প্রখ্যাত ডাচ চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গগকে কে না চেনে? তার সংক্ষিপ্ত, গৌরবান্বিত এবং বিষাদময় জীবন যেকোনো সৃজনশীল লোকের জন্যই অনুপ্রেরণা। মানসিকভাবে প্রবল বিপর্যস্ত হওয়ার পরও তার মধ্যে থাকা শক্তি, চিন্তা-ভাবনা ও কাজের দিক থেকে সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা ইত্যাদির সাথে পৃথিবীর সকল প্রত্যাহত মানুষ নিজেদের মিল খুঁজে পান।
কার্ক ডগলাস থেকে বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ; কিংবা মার্টিন স্করসেজির মাধ্যমে রূপালি পর্দায় ভিনসেন্টের জীবনী নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রও কম নয়। তার জীবন ছিল সূক্ষ্মতা ও স্ববিরোধিতায় পরিপূর্ণ। তাই সকল উজ্জ্বল বর্ণ আর শৈল্পিক তুলির আঁচড়ের মাঝেও তাকে নিয়ে নির্মিত সিনেমা ক্যামেরার কর্কশ আলোর নীচে এসে চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে যেতে পারে। খুব কম সময়ই একজন শিল্পীর সিনেমাটিক প্রতিরূপকে তার অঙ্কিত চিত্রের মতো কমনীয় হতে দেখা যায়। এসব গুটিকয়েক সিনেমার কাতারেই পড়বে জুলিয়ান স্ন্যাবল নির্মিত ২০১৮ সালের সিনেমা, অ্যাট ইটার্নিটি’স গেইট।
সাধারণ কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির বায়োপিকে একজন পরিচালক সে ব্যক্তির জীবনের সবচেয়ে সেরা সময়কে ক্যামেরায় বন্দী করতে চেষ্টা করেন। যা দেখে দর্শক তাকে ভালোভাবে জানবে, তার মেধার প্রশংসা করবে। কিন্তু ঐ যে বললাম, ভ্যান গগ এবং তার মেধার ব্যাপারে কে না জানে? তাই সজ্ঞানেই এই পথ থেকে দূরে থেকেছেন পরিচালক স্ন্যাবল। সাথে এই অসাধারণ প্রজেক্টে নিজের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ও পর্বতপ্রমাণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন উইলেম ডেফো।
এমন না যে পরিচালক ভ্যান গগের কল্পনাশক্তিকে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে পারার ক্ষমতার স্তুতি করেননি। এই আমেরিকান পরিচালক নিজেও একজন চিত্রশিল্পী। জীবদ্দশায় তিনি যে নাম-যশ উপভোগ করছেন, তার ছিঁটেফোঁটাও ভ্যান গগ উপভোগ করে যেতে পারেননি। সিনেমায় তার লক্ষ্য ছিল একটাই- ভ্যান গগের দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় আর নিষ্পেষিত মনস্তত্ত্বের গভীরে প্রবেশ করা। তিনি জীবনকে যেভাবে দেখেছেন, সেভাবে দেখাতে চেষ্টা করা। যেন দর্শকের মনে হয় তারা কেবল ভ্যান গগের জীবনটাকে দেখছেনই না, বরং তার জীবনটাকে যাপন করছেন।
তিনি সিনেমায় যেভাবে ভিনসেন্টের আখ্যানে প্রাণ সঞ্চার করেছেন, সেটা আসে ভাঙা-ভাঙা অংশে এবং কল্পিত দৃশ্যকল্পে। যেমন- জগদ্বিখ্যাত কান কেটে ফেলার দৃশ্যটি পর্দায় দেখানো হয় না। আবার এক স্কুল বালকের সাথে ভ্যান গগকে ঝগড়া করতে দেখি আমরা। ঝগড়ার কারণ ঐ বালকটি ছবি আঁকার সময় তাকে জ্বালাতন করে। গগের জীবনে এ ধরনের ঘটনা ঘটার কোনো উল্লেখ নেই। এসব কল্পনা আর বাস্তবতা মিলে সিনেমায় পরিচালক কর্তৃক একটি স্বতন্ত্র আখ্যায়িকা তৈরি হয়। যার মাধ্যমে দর্শক ভ্যান গগের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানসিকতার গভীরে প্রবেশ করে, সহজে বেরোতে পারে না।
জুলিয়ান স্ন্যাবলের মতে, ভ্যান গগ তার লেখা চিঠিতে জীবনের যেরকম চিত্র তুলে ধরেছেন, তার ব্যাপারে যেসকল জনশ্রুতি আছে এবং যেসব বিষয়কে সত্য বলে মেনে নেয়া হয়েছে সেগুলোই চিত্রায়িত হয়েছে। আর কিছু কিছু দৃশ্য আছে যেগুলোকে স্রেফ কল্পনা করা হয়েছে। এ সবের মিলিত রূপই এই সিনেমা। এটি ভ্যান গগ সম্পর্কিত কোনো পুঙ্খানুপুঙ্খ বায়োপিক নয়।
বায়োপিক বানানোর এমন আনকোরা পদ্ধতি হয়তো গল্পের বর্ণনাকে ক্ষেত্রবিশেষে একটু আলগা করে দিয়েছে। তবে এই ধারার সিনেমা নির্মাণের প্রথাগত নিয়মের বাইরে যাওয়াটা সজীবতা নিয়ে এসেছে অ্যাট ইটার্নিটি’স গেইট-এ। ফলে প্রাঞ্জলভাবে ফুটে উঠেছে ভ্যান গগের কিংবদন্তীতুল্য স্ববিরোধীতা। তার উৎপীড়িত হৃদয় যতটা তাকে জীবনের পথে পিছিয়ে দিয়েছে ঠিক ততটাই শানিত করেছে শিল্পী-সত্তাকে।
অ্যাট ইটার্নিটি’স গেইট-এর দৃশ্যায়ন দর্শকের চেতনাকে পুলকিত করবে। এখানে সিনেমাটোগ্রাফিতে আছেন ফরাসি সিনেমাটোগ্রাফার বেঁনোয়া ডেলহম; হাতে ধরা ক্যামেরায় যার মুন্সিয়ানা সর্বজনবিদিত। সুনিপুণতার সাথে তিনি তুলে এনেছেন ফুল, পাতা, গম ক্ষেতের উপর আলোর নাচনসহ ভ্যান গগের দৃষ্টি আকর্ষণকারী সকলকিছুকে। ১৮৯০ সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে আত্মহত্যা করার আগে, নিজের শেষ দিনগুলোতে ভিনসেন্টকে যে নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল তাও এখানে থিম হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে।
গল্পের সূত্রপাত ঘটে প্যারিসে, যেখানে সমালোচকরা ভিনসেন্টের কাজকে অবহেলা করে। সর্বদা সহানুভূতিশীল ছোট ভাই থিওর (রুপার্ট ফ্রেন্ড) সমর্থনও তার নিরাশা কাটাতে পারে না। সহসাই কাছের বন্ধু পল গঁগা (অস্কার আইজ্যাক) কর্তৃক প্রণোদিত হয়ে ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে দিকে যাত্রা করেন। গঁগার মতে, এখানেই সূর্যরশ্মি তার সকল মোহনীয়তা নিয়ে হাজির হয়। যা তাদেরকে দিতে পারে ছবি আঁকার অফুরন্ত রসদ।
এখানে এসে ভিনসেন্ট অবস্থান করেন আর্ল নামের এক ছোট শহরে। আর্লে তার সৃজনী শক্তির ঝলক দেখা যায়। মাত্র ৮০ দিনের ব্যবধানে ৭৫টি চিত্রকর্ম সম্পন্ন করেন। এক কক্ষের খুপরি বাসা আর তার জীর্ণ পরিবেশ একটুও বিরক্তি উদ্রেক করেনি তার, এঁকে গেছেন তিনি মনের হরষে। এখানকার পরিবেশ তাকে এনে দিয়েছে পরমানন্দ। যা প্রতিধ্বনিত হয়েছে তার কণ্ঠে, “যতবার আমি তাকাই, ততবারই এমনকিছু দেখি যা আমি আগে কখনো অবলোকন করিনি।” আর ভিনসেন্ট যা দেখেন, তা যেন দর্শকও দেখতে পায় সে ব্যাপারে অত্যন্ত যত্নশীল ছিলেন পরিচালক স্ন্যাবল।
ভ্যান গগের সমাজ বিমুখতা তাকে নিয়ে আসে পার্শ্ববর্তী পাগলা গারদে; যেখানে একাকীত্বের নিষ্পেষণ চুষে নেয় তার জীবনীশক্তিকে। নিজের কাজের সমালোচনা ক্রোধিত করে তাকে। এক্ষেত্রে বড় আঘাত আসে প্রিয় বন্ধুর দিক থেকেই। গঁগা তাকে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত রং ব্যবহারের দায়ে অভিযুক্ত করেন। বলেন, গগের ছবিতে তেলের পিণ্ড তাকে চিত্রকর্মের বদলে ভাস্কর্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। পাগলা গারদে কিছুদিন থাকার পর ভিনসেন্ট সুস্থ হয়েছেন কিনা তা নির্ণয়ের দায়িত্ব পড়ে একজন পাদ্রির (ম্যাড মিকেলসেন) উপর। পাদ্রীর সাথে তার কথোপকথনে এই সিনেমার কিছু সেরা দৃশ্যের অবতারণা হয়। এছাড়া তার জীবনের ব্যাপারে নানা তথ্যও জানা যায় এসব দৃশ্যে।
পাদ্রি তাকে প্রশ্ন করেন তিনি কেন আঁকেন? জবাবে ভিনসেন্ট একটা শব্দই উচ্চারণ করেন। আর সেটা হলো, ‘সূর্যমুখী’। একপর্যায়ে পাদ্রি তার শিল্পকে বাতিল করে দেন। বলেন কেউ তাকে দাম দেবে না, বিখ্যাতদের কাতারে তিনি স্থান পাবেন না। মনস্তাপে গগ তখন বলেন, “হয়তো ঈশ্বর আমাকে দিয়ে সেসকল মানুষের জন্য চিত্রাঙ্কন করাচ্ছেন, যাদের এখনো জন্ম হয়নি।” দর্শক হিসেবে যা আমাদের কাছে দৈববাণীর মতো শোনায়।
এই উক্তির মাধ্যমে পরিচালক সরাসরি গগের পক্ষাবলম্বন করেন। এই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া পুরো চিত্রনাট্য সূক্ষ্মতা এবং প্রাঞ্জলতার সমন্বয়ে লেখা। যেটি স্ন্যাবল লিখেছেন জ্যাঁ-ক্লদ ক্যারিয়ের এবং লুইস কুগলবার্গের সাথে মিলে। একটি মর্মন্তুদ গল্পের মাধ্যমে পরিচালক ভ্যান গগ সম্পর্কিত প্রচলিত কিংবদন্তির বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। দেখিয়েছেন দুনিয়া তাকে যে খ্যাপাটে বলে, তিনি মূলত ছিলেন বেশ বিচক্ষণ ব্যক্তি।
ভ্যান গগকে নিয়ে নির্মিত অন্যান্য চলচ্চিত্রের চেয়ে এটি তার জীবনকে সবচেয়ে সুচারুভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। জুলিয়ান স্ন্যাবলের ব্যাপারে যাদের জানাশোনা আছে, তাদের কাছে অবশ্য ব্যাপারটি স্বাভাবিক বলেই বোধ হবে। কেননা, এর আগেও তাকে আমরা বিভিন্ন চলচ্চিত্রে শিল্পী এবং তাদের কর্মকাণ্ডকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে দেখেছি। তার নিও-এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রকর জ্যাঁ-মিঁশেল বাসকিয়াকে নিয়ে নির্মিত বাসকিয়া (১৯৯৬), ঔপন্যাসিক রেইনাল্দো আরেইনাসকে নিয়ে নির্মিত বিফোর নাইট ফলস (২০০০) বা লেখক জ্যাঁ-ডমিনিক বওবিকে নিয়ে নির্মিত দ্যা ড্রাইভিং বেল অ্যান্ড দ্যা বাটারফ্লাই (২০০৭) সিনেমাগুলোই তার সাক্ষ্য দেবে। তবে নিঃসন্দেহে অ্যাট ইটার্নিটি’স গেইটই এখন পর্যন্ত তার সেরা কাজ। শিল্প তৈরির প্রক্রিয়া এবং তার সাথে সম্পর্কিত আত্মিক কষ্টের গভীরে গিয়েছেন তিনি এটিতে। তাতিয়ানা লিসোভস্কিয়ার পিয়ানোর মূর্ছনা এই প্রক্রিয়ার মাহাত্মকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহু গুণে।
ভ্যান গগের চরিত্রে ডেফোর অভিনয়ের কথা যতই বলি, কম পড়ে যাবে। নিজের এমনিতেই বর্ণিল ক্যারিয়ারকে যেন আরো এক ধাপ উঁচুতে নিয়ে গেলেন তিনি। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৩৭ বছর, অন্যদিকে তার চরিত্রে ডেফো অভিনয় করলেন ৬৩ বছর বয়সে এসে। ২৬ বছরের এই বিশাল ব্যবধানকে কোনো বাধা হতে দেননি তিনি।
অ্যাট ইটার্নিটি’স গেইট-কে ড্রামা হিসেবে কতটা বিবেচনা করা হবে কিংবা বায়োপিক হিসেবে এটি কতটা পরিপূর্ণ সে নিয়ে তর্কের অবকাশ আছে। তবে পেশায় চিত্রশিল্পী স্ন্যাবল যেন ভ্যান গগ সম্পর্কিত নিজের অনুভূতিকে অঙ্কন করলেন এখানে, ক্যানভাসের বদলে ব্যবহার করলেন রূপালী পর্দা। যত তর্কই হোক, নিঃসন্দেহে এটি একটি শৈল্পিক বিজয়। বায়োপিকের চেনাজানা ছাঁচের বাইরে গিয়ে যেটি এই জনরায় নিয়ে এসেছে বৈচিত্র্য।