ইতিহাস পড়ে ঠিক যতটুকু আনন্দ পাওয়া যায় মিথলজি কিংবা পৌরাণিক গল্প পড়েও তেমনি আনন্দ পাওয়া যায়। আজ আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে হয়তো কয়েক হাজার বছর আগে কোনো এক মহান সভ্যতা ছিল, তাদের রাজ্য ছিল, ছিল ঘরবাড়ি, আত্মীয়-পরিবার। ভাবতেই কেমন শিহরণ লাগে গায়ে। কিন্তু পৌরাণিক গল্পের মাঝে ডুবে গিয়ে আমরা ভুলে যাই আজ থেকে শত হাজার বছর পূর্বের এসব গল্প নিছক গল্প নয় বরং সেগুলো আদিম সভ্যতা, সংস্কৃতি, চিন্তা-চেতনা আর ধর্মের কথা বলে।
সেসব দেবতাদের কথা বলে যারা বাস করতেন মানুষের মাঝে, অলিম্পাস পাহাড়ের চূড়ায় কিংবা কখনো সূর্যের প্রতিরূপে অথবা মূর্তির অভ্যন্তরে। সময়ের প্রবাহে সভ্যতা বিলীন হয়, বদলে যায় ধর্ম আর সংস্কৃতি। তারপর বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যান সেসব ক্ষমতাধর দেবতাগণও। এমনই পৌরাণিক চরিত্র আর বর্তমান বাস্তব জীবনের আলোকে গড়ে উঠেছে নিল গেইম্যান রচিত তার বিখ্যাত আর সেরা সৃষ্টি আমেরিকান গডস বইটির গল্প। বইটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে খানিকটা ইতিহাস আর মিথের পাতা থেকে ঘুরে আসা যাক।
আমেরিকা আবিষ্কার
বর্তমান বিশ্বের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী এক দেশের নাম। পৃথিবীর ইতিহাসে যে কয়টি ঘটনার কথা গুরুত্বর সাথে স্মরণ করা হয় তার মধ্যে পঞ্চদশ শতাব্দীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আবিষ্কার অন্যতম। বর্তমান স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের পেছনের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। ১৪৯২ সালে ইতালিয় নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা মহাদেশে পা রাখেন। অবশ্য, ইতিহাস বলে কলম্বাস যাওয়ার বহু আগে থেকেই ভাইকিংদের আমেরিকায় যাতায়াত ছিল। তবে, আমেরিকানদের সাথে ইউরোপীয়দের সব ধরনের সম্পর্কের সূত্রপাত এবং এই জায়গাটার সম্পর্কে বিশ্বের পরিচয় ঘটেছিল মূলত কলম্বাসের হাত ধরেই।
কলম্বাস প্রথমে এই মহাদেশকে ভারত ভেবেছিলেন এবং সেখানকার অধিবাসীদের রেড ইন্ডিয়ান বলে ভুল করেছিলেন। আমেরিকার জন্মলগ্ন থেকেই এখানে অভিবাসীদের বসবাস। এসকল অভিবাসীরা স্বাধীনতার খোঁজে এখানকার মাটিতে এসে খুঁটি গেড়েছিল। তাই আমেরিকার এই বসতিগুলো ধীরে ধীরে একটা আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়। ইউরোপিয়রা বিশেষ করে ব্রিটিশরা যাদের শাস্তি কিংবা নির্বাসন দিতে চাইতো তাদের রেখে যাওয়া হতো এই নতুন মহাদেশে।
এরপর সারা ইউরোপের সাদা চামড়ার অধিকারীরা, নীল কিংবা সবুজ চোখের মণির লোকেরা অথবা সোনালী চুলের ককেশিয়; এমন কোনো গোত্র বা সম্প্রদায় বাকি ছিল না যারা আমেরিকায় অভিবাসী হয়ে আসেননি। আজকের আমেরিকা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ দ্বারা পরিপূর্ণ।
