সত্যজিতের ‘নায়ক’: অন্তর্নিহিত ময়নাতদন্ত

“আই উইল গো টু দ্য টপ ! দ্য টপ ! দ্য টপ !”

সংলাপটা শুনলে যেকোনো বাঙালি দর্শক, সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’-এর অরিন্দম মুখার্জীকে চিনে নেবে। তৎকালীন টলিউডের ম্যাটিনি হিরো উত্তমকুমার, প্রথমবার মানিকবাবুর ছবিতে; এ যেন সিনেপ্রেমী দর্শকদের কাছে উপরি পাওনা। ফলত শোনা যায়, নায়কের প্রিমিয়ার শো দর্শকদের অতি উৎসাহে ভেস্তে যাবার উপক্রম হয়েছিল, ইন্দিরা সিনেমা হল উপচে জনজোয়ার চলে এসেছিল হাজরা মোড়ে, চিহ্নস্বরূপ জামার হাতাও ছিঁড়েছিল মহানায়কের। এহেন ক্লাসিক সিনেমা নিয়ে ময়নাতদন্ত করতে বসলে,ছবির মহার্ঘতাকে যাতে কোনোভাবে লঘু করা না হয়, সেদিকে বাড়তি সতর্কতা রাখতে হয়।

কাঞ্চনজঙ্ঘার পর, নায়কে এসে নিজের মৌলিক গল্প নিয়ে ছবি করার ক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায় অনেক বেশি সংযমী, সুনিয়ন্ত্রিত, এবং নিঁখুত। চলচ্চিত্রকে বিষয় হিসেবে দেখার প্রাধান্য থেকেই, থিমেটিক ন্যারেটিভের উপরেই বরাবর জোর দিয়েছেন তিনি। ফলত নায়কের ক্ষেত্রেও নায়ক অরিন্দম মুখার্জীকে বিষয় করেই আবর্তিত হয়েছে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলী। শিল্পের মধ্যে থিম আর ফর্মের যে বিরোধ, নৈতিক অবনমনের সাথে মতাদর্শের যে বিরোধ, তার সাথে সমাজের শ্রেণিগত বিরোধের কোনো ফারাক নেই। এই শ্রেণিবৈষম্যের দ্বন্দ্বকে পাথেয় করে, সত্যজিৎ যেভাবে ট্রেনের কামরার ক্লাস বিভাজন দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই ‘ক্লাস বিভাজন’ বোঝালেন, তা গল্পকে সহজবোধ্য করার পাশাপাশি দর্শককেও এই ট্রেন ভ্রমণের এক অংশীদার করে তোলে।

Uttam Kumar's greatest histrionic challenge was performing in 'Nayak' | Bengali  Movie News - Times of India
ট্রেন ভ্রমণেই পুরো সিনেমা; Image Source: Times of India

কাহিনীর বিন্যাস

ছবির গল্প শুরুই হয় টলিউডের খ্যাতির শীর্ষে থাকা নায়ক অরিন্দম মুখার্জীকে কেন্দ্র করে। অর্থ, বৈভব, প্রতিপত্তির চূড়ায় বসে থাকা এক সেলুলয়েডের নায়কের সাথে তারই মনের ভেতর ঘরে বাস করা, রক্তমাংসের জ্যান্ত মানুষটির নিরন্তন দ্বন্দ্বকে নিয়ে। অরিন্দম মুখার্জী পুরস্কার নিতে দিল্লি চলেছেন, উঠেছেন ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস কামরায়। অরিন্দম মুখার্জীর চোখ দিয়েই আমরা পরিচিত হই তার সহযাত্রীদের সাথে, যারা সমাজের এলিট সমাজের প্রতিনিধি। যাদের মধ্যের মধ্যে কোনো গভীরতা নেই, বিবেকবোধ নেই, শুধু আছে উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রত্যাশা আর আত্মপ্রসাদের অভিলিপ্সা। ভণ্ডামি যাদের পরতে পরতে।

