১৪ মার্চ, ২০১৮; অসংখ্য ভক্তের মন খারাপ করে দিয়ে চলে গেলেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ স্টিফেন উইলিয়াম হকিং। পৃথিবীর অন্যতম সেরা এই পদার্থবিদ তার কাজ এবং সাফল্যের জন্য সবসময়ই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। হকিংয়ের জীবন নিয়ে এ যাবৎ প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য লেখা, নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। তার বৈচিত্র্যময় জীবনের বিভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে সেসব লেখায়। পাশাপাশি কিছু বৈচিত্র্যপূর্ণ তথ্য থেকে গিয়েছে আলোচনার বাইরে। সেসব আলোচনার বাইরে থাকা কিংবা কম আলোচিত হওয়া বিষয়গুলো নিয়ে আজকের আয়োজন।
মহাশূন্য ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
৬৫ বছর বয়সে স্টিফেন হকিং জিরো গ্র্যাভিটি অনুভবের জন্য বিশেষায়িত এক বিমানে চড়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের জিরো গ্র্যাভিটি কর্পোরেশনের বিশেষায়িত বিমানে এমন সুবিধা রয়েছে যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে যেকেউ চাইলেই পৃথিবীতে থেকেই মহাশূন্যে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিতে পারে। এই ফ্লাইট অল্প সময়ের জন্য কয়েকটি স্তরে অভিকর্ষবিহীন পরিবেশ তৈরি করে। এটি ঠিক মহাশূন্যে ভ্রমণের মতোই। তবে স্টিফেন হকিং যে শখের বশে এই ভ্রমণ করেছেন, তা কিন্তু নয়। মহাশূন্য সম্পর্কে মানুষকে আরো বেশি উৎসাহী করাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, “ভবিষ্যতে হয়তো পৃথিবীর বাইরে মানুষের জন্য একটি বিকল্প ধারার আবাসন তৈরি করার প্রয়োজন হতে পারে।”
এই ভ্রমণের মাধ্যমে তিনি মহাকাশ সম্পর্কে কাজ করা বিজ্ঞানীদের আরো বেশি করে অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছিলেন। পাশাপাশি মহাকাশ সম্পর্কে মানুষের মনের ভ্রান্ত ধারণাগুলো দূর করার মাধ্যমে মহাকাশ সম্পর্কে সবাইকে আরো বেশি করে উৎসাহী করে তুলতে চেয়েছিলেন।
হকিং এলিয়েনের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন
স্টিফেন হকিং ভিনগ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণী এলিয়েনের অস্তিত্ব কখনোই অস্বীকার করেননি। ২০০৮ সালে নাসার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে হকিংকে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। Why We Should Go Into Space শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে হকিং বেশ শক্ত তথ্য-উপাত্তসহ বলেন-
“পৃথিবীর বাইরে কোনো এলিয়েন সম্প্রদায় থাকাটা একদমই অসম্ভব কিছু নয়। দেখুন, এই মহাবিশ্বের ব্যাপকতা আসলে আমাদের ধারণার বাইরে। আমরা মহাবিশ্বকে যতটা বড় ভাবি, এটি আসলে তার থেকেও হাজার হাজার গুণ বড়। মহাবিশ্বের অনেক অংশ সম্পর্কে আমাদের আদৌ কোনো ধারণাই নেই। কাজেই পৃথিবীর বাইরে যেকোনো বর্বর অথবা মানুষের চেয়েও বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো প্রাণী বা সম্প্রদায় নেই, একথা আমরা বলতে পারি না।