দেবতা হওয়ার চাইতে, মানুষ হওয়া ভালো। আমাদের কারো বিশ্বাসের দরকার হয় না। আমরা ওসব ছাড়াও জীবন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। -নিল গেইম্যান
জার্মান মানচিত্রকর মার্টিন ওয়াল্ডসিম্যুলার ১৫০৭ সালের দিকে সমগ্র বিশ্বের একটি আনুমানিক মানচিত্র প্রকাশ করেন। সেখানে ইতালিয় আবিষ্কারক ও মানচিত্রকর আমেরিগো ভেসপুচির নামানুসারে পশ্চিম গোলার্ধের নামকরণ করেন আমেরিকা। পরবর্তীতে ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই অনেক চড়াই-উতড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আমেরিকা স্বাধীনতা লাভ করে।
পঞ্চাশটি স্বাধীন অঙ্গরাজ্যের সমন্বয়ে তৈরি হয় দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা (The United States of America-USA)। লক্ষ লক্ষ অভিবাসী স্বাধীনতার খোঁজে খুঁটি গেড়েছিল এখানে; একটা স্বাধীন দেশের আশায়। অবশেষে স্বাধীন দেশ তারা পেয়েছে। কিন্তু সেই অভিবাসীরা কি পেরেছে তাদের দেবতাদের কিংবা পৌরাণিক চরিত্রসমূহকে পেছনে ফেলে রেখে আসতে? না, পারেনি। তাদের রক্তে, মস্তিষ্কের কোঠরে, ধ্যান-ধারনা, চিন্তা-চেতনায় তখনো দেবতারা বিরাজ করতেন।
অভিবাসীদের ন্যায় এখানে স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল তাদের দেবতা এবং পৌরাণিক চরিত্ররাও। আইরিশদের সাথে এসেছিল ফেইরি আর ল্যাপ্রিকনদের দল, নরওয়েজিয়ানদের সঙ্গ দিতে এসেছিল নর্স-দেবতাগণ, মিশরীয় আর স্লাভিক দেবতা গণ এসেছিল তাদের গোত্রের একাকীত্ব ঘুচাতে, শুধু কি এরাই? আফ্রিকান আনানসি, হাইতিয়ান ভুডো, তিন ধর্মের রানী চরিত্র বিলকিস, মধ্যপ্রাচ্যের ইফ্রিতদের দল; সবাই দলে দলে এসেছিল।
মানুষ বিশ্বাস করে। এটাই মানুষের কাজ। তারা বিশ্বাস করে। কিন্তু সেই বিশ্বাসের দায় দায়িত্ব নিতে চায় না। কল্পনা করে, কিন্তু সেই কল্পনা বাস্তব হয়ে সামনে এসে দাঁড়ালে আর তাতে ভরসা রাখতে পারে না। মানুষ শূন্যতাকে ভরিয়ে তোলে ভূত, দেবতা আর ইলেকট্রনের গল্পে। মানুষ ভাবে, মানুষ বিশ্বাস করে। আর সম্ভবত, খুব সম্ভবত সেই বিশ্বাসের কারণেই মিলে বস্তু। – নিল গেইম্যান
সৃষ্টির শুরুতে এই ধরনীর বুকে একটা সময় শুধু দেবতাদের রাজত্ব ছিল। শুধু দেবতাই না দেবীদের পদ চারণাও ছিল ধরনীর বুকে। দেবতারা একটা সময় পর থেকেই নিজেদের নিঃসঙ্গ ভাবা শুরু করলো। তাই সব দেবতা মিলে সিদ্ধান্ত নিল তারা তাদের প্রতিনিধিদের এই ধরনীর বুকে পাঠাবে। যারা এই পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখবে এবং তাদের গুণকীর্তন করবে।
দেবতারা মানুষ তৈরি করে পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন। এরপর গোত্রভেদে আলাদা হয়ে মানুষের পুজো নিতে মানুষের মনে বসবাস করতে শুরু করলেন। এমনকি তারা অভিবাসীদের ন্যায় বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের খুঁটি গাড়লেন। প্রথম প্রথম মানুষ দেবতাদের গুণকীর্তন করতো ঠিকই কিন্তু একটা সময় পর মানুষ ধীরে ধীরে পুরনো দেবতাদের উপর থেকে বিশ্বাস হারাতে শুরু করে। নতুন নতুন প্রযুক্তি আর ভাবনাকে নতুন দেবতা বলেই গণ্য করে।