ইমপোর্ট-এক্সপোর্টের ব্যবসা করা শিল্পপতির কথাই ধরা যাক, যিনি অরিন্দম মুখার্জীর মেয়েঘটিত স্ক্যান্ডালের জন্য তাকে ভর্ৎসনা করেন আবার নিজেই পরস্ত্রীকাতর হয়ে পড়েন। অন্যদিকে বিজ্ঞাপন কোম্পানির মালিক, যিনি নিজের ব্যবসার স্বার্থে সুন্দরী স্ত্রীকে ব্যবহার করতে পিছপা হন না, আবার স্ত্রীর স্বাধীনভাবে সিনেমায় নামার সিদ্ধান্ত কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। এদের সাথে আমরা কেউই একাত্ম হতে পারি না। নায়ক অরিন্দম মুখার্জীও সমাজের এই উঁচু তলার বাসিন্দা। সাধারণ মানুষের সাথে তার সম্পর্ক ছিন্নমূলের মতো, সাধারণ মানুষ তার কাছে শুধুমাত্র তার বাজারের একটা একক মাত্র। সতর্ক কেতাবি সাবধানতা তার অঙ্গে অঙ্গে স্পষ্ট।

এরই মাঝে  আমরা পাই আধুনিকা, পরিশীলিতা, অদিতি সেনকে, সে যেন ঘুণধরা সমাজের বুকে এক আলোর দীপ্তি। মেয়েদের পত্রিকার সম্পাদিকা, অদিতি সেনের সাথেই ট্রেনের রেস্তোরাঁয় কথোপকথনকালে উঠে আসে অরিন্দম মুখার্জীর জীবনের আজানা অন্ধকার দিকগুলো, এই স্বীকারোক্তি যেন কোথাও গিয়ে নায়কের নিজের কাছে নিজের স্বীকারোক্তি, নিজের অন্তরাত্মার কাছে নিজের ব্যাখ্যা, অদিতিরূপে শর্মিলা ঠাকুর এখানে প্রতীকী মাধ্যম মাত্র।

নায়কের স্বপ্নদৃশ্য ও পরাবাস্তববাদ

খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেও মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ার যে ভয় নায়কের অরিন্দম মুখার্জীর মধ্যে বারংবার কাজ করত, সেই মনস্তাত্ত্বিক গভীরতাকে স্পর্শ করতে গেলে, ছবিতে পরাবাস্তববাদী, বিমূর্ত আঙ্গিকের অনুপ্রবেশ ঘটনোই সত্যজিৎ শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন।বস্তুগত সত্যের নিরিখেই তিনি সাজিয়ে তুলেছিলেন শিল্পসম্মত এই পরাবাস্তবাদী দুনিয়া।

স্বপ্নদৃশ্যটিকে তিনভাগে ভাগ করে দেখলে প্রথম ভাগে আমরা দেখি, টাকার বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে অরিন্দম স্লো মোশনে পা ফেলে এগিয়ে চলেছে, অভিব্যক্তিতে গ্ল্যামারের সুখ ঠিকরে বেড়াচ্ছে, পরক্ষণেই বড় বড় পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছেন অনেকটা টাকা বেছানো পথ, দু’হাতে টাকার সুখ উপভোগ করছেন, অবশেষে টাকার বালিয়াড়ির চূড়ায় এসে দাঁড়ালেন অরিন্দম।

Raw life - Film - TLS
প্রথম ভাগের স্বপ্ন; Image Source: Times Literary Supplement

স্বপ্নের দ্বিতীয় পর্বে আচমকাই চারপাশে শ্মশানের নিস্তবতা, আলোর দীপ্তি ক্রমশ ম্লান হয়ে আসছে, আবহসঙ্গীতে পরিবর্তন এসেছে, হরিনাম সংকীর্তনের মতো হরিবোল বাজছে আবহে। চারপাশে অসংখ্য কঙ্কালের হাত, তাদের হাতে ধরা এক একটা টেলিফোন রিসিভার। তাহলে কী যে ছবির অফার আসছে, সবই হতে চলেছে চূড়ান্তভাবে অসফল!

