মানুষের বিনোদন মাধ্যমের তালিকায় বর্তমান বিশ্বে সিনেমার স্থান একদম প্রথমদিকে। তাই একটি সিনেমার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে যত সহজে কোনো বার্তা পৌঁছানো যায়, বিনোদনের অন্য কোনো মাধ্যমে অতটা সহজে পৌঁছানো যায় না। সেজন্য আধুনিক বিশ্বে বিনোদনের পাশাপাশি সিনেমা হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের কাছে সমাজের অন্যায়-অবিচার ও অসঙ্গতি তুলে ধরার একটি ভালো মাধ্যম। এছাড়া প্রচার-পোপাগান্ডা, এমনকি জনমত তৈরির ক্ষেত্রেও সিনেমা বর্তমানে একটি মোক্ষম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ মাধ্যমকে সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যবহার করেছে ইহুদিরা। এ সময়ে বিশ্বব্যাপী ইহুদিদের নিয়ে প্রায় দু’শোর কাছাকাছি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ‘মিউনিখ’, ‘দ্য পিয়ানিস্ট’, ‘ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস’, ‘দ্য ডিফায়েন্স’-এর মতো হাই জনপ্রিয় সিনেমাগুলো এর মধ্যে অন্যতম। এসব সিনেমার মাধ্যমে ইহুদিরা পাশ্চাত্যে দারুণভাবে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। একইসাথে সিনেমাগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ফিলিস্তিনের বুকে জোরপূর্বক প্রতিষ্ঠিত ইহুদি রাষ্ট্রটির টিকে থাকার দাবিকেও বৈধতা দিয়ে এসেছে।
সে তুলনায় ফিলিস্তিনের বুকে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে সেখানকার আরব জনগোষ্ঠীর উপর যে ঘন দুর্যোগ নেমে এসেছে, যেভাবে সেখানে ফিলিস্তিনিরা গণহত্যার শিকার হয়েছে, যেভাবে তাদেরকে নিজেদের আবাসভূমি থেকে ব্যাপকভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে, নাটক-সিনেমার পর্দায় তার সিকিভাগও উঠে আসেনি।
তবুও স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যে কয়েকটি সিনেমা ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগের চিত্র যথাযথভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে, তার মধ্যে বাযমান্দেহ (দ্য সারভাইভার) নামক ইরানী সিনেমাটি অন্যতম।
কাহিনীর শুরু যেখান থেকে
সিনেমার কাহিনী শুরু হয়েছে ফিলিস্তিনের হাইফা শহরের এক ডাক্তার ও তার পরিবারকে কেন্দ্র করে। তখনো ফিলিস্তিনের বুকের উপর ‘ইসরায়েল’ নামক রাষ্ট্রটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফিলিস্তিন তখনো ব্রিটিশদের অধীনে। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ব্রিটিশরা এখান থেকে ‘যাই যাই’ করছে। তবু ফিলিস্তিনের বুকের উপর একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যাবতীয় ষড়যন্ত্র প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে তারা। তাই, ইহুদি চরমপন্থী সংগঠনগুলোর উপদ্রবে তটস্থ পুরো জনপদ।
হাইফা তার ব্যতিক্রম নয়। জায়োনিস্টরা শহরটি দখল করে নিতে বদ্ধপরিকর। তাই এই বন্দর নগরীটিও তটস্থ। তবুও সিনেমার প্রধান চরিত্র ডা. সাঈদ নির্ভয়ে সেবা দিয়ে যান হাইফার সাধারণ নাগরিকদের। ইহুদি চরমপন্থী সংগঠনগুলো হাইফার সাধারণ ফিলিস্তিনিদের উপর যে সশস্ত্র হামলা শুরু করে, তাতে নিহত হন সাঈদ ও তার স্ত্রী।
নিহত সাঈদের বাসা দখল করে নেয় পোল্যান্ড থেকে আসা এক নিঃসন্তান ইহুদি দম্পতি। তারা দখল করে সাঈদের একমাত্র জীবিত সন্তান ফারহানকেও। এদিকে বাসায় ফিরে এসে সাঈদের মা জানতে পারেন, ইহুদী পরিবারটি তার ছেলের বাসার সাথে সাথে নাতি ফারহানকেও জবরদখল করে নিয়েছে। বদলে নিয়েছে ফারহানের নাম।
ছেলে আর ছেলের বউকে হারিয়ে দিশেহারা সাঈদের মা কোনোভাবেই নিজের নাতিকে হারাতে চান না। ফারহানই যে তার বংশের শেষ বাতি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সাঈদের মা সেবিকার বেশে চাকরি নেন সেই ইহুদি পরিবারের বাসায়। নাতি ফারহানকে নিয়ে কীভাবে পালানো যায়, আঁটতে থাকেন সে ফন্দি। পরিবারের কবল থেকে ফারহানকে উদ্ধারের প্রাণান্তকর চেষ্টা নিয়ে এগোতে থাকে সিনেমার কাহিনী।
সাঈদের মা কি পারবেন নিজের নাতিকে রক্ষা করতে? নাকি অজস্র ফিলিস্তিনির মতো সাঈদের বংশের শেষ চিহ্নটি নিধনের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে? ফারহান কি হয়ে উঠতে পারবে ‘দ্য সারভাইভার’?
গাসসান কানাফানি, গল্পের স্রষ্টা
ফিলিস্তিন প্রতিরোধ আন্দোলনের বিখ্যাত নেতা, কবি ও সাহিত্যিক গাসসান কানাফানি। তিনি জন্মগ্রহণ করেন হাইফার অদূরে, আক্কা নগরীতে। ইসরায়েলিদের জবরদখলের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৮ সালে হাইফার মাস-এক্সোডাসের শিকার হয়ে আরো অনেক ফিলিস্তিনির মতো কানাফানিও নিজ জন্মভূমি ছাড়তে বাধ্য হন। আশ্রয় নেন লেবাননে। পরবর্তীতে যোগ দেন ফিলিস্তিন প্রতিরোধ আন্দোলনে। ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে তিনি রচনা করেন বিখ্যাত সব কবিতা-প্রবন্ধ-উপন্যাস। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘রিটার্ন টু হাইফা’। আর এ উপন্যাস অবলম্বনে ‘বাযমান্দেহ’ নির্মিত হয়েছে। উপন্যাসটি প্রকাশের কয়েক বছর পর কানাফানিকে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ হত্যা করে।
শিল্পীরা
এই সিনেমায় শামুন নামক এক ইহুদি চরমপন্থী নেতার চরিত্রে অভিনয় করেন বিখ্যাত সিরিয়ান অভিনেতা গাসসান মাসুদ। ফিলিস্তিনে ইহুদী উগ্রবাদী সংগঠনের বর্বর নেতা হিসেবে শামুন চরিত্রকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন দুর্দান্তভাবে। হলিউডের বিখ্যাত সিনেমা কিংডম অভ হেভেনে অভিনয় করে এই অভিনেতা রীতিমতো ‘সালাউদ্দীন আইয়ুবী’ খেতাব পেয়ে গিয়েছিলেন।
ডা. সাঈদের চরিত্রে অভিনয় করেছেন আরেক সিরিয়ান অভিনেতা জামাল সুলেয়মানি। মজার ব্যাপার হলো, তিনিও সিরিয়ান একটি টিভি সিরিজে সালাউদ্দিন আইয়ুবী চরিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি লাভ করেন। সাঈদের বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছেন আল আলদীন কুশ, মায়ের চরিত্রে ছিলেন অভিনেত্রী সালমা আল মাশরি।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