পুরাতন দেবতাদের তুলনায় নতুন দেবতাদের দেয়া উপহার তাদের কাছে অধিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তখন পুরনো দেবতারা নেমে আসেন ধরনীর বুকে, নতুন দেবতাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে। সবার অলক্ষ্যে অনস্তিত্বের ময়দানে হয় সেই যুদ্ধ। রক্তের বন্যায় সৃষ্টি হয় নতুন নীল নদ কিংবা মিসিসিপি অথবা সিন্ধু। ভেসে হারিয়ে যায় কতশত সভ্যতা। তারপর আবার সব নিশ্চুপ। একই নিয়মে নতুন করে শুরু হয় সবকিছু। তাই হয়তো বলা হয়, যখন দেবতাদের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে যায় তখন হারিয়ে যান দেবতারাও।
যে যুদ্ধে দুই পক্ষই নিজেদেরকে সঠিক বলে মনে করে, তার চাইতে নির্মম যুদ্ধ আর কোনটা হতে পারে? সবচেয়ে বিপদজনক তারাই, যারা মনে করে তাদের প্রতিটা পদক্ষেপ ভালোর জন্য নেওয়া। – নিল গেইম্যান
বই লিখে লেখকেরা যেসব সম্মানজনক পুরস্কার পেয়ে থাকেন সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দ্য নেবুলা (The Nebula) আর দ্য হুগো অ্যাওয়ার্ড (The Hugo Award) যা দেয়া হয় সায়েন্স ফিকশনের জন্য। হরর জনরার জন্য দেয়া হয় ব্রাম স্টোকারস অ্যাওয়ার্ড (Bram Stokers Award) এবং দ্য লোকাস অ্যাওয়ার্ড (The Locus Award) দেয়া হয়ে থাকে ফ্যান্টাসি জনরার বইয়ের জন্য।
একটি বই যখন এই তিন তিনটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পায় তখন বাধ্য হয়েই ভাবতে হয় বইটির বিষয়বস্তু কতটা বৈচিত্র্যময়? তাই নয় কি? এই তিন ক্যাটাগরিতেই পুরস্কার পাওয়া নিল গেইম্যানের আমেরিকান গডস। স্বয়ং নিল গেইম্যান বইটির জনরা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। তাই বইটির জনরা নিয়ে না বলে বাদবাকি বিস্তারিত কথায় যাওয়া যাক।
কাল্পনিক গল্প পড়ে লাভ কী? সেগুলো জীবনের রূঢ় বাস্তবতাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না। – নিল গেইম্যান
গল্পপ্রসঙ্গ
শ্যাডো মুন। গায়ে-গতরে বিশালদেহী আর ভাব-ভঙ্গিমায় ভীতি জাগানিয়া। গত তিনবছর আগে কোনো এক ঝামেলায় মারামারি করার শাস্তিস্বরূপ তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত কয়েদি সে। জেলখানার তিনটি বছর অনেক লম্বা সময়; জেল জীবনের শুরুতে এমনটাই ভাবতো শ্যাডো। সবকিছু কেমন যেন অপরিচিত আর বিস্বাদময় লাগতো তার কাছে। কিন্তু দিন যত গড়ায় মানুষ যেকোনো পরিস্থিতিতেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
ঠিক তেমনি শ্যাডোও ধীরে ধীরে জেল-জীবনে অভ্যস্ত হতে শুরু করে। কিন্তু দিন নামক এত লম্বা সময় কীভাবে পার করবে সে? জেলের গ্রন্থাগার থেকে বই পড়তে গিয়ে একটা হাত সাফাইয়ের খেলার বই পেয়ে যায় সে, যেটা পুরোটাই পয়সার কারসাজি। পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়াম করা শুরু করেছিল। আর রাতে যতক্ষণ জেগে থাকতো ততক্ষণ নিজেকে ব্যস্ত রাখতো জেল থেকে বেরোবার পর সে কী কী করবে তা ভাবতে।
