অতঃপর তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকল।
ছোটবেলায় গল্প পড়ার সময় কিংবা সিনেমা দেখার সময় শেষটা সবসময় আমরা এমনই দেখতাম। গল্পের কলাকুশলীরা সবাই সুখেশান্তিতে বাস করতে থাকে। কিন্তু বাস্তব জগতে কি এমন দেখা যায়? আমরা যে ‘শান্তি’ প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লব বা যুদ্ধ দেখতে পাই, সেগুলো কি আমাদের শান্তি এনে দেয়?
না, বাস্তব জীবন গল্পের মতো এত সাদামাটা নয়। এখানে শেষের পরেও শেষ থাকে। গল্পের শেষে আরেক নতুন গল্প শুরু হয়। আর এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, সুখে-শান্তিতে আর বসবাস করা হয়ে ওঠে না। এই যে গল্পের পেছনে অনেক গল্প থাকে, তা নিয়ে দারুণ এক ব্যঙ্গাত্মক রূপকধর্মী উপন্যাস লিখে গিয়েছেন ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েল। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সালে, ইংল্যান্ডে। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর স্ট্যালিনের শাসনামলকে অবলম্বন করে লেখা হলেও এর গল্প আজ প্রায় আট দশক পরেও খুব প্রাসঙ্গিক।
বইয়ের গল্প মূলত একটা পশু খামারের কয়েকটা প্রাণীকে নিয়ে। খামারের মালিক মিস্টার জোন্স। তার খামারে রয়েছে শূকর, গরু, ঘোড়া, গাধা, ভেড়া, মুরগি, হাঁস, কুকুর, এমনকি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আর বিড়ালও। জোন্স এই প্রাণীদের দিয়ে অনেক পরিশ্রম করান, খাবার কিংবা বিশ্রাম দেন না ঠিকমতো। তাই প্রাণীরা ঠিক করে, তারা বিদ্রোহ করবে। এই খামারে এত শস্য, কিন্তু সব খাবার নিয়ে যায় মানুষরা। তারা পায় অল্প কিছু খাবার। অথচ এসব শস্য উৎপাদনে তাদের অবদানই বেশি। তাদেরকে দিয়ে কাজ করিয়ে সব সুবিধা ভোগ করছে মানুষরা।
এসব অসঙ্গতি নিয়ে এক রাতে সকল প্রাণীর উদ্দেশে বক্তৃতা দেয় বয়স্ক শূকর ওল্ড মেজর। অন্যান্য প্রাণীও তাতে সায় দেয়। এর কিছুদিন পর মারা যায় ওল্ড মেজর। কিন্তু তার আদর্শ রয়ে যায়। যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ওল্ড মেজর বক্তৃতা দিয়েছিল, সেটা শ্রদ্ধার উদ্দেশ্যে চিহ্নিত করে রাখে তারা।
এরপর প্রাণীদের নেতৃত্বে আসে স্নোবল আর নেপোলিয়ন নামের দুই তরুণ শূকর। তাদের নেতৃত্বে একসময় বিদ্রোহ হয়। মিস্টার জোন্সের সাথে খামারের সব প্রাণীদের সংঘর্ষ হয়। জোন্স পালিয়ে বাঁচেন। খামার চলে আসে প্রাণীদের দখলে। আগে যে খামারের নাম ছিল ‘ম্যানর ফার্ম’, এখন তার নতুন নাম দেওয়া হয় ‘অ্যানিমেল ফার্ম’।
প্রাণীদের প্রধান শত্রু ঘোষণা করা হয় মানুষদের। মানুষরা যেসব কার্যকলাপ করে থাকে, যেমন- পোশাক পরা, মদ্যপান; সেসব নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। প্রাণীদের জন্য সাতটি বিধি প্রধান করা হয়। জাতীয় সঙ্গীতের মতো তাদেরও একটা সঙ্গীত ঠিক করা হয় ‘বিস্টস অভ ইংল্যান্ড’।