চলচ্চিত্রটির মূল দৃশ্যপট হাইফায় ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে সংঘটিত ইসরায়েলের অপারেশন পাসওভার ক্লিনিং। যার নেতৃত্ব দেয় ইহুদি চরমপন্থী সংগঠন হাগানা। যুদ্ধে সাধারণত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত দুটি পক্ষ থাকলেও হাইফা যুদ্ধে সেটি ছিল না। ভারি অস্ত্রসজ্জিত ইসরায়েলের সে বর্বর হামলার বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি ফিলিস্তিনিরা। এর পরেও পশ্চিমারা একে ‘হাইফা হত্যাকাণ্ড’ বা ‘হাইফা এক্সোডাস’ না বলে ‘হাইফা যুদ্ধ’ বলে। ইসরায়েলের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকাণ্ড এবং জোরপূর্বক উচ্ছেদাভিযানকে বৈধতা দেবার জন্যই যে তাদের এ যে বুজরুকি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ অভিযানে ইহুদিরা হাইফাবাসীদের উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে উচ্ছেদ করে নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে। ভূ-কৌশলগতভাবে অন্তত গুরুত্বপূর্ণ এ শহর দখল করে নেয় তারা। সমুদ্রের নীল আভায় রঞ্জিত হাইফা সিক্ত হয় ফিলিস্তিনিদের লাল রক্তে। নারকীয় দুর্ভোগে পড়ে এ অঞ্চলের সাধারণ ফিলিস্তিনি অধিবাসী, যা আজও বংশপরম্পরায় বয়ে বেড়াচ্ছে তারা। ‘বাযমান্দেহ’ চলচ্চিত্রে হাইফার ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরায়েলের সেসব বর্বরতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
নির্মাণশৈলী
সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে প্রায় ছাব্বিশ বছর আগে। স্বাভাবিকভাবে এতে নানা প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবুও কাহিনীর বিন্যাস এবং সাসপেন্স তৈরিতে পরিচালক সাইফুল্লাহ দাদ যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন, তা যেন সব সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে গেছে।
আধুনিক সিনেমাটোগ্রাফির ছাপ এতে দেখতে পাওয়া যায় না। তবুও সিনেমার সেট তৈরি এবং চিত্রায়নের দক্ষতা কাহিনীটি অনেক বেশি বাস্তবিক করে তুলেছে। এতে কুশীলবদের কৃতিত্বও কম নয়। প্রতিটি খুঁটিনাটি চরিত্র নিখাদভাবে ফুটে উঠেছে অকৃত্রিম অভিনয় দক্ষতার মাধ্যমে। এটিই সম্ভবত ইরানী চলচ্চিত্রগুলোর সবচেয়ে শক্তিশালী দিক।
কেন দেখবেন ‘বাযমান্দেহ’
ফিলিস্তিন সংক্রান্ত প্রাচ্যের সংবাদমাধ্যমগুলোর সাধারণ ফুটেজ ও ছবি দেখে দর্শকের কল্পনায় ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগের যে চিত্র অঙ্কিত হয়, ‘বাযমান্দেহ’ যেন তাকেই বাস্তবে রূপ দিয়েছে। সিনেমাটি ফিলিস্তিনের অবহেলিত শোকগাথাকে প্রাণ দিয়েছে। প্রতিটি দৃশ্য টানটান উত্তেজনায় পরিপূর্ণ, ফিলিস্তিনের দুঃখে ভারাক্রান্ত। সিনেমায় ফারহানের বেঁচে থাকার প্রার্থনায় দর্শক শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত অপলক দৃষ্টিতে পর্দায় তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হবেন। এমনকি সিনেমা শেষ হওয়ার পরও দর্শকের মনে সে প্রার্থনার রেশ রয়ে যাবে। দর্শক অশ্রুসিক্ত হবেন। প্রার্থনায় বলে উঠবেন,
”ফিলিস্তিনের ফারহানরা বেঁচে থাকুক, ফিলিস্তিন ফারহানদের হোক, ফিলিস্তিন ফিলিস্তিনিদের হোক।”