জেলের প্রথম দুটো বছর এভাবে কাটলেও দ্বিতীয় বছরের মাঝামাঝি সময়ে শ্যাডোর সেলের আরেক কয়েদি লোকি লেস্মিথের সাথে তার ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত হয়। ততদিনে অবশ্য শ্যাডোর জেল পরবর্তী জীবনের তালিকা ছোট হতে হতে মাত্র তিনটি কাজে এসে দাঁড়িয়েছে। যার শেষ কাজটি ছিল জেল থেকে বের হয়ে মাথা নিচু করে বাকিটা জীবন পার করে দেয়া।
একদিন রাতে হুট করে শ্যাডোর ডাক পরে অফিস ঘরে। আর সেখান থেকেই জানতে পারে শ্যাডোর মুক্তির দিন ঘনিয়ে আসেছে। যারপনাই খুশি হয় শ্যাডো। প্রাণপ্রিয় স্ত্রী লরাকে ফোন দেয় শ্যাডো। সময় গড়িয়ে যায় শ্যাডোর মুক্তির আর মাত্র আটচল্লিশ ঘন্টা বাকি। এমন সময় ওয়ার্ডেন দেখা করতে চায় শ্যাডোর সাথে। শ্যাডোর হাতে একটি স্থানীয় পত্রিকা দিয়ে জানায়, শ্যাডোর স্ত্রী লরা এবং তার সবচাইতে কাছের বন্ধু রবি এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। ওয়ার্ডেন তাই শ্যাডোর মুক্তির দিনের একদিন আগেই ছেড়ে দেয়। কিন্তু শ্যাডো কার কাছে যাবে? তার জন্যে অপেক্ষায় থাকা মানুষটিই যে আর নেই!
মানুষ কেবল তখনই সুখী হয়, যখন সে মাটির নিচে থাকে। – নিল গেইম্যান
লরার কেটে রাখা টিকেটে করেই ঈগল পয়েন্টে লরার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের জন্য রওয়ানা দেয় শ্যাডো। বিমানে নিজের পাশের সিটে বসা এক অদ্ভুত লোকের সাথে পরিচয় হয় শ্যাডোর; নাম মিস্টার ওয়েনসডে। যার এক চোখ কাচের তৈরি আর অন্যটা চামড়ার। যে শ্যাডোর জেল থেকে বের হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন এতদিন। যে কিনা শ্যাডোর নাড়ি-নক্ষত্র সবই জানেন। সঙ্গি হারানোর বেদনায় ব্যথিত হন তিনিও। শ্যাডোকে নিজের দেহরক্ষী হিসেবে চাকুরিতে নিয়োগ দিতে চান বিনিময়ে শ্যাডো যা চায় তাইই পাবে।
শ্যাডো তা প্রত্যাখান করে এবং বিমান বিরতিতে পালিয়ে যায় সে। কিন্তু খুব একটা সুবিধে করতে পারে না সে। কেননা শ্যাডো যেখানেই যায় মিস্টার ওয়েনসডে রহস্যজনকভাবে সেখানেই উপস্থিত হন। শেষমেশ মিড পান করার মধ্য দিয়ে শ্যাডোকে নিজের দেহরক্ষী করতে সক্ষম হন মিস্টার ওয়েনসডে। কিন্তু শ্যাডো শর্ত দেয় প্রথমে নিজের স্ত্রীর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে। ঈগল পয়েন্টে শেষবারের মতো স্ত্রীর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে এসে কাছের বন্ধু রবির স্ত্রী অড্রির সাথে দেখা হয় কিন্তু লরার কফিনে এক দলা থুথু ছিটিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে চলে যায় অড্রি। কেন অড্রি এমন জঘন্য কাজ করলো? কতটা কষ্ট পেলে মানুষ মৃত্যুর পরেও আরেকটা মানুষকে এরকম ঘৃণা করতে পারে!
