ব্যাড সায়েন্স: প্রতারকের খপ্পড়ে পড়ে বিজ্ঞান যখন খলনায়ক

নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের খেয়াঘাটে প্রায়ই একটা জটলা লক্ষ্য করা যায়। জটলার কেন্দ্রে থাকেন রঙিন শার্ট পরা ছিপছিপে গড়নের একজন বিক্রেতা। তার সামনে রাখা টেবিলে সাজানো থাকে হরেক রকম ওষুধপত্র। তিনি নানান রকম অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে ওষুধের গুণ বর্ণনা করেন। কিন্তু এখানে অন্য একটি জিনিস দেখে আপনার চোখ আটকে যাবে। বিক্রেতার গলায় ঝুলানো একটি লাল প্ল্যাকার্ডে বড় হরফে লেখা ‘বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার, এক ওষুধে হাজার প্রতিকার’। উৎসুক জনতা সেই বিজ্ঞানের রোমাঞ্চকর আবিষ্কার ওষুধ কেনার জন্য সেখানে প্রায়ই জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকেন। আবার সেই ওষুধ সেবন করে অনেকে উপকার পেয়েছেন সে কথাও প্রায় শোনা যায়।

অযৌক্তিক বিজ্ঞাপনে অবাধে বিক্রি হচ্ছে ওষুধ; Image Source: Lalmohan News

রেল স্টেশন, বাস স্ট্যাণ্ড, হাট, বাজারসহ নানা স্থানে প্রায়ই এ ধরনের দৃশ্য দেখা যায়। ওষুধ বিক্রির উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানকে তারা বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহার করেন। কিন্তু এই বিজ্ঞাপন কতটা যৌক্তিক, সেটার নিশ্চয়তা নেই। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়ই এমন পোস্ট দেখা যায় যেখানে বলা থাকে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে হওয়া এক জরিপে দেখা যায়, যারা দুই বেলা আলু খান তাদের হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা ৫০% কম থাকে’। মাঝে মাঝে বড় বড় পত্রিকাগুলোতেও এসব খবর দেখা যায়। কিন্তু কারা, কখন এই জরিপ করেছে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। মাঝে মাঝে নামকরা প্রতিষ্ঠানের নাম সংযুক্ত থাকলেও একটু অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, আদৌ এ ধরনের কোনো জরিপ করা হয়নি। এভাবে বিজ্ঞানের নাম ব্যবহার করে চলছে প্রতারণা, যার স্বীকার হচ্ছে সহজ-সরল মানুষ। এই প্রতারণা কেবল আমাদের পাড়া-মহল্লা বা দেশের সীমারেখায় আবদ্ধ নেই। এর বিস্তৃত সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। এমনকি উন্নত রাষ্ট্রগুলোর বিখ্যাত পত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেলেও প্রতারকরা বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে বেড়াচ্ছে।

বেন গোল্ডেকর; Image Source: Kris Krüg

বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে দিনের আলোয় ডাকাতি করা দেখে বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিবর্গ অনেকেই প্রতিবাদ করেছেন। অনেকে সেমিনার কিংবা ফিচার প্রবন্ধের মাধ্যমে অন্যদের সচেতন করার চেষ্টা করেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজনের নাম হচ্ছে বেন গোল্ডেকর। পেশায় চিকিৎসক এবং গবেষক জনাব গোল্ডেকরের প্রতিবাদ মাধ্যম হচ্ছে একটি ওয়েবসাইট, যার নাম Bad Science। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ থেকে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় বড় প্রতারণার ঘটনাগুলো সংগ্রহ করে তিনি সেগুলোর বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এবং যুক্তি প্রদানের মাধ্যমে প্রতারকদের মুখোশ উন্মোচনের চেষ্টা করে চলেছেন। Bad Science-এর বার্তাকে আরো গোছানোভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে তিনি বই রচনা শুরু করেন। সেই প্রয়াস থেকে ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয় তার কালজয়ী প্রবন্ধমূলক গ্রন্থ Bad Science।