স্বপ্নের তৃতীয় ভাগে দেখি অরিন্দম টাকার চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে, চিৎকার করে ডাকছে, “শঙ্করদা! শঙ্করদা!” এই শঙ্করদা যেন অরিন্দমের যৌবনের এক মতাদর্শের প্রতীকী রূপ, সে কাতর হয়ে শঙ্করদার কাছে সাহায্য ভিক্ষা করছে, কিন্তু শঙ্করদার অতিনাটকীয় হাসির শব্দে স্বপ্নের ইতি।

মনস্তাত্ত্বিক আবর্তনে কীভাবে ইন্দ্রিয়চেতনা ও নান্দনিক সচেতনতা একে অপরের সাথে সংঘবদ্ধ বিন্যাস ঘটাতে পারে, এই স্বপ্নদৃশ্যে তার একটা ইঙ্গিত মেলে। বুর্জোয়া সামাজিকতা যেখানে বারংবার চলচ্চিত্রে প্রতিফলন ঘটিয়ে এসেছে, তাতে আঙ্গিকের মোটিভ পরাবাস্তবতার জন্ম দেয়। তবে তার ভিত্তি থাকে কল্পিত বাস্তবের মাটিতেই। নায়কের স্বপ্নদৃশ্যের মতো এত বড় স্বপ্নদৃশ্য এর আগে কোনো ছবিতে ব্যবহৃত হয়নি, এখানে সত্যজিৎ শুধু একটি নয়, বরং দু’টি স্বপ্নদৃশ্যের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন। অরিন্দমের জীবনের যাবতীয় ভয়, সেটা হিরোইজম হারানোর ভয়ই হোক কিংবা সুনাম নষ্টের ভয়, সমস্ত ভয়ের বিচ্ছিন্ন প্রতীকী রূপ অবয়ব নিয়েছে স্বপ্নে, টেনে নিয়ে গিয়েছে দর্শককে- এক অভিনেতার আড়ালে হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিমানুষটির দিকে। যার নিজস্ব অনুভূতি, ভয়, রাগ, দুঃখ প্রকাশের কোনো জায়গা নেই, সে বিনোদন জগতের এক নিরন্তর শ্রমিক।

আদর্শের সংঘাত- সফলতার সিড়িতে দাঁড়িয়ে একাকিত্বের গল্প

সিনেমা বনাম থিয়েটারের মধ্যে আপাতভাবে কোনো বিরোধ না থাকলেও, আদর্শের জায়গা থেকে কমিটমেন্টের প্রশ্নে থিয়েটার একজন অভিনেতার কাছ থেকে চিরকালই সততা দাবি করে, এখানে লক্ষ লক্ষ টাকার লেনদেন নেই, নামডাক থাকলেও  চলচ্চিত্রের হিরোর তুলনায় তা নগণ্য। অরিন্দমের সিনেমায় নামার কথা শুনে পাড়ার ক্লাবের সভাপতি শঙ্করদার সাথে অরিন্দমের কথোপকথোন কালে আদর্শ বনাম উন্নতি, শিল্প বনাম অর্থের চিরাচরিত দ্বন্দ্বগুলো প্রকট হয়ে ওঠে। অভিনেতার নিজস্ব সত্ত্বা কই আদৌ সিনেমার টেকনোলজির প্রাচুর্যে হারিয়ে যায়, সেখানে সে কি স্রেফ পরিচালকের হাতের পুতুল?

প্রশ্নগুলো সত্যজিৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে উত্থাপন করেছেন ছবিতে, থিসিস, অ্যান্টিথিসিসের অংশ হিসাবে। যদিও শঙ্করদার মৃত্যুর পর অরিন্দম সমস্ত দ্বান্দ্বিক দোলাচল ঘুচিয়ে যখন সিনেমায় নামার সিদ্ধান্তই কার্যকর করে, তখন থিসিস, অ্যান্টিথিসিসের সমন্বয়ে কোনো সিন্থেসিস ঘটে না; বরং অরিন্দম উন্নতির চোরাস্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়। শঙ্করদার মৃত্যু অরিন্দমের জীবনে জীবনের একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে অন্য অধ্যায়ে পদার্পণের ল্যান্ডমার্ক হয়ে থাকে।

