পলাশীর যুদ্ধ শেষ হয়েছে প্রায় এক যুগ হলো। ইংরেজরা এখন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। পুতুল নবাব সিংহাসনে বসে দেশ চালান। ইংরেজদের অত্যাচারে বাংলার জনজীবন বিপর্যস্ত। রাজস্ব আদায়ের অতিরিক্ত চাপ। ফলস্বরূপ ১৭৬৯-‘৭০ এর ভয়াবহ মন্বন্তর। আর এই সময়টাকেই উপজীব্য করে বঙ্কিম রচনা করলেন তাঁর আলোচিত-সমালোচিত উপন্যাস আনন্দমঠ।
১২৮৭ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যা থেকে ১২৮৯ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা পর্যন্ত বঙ্গদর্শন পত্রিকায় আনন্দমঠ ছাপা হয়। বই আকারে বেরোয় ১২৮৯ বঙ্গাব্দে মানে ১৮৮২ সালে।
আনন্দমঠ উপন্যাসটির লক্ষ্য ছিল তৎকালীন হিন্দু সমাজের ‘রেঁনেসা’ বা নবজাগরণ সৃষ্টি করা- ভারতবর্ষে আর্যদের হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনা। তবে ইউরোপীয় নবজাগরণের মতো শিল্প বা সাহিত্য দিয়ে নয়, বরং বিতর্কিত একটি উপায় দেখিয়ে দিয়েছিলেন বঙ্কিম- যুদ্ধ বা সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়া।
ভারতবর্ষে মুসলমানরা কখনো ভূমিপুত্র ছিল না- ইসলাম এই অঞ্চলে এসেছে তার জন্মভূমি থেকে, সেই সুদূর মধ্যপ্রাচ্য থেকে। ধীরে ধীরে ইসলাম এখানে তার আসন পাকাপোক্ত করে। বঙ্কিম মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন কি না তা তর্কসাপেক্ষ, তবে আর্যাবর্তে ইসলামের এরূপ জয়জয়কার দেখে বঙ্কিম যে কিছুটা নাখোশ ছিলেন সেটা তার আনন্দমঠ পড়ে ঢের আন্দাজ করা যায়।
সেসময় ভারতবর্ষে মুসলমানদের অবস্থা নিতান্তই জীর্ন ছিল। বিশেষত ইংরেজদের কাছে মুসলমান নবাবের পরাজয় হয়তো তারা মেনে নিতে পারেনি। ফলে দেখা গেল শিক্ষাদীক্ষায় হিন্দুরা এগিয়ে যাচ্ছে আর মুসলমানরা সমান তালে পিছিয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই বোধহয় আনন্দমঠ তৎকালীন সমাজে ব্যপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কারণ, আপামর মুসলমানদের তখন এ নিয়ে প্রতিবাদ করার কোনো অবকাশ ছিল না। বঙ্কিমের জীবদ্দশায়ই উপন্যাসটির পাঁচটি সংস্করণ বের হয়।
উপন্যাসে চরিত্ররা অনেক জায়গায় সরাসরি মুসলমানদের আক্রমণ করেছে। কিন্তু এর কারণ কী? উপন্যাস পড়ে যেটুকু অনুধাবন করা যায়, তাতে মনে হয় মীরজাফরের বেইমানি আর পরবর্তীতে নিষ্ঠুর রাজ্য শাসনই এই ‘বিদ্বেষ’-এর সৃষ্টি করেছে। কারণ ভবানন্দের মুখ থেকে আমরা শুনি, ‘সকল দেশের রাজার সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণের সম্বন্ধ; আমাদের মুসলমান রাজা রক্ষা করে কই?’
উপন্যাসের পটভূমি ছিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। আবার কাছাকাছি সময়ে ঘটেছিল ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। দুটো থেকেই মশলা নিয়েই বঙ্কিম তার উপন্যাস গেঁথেছেন। মহেন্দ্র আর কল্যাণী ছিল তার উপন্যাসের বাহক। এই দুই চরিত্রের উপর ভর করেই উপন্যাস এগিয়ে গেছে।
আনন্দমঠ-এ বঙ্কিম তার নিজস্ব কিছু তত্ত্ব চরিত্রের মুখ দিয়ে প্রকাশ করেছেন। তার উদ্দেশ্য ছিল সমাজকে কিছু ‘শেখানো’, বিশেষত তৎকালীন তরুণ হিন্দুসমাজকে। আর এই জায়গাতেই এই উপন্যাসের মূল নিহিত। সেজন্যই আনন্দমঠ ‘উদ্দেশ্যমূলক দোষে দুষ্ট’।
শ্রী চৈতন্যের বৈষ্ণব ধর্মের নতুন সংজ্ঞা দিয়েছেন বঙ্কিম তার আনন্দমঠ উপন্যাসে। যেখানে বৈষ্ণবধর্মে শুধু প্রেমের কথা বলে, সেখানে বঙ্কিম নতুন তত্ত্বে তাকে একেবারে ‘দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন’ পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। দুটি পুরোপুরি সাংঘর্ষিক আর আশ্চর্যের ব্যাপার হলো দুটিকে একসাথ করে বঙ্কিম সেটাকে মায়ের (দেশমাতা) সন্তানদের ধর্মে রুপান্তর করলেন!