তিনি এক শিশুতোষ বইয়ের লেখক
হকিংয়ের আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য- তিনি একটি শিশুতোষ ফিকশনের লেখক! তার কন্যা লুসি হকিংকে সাথে নিয়ে লিখেছিলেন জর্জ’স সিক্রেট কী টু দ্য ইউনিভার্স নামের এক কিশোর সায়েন্স ফিকশন। ২০০৭ সালে প্রকাশিত এই বইয়ের কাহিনী জর্জ নামক এক প্রযুক্তিপ্রেমী কিশোরকে নিয়ে। সেই কিশোরের প্রযুক্তির নানা বিষয়ে ছিল প্রবল আগ্রহ। কিন্তু জর্জের মা-বাবা চান না, সে প্রযুক্তির পেছনে সময় নষ্ট করুক। হার না মানা জর্জের হঠাৎ করেই বন্ধুত্ব হয় এক বিশেষ কম্পিউটারের সাথে। কম্পিউটারটি পৃথিবীর সেরা কম্পিউটার। পৃথিবী ও মহাকাশের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার এক বিশেষ ক্ষমতা আছে এর।
একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে তিনি এই বইটি লিখেছিলেন। তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল, পদার্থবিদ্যার জটিল বিষয়গুলো, বিশেষ করে কৃষ্ণবিবর এবং সৃষ্টিতত্ত্বের মতো কঠিন বিষয়গুলো, খুব সহজভাবে কিশোরদের সামনে উপস্থাপন করা। বইটির দ্বিতীয় কিস্তি ২০০৯ সালে George’s Cosmic Treasure Hunt নামে প্রকাশিত হয়।
অসংখ্য সম্মাননা-স্বীকৃতি পেলেও নোবেল পুরষ্কার ছিল অধরা
পদার্থবিদ্যার মহান এই দিকপাল জীবনে প্রচুর স্বীকৃতি, পুরস্কার এবং সম্মাননা অর্জন করেছেন। তার পরিধি এতই বিশাল যে, অল্প পরিসরে তা বর্ণনা করা একটু মুশকিলই বটে। তার পাওয়া স্বীকৃতি এবং সম্মাননার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
- লন্ডনের রয়েল সোসাইটি’র ফেলোশিপ (১৯৭৪)।
- বিজ্ঞানে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৭৫ সালে ষষ্ঠ পোপ পলের হাতে রজার পেনরোজ পদক।
- রয়েল সোসাইটি থেকে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন পুরস্কার এবং হিউজেজ পদক।
- ১৯৭৯ সালে পরবর্তী ৩০ বছরের জন্য কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান অধ্যাপকের পদ অর্জন। উল্লেখ্য, স্যার আইজ্যাক নিউটন ১৬৬৩ সালে এই পদে অভিষিক্ত হয়েছিলেন।
- আশির দশকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কমান্ডার নাইট উপাধি।
- জাতীয় সেবায় অবদানের জন্য কম্প্যানিয়ন অব অনার উপাধি।
- ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার থেকে সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব।
- ১২টিরও বেশি সম্মাননাসূচক ডিগ্রি।
কিন্তু এই মহান পদার্থবিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পাননি। এটি তার জন্য দুর্ভাগ্যই বলতে হবে।
বাজিতে হেরে গিয়েছিলেন হকিং
