‘সং অব দ্যা সী’ মুভির মাধ্যমে আইরিশ অ্যানিমেশন নির্মাতা টম মুর নিজেকে সেল্টিক সংস্কৃতির একজন রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, এই অ্যানিমেশনটির মাধ্যমে বাচ্চাদের জন্যে গল্প বলার ক্ল্যাসিক যে রূপটি ছিল, সেটিও তিনি তার নির্মাণজাদুতে জীবিত করে তুলেছেন। আইরিশ উপকথা থেকে অনুপ্রেরিত গল্পটি মুরের চমকপ্রদ হাতে আঁকা অ্যানিমেশনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তার এই জাদুচারিত গল্পটি আধুনিক সময়ের পটভূমিতে বুনলেও, ভিজ্যুয়াল রেফারেন্সের জন্য এর গভীরতা পিকটিশ সময়ের পূর্বেকার আঁকুনিতেও শেকড় ছড়িয়েছে।
টম মুর পরিচিতি পেয়েছিলেন তার প্রথম অ্যানিমেশন ‘দ্যা সিক্রেট অব কেলস’ (২০০৯) দিয়ে, যেটিও একটি সেল্টিক সংস্কৃতি প্রভাবিত ফ্যান্টাসি ঘরানার গল্প ছিল। সেই ছবিটি অস্কারে মনোনয়নও পেয়েছিল। সং অব দ্যা সী ছবির মাধ্যমে টম মুর নিজেকে আরো বেশি প্রমাণ করেছেন। এই ছবিটির প্রতিটি অংশই সেল্টিক সংস্কৃতি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছে। কিন্তু সেখানেই বসে থাকেনি, এর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে গেছে এবং আইরিশ অন্যান্য সংস্কৃতির সাথেও যুক্ত হয়েছে। ছবিটির রঙ, ধরন এবং আবেগ আলাদা আলাদাভাবে বেশ পরিচিত কিন্তু তাদেরকে যখন একসাথে মেশানো হয়েছে, এর থেকে সম্পূর্ণ নতুন একটি রূপ পাওয়া যাচ্ছিল।
বিখ্যাত আইরিশ কবি ইয়েটসের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু হয়ে ছবিটির জাদুকরী ও বিষণ্ণ ন্যারেটিভ দর্শককে একটি লাইটহাউজ দ্বীপের অপার্থিব সৌন্দর্য থেকে মাটির নিচের লেগুনে এবং সেখান থেকে ভয়ংকর দর্শন এক পেঁচা-ডাইনীর কাছে বয়ে নিয়ে যায়। জাদু ও বিষাদের মিশেল যে এতো ভালো কাজ করতে পারে, তা না দেখলে অবিশ্বাস্য মনে হবে।
গল্পটি এমন, যেন তা সময়ের সাথে সাথে বেড়ে ওঠে। শুরুটা বেনকে দিয়ে, একজন লাইট হাউস কীপারের ছেলে, যে বাবা-মায়ের সাথে তার ছোট বোনের জন্মের অপেক্ষা করছে। তাদের মধ্যে বেশ প্রাণবন্ততা পাওয়া যায়। ছোট এই শিশুর জন্যে নার্সারি রুমের দেয়ালগুলো রূপকথার ম্যুরাল দিয়ে এঁকে রাখা হয়েছে।
গল্পের এক পর্যায়ে বুঝা যায় যে, বেনের মা একজন সেলকি, যে তার বড় একটা সময় মানুষের দুনিয়ায় কাটিয়েছে। সমুদ্র থেকে ধার করে আনা তার এই সময়টুকু শেষ হয়ে যাওয়ায় একরাতে সে বিদায় নিয়েছিল। সেল্টিক লোককথা অনুযায়ী, সেলকিরা একইসাথে মানুষ এবং সীল। তারা সীল অথবা মানুষে রূপান্তর হতে পারে। আইরিশ রুপকথার এই উপাদানটি সমগ্র গল্পে বেদনার জন্যে জটিল একটি উপমা হয়ে দাঁড়ায়। মুর এবং তার সহলেখক উইলিয়াম কলিনস এই বিচ্ছেদটি অনেক সংবেদনশীলতার সাথে ব্যবহার করেন, যা অনেকটাই পিক্সারের আপ-এর (২০০৯) কথা মনে করিয়ে দেবে। ছুরিকাঘাতের মতো এই বেদনাটির আকস্মিকতা অনুভব করা যায়। বাচ্চা সায়োর্শাকে ঘিরে এই বিষাদের মেঘ ঘনীভূত হতে থাকে।
