ক্যাম্পের তাঁবুতে আলো আঁধারি। বাতাসে যেন কেউ বরফের গুড়ো মিশিয়ে রেখেছে। একটা বাচ্চা মেয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে কাঁপছে শুয়ে। শীতে ঠোঁট ফেটেছে আগেই। মুখের রং ফ্যাকাসে। জ্বর কখনো ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট, আবার কখনো ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট। কেউ একজন ঝুঁকে পড়ে বলল, “পূর্ণা, আবার আসা যাবে। এবারের মতো ফিরে চলো!” গলা থেকে আওয়াজ বের করতেও কষ্ট হচ্ছিল মেয়েটার, তবু বলল, “না আমি যাব, এই অভিযান আমাকে শেষ করতেই হবে।”
পূর্ণা মালাওয়াত, তেলেঙ্গানার নিজামাবাদ জেলার অপরিচিত এক গ্রাম পাকালার বাসিন্দা। এই গ্রাম ভারতের অন্যান্য প্রত্যন্ত গ্রামের মতোই সুবিধাবঞ্চিত। ৯-১০ বছরের মেয়েদের ধরে বেঁধে বিয়ে দেওয়া হয় বাড়ি থেকে। বছর ঘুরতেই বাচ্চা হয় তাদের। মা ও শিশু মৃত্যুহার সেখানে আকাশছোঁয়া। এই পরিবেশেই বেড়ে উঠেছে পূর্ণা। আশেপাশের লোকজন বার বার তার বাবা-মাকে কথা শোনাত, অনেক তো বয়স হলো, আর কত পড়ালেখা করবে মেয়ে? ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিলেই ঝামেলা চুকে যায়। কিন্তু পূর্ণা যেন ভাগ্য নিয়ে জন্মেছিল। তার বাবা-মা কিংবা বড় ভাই কেউই তার বিয়ে দেওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করেনি। বরং কীভাবে পূর্ণা ভালো করে লেখাপড়া করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখেছে।
পূর্ণার স্কুলের এক শিক্ষক মেয়েদেরকে ক্লাসে ঢুকতে দিতেন না। স্কুলে মেয়ে ভর্তি হতো খুব কম। যারা ভর্তি হতো তারাও বিয়ে করে স্কুল ছেড়ে চলে যেত। পূর্ণাকে উন্নত লেখাপড়া আর থাকার ব্যবস্থার জন্য পাঠানো হলো তেলেঙ্গানা সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার রেসিডেন্সিয়াল এডুকেশনাল ইনস্টিটিউশন্স সোসাইটিতে। সেখানে গিয়ে প্রথমবারের মতো পূর্ণা ভলিবল বা কাবাডির মতো খেলার সাথে পরিচিত হলো।
তার ক্রীড়ানৈপুণ্যে তাক লেগে গেল শিক্ষকদের। সেজন্যই হয়তো সবার মাঝে বেশি করে চোখে পড়তে লাগল সে। সোসাইটির সেক্রেটারি প্রবীণ কুমার দেখলেন পূর্ণাকে। বুঝেছিলেন এই মেয়ের স্থান আরো উপরে, হয়তো সেটা পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। পূর্ণা উঠে এসেছে তেলেঙ্গানার অবহেলিত এক আদিবাসী গ্রাম থেকে, যেখানে খেলাধুলা তো দূরের কথা, দু’বেলা মুখে খাবার জোগাতে হিমশিম খেতে হয়। পূর্ণার পরিবারের মাসিক আয় তিন হাজার টাকার মতো। তার ছোট্ট জীবনে সে পর্বতারোহণের নামও শোনেনি। কখনো হয়তো ভাবেওনি সে-ই হবে সর্বকনিষ্ঠা এভারেস্টজয়ী?
একজন আইপিএস প্রবীণ কুমার
প্রবীণ কুমার স্মৃতি হাতড়ান এভাবে,
“গ্রামের শেষ মাথার বাড়িটা আমাদের। বাবা অংকের খুব ভালো শিক্ষক ছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল দলিত ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেবেন। কিন্তু ভাড়া বাসাটা ছাড়ার নোটিশ দিয়ে দিলো বাড়িওয়ালা। দলিত শিশু হয়ে জন্মানো খুবই কষ্টের। ছোটবেলার কিছু স্মৃতি এখনো আমাকে পীড়া দেয়। বাসায় বিদ্যুৎ এসেছিল আমি যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি।”
এত দারিদ্র আর বৈষম্য দেখে বড় হয়ে তিনি পেয়েছিলেন আইপিএসের সম্মান। দেখেছেন অনেক দরিদ্র মেধাবী লোক আস্তাকুঁড়ে চলে যাচ্ছে সঠিক শিক্ষার অভাবে। প্রবীণ স্নাতকোত্তর পড়েছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২২ বছরের পুলিশি জীবন ছেড়ে মুখ্য মন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছিলেন যেন আবারো তাকে পাঠানো হয় অবহেলিত কোনো স্থানে। তাকে পূর্ণাদের স্কুলের সেক্রেটারি করে পাঠানো হল।
শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে থাকা-খাওয়া আর পড়ালেখার কথা বললেও এখানে এসে বাস্তবতা উপলব্ধি করলেন তিনি। খাবার জঘন্য, বাচ্চাদের সাথে দাসের মতো আচরণ করা হয়, শিক্ষকেরা কোনোমতে দায় সারতে পড়ান। প্রথম ছয় মাস তিনি শিক্ষার্থীদের সাথে থাকলেন, খাওয়াদাওয়া করলেন। ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হয়। এরই কোনো সময়ে এখানেই তিনি আবিষ্কার করেছিলেন পূর্ণাকে।
