জগৎজোড়া বিখ্যাত এক তাত্ত্বিক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং। তার জীবন বেশ ব্যতিক্রম আঙ্গিকে কেটেছে। ডাক্তার সময়ের ফ্রেম বেধে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন তার বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কিন্তু স্টিফেন হকিং সবার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে বেঁচে ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তার কেবলমাত্র মস্তিষ্ক কাজে লাগিয়ে একের পর এক তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ধারণা দিয়ে গেছেন। লিখেছেন জনপ্রিয় সব বই। সাবমেরিনে চেপে সাগরতলে গিয়েছেন, অনুভব করেছেন মহাশূন্যের ওজনশূন্যতা, উপস্থাপনা করেছেন প্যারা অলিম্পিকের মতো আসরের। তার লিখিত বই ‘ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম‘ প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি বিজ্ঞানমহলের বাইরেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। আন্তর্জাতিকভাবে বেস্ট সেলার হিসেবে বইটির কোটি কপি বিক্রি হয়। তাকে নিয়ে রচিত হয়েছে গ্রন্থ, তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র। মোটর নিউরন রোগে তার পুরো শরীর পক্ষপাতগ্রস্ত হয়ে যায়। এরপর তিনি যেভাবে বিজ্ঞানজগতে রাজত্ব করে গেলেন, তা আসলেই এক বিস্ময়। স্টিফেন হকিংয়ের আরেকটি বই ‘মাই ব্রিফ হিস্ট্রি‘। এই আত্মস্মৃতির গ্রন্থে তিনি নিজে তার বেড়ে ওঠা, শৈশব, বিয়ে, সন্তান, এবং শেষবেলা সম্পর্কে বলে গেছেন।
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে- ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং আত্মস্মৃতি বলার ফাঁকে ফাঁকে আমাদের পদার্থবিজ্ঞানও পড়িয়েছেন। বইটির কলেবরে বিজ্ঞানীর জীবনের সাথে জড়িয়ে যাওয়া মহাবিস্ফোরণ, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ, কৃষ্ণগহবরের মতো বিষয়গুলো সহজাতভাবে উঠে এসেছে। আত্মস্মৃতিমূলক গ্রন্থ ‘মাই ব্রিফ হিস্ট্রি’ বাংলা ভাষার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন বিজ্ঞানকর্মী ও উদ্যোক্তা জাহাঙ্গীর সুর। ২০১৯ সালে বইটি ‘দেশ পাবলিকেশন্স’ থেকে প্রকাশিত হয়। অনুবাদক বইটির একটি সুন্দর নাম দিয়েছেন- ‘আমার এই ছোট্ট জীবন’। অনুবাদগ্রন্থে সাধারণত মূল লেখকের ধারা বর্ণনা করা হয়। কিন্তু অনুবাদ যে ভাষায় করা হয় তখন সেটা সেই ভাষার সম্পদ হয়ে যায়। অনুবাদের নিজস্ব কিছু ক্ষমতা থাকে। জাহাঙ্গীর সুর স্টিফেন হকিংয়ের আত্মস্মৃতিতে প্রবেশের পূর্বে ‘হকিং কি নোবেলবঞ্চিত’ শিরোনামে একটি ছোট প্রবন্ধ জুড়ে দিয়েছেন। এটি আমাদের অনুসন্ধিৎসু মনে একটু হলেও আঁচড় কাটবে।
‘আমার এই ছোট্ট জীবন’ বইটি ১৩টি অধ্যায়ে বিভক্ত। স্টিফেন হকিং তার এই গ্রন্থটি শৈশবের কাহিনি দিয়ে শুরু করেন। ঘটনাপ্রবাহে এরপর আসে সেন্ট আলবান্স, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, ক্যালটেকের জীবন এবং সীমানাহীন নামক অধ্যায়। তার স্মৃতির সাথে মিশেছে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ, মহাবিস্ফোরণ, কৃষ্ণগহবর, সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, সময় পরিভ্রমণ ও কাল্পনিক সময়ের মতো অধ্যায়। মহাকাশ ও সময় পরিভ্রমণ নিয়ে যদি পাঠকের কৌতূহল থাকে, তাহলে তার কাছে এই বিষয়গুলো কাঠখোট্টা মনে হবে না।