বেন আর সায়োর্শাকে তাদের দাদির সাথে শহরে থাকার জন্যে পাঠানো দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে এক বিচিত্র ও বিপজ্জনক অভিযানে যাত্রা করে। যেখানে সায়োর্শাকে বাঁচাতে পরীদের সাথে পেঁচার ফাইট হয়, প্রাচীন এক মন্দিরের লেগুনে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর মেলে। কমনীয় আঁকুনি এবং ন্যারেটিভের মাধ্যমে বাচ্চাদের শোকার্ত হৃদয়ের একটি ‘ফ্যান্টাস্টিক্যাল’ ভার্সন হয়ে দাঁড়ায়। ছবির প্রতিটি দৃশ্য কল্পনার মতো জ্বলজ্বল করে, যেটি শুধুমাত্র টুডি, হাতে আঁকা অ্যানিমেশনেই সম্ভব। চরিত্রগুলোকে তাদের চারপাশের পরিবেশ দ্বারা জড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো এখানে জাপানের বিখ্যাত স্টুডিও ঘিবলির নান্দনিকতার কথা মনে করিয়ে দেবে। এই অ্যানিমেশনে স্টুডিও ঘিবলির প্রভাব যেন জ্বলজ্বল করছে। শুধুমাত্র অ্যানিমেশন ধরনেই নয়, প্লটের মধ্যেও। একটি দৃশ্য মাই নেবার টোটোরো-র (১৯৮৮) ক্যাটবাস রাইডের কথা মনে করিয়ে দেয়। আবার, স্পিরিটেড অ্যাওয়ে (২০০১) ছবিতে চিহিরোর সাথে ডাইনি ইউবাবার প্রথম সাক্ষাতের দৃশ্যটি এখানে ম্যাকার ঘরে যেন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাছাড়াও, মার্ক বেকার, মিশেল অসেলট এবং দ্যা লিজেন্ড অব জেলডা ভিডিও গেমের একটি বৈচিত্র্যময় মিশ্রণের সাথে এখানে যুক্ত হয়েছে জার্মান এক্সপ্রেশনিজম। টুডি অ্যানিমেশন যে থ্রিডি অ্যানিমেশনের তুলনায় অনেকটাই স্বকীয়, তা এই ছবিতে প্রমাণ করা হয়েছে।
সং অব দ্যা সীর সংগীত এতোই কোমল ও সূক্ষ্ম যে, তা অপার্থিব অনুভূতি দেবে। এরকম মাত্রার সংগীতের কৃতিত্ব দিতে হয় সুরকার ব্রুনো ক্যুল্যাইজ এবং আইরিশ ফোক ব্যান্ড কিলাকে। সচরাচর শোনা যায় না, এরকম অনেক বাদ্যযন্ত্র তারা এই ছবিটিতে ব্যবহার করেছেন। এছাড়াও, গানগুলোতে ব্যবহৃত হয়েছে আইরিশ গ্যালিক ভাষা। কবি ইয়েটসের লেখা অনুসরণ করে এই গানগুলো লেখা হয়েছিল। এক্ষেত্রে ‘দ্যা স্টোলেন চাইল্ড’ কবিতার কথা না বললেই নয়, যেখানে পরীরা একটি বাচ্চাকে পানিতে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্যে প্রলুদ্ধ করে। অ্যানিমেশনটিতে সঙ্গীতের একটি গুরুত্ব হচ্ছে, সায়োরশা কথা বলতে পারে না কিন্তু তার শামুক আকৃতির বাঁশি বাজিয়ে একটি সংস্কৃতির সাথে অংশগ্রহণ করে, তাদের সংগীতে সুর মেলায়।