বঙ্কিমের অগ্রসর চিন্তা-ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে আনন্দমঠ-এ। ভেবে অবাক হতে হয়, সেই ১৯ শতকে একজন ‘উগ্রবাদী’ চিন্তা করছে যে সে তার আস্তানায় কামান-বন্দুক বানাবে, তা-ও আবার বাইরে থেকে কারিগর আনিয়ে! বঙ্কিমের এরকম অগ্রসর, আধুনিক চিন্তাবোধের সুপ্রকাশ ঘটেছে কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসেও, যেখানে দেখা যায় পরাজিত প্রেমিক তার প্রেমিকাকে স্বহস্তে খুন করছে।
বঙ্কিমের লিখনশৈলীর জবাব নেই। তার লেখা কঠিন বলে অনুযোগ করা হলেও সচেতন পাঠক ঠিকই লেখার ভেতর থেকে নির্যাসটুকু অনুভব করে নেবেন। আনন্দমঠ-এও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরকে বঙ্কিম যেভাবে এ উপন্যাসে চিত্রায়িত করেছেন তা পাঠকের মনে শিহরণ জাগাতে বাধ্য। দুর্ভিক্ষে মানুষ কতটা অসহায় হয়ে পড়েছিল তা বুঝতে পারা যায় যখন দেখা যায় মানুষ খিদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে স্বমাংস আহারের প্রয়াস পাচ্ছে।
উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্র, শান্তি চরিত্রটি তৎকালীন নারীসমাজের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন, স্বতন্ত্র্য একটি চরিত্র। বঙ্কিম তার উপন্যাসগুলোতে নারী চরিত্র নিয়ে গবেষণা করেছেন। কপালকুণ্ডলা, প্রফুল্ল এগুলো তার নিরীক্ষাধর্মী চরিত্র। শরৎবাবুর নায়িকারা কেঁদে বুক ভাসান, রবিবাবুর নায়িকারা প্রেমে হাবুডুবু খান। বঙ্কিমের নায়িকারাও হয়তো বা এগুলো থেকে বিচ্যুত নন, কিন্তু বঙ্কিম সেখানে অনন্য কিছু বৈশিষ্ট্য যোগ করেছেন যেগুলো তার নারী চরিত্রগুলোকে বাকি সবার থেকে কিছুটা হলেও আলাদা করেছে। এ উপন্যাসেও স্বাভাবিকভাবে এসেছে প্রেম-ভালোবাসা, আবেগের গল্প। নারীকে বর্ণনা করা হয়েছে ‘সর্বশক্তিমান’ হিসেবে- যে কি না খুব সহজেই সব পুরুষকে তার রূপ আর মোহজালে আবদ্ধ করে পরাজিত করে ফেলতে পারে। যেমনটা ভবানন্দের ক্ষেত্রে হয়েছে আমরা দেখি, পরনারী কল্যাণীর রূপে মুগ্ধ হয়ে নিজের ব্রত, ধর্ম, প্রতিজ্ঞা সবই বিসর্জন দিয়েছে সে। তাই তো বঙ্কিমের ভাষায়, ‘হায়! রমণীরূপলাবণ্য! ইহসংসারে তোমাকেই ধিক।’
বঙ্কিম সুচতুর ছিলেন। ইংরেজদের সাথে লড়তে যাননি। কারণ তাতে আর যা-ই হোক হিন্দুদের শ্রীবৃদ্ধি হবে না। তাই তো উপন্যাসের শেষে এসে মহাপুরুষের মুখ দিয়ে তিনি জানিয়ে দিলেন, ইংরেজদের সাথে সংঘাত করো না। বরং তাদের সাথে মিলে নিজের জ্ঞান আর ধন উভয়ই বৃদ্ধি করো।
বইটি অনলাইনে কিনতে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে: