ এসে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের প্রাঙ্গনে জড়ো হতে থাকে।
প্রায় ১,৩০০ ফুট উচ্চতার ভবনের ছাদের মাথায় তখন পেতি এক পা-দু’পা করে এগিয়ে যাচ্ছেন। নিজেকে যতটা সম্ভব শান্ত রেখে তিনি দড়ির দিকে নজর দিচ্ছিলেন। যেন পৃথিবীর সাথে তার কোনো সংযোগ নেই। ওদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা দ্রুত ভবনের ছাদে উঠে আসে। নিউইয়র্ক পুলিশের বিশেষ বাহিনী প্রেরণ করা হয়। কিন্তু কেউই পেতিকে দড়ির উপর থাকা অবস্থায় কোনোরূপ দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেনি। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছিল প্রথমেই পেতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দীর্ঘ ৪৫ মিনিট পর্যন্ত পেতি প্রায় ৮ বার দড়ির উপর পদচারণা করেন। একপর্যায়ে পেতি এতটাই নিয়ন্ত্রণে ছিলেন যে, তিনি দড়ির উপর শুয়ে পড়েন। এই দৃশ্য দেখে নিচের দর্শকরা উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠেন।
শেষপর্যন্ত বিজয়ীর বেশে ফিরে আসেন পেতি। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে দক্ষিণ টাওয়ারের ছাদে প্রত্যাবর্তন করার পর তাকে পুলিশ আটক করে। লাখ লাখ জনতার মাঝ দিয়ে তিনি হাসতে হাসতে পুলিশের ভ্যানে উঠে পড়েন। সাধারণ জনতা তাকে করতালিত মাধ্যমে অভিবাদন জানাতে থাকে। তার মানসিক সুস্থতা পরীক্ষা করার পর তাকে বিচারকের মুখোমুখি হতে হয়।
এক নাটকীয় রায়ে তাকে বেশ মজাদার শাস্তি প্রদান করে মুক্তি দেওয়া হয়। তার শাস্তি ছিল, তাকে সেন্ট্রাল পার্কে শিশুদের সম্মুখে বিনামূল্যে এই কসরতটি পুনরাবৃত্তি করতে হবে। পেতি বেশ উৎসাহ নিয়ে এই শাস্তি মাথা পেতে নিলেন।
অতঃপর পেতি
মুক্তিলাভের পর ফিলিপ পেতি রাতারাতি জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। জীবনের পরবর্তী সময়টা তিনি লিংকন সেন্টার, বিভিন্ন শিশু পার্কসহ বিনোদনমূলক স্থাপনায় কসরত প্রদর্শন করে দিন কাটাতে থাকেন। বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের বিখ্যাত টুইন টাওয়ারে তাকে আজীবন প্রবেশাধিকার প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে পেতির এই অর্জনকে স্মরণীয় করে রাখতে পরিচালক রবার্ট জেমেকিস ‘দ্য ওয়াক’ নামে হলিউডে একটি সিনেমা তৈরি করেন।
২০১৫ সালের বিশ্বজুড়ে মুক্তি পায় ফিলিপ পেতির জীবনীমূলক চলচ্চিত্রটি। এর মাধ্যমে পুরো বিশ্ববাসীর নিকট নতুনরূপে প্রকাশিত হয় সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। বর্তমানে ফিলিপ পেতি কেটস্কিল শহরে নিজের পরিবারের সাথে বসবাস করছেন। অবসর সময়ে তিনি সেইন্ট জন গির্জায় বিভিন্ন কসরত প্রদর্শন করে সবার মাঝে আনন্দ বিলিয়ে দেন।
২০০১ সালে ফিলিপ পেতির স্মৃতিবিজড়িত টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়ে যায়। মাটির সাথে মিশে যায় সেই ভবনের ছাদগুলো। কিন্তু ফিলিপ পেতি আজও স্মৃতিচারণ করেন। তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন তার সহকর্মীদের। তিনি তার অর্জন নিয়ে গর্বিত। ফিলিপ পেতির মতো অন্যরকম বিজয়ী আমাদের নতুন করে সবকিছু অর্জন করতে শিক্ষা দেয়। Man on Wire নামক প্রামাণ্যচিত্রে তিনি বলেন,
“জীবনে কোনো ‘কেন’র স্থান নেই। আমার কাছে সবকিছু একদম সরল। জীবনকে উপভোগ না করতে পারলে, জীবনটা অপচয় হয়। তোমাকে অবশ্যই বিদ্রোহ করতে হবে। নিজের প্রতিবন্ধতাকে ভেঙে ফেলতে হবে। প্রতিটি সিদ্ধান্তকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে। প্রতিটি স্বপ্নকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে। আর তাহলেই তুমি দড়ির উপর সাবলীলভাবে হেঁটে বেড়াতে পারবে। তখন কঠিন জীবনকেও সহজ মনে হবে।”
ফিচার ইমেজ: Star Tribune