ছবিটির মসৃণাকারের ক্যারেক্টার ডিজাইন গেনডি টারটাকোভস্কির ‘দ্যা পাওয়ারপাফ গার্লস’, ‘সামুরাই জ্যাক’ ও জনপ্রিয় আমেরিকান সিরিজ ‘ফ্ল্যাপজ্যাক’, ‘ফোস্টার’স হোম ফর ইমেজিনারি ফ্রেন্ডস’ কার্টুন স্টাইলের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু গোলাকার চোখের, সাধারণ দেখতে এই চরিত্রগুলো তাদের অভিযান চালিয়ে যায় জমকালো পরিবেশের মধ্য দিয়ে, যেগুলো জলরঙা টেক্সচার এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ রঙ ও প্যালেটের মধ্য দিয়ে ব্যতিক্রম হয়ে ওঠে।
আমেরিকান অ্যানিমেশনগুলো প্রধানত পরিচালিত হয় প্লট আর চরিত্র দ্বারা। সং অব দ্যা সী সেখানে ভিন্ন ফর্মুলা অনুসরণ করেছে। পুরো গল্পটিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্যে এখানে শুধু প্লট কিংবা চরিত্রই গুরুত্ব পায়নি, বরং হারিয়ে যাওয়া আইরিশ রূপকথা, মৃতপ্রায় সংস্কৃতিকে কীভাবে পৃথিবীর সামনে প্রদর্শন করা যায়, সেদিকে পরিচালক আগ্রহী হয়েছেন। এই ছবিটি প্রচলিত অ্যানিমেশনগুলোর অডিয়েন্সদের মনকে প্রসারিত করতে উৎসাহিত করবে, যেন এটির কাব্যিক অভিজ্ঞতাটি অর্জন করতে পারে।
বেশ কৌতূহলোদ্দীপকভাবেই, এই গল্পের সাথে সাধারণ আমেরিকান অ্যানিমেশনের তফাৎ হলো, এখানে ‘খারাপ’ ব্যাপারটা আপেক্ষিক। ভিলেইনের খারাপ কাজের পেছনে অনেকসময় ভালো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। ভিলেইন যেকোনো গল্পের একদম অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়, তা এখানে প্রতিফলিত হয়েছে। ডিজনি ছবিগুলো যে দ্বৈতবাদী পৃথিবীর ধারণা দেয়, এই গল্প সেদিকে আগায়নি। পৃথিবীতে খারাপ এবং ভালো আলাদা আলাদাভাবে বসবাস করে না।
বড় ভাই বেন তার ছোট্ট বোনকে নিয়ে বিভিন্ন রহস্যের সমাধানের যে প্যাঁচালো রাস্তায় পা দিয়েছিল, সেটা ইচ্ছা করলেই পশ্চিমের গৎবাঁধা ফর্মুলাটি অনুসরণ করতে পারতো। কিন্তু স্থানীয় রূপকথাকে ডিজনির পরিচিত আকৃতি দেওয়া তাদের উদ্দেশ্যে ছিল না। বরং, গল্পের জন্যে একটি উপযুক্ত শৈলী তারা খুঁজে নিতে চেয়েছিলেন, যার মাধ্যমে আইরিশ সংস্কৃতি কেন্দ্রিক একটি বিশেষায়িত ন্যারেটিভের সাথে গল্পটির যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। এই শৈলীটিই সং অব দ্যা সী দেখার অভিজ্ঞতাটিকে নতুনত্ব দিয়েছে। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, চরিত্রগুলো এতো সরলভাবে বানানো হয়েছে যে, একদম শিশু দর্শকও তাদেরকে উপলদ্ধি করতে পারবে, সহমর্মিতা অনুভব করতে পারবে।
সং অব দ্যা সী এমন একটি দুনিয়ায় জীবন্ত যে, যেখানে এটি বড়দের দুনিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে, কখনো কখনো অবাধ্যও হয়ে ওঠে। এটা দেখতে হবে, উপলদ্ধি করতে হবে ছোট বাচ্চাদের মতো করেই এবং তাতেই শিশুকালের হারানো আনন্দটি আবারো উপভোগ করা যাবে।