বই বা লিখিত কোনো তথ্য সেই সময় ধারণ করে রাখে। এভাবেই লিখিত ইতিহাস প্রজন্ম থেকে পৌঁছায় পরবর্তী প্রজন্মে। স্টিফেন হকিংয়ের সময় দেখা যায়- তার বাবা-মা সন্তান লালনপালনের জন্য বই পড়ছেন, গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো ছবি তুলে রাখছেন, সন্তানের পড়শোনার জন্য স্কুল বাছাই করছেন। আমরা এই একুশ শতকের বাংলাদেশে যা বেশি সংখ্যায় সবেমাত্র শুরু হতে দেখছি। হকিংয়ের বাবা-মায়ের বাস ছিল লন্ডনে, কিন্তু তার জন্ম অক্সফোর্ডে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি কথা দিয়েছিল কেমব্রিজে তারা বোমাবর্ষণ করবে না। বিনিময়ে ব্রিটিশরা কথা দিয়েছিল তারা হাইডেলবার্গ ও গটিনজেনে বোমা ফেলবে না। ফলে নিরাপদ স্থান ভেবেই তার বাবা-মা তখন কেমব্রিজে বসবাস করতেন।
স্টিফেন হকিং অনেকটা রাখ-ঢাকহীনভাবে তার বেড়ে ওঠার বর্ণনা দিয়েছেন। আত্মস্মৃতিতে তিনি তার পরিবারের সুখ-দুঃখ সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এক জায়গায় তিনি তার বাবার সম্পর্কে লিখেছেন,
টাকা বাঁচানোই তার কাছে বড় ব্যাপার ছিল; কে কী বললো, কে কী ভাবল- এ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তিনি যখন তরুণ ছিলেন, তখন তার পরিবার খুবই দরিদ্র ছিল। এই সত্য তার সারাজীবনে দীর্ঘস্থায়ী এক ছাপ রেখে গিয়েছিল। ছোটবেলায় নিজের আনন্দের জন্য অর্থ খরচ করার কথা ভাবতেই পারতেন না। এমনকি পরে যখন আর্থিক সামর্থ্য আসলো, তখনও তার এই স্বভাব বদলায়নি।
আত্মস্মৃতি সাধারণত একটি গতিপ্রবাহের মতো চলতে থাকে। লেখকের সাথে সাথে পাঠকও সেই প্রবাহের অলিতে-গলিতে মিশে একাকার হয়। স্টিফেন হকিংয়ের পুরো পরিবার কিছুদিনের জন্য ভারতে এসেছিলেন। কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিলেন। কিন্তু আফসোস, ভারত ভ্রমণ নিয়ে তার গল্পের স্রোত বেশি দূর এগোয়নি। তার একটি কথা পাঠকদের মনে অবশ্যই দাগ কাটবে,
আপনি কোন স্কুলে পড়তেন কিংবা আপনি কোথা থেকে এসেছেন— পদার্থবিজ্ঞানে এসবের কোনো মানে নেই। এখানে মুখ্য একটাই— আপনি ঠিক কী করছেন।
এ কথাটি শুধুমাত্র পদার্থবিজ্ঞানেই নয়, মানবজীবনের ক্ষেত্রেও সমান সত্য। হয়তো সত্যগুলো অনুধাবন করতে পেরেছেন বলেই তিনি স্টিফেন হকিং হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। কেমব্রিজে পড়ার সময় তিনি বুঝতে পারেন যে, মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত তিনি, শুরু হয় অন্যজীবন। এই জীবনযুদ্ধে তিনি হার মানেননি। একসময় যুক্তরাজ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালটেকে চলে যান। ইতিমধ্যে তার হুইলচেয়ার জীবনের চার বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায়।
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কখনো তার গবেষণায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। একসময় স্যার আইজ্যাক নিউটন ও পল ডিরাকের মতো বিজ্ঞানীদের উত্তরসূরি হিসেবে গণিতের লুকাসিয়ান প্রফেসর নির্বাচিত হন। তিনি যে হুইল চেয়ারে বসতেন এবং যে ভয়েস-সিন্থেসাইজারের সাহায্যে কথা বলতেন, সেই বিষয়েও লিখেছেন। লিখেছেন কীভাবে তিনি বই ও গবেষণাপত্র রচনা করেছেন। প্রথম সংসারের টানাপোড়েন, বিচ্ছেদ এবং দ্বিতীয় বিয়ে, সন্তান, মোটর নিউরন রোগ, গবেষণা, তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘আমার এই ছোট্ট জীবন’। এই সীমিত জীবনে স্টিফেন হকিং সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছেন সাতবার, জাপানে গিয়েছেন ছয়বার, চীনে গিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়া বাদে প্রতিটি মহাদেশে গিয়েছেন। শুধু একাগ্রতা, অদম্য চিন্তাশক্তির কারণে তা সম্ভব হয়েছে। যুগে যুগে পৃথিবীর মানুষের কাছেই তিনি উদাহরণ হয়ে থাকবেন।
পদার্থবিদ্যা