জীবনে একবার বাজিতে হেরে গিয়েছিলেন তিনি। তা-ও আবার তার প্রিয় বিষয় কৃষ্ণবিবর নিয়ে। ১৯৯৭ সালে হকিং কৃষ্ণবিবরের সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে আরেক পদার্থবিজ্ঞানী জন প্রেস্কিলের সাথে রীতিমতো বাজিই ধরে বসেন। কৃষ্ণ বিবরের উত্থান এবং এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে স্টিফেন যে ধারণা দেন তার সাথে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করেন তারই বন্ধুপ্রতিম তাত্ত্বিক পদার্থবিদ জন প্রেস্কিল। পরবর্তীতে এই দুই পদার্থবিদ পরস্পরের প্রতি একরকম বাজিই ছুঁড়ে দেন। পরবর্তীতে ২০০৪ সালের দিকে এক সেমিনারে তার তত্ত্বের ত্রুটি স্বীকার করে নেন হকিং। বাজিতে যে তিনি হেরেছেন, বিষয়টি তিনি অকপটে স্বীকার করেন।
ডাক্তাররা তাকে মাত্র কয়েক বছরের আয়ু বেঁধে দেন
হকিংয়ের বয়স তখন সবেমাত্র ২১। বড়দিনের ছুটিতে বাসায় এসেছেন। এক পার্টিতে জেইন ওয়াইল্ড নামের এক মেয়েকে (পরবর্তীতে হকিংয়ের সহধর্মিণী) হঠাৎ ভালো লেগে গেল তার। তারই কিছু দিন পরে অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। দুই সপ্তাহের মেডিকেল টেস্ট শেষে ধরা পড়লো, তিনি খুবই জটিল এক স্নায়ুতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত। ডাক্তাররা তাকে মাত্র দুই বছরের আয়ু বেঁধে দেন। কিন্তু ডাক্তারদেরকে ভুল প্রমাণ করে তিনি বেঁচেছেন অনেক দিন। খুবই জটিল ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে বেঁচে থেকে নিরলস কাজ করেছেন বিজ্ঞানের কল্যাণে।
স্কুলে ছিলেন সাধারণ মানের ছাত্র
ছোটবেলায় স্কুলের পরীক্ষায় তিনি কখনো খুব ভালো ফল করতে পারেননি। পরীক্ষায় পাওয়া তার নম্বর ছিল বরাবরই মাঝারি মানের। কিন্তু তার যে মেধার কোনো কমতি ছিল না সেই বিষয়টি তার স্কুলের শিক্ষকরাও বেশ ভালোভাবে টের পেয়েছিলেন। ভবিষ্যতে তিনি যে খুব নামকরা কেউ হবেন, বিষয়টি নিয়ে তারা বেশ আশাবাদীই ছিলেন। ছেলেবেলায় তাকে ‘আইনস্টাইন’ নামে ডাকা হতো। সাধারণ গ্রেড থাকা সত্ত্বেও তার বাবার ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখিয়ে তিনি অক্সফোর্ডে পড়ার জন্য চেষ্টা করেছিলেন, এবং নির্বাচনী পরীক্ষায় উতরেও যান।
থেকেছেন অক্সফোর্ডের নৌ চালনা দলে
ছেলেবেলায় স্টিফেন হকিং প্রায়ই বিষণ্ণতায় ভুগতেন। জীবনীকার ক্রিস্টিন লারসেনের লেখা অনুসারে, স্কুলে হকিংয়ের খুব একটা বন্ধুবান্ধব ছিল না। এমনকি অক্সফোর্ডে ১ম বর্ষে থাকাকালীন তিনি প্রচণ্ড একাকীত্বে ভুগতেন। এই অসুখী অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৌ-চালনা দলে যোগ দিয়েছিলেন। শারিরিকভাবে দুর্বল হওয়ার কারণে তিনি দাঁড় টানতে পারতেন না। তার কাজ ছিল রশি ধরে থাকা। দলে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি। সবাই তাকে ‘সাহসী’ বলে সম্বোধন করতো।
জীববিদ্যা একদমই পছন্দ করতেন না
ছেলেবেলা থেকে হকিং গণিত খুবই ভালোবাসতেন। তবে তার বাবা চেয়েছিলেন হকিং মেডিসিনে পড়াশোনা করুক। তিনি কিন্তু কখনোই জীববিদ্যাকে খুব একটা ভালো নজরে দেখতেন না। প্রবল ইচ্ছে থাকলেও অক্সফোর্ডে তখন গণিত মূল বিষয় হিসেবে না থাকার কারণে তিনি মেজর হিসেবে পদার্থবিদ্যাকেই বেছে নেন। জীববিদ্যার প্রতি তার নজর ছিল এমন- “Too inexact, too descriptive”
ফিচার ইমেজ- The Week UK