স্ত্রীর শেষকৃত্যানুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে একদল অপহরণ করে শ্যাডোকে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত লিমুজিনের ভেতরে বসা মোটা ছেলেটা নিজেকে নতুন দেবতা বলে দাবী করে এবং শ্যাডোকে বলে,
মিস্টার ওয়েনসডে এখন অতীত স্মৃতি, ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে তাদের। আমরাই এখন ভবিষ্যৎ, এখন সময় আমাদের। ভাষা হচ্ছে ভাইরাস আর ধর্ম হচ্ছে একটা অপারেটিং সিস্টেম। প্রার্থনা আসলে স্প্যাম ছাড়া কিছুই না। মনে রেখো শ্যাডো, ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছে।
রাতে মোটেলে ফিরে মৃত স্ত্রীকে দেখতে পায় শ্যাডো। না মৃত অবস্থায় নয় মৃতদের ন্যায় তবে জীবিত অবস্থায়। ব্যাপারটা বারবার ঘটতে থাকলে শ্যাডো ঠিক বুঝতে পারে না- এটা স্বপ্ন নাকি বাস্তবতা? মিস্টার ওয়েনসডের সাথে পরিচিত হওয়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে সমাজের বিভিন্ন ভাঁজে লুকিয়ে থাকা অদ্ভুত মানুষদের সাথে পরিচয় হয় শ্যাডোর, যারা কিনা নিজেদেরকে প্রাচীন কালের দেবতা হিসেবে দাবী করে।
কোনো এক অজ্ঞাত কারণে প্রাচীন কালের দেবতা দাবী করা আর নতুন দিনের দেবতাদের মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় শ্যাডো। নিজের অজান্তেই পুরাতন আর নতুন দেবতাদের সংঘর্ষের মাঝে এক নগণ্য ঘুঁটিতে পরিণত হয় শ্যাডো। রহস্যের আরো ঘন জালে জড়িয়ে গন্তব্যের দিকে ছুটে যায় শ্যাডো মিস্টার ওয়েনসডের দেহরক্ষী হয়ে। অবশেষে এক পাহাড়ের চূড়ায় আদি দেবতা খ্যাত মিস্টার ওয়েনসডে সকল আদি দেবতাদের এক জোট করে বলে,
মানুষ আজকাল আমাদের ছুঁড়ে ফেলে নতুন দেবতাদের উপাসনা শুরু করেছে। প্রযুক্তি, ইন্টারনেট, টেলিভিশন সহ নাম না জানা অসংখ্য দেবতা। আমরা যদি এখনই কিছু না করি তবে একদিন বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবো। আমাদের হারানো ক্ষমতা আর অবস্থান ফিরে পেতে হবে আর তার জন্য দরকার যুদ্ধের। রক্তের বন্যায় সব ভেসে গিয়ে নতুন করে সভ্যতার সূচনা হবে।
শেষ পর্যন্ত কি হয়? যুদ্ধে জয়ী হয় কারা? বিস্মৃত হতে থাকা পৌরাণিক চরিত্র কিংবা আদি দেবতারা নাকি বর্তমান যুগের ক্ষমতাবান নতুন দেবতারা? আদি দেবতা মি. ওয়েনসডের জয় নাকি নতুন দেবতা মি. ওয়ার্ল্ডের জয়? লেপ্রিকনদের উচ্ছ্বাস নাকি নিয়ন বাতির ঝিকিমিকি বিকাশ? লোকির হাসোজ্জ্বল মুখ নাকি টিভির নতুন কোনো সংযোজন?