Nayak - Upperstall.com
আদর্শিক দ্বন্দ্ব; Image Source: Upperstall.com

দ্বিতীয় ঘটনা বীরেশের। সেসময় কলকাতা আন্দোলনে উত্তাল, বীরেশ ট্রেড ইউনিয়ন লিডার, আর অরিন্দম শখের থিয়েটার অভিনেতা। সে বীরেশের সাথে শ্রমিক মহল্লায় যায়, তবে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে তার কোনো আগ্রহ ছিল না। তবে সেই প্রথম জীবনের অরিন্দমের মধ্যেও বিবেকবোধ ছিল, শ্রমিক আন্দোলনে পুলিশের হামলা দেখে সে চুপ করে বসে থাকতে পারিনি, বন্ধুত্বের স্বার্থেই সে ছুটে গিয়েছে বন্ধুকে বাঁচাতে। অভিনেতা হিসাবে নাম করার পর সেই অরিন্দমই যখন বীরেশের সাথে শ্রমিক আন্দোলনে শ্রমিকদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে ‘ইমেজ’ নষ্ট হবার ভয় পায়, তখন অরিন্দমকে স্রেফ একজন মেরুদণ্ডহীন আত্মসর্বস্ব মানুষ ছাড়া আর কিচ্ছু মনে হয় না।

আর এভাবেই সাফল্যের সিঁড়িতে একধাপ করে এগোতে গিয়ে অরিন্দম যে কখন সমাজবিচ্ছিন্ন, আত্মমগ্ন, দূরের এক নক্ষত্র হয়ে উঠেছে, তা সে নিজেও টের পায় না। দর্শকের কাতারে আমরা কেবল এক নিঃসঙ্গতার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাই, যে মানুষটা আকাশ ছুঁতে গিয়ে নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে বসে আছে।

কারিগরী দিক

নায়কে মানিকবাবু উত্তমকুমারকে মেকআপ করতে দেননি, এ নিয়ে তার মনে বেশ কিছুটা খুঁতখুঁতানি ছিল। সারা ছবি জুড়ে উত্তমকুমারের এত বেশি মিড শট ও ক্লোজ শট নেওয়া হয়, তাতে তার কপালের মধ্যে চামড়ার ভাঁজ এর আগে কোনো ছবিতে দেখা যায়নি। ট্রেনের সমস্ত দৃশ্যই ইনডোরে সেট বানিয়ে শ্যুটিং করা, বংশী চন্দ্রগুপ্তর বানানো সেট আর সুব্রত মিত্রের ক্যামেরার কাজ ছাড়া সত্যজিতের পক্ষেও এই ছবি উতরানো সহজ ছিল না। শোনা যায়, ট্রেনের সাউন্ড ট্র্যাক রেকর্ড করতে ট্রেনের ভেস্টিবিউলে চেপে কলকাতা থেকে দিল্লী গিয়েছিলেন সত্যজিৎ ও চিত্রগ্রাহক সুব্রত মিত্র, এত পরিশ্রম করে বানানো নায়ক নিঃসন্দেহে বাংলা চলচ্চিত্রে থিমের সাথে ফর্মের এক চমৎকার মেলবন্ধনের গল্প বলে।

Satyajit Ray's 'Nayak' completes 50 years - and still remains relevant -  The Economic Times
অদিতি সেনের ভূমিকায় শর্মিলা ঠাকুর; Image Source: The Economic Times

পরিশেষে বলা যায় অরিন্দমরূপী উত্তমকুমারের সাথে অদিতি সেনের ভূমিকায় অভিনীত শর্মিলা ঠাকুরের স্ক্রিনপ্লে পুরোপুরি রোম্যান্টিক ছাঁচে না ফেলার মধ্যেও একটা বাস্তবিক সম্ভাবনা থাকে, প্রেডিক্টেবল মনে হয় না। মোটা চশমার কাঁচের ওপারে সংযমী অদিতির মধ্যে এক গভীর আত্মমর্যাদা আছে, নির্লিপ্ত দম্ভ আছে, স্নিগ্ধতার আস্তরণ আছে, যে শত শত ‘হ্যাপি এন্ডিং’কে উপেক্ষা করে সংক্ষিপ্তভাবে শুধু বলতে পারে, “মনে রেখে দেব”।

This article is in Bangla. It is a review of the famous bengali film 'Nayak', directed by Satayjit Ray, featuring Uttam Kumar.

References:

1.রুদ্র সুব্রত, ১৯৯৬; সত্যজিৎ জীবন আর শিল্প, প্রতিভাস, কলকাতা

2.আনন্দলোক; ২৭শে এপ্রিল ২০১৫ (সত্যজিৎ রায় সংখ্যা)

3.বন্দ্যোপাধ্যায় পার্থপ্রতীম, ১৯৯২, চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব, এবং মুশায়েরা, কলকাতা

Featured Image: Times of India

Related Articles

Exit mobile version