রহস্য কিংবা রোমাঞ্চকর কোনো কিছুর প্রতি মানুষের একটা আলাদা আকর্ষণ কাজ করে। রহস্য যত বেশি ঘনীভূত হয়, তত বেশি সেটি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে মানুষের কাছে। বই পড়ুয়ারা এই রহস্যের স্বাদ বইয়ের মধ্যে খুঁজে পেতেই যেন বেশি ভালোবাসে। গল্প, উপন্যাসের রহস্যে ঘেরা চরিত্রের সাথে সেও যেন ডুব দেয় রহস্যের সমুদ্রে। যে কাল্পনিক চরিত্রগুলোকে কেন্দ্র করে গল্প বা উপন্যাসগুলো রচিত হয় সেগুলোর মধ্যে পাঠক বাস্তবতাকে খুঁজতে থাকে, কারণ রোমাঞ্চকর চরিত্র কিংবা ঘটনা তাকে অনেক ভাবিয়ে তোলে, তাই সে সত্যিকারভাবে তার অস্তিত্বের সন্ধান পেতে চায়।
পাঠকের মনের এই তৃষ্ণাকে মেটাতে পারে এমন একটি বইয়ের খবর আজ দিতে চাই, যে বইয়ের চরিত্রগুলো পুরোপুরিভাবে বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া এবং যা পাঠককে প্রতি মুহূর্তে শিহরিত করে তুলবে। শুধু কী তা-ই! পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন কিছু রাষ্ট্রের রহস্যময় কিছু ঘটনা, রাজনীতির খবরাখবর যে বইটি পাঠককে দেবে তার নাম ‘স্পাই স্টোরিজ – এসপিওনাজ জগতের অবিশ্বাস্য কিছু সত্য কাহিনি‘; লিখেছেন মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা।
মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা পেশায় একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। জন্মের পর থেকেই তার বসবাস লিবিয়াতে। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হলেও শখ রয়েছে বিচিত্র বিষয়ে। ইতিহাস, তথ্যপ্রযুক্তি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে জানতে, চিন্তা করতে এবং এসব বিষয়ে লেখালেখি করতে তিনি পছন্দ করেন।
‘স্পাই স্টোরিজ’ বইটি রচিত হয়েছে ছয়জন সত্যিকার গুপ্তচরের শ্বাসরুদ্ধকর কিছু ঘটনার আলোকে। বইয়ের মূল আকর্ষণই হলো এর প্রত্যেকটি ঘটনা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। লেখক এখানে মূলত সেসব গুপ্তচরদের নিয়ে লিখেছেন, যারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, কিন্তু আলোচনায় সেভাবে উঠে আসতে পারেননি। যে ছয়জন গুপ্তচরের কাহিনি এতে বর্ণিত আছে, তারা হলেন অ্যাডলফ তোলকাচভ, ব্রায়ান রিগ্যান, এজেন্ট স্টর্ম, শুলা কোহেন, আশরাফ মারোয়ান ও আনা মন্টেজ।
সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা সিআইএ (CIA) যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাধীন একটি বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা। এই সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ একজন স্পাই ছিলেন সি.কে স্ফিয়ার (ছদ্মনাম), যার আসল নাম অ্যাডলভ তোলকাচভ, যাকে বলা হয় বিলিয়ন ডলার স্পাই। অ্যাডলভ তোলকাচভ ১৯৭৯-৮৫ সাল পর্যন্ত সিআইএ-র হয়ে কাজ করেন। সিআইএ-র হয়ে কাজ করলেও মূলত তিনি ছিলেন সোভিয়েত মিলিটারি এস্টাবলিশমেন্টের উচ্চপর্যায়ের একজন রাডার বিশেষজ্ঞ।
ব্রায়ান রিগ্যান ‘স্পাই’ শব্দটির সাথেই তিনি পরিচিত ছিলেন না। কিন্তু পরিস্থিতি একসময় তাকে বাধ্য করে রহস্যময় এই জগতে প্রবেশে।
এজেন্ট স্টর্ম ছিলেন একজন সিআইএ স্পাই, যার প্রকৃত নাম মর্টেন স্টর্ম। উচ্ছৃঙ্খল ছিল তার জীবনযাপন। ধর্মান্তরিত হয়ে উগ্রপন্থী বন্ধুদের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে প্রথমে তিনি আল কায়দায় যোগদান করেন। এরপর সেখান থেকে বের হয়ে কাজ করেন বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে।
মানুষকে আকৃষ্ট করবার অসাধারণ এক ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন শুলা কোহেন, যার পুরো নাম শুলামিত আরজাই কোহেন। তার এসপিওনাজ জীবনে প্রবেশ করা নিয়ে মতভেদ আছে। দীর্ঘ ১৪ বছর তিনি নিভৃতে গুপ্তচরবৃত্তির সাথে জড়িত ছিলেন।
আশরাফ মারোয়ান ছিলেন ইসরায়েলের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা। অনেকেই তাকে ডাবল এজেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করে, কারণ তিনি একজন মিশরীয়। ইসরায়েলের এজেন্ট হয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও মিশরীয় কর্তৃপক্ষও তাকে তাদের এজেন্ট হিসেবে দাবি করে। আশরাফ মারোয়ানের মৃত্যুর পর মিশরীয় কর্তৃপক্ষ তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করে। মারোয়ানের মৃত্যুকে ঘিরে রয়েছে অমীমাংসিত রহস্য।
আনা মন্টেজ ছিলেন ডিআইএর (DIA – Defense Intelligence Agency) একজন সিনিয়র অ্যানালিস্ট। তার কাজ ছিল কিউবা সংক্রান্ত বিভিন্ন গোয়েন্দা-তথ্য বিশ্লেষণ করা। কিউবার উপর তার সীমাহীন জ্ঞান এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতার কারণে কর্মক্ষেত্রে তার উপাধি ছিল ‘কুইন অফ কিউবা’ তথা ‘কিউবার রানি’।