ম্যাড সুইনির পাগলামি নাকি ইন্টারনেটের বিস্তার? বিলকিসের অলৌকিকতা নাকি প্রযুক্তির উৎকর্ষতা? তবে কি অনস্তিত্বের ময়দানে রক্তের বন্যায় তৈরি হয় নতুন কোনো মিসিসিপি নাকি পুরাতন মিসিসিপিই গর্বের সাথে বয়ে চলে? লরাইবা কেমন করে মৃত হয়েও জীবিতদের ন্যায় ঘুরে বেড়ায়? শ্যাডোই বা কেন এসবের মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়? আদি অস্তিত্বের শেকড় ভুলে কি তবে নতুনের কেতন ওড়ে? জানতে হলে অবশ্যই পড়তে হবে নিল গেইম্যান রচিত আমেরিকান গডস নামের এই ঢাউস আকৃতির বইটি।
লেখক প্রসঙ্গ
১৯৬০ সালের ১০ নভেম্বর ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারে নিল রিচার্ড গেইম্যান এর জন্ম। একদম ছোট থাকতেই নিল গেইম্যানের বইয়ের প্রতি ভালোবাসা আর নেশাটা জেঁকে বসে। সেই সুবাদেই সি এস লুইস, জে আর আর টলকিন, জে বি কাবেল, এডগার অ্যালান পো, উরসুলার মতো লেখকদের বই গোগ্রাসে গিলেছেন একদম ছোটকালই। বাবা-মা চাকরিতে যাবার সময় নিলকে স্থানীয় পাঠাগারে রেখে যেতেন এবং সেখানেই সবচাইতে বেশি স্বচ্ছন্দ্যবোধ করতেন তিনি।
লেখালেখির শুরুটা সাংবাদিকতা দিয়ে। তার গ্রাফিক নভেল সিরিজ ‘স্যান্ডম্যান’ তার লেখালেখির ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পাশাপাশি স্যান্ডম্যান প্রথম কমিক বুক হিসেবে বেশ কিছু পুরস্কারও পায়। তারপর থেকেই নিল গেইম্যানকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে ৩০টিরও অধিক নামকরা এবং একাধিকবার পুরষ্কারপ্রাপ্ত বইয়ের রচয়িতা তিনি। তার লেখা বইয়ের কাহিনী অবলম্বনে বানানো হয়েছে চলচ্চিত্র, টিভি সিরিজ এবং রেডিও নাটকও।
দ্য হুগো অ্যাওয়ার্ড, দ্য নেবুলা অ্যাওয়ার্ড, দ্য লোকাস অ্যাওয়ার্ড, নিউবেরি মেডেল কি নেই গেইম্যানের অর্জনের ঝুলিতে? জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা এই লেখকের প্রায় প্রত্যেকটি বইই পাঠক সমাদৃত। তার লেখা উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো দ্য গ্রেভইয়ার্ড বুক (The Graveyard Book), কোরালাইন (Coraline), দ্য ওশান এট দ্য এন্ড অফ দ্য লেন (The Ocean at the end of the lane), নর্স মিথলজি (Norse Mythology), স্মোক এন্ড মিরর (Smoke and Mirror), ফ্র্যাজাইল থিংস (Fragile Things), নেভারহোয়্যার (Neverwhere), স্টারডাস্ট (Stardust) ইত্যাদি।
আমেরিকান গডস বইটির উল্লেখযোগ্য যে কয়েকটা ব্যাপার আছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নিল গেইম্যানের দৃষ্টিভঙ্গি এবং লেখনী শক্তি। তার ভাবনার জগত অন্য সবার থেকেই আলাদা বলে তার লেখার মাধুর্যও অন্য সবার থেকে আলাদা। রূপকথা বা মিথের সেই ক্লাল্পনিক দৃশ্যগুলোই নিল গেইম্যান খুব সহজ স্বাভাবিক ভাবে দেখেন এবং বর্ণনাও করেন। গল্পের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা মিথ, ফ্যান্টাসি আর ইতিহাসগুলো এমনভাবে তৈরি করেন যাতে পাঠক সেগুলো পড়ে কল্পনাপ্রবণ হয়ে পড়েন।