প্রতি রবিবার তাদের একটা সভা হতো। সেখানে এই সঙ্গীত পরিবেশনার পর তাদের মধ্যে খামার পরিচালনা বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। একসময় স্নোবল আর নেপোলিয়নের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা গেল। মতপার্থক্য রূপ নিল তিক্ততায়। প্রাণীরা দেখল, তারা যে উদ্দেশ্যে বিদ্রোহ করেছিল, সেই সুখশান্তি তাদের আর অর্জিত হয়নি। বরং এখনো অনেক পরিশ্রম করে যেতে হচ্ছে। অন্যদিকে শূকররা বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে অন্যান্য প্রাণীদের চেয়ে নিজেরা বেশি বেশি সুবিধা ভোগ করছে। তারা যে আদর্শকে সামনে রেখে বিদ্রোহ করেছিল, ধীরে ধীরে সেখান থেকে সরে আসে। এমনকি তাদের প্রাণীসত্ত্বার অস্তিত্বও হারিয়ে যেতে বসে একসময়।
অরওয়েলের এ উপন্যাস থেকে শিক্ষা পাওয়া যায়, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। আমরা বিভিন্ন বিপ্লবের ইতিহাস থেকে অনেক বিপ্লবী নায়ক দেখতে পাই। কিন্তু বিপ্লব পরবর্তী সময়ে তারা কতটুকু সফলতা দেখাতে পেরেছেন? অ্যানিমেল ফার্মে দেখা যায়, বিপ্লব পরবর্তী সময়ে বিপ্লবীরা নিজেরাই নিজেদের শত্রুতে পরিণত হয়। যে স্বৈরাচার থেকে সাধারণ নাগরিকদের মুক্তির স্বপ্ন দেখান বিপ্লবীরা, পরবর্তী সময়ে তারাই স্বৈরশাসকে পরিণত হন। সাধারণ মানুষদের কখনো মুক্তি মেলে না।
বিপ্লবীরা স্বপ্ন দেখান, সব মানুষকে সমান অধিকার বা মর্যাদা দেওয়া হবে। কিন্তু পরে দেখা যায়, নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য জনগণের মৌলিক অধিকারও তারা হরণ করে নেন। শাসনযন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য আশ্রয় নেন মিথ্যা প্রোপাগান্ডার। নির্যাতন করেন সাধারণ মানুষের উপর। তারা দমন করেন বিরোধী মতের।
সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, সাধারণ মানুষরা যে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, এটা তাদের বুঝতে দেওয়া হয় না। তাদের বিভিন্নভাবে বোঝানো হয়, স্বৈরশাসকরা যা করছেন, তাদের ভালোর জন্যই করছেন। শাসক শ্রেণির লোকরা আমজনতাকে অভুক্ত রেখে নিজেরা ভরপেট আহার করলেও সেখানে বিভিন্ন যুক্তি দেওয়া হয়, এটা তাদের ভালোর জন্যই করা হচ্ছে। তারা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী আইনের শাসন ব্যবহার বা পরিবর্তন করে থাকেন। শত্রু না থাকলে নতুন কাল্পনিক শত্রু বানান, নিজেদের দোষ অন্যের ওপর চাপানোর জন্য। ইতিহাসও লেখেন নিজেদের পক্ষে যায়, এমনভাবে সাজিয়ে।
এ কারণেই তাদের নীতিমালাতে লেখা, ‘অল অ্যানিম্যালস আর ইকুয়াল’ হয়ে যায় ‘অল অ্যানিমেলস আর ইকুয়াল বাট সাম অ্যানিমেলস আর মোর ইকুয়াল দ্যান আদারস’।
জর্জ অরওয়েল উপন্যাসিকাটি এমন সময় লেখেন, যখন ব্রিটেন আমেরিকা ও রাশিয়ার সাথে মিত্রপক্ষ হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়ছে। রুশ সমাজতান্ত্রিকতার ভাবমূর্তির কথা চিন্তা করে প্রকাশকরা বইটি প্রকাশ করতে চাননি। অবশেষে ১৯৪৫ সালে বইটি প্রকাশ পায়।
টাইম ম্যাগাজিন বইটিকে ১৯২৩-২০০৫ সালের মধ্যে ইংরেজি ভাষার সেরা ১০০টি উপন্যাসের মধ্যে জায়গা দিয়েছিল। ২০০৩ সালে বিবিসি কর্তৃক যুক্তরাজ্যের পাঠকদের সবচেয়ে প্রিয় বইয়ের জরিপে এই উপন্যাসটি ৪৬ নাম্বারে ছিল। ১৯৯৬ সালে হুগো অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয় একে। শাসক আর শোষিতের সম্পর্ক অনুধাবনের জন্য অত্যন্ত সুখপাঠ্য সরল ভাষার একটি বই ‘অ্যানিমেল ফার্ম’।