পূর্ণার এভারেস্ট অভিযান
শতাধিক শিক্ষার্থী থেকে পূর্ণাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল রক ক্লাইম্বিং প্রশিক্ষণের জন্য। বিখ্যাত রকে অনায়াসেই উঠে গিয়েছিল পূর্ণা। কিন্তু নামার জন্য নিচে তাকাতেই তার ভয় লাগলো। এটা তার প্রথম ভয়, কিন্তু এই ভয় তাকে থামিয়ে দিতে পারেনি। রকে কৃতিত্ব দেখানোর পর পূর্ণাকে আরো ভালো প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য দার্জিলিং পাঠানো হলো। সেখানে সে শিখেছিল কীভাবে বরফ আর তুষারে ঢাকা পর্বতে টিকে থাকতে হয়।
প্রশিক্ষক শেখর বাবু (২০০৭ সালে এভারেস্ট জয়ী) প্রথম পূর্ণাকে এভারেস্টের কিছু ভিডিও দেখান। এর আগে সে এভারেস্ট সম্পর্কে কিছুই জানতো না। কাবাডি ভলিবল খেলার কারণে পাহাড়ে ওঠার মতো দৈহিক সক্ষমতা ছিল তার। তিন মাস অনবরত হাঁটা, দৌড়, যোগব্যায়াম আর মানসিক প্রস্তুতি নিল। এভারেস্টে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে লাদাখ আর দার্জিলিংয়ের পাহাড়গুলোতে চলেছে পর্বতারোহণের শেখা বিদ্যাগুলোর ঝালাই। এবার পালা সেই মহান চূড়া অভিযানের।
পূর্ণার সাথী হলো ১৭ বছরের আরেক নতুন পর্বতারোহী আনন্দ কুমার। এভারেস্টের দুটি রাস্তা আছে। একটি নেপালের ভেতর আরেকটি তিব্বতে। তিব্বত চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন। নেপালের দিকটায় এভারেস্ট অভিযাত্রীদের জন্য একটা কড়া নিয়ম হলো, অবশ্যই বয়স ১৬ কিংবা তার বেশি হতে হবে। অগত্যা তিব্বতের দিক দিয়েই যেতে হলো পূর্ণার দলকে। বেস ক্যাম্পে বসে পূর্ণারা যখন হিমশীতল প্রকৃতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল, তখন খবর এল, নেপালের দিকটায় তুষারধ্বসে ১৭ জন শেরপা মারা গেছেন। পূর্ণা আর আনন্দকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তারা ফিরতে চায় কিনা। পূর্ণা বলেছিল, “আমাদের জন্য পিছিয়ে যাওয়া বলে কিছু নেই, আকাশটা আমাদের সীমা, ওটাই লক্ষ্য!”
১১০০০ ফুট উপরে সে দেখেছিল ছয়জন পর্বতারোহীর মৃতদেহ। মহান পর্বতের হিমশীতল উচ্চতায় লীন হয়েছে তাদের পর্বতের প্রতি ভালোবাসা। ভয় পেয়েছিল বটে, কিন্তু আকাশটাই যে তার সীমা! চূড়ায় পৌঁছানোর একদিন আগে পূর্ণা জ্বরে পড়ে। তবুও না দমে গিয়ে এই অবহেলিত আদিবাসী, ১৩ বছর ১১ মাস বয়সে এভারেস্টের চূড়ায় ভারতের, তেলেঙ্গানার, আর তার সংস্থার পতাকা ওড়িয়েছিল।
এভারেস্ট বিজয়ের পর পূর্ণা পুরো ভারত ঘুরেছে, সাক্ষাৎ করেছে প্রধাণমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে, ইউরোপের সর্বোচ্চ চূড়া এলব্রুস জয় করেছে। তার অভিযান নিয়ে চলচ্চিত্রও তৈরি হয়েছে বলিউডে। সে চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিল রাহুল বোস। তবে চলচ্চিত্রটিতে কিছু বিষয় আছে কাল্পনিক। যেমন পূর্ণার এক চাচাতো বোন থাকে যাকে পূর্ণার পরিবার জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়। বাস্তবে পূর্ণার চাচার কোনো মেয়েই নেই। দেখানো হয়েছে পূর্ণার বাবা-মাও চাইতো পূর্ণার বিয়ে হয়ে যাক। কিন্তু বাস্তবতা ছিল অন্যরকম। মূলত চলচ্চিত্রে একটি অবহেলিত সমাজের চিত্র তুলে ধরার জন্য এসব ঘটনা আনতে হয়েছে।
পূর্ণা পর্বতারোহণ বেছে নিয়েছিল, কারণ পুরুষতান্ত্রিক ভারতে এখনো মেয়েদের ছোট করে দেখা হয়। তার উপর সে একজন আদিবাসী। সে প্রমাণ করতে চেয়েছিল মেয়েরা চাইলে সবকিছু করতে পারে। এখন পর্বতারোহণ ছেড়ে লেখাপড়ায় মন দিয়েছে সে। স্নাতক শেষে কিলিমানজারো, কেটু বিজয়ের স্বপ্ন তার। ইচ্ছে প্রবীণ কুমারের মতো আইপিএস অফিসার হওয়ার। তারপর ফিরে এসে অবহেলিত মানুষদের জন্য কাজ করবে। আর পর্বতারোহণ? সেটা এমন একটা জিনিস যা পূর্ণা আজীবন ছাড়তে পারবে না।
ফিচার ইমেজ: Makers