বইয়ে শ্যাডোর কাহিনী বর্ণনার মাঝে আমেরিকায় নির্বাসিতদের আগমন, নির্বাসিতদের পৌরাণিক চরিত্রসমূহের আগমন অর্থাৎ দেব-দেবীদের আগমন, পরবর্তীতে কিভাবে তারা স্থায়ীভাবে খুঁটি গেড়েছিল তার বর্ণনা; এসব লেখক সাবপ্লট হিসেবে ব্যবহার করলেও অতীত ইতিহাস পেছনে টানার কারণে বর্তমান কালের এই উপন্যাসের গল্প হয়েছে আরো বেশি সমৃদ্ধ আর শক্তিশালী।
শ্যাডো যার বাংলা অর্থ ছায়া। গল্পেও তেমনি নতুন আর পুরাতন দেবতাদের মাঝে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায় শ্যাডো। উপন্যাসের পটভূমি থেকে শুরু করে চরিত্রায়ন, বিষয়বস্তু, ইতিহাসের বর্ণনায় এতটা বৈচিত্র্য টেনে আনা সম্ভবত নিল গেইম্যানের পক্ষেই সম্ভব। এত বৈচিত্র্যের ভিড়ে পাঠক যখন বইয়ের পাতা উল্টান তার সাথে সাথে পাঠকের শতাব্দীও উলটে যায়।
পাঠক চলে যান কখনো একবিংশ শতাব্দী আবার কখনো হাজার বছরের পুরানো সভ্যতায় কিংবা কখনো জনমানবশূন্য পুরাণে। গল্পের এই সময়কালের পরিবর্তন পাঠককে ক্ষণে ক্ষণে শিহরণ দেয়। একই সাথে ফ্যান্টাসি, হরর, মিথ, বাস্তবতাকে উপজীব্য করে এভাবেও উপন্যাস লেখা যায় তা এই বই না পড়লে জানতাম না।
পাঠক হিসেবে কিছু অসংগতির কথা বলাটাও যুক্তিযুক্ত। আর সেটা হচ্ছে দীর্ঘতা। এই বইয়ে সবকিছুই বিস্তারিতভাবে তুলে ধরার কারণে বইটা যেমন ঢাউস আকৃতির হয়েছে ঠিক তেমনি বইটার ভেতরে কিছু কিছু বর্ণনা বেশ বড় আর বিরক্তির উদ্রেক ঘটিয়েছে। আর এছাড়া গল্পের শুরুটা আর শেষটার তুলনায় গল্পের মাঝের অংশটা অনেকটাই শিথিল লেগেছে।
আরেকটি বিষয় খোলাসা করে দিচ্ছি সেটা হচ্ছে এটি সম্পূর্ণ মিথ নির্ভর একটি উপন্যাস। আর মিথের মানেই কল্পনা। মিথ আর ফ্যান্টাসি পাগল বইপ্রেমী হলে এই বইটি অবশ্য পাঠ্য। তবে নিল গেইম্যানের নর্স মিথলজি বইটা পড়া থাকলে অথবা নর্স থেকে শুরু করে ইজিপশিয়ান, আফ্রিকান, স্লাভিক আর নেটিভ আমেরিকানদের পৌরানিক চরিত্রসমূহ সম্পর্কে জানা থাকলে বইটা পড়ে আরো বেশি আনন্দ পাবেন। আর একই নামে একটা টিভি সিরিজও আছে তবে বইটা পড়ে দেখলে সেটাও উপভোগ্যই হবে। ইংলিশ পড়া নিয়ে যাদের সঙ্কোচ আছে তারা বাংলা অনুবাদটাও পড়তে পারেন।
বইয়ের কিছু ভালো লাগা উক্তি –
মৃত মানুষের কাছে প্রাপ্ত জ্ঞানে কোন খাদ থাকে না।
জীবন আর মৃত্যু আসলে একই পয়সার এপিঠ-ওপিঠ।
একজন মৃত মানুষ সবচাইতে বেশি ভয় পায় শূন্যতাকে।
তিনজনের মাঝে কোনো কথা কেবল তখনই গোপন থাকে, যখন তাদের মাঝে দুইজন মৃত হয়।
আসলে বুড়ো বয়সে মানুষের আর লড়াই করে বাঁচার ইচ্ছা থাকে না। মরণটা হয় সে কারণেই।
আন্তরিকতা আর সততার ভান করা শিখে নিলে, আর কোনো কিছুই একজন প্রতারককে আটকাতে পারে না।
মানুষ চায় উপাসনা করার অজুহাত পেতে। আজকাল শুধু পাহাড় দেখতে যাবার মাঝে সার্থকতা খুঁজে পায় না মানুষ।