স্টিফেন হকিংয়ের বইটিতে ছোট ছোট প্রবন্ধ আকারে তার জীবন সংগ্রামের সাথে পদার্থবিদ্যাও উঠে এসেছে। বই একজন মানুষের চিন্তাজগতের আমূল পরিবর্তন আনতে পারে। সাহিত্যপ্রেমী কোনো মানুষকে এই বই বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলতে পারে। কারণ, এতে পদার্থবিদ্যার কিছু লোভনীয় বিষয়ের আলোচনা রয়েছে, যেমন-টাইম মেশিন। এ যুগের বহু চর্চিত একটি বিষয়। সত্যিই কি সময় পরিভ্রমণ সম্ভব? বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এই বিষয়ের উপর একটি প্রবন্ধ লিখে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সভ্যতা যত উন্নত হোক না কেন, সম্ভবত তাদের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ হয়তো মহাবিশ্বের একটি সসীম অংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।’ মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে ব্যাখ্যা করেছেন একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে। অনুবাদক তার নিজস্ব ঢঙে আলাদাভাবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ-জ্যোতির্বিদ্যা ব্যাখ্যা করেছেন। বলেছেন কীভাবে লাইগো (লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজারভেটরি) মহাকর্ষীয় ঢেউকে শনাক্ত করেছিল। মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বটি বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংকে পুরো পৃথিবীতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। যদিও তথ্যটির প্রথম প্রবক্তা বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী জর্জ ল্যামেটার, কিন্তু ‘বিগ ব্যাং’ শব্দটির সাথে আমরা স্টিফেন হকিংকেই বেশি পাই। মহাকর্ষ তত্ত্ব, সৃষ্টি তত্ত্ব, কোয়ান্টাম তত্ত্বের মতো বিষয়গুলো তিনি জীবিত অবস্থায় খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন। এই বইয়ের আরেকটি বিষয় হলো কৃষ্ণগহবর। মহাবিশ্বের এক রহস্যময়ী বিষয়। স্টিফেন হকিং আবিষ্কার করলেন কৃষ্ণগহবর থেকেও নিঃসরণ হতে পারে। লিখলেন কাল্পনিক সময় নিয়েও। পাঠক হিসেবে আপনি যদি বিজ্ঞানের বিষয়গুলো একটু মনোযোগ ও সময় নিয়ে পড়েন তাহলে উপকৃত হবেন।
জাহাঙ্গীর সুর স্বাভাবিক ও মননশীল অনুবাদ করেছেন। বিজ্ঞানের বিষয়গুলো বুঝতে খুব বেশি একটা বেগ পেতে হয়নি। তবু কিছু বিষয়— যেমন, তিনি অনুবাদে টাইম মেশিনের বাংলা করেছেন ‘সময় কল’। এন্ট্রপির বাংলা করেছেন ‘বিশৃঙ্খলা’। বিজ্ঞানের এসব পরিভাষা ঠিক রেখে অনুবাদ এগিয়ে নিলে হয়তো বুঝতে আরো সুবিধা হতো। সর্বোপরি বিবেচনায় অনুবাদ ছিল সাবলীল, ছিল স্বকীয়তা।
স্টিফেন হকিং জীবিত সকলের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন। এরকম অদম্য মানুষ পৃথিবীতে ছিলেন বলেই হয়তো পিছিয়ে পড়া মানুষজন আশা সঞ্চার করে আবার জেগে ওঠে। স্টিফেন হকিং নিজেই বলেছেন,
মাত্র ২১ বছর বয়সে আমি মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত হয়েছিলাম। তখন মনে হয়েছিল, এটা একটা বড় ধরনের অবিচার। কেন এটা আমার জীবনেই ঘটবে? সে সময় ধরেই নিয়েছিলাম, আমার জীবন আসলে শেষ। আমার ভেতরে যে অমিত সম্ভাবনা লুকিয়ে ছিল, আমি তা ঘুণাক্ষরেও তখন বুঝতে পারিনি। কিন্তু ৫০ বছর পর, এখন নিজের জীবন নিয়ে আমি খুবই পরিতৃপ্ত। আমি বিয়ে করেছি দুবার। আমার আছে চমৎকার আর গুণী তিন সন্তান। বৈজ্ঞানিক কর্মক্ষেত্রেও পেয়েছি সফলতা।
পাঠক হিসেবে মনে হয়েছে, সফল হতে হলে দরকার অদম্য মানসিকতা, দরকার লেগে থাকার প্রবণতা। আপনার কি নেই সেটা নিয়ে পড়ে থাকলে সফলতা ধরা দেবে না। স্বপ্নের পেছনে, লক্ষ্যের পেছনে ছুটতে হবে অবিরাম। এভাবেই শেষ হলো স্টিফেন হকিংয়ের ‘আমার এই ছোট্ট জীবন’।