ব্যাড সায়েন্স বইয়ের প্রচ্ছদ; Image Credit: Fourth Estate

বই নিয়ে আলোচনার পূর্বে বইয়ের লেখক জনাব গোল্ডেকর সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যাক। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক স্বাস্থ্য বিজ্ঞান বিভাগের একজন ফেলো গবেষক হিসেবে কর্মরত বেন গোল্ডেকরের জন্ম ১৯৭৪ সালের ২০ মে। কর্মজীবনে চিকিৎসক, গবেষক, প্রচারক, শিক্ষক- এসব পরিচয়ের বাইরেও তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন সমাজসেবী। বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, প্রতারক ও ওষুধ কারখানার কর্মকর্তাদের যত্রতত্র ভুল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট পণ্য বিক্রয়ের মাধ্যমে মুনাফা হাতিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে তিনি জোর আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্যাড সায়েন্স ছাড়াও তিনি ব্যাড ফার্মা নামক বই লিখে শুধু ঔষধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মিথ্যচারের মুখোশ উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন। বইটি বিশেষজ্ঞ ছাড়াও সাধারণ পাঠকদের নিকট ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া তিনি নতুন ওষুধ বাজারে ছাড়ার পূর্বে ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষা ব্যবস্থা রোধ করতে AllTrials নামক সামাজিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেছেন। এসব পদক্ষেপের জন্য বিজ্ঞান সমাজের বেশ পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন তিনি।

বেন গোল্ডেকরের AllTrials আন্দোলনের একটি গণসচেতনতামূলক লিফলেট; Image Source: AllTrials

বই লেখালেখি, ওয়েবসাইট পরিচালনার পাশাপাশি তিনি ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল, দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় স্বাস্থ্য বিষয়ক কলাম লেখেন। বিভিন্ন সেমিনার, টেলিভিশন চ্যানেল, বেতার চ্যানেলে স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান অনুষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত বক্তা হিসেবে পরিচিত তিনি। তিনি সুবিখ্যাত TED Talk অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে অংশ নিয়েছেন।

TED Talk অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন বেন গোল্ডেকর; Image Source: TED

২০০৮ সালে ফোর্থ এস্টেট প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ব্যাড সায়েন্স বইটি। বাজারে আসার পর পরই এটি চারদিকে সাড়া ফেলে দেয়। প্রকাশনার প্রথম সপ্তাহে উঠে আসে বেস্ট সেলার তালিকার শীর্ষে। এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বইটির সর্বমোট ৫ লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়েছে বলে জানা গেছে। যুক্তরাজ্যের বাইরেও বইটি বহুল প্রশংসিত হয়। পাঠক চাহিদা পূরণ করতে বিশ্বের প্রায় ১৮টি ভাষায় বইটি অনূদিত হয়েছে। যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, বইটি কেমন? তাহলে বলা যায়, পপুলার সায়েন্সের মুখোশে রচিত ‘ক্রাইম থ্রিলার’ বই এই ব্যাড সায়েন্স। একেবারে গ্যাংস্টার কায়দায় বইয়ের শুরু থেকে তিনি এসব ভুয়া বিজ্ঞান পণ্যের বিরুদ্ধে আক্রমণ করে গেছেন। একের পর এক অকাট্য যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে উন্মোচন করেছেন বিলাসবহুল থেরাপির পেছনের সত্য চিত্র। বড় বড় স্বাস্থ্য অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ বেশে হাজির হওয়া কয়েকজন প্রতারকের নামও তিনি বইতে উল্লেখ করেছেন, যাদের অনেকেই রীতিমতো সেলিব্রিটি পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব। এমনকি যুগ যুগ ধরে চলে আসা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবস্থাকেও তার শিকার থেকে বাদ দেননি।

ব্যয়বহুল ডিটক্স ফুট বাথ; Image Source: Isthmus Wellness

ব্যাড সায়েন্সের সাথে পাঠকের যাত্রা শুরু হবে বিখ্যাত স্পা সেন্টারগুলোতে ব্যবহৃত অগ্নিমূল্যের ডিটক্স ফুট বাথের মাধ্যমে। ডিটক্স মোম থেরাপি, হপি ইয়ার ক্যাণ্ডেল, ব্রেইন ফিশ ওয়েল এর সাথে আরো কিছু ভুয়া পণ্য নিয়ে লেখকের হালকা মেজাজের আলোচনায় পাঠক খুব দ্রুত বইয়ের মাঝে ডুবে যেতে পারবেন। শুরুর দিকে বইয়ের আলোচনার গভীরতা স্বল্প হলেও ধীরে ধীরে তা বিস্তৃত হতে থাকে। যার প্রতিফলন দেখা যায় হোমিওপ্যাথি নিয়ে লেখা অধ্যায়ে। স্যামুয়েল হ্যানিম্যান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই চিকিৎসা পদ্ধতির উত্থান এবং এর কার্যপ্রক্রিয়া নিয়ে বিশদ আলোচনার পর তিনি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন কেন এই পদ্ধতি বর্তমান যুগে মানানসই নয়। এই আলোচনার ফাঁকে একটি নতুন মানসিক প্রভাবের সাথে পাঠকরা পরিচিত হবেন, যাকে বলে প্ল্যাসিবো প্রভাব। এই প্রভাবের ফলে রোগী কোনো ঔষধি গুণাগুণহীন বস্তু সেবনের পরেও নিজে থেকে সেরে ওঠে। প্ল্যাসিবো সম্পর্কে অনেকের কম-বেশি জানাশোনা আছে, কিন্তু সেটা আসল ফলাফলের সাথে কত বড় তফাৎ করে দিতে পারে, তা জেনে রীতিমতো চমকে উঠতে হয়।

প্ল্যাসিবো প্রভাবের ফলে রোগী কোনো ঔষধি গুণাগুণহীন বস্তু সেবনের পরেও নিজে থেকে সেরে ওঠে; Image Source: Vox

দ্বিতীয় কিস্তিতে পাঠকরা আরো গভীর আলোচনায় ডুব দেবেন। এই যাত্রায় যোগ হবে বিশ্বব্যাপী MRSA ড্রাগ সম্পর্কিত ভীতি নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা। হয়তো ভাবছেন, যদি পাঠকের বিজ্ঞান সম্পর্কে মৌলিক ধারণা না থাকে, সেক্ষেত্রে হয়তো বইটি পড়া কঠিন হবে। কিন্তু খুশির খবর, লেখক বইটি শুধু বিজ্ঞানী এবং গবেষকদের জন্য লেখেননি। সাধারণ পাঠকদের কথা চিন্তা করে তিনি বেশ গুছিয়ে গবেষণার মৌলিক ধাপগুলো বর্ণনা করেছেন। কী কী কারণে কোনো পরীক্ষার ফল অগ্রাহ্য করতে হয়, তা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন তিনি। এর মাধ্যমে পাঠকদের নিকট বিজ্ঞান প্রতারণার বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে উঠবে। তাছাড়া বিজ্ঞাপন বা পত্রিকা রিপোর্টে উল্লেখ থাকা বেনামি গবেষণা এবং জরিপ যাচাই করার সঠিক পদ্ধতি নিয়েও তিনি আলোচনা করেছেন।

তথাকথিত পুষ্টিবিদ গিলিয়ান ম্যাককিথ; Image Source: Huffington Post
বিতর্কিত অধ্যাপক প্যাট্রিক হলফোর্ড; Image Source: Galway Now

তবে বইয়ের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অধ্যায় হচ্ছে মুখোশ উন্মোচন পর্ব। এই পর্বে কালের জনপ্রিয় তথাকথিত ‘পুষ্টিবিদ’ ও ভুয়া পিএইচডিধারী গিলিয়ান ম্যাককিথ এবং অধ্যাপক প্যাট্রিক হলফোর্ডের মিথ্যাচারের মুখোশ উন্মোচন করা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইতিমধ্যে দুজনই বেশ কয়েকটি খাদ্য বিষয়ক বেস্ট সেলার বই প্রকাশ করেছেন। দুজনই ইউরোপের বিখ্যাত টেলিভিশন চ্যানেলে স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠান পরিচালনা করে আসছেন। তাদের বইগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ এবং পাল্টা যুক্তির মাধ্যমে লেখক তাদের প্রতারণা তুলে ধরেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তাদের বইতে এত হাস্যকর ভুল তথ্য প্রদান করা রয়েছে যা পড়লে বিজ্ঞানমনস্ক যে কারো চোখ কপালে উঠে যাবে। পাঠক নিজে অনুসন্ধানের মাধ্যমে তাদের ভুয়া ডিগ্রীর রহস্য ফাঁস করেছেন। প্রতারক চক্রের মাধ্যমে ভোক্তাদের ফাঁদে ফেলার পেছনে গণমাধ্যমে ঘৃণ্য ভূমিকা নিয়েও তিনি আলোচনা করেছেন।

গণমাধ্যমের সহায়তায় প্রতারকরা বিজ্ঞানকে কলুষিত করছে; Image Source: Newslaundry

লেখক বেন গোল্ডেকর তার এই অসাধারণ প্রয়াসের জন্য সম্মানজনক রয়্যাল সোসাইটি সায়েন্স বুক পুরষ্কার এবং স্যামুয়েল জনসন পুরষ্কারে শ্রেষ্ঠ বই বিভাগে মনোনীত হন। প্রকাশিত হওয়ার পর ২০০৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বইটিকে দ্য ডেইলি মেইল পত্রিকা ‘সপ্তাহের সেরা স্বাস্থ্য বই’ হিসেবে নির্বাচিত করে। পাঠকদের নিকট ইতিবাচক সাড়া পেয়ে তিনি বইটির নতুন সংস্করণ প্রকাশের কাজে হাত দেন। নতুন সংস্করণগুলোয় বেশ কিছু নতুন অধ্যায় যুক্ত হয়েছে।

সপ্তাহের সেরা স্বাস্থ্য বই ব্যাড সায়েন্স; Image Source: The Daily Mail

বইয়ের বিষয়বস্তু ইউরোপভিত্তিক হলেও এ ধরনের প্রতারণা পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে ভুঁইফোঁড় সংবাদমাধ্যমগুলো বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশ করছে যার আদৌ কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। সাধারণ মানুষ খুব সহজে সেই ফাঁদে পা দিয়ে নিজের ক্ষতি করছে। প্রাথমিকভাবে ক্ষতির পরিমাণ কম হলেও, একসময় সেটা বড় আকার ধারণ করবে। তখন তা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। বেন গোল্ডেকর এই উদ্দেশ্যে আমাদের জন্য বইটি রচনা করেছেন। বিজ্ঞানমনস্ক কৌতূহলী এবং বইপ্রেমীদের জন্য ব্যাড সায়েন্স বেশ উপভোগ্য বই হবে। বৈজ্ঞানিক যুক্তির মোড়কে থ্রিলার বইয়ের স্বাদ পেতে চাইলে এই বইটি হতে পারে সবচেয়ে উপযোগী। আশা করি, বইটি পড়ে আমরা বিজ্ঞান প্রতারণা বিষয়ে আরো সচেতন হবো।

This is a Bangla book review of Bad Science. The writer of this best selling non-fiction book is Dr. Ben Goldacre. This book reveals the truth behind many popular nutritional belief bestowed by some profit hungry businessmen.

References: All the references are hyperlinked.

Feature Image: Washington Post.

 

Related Articles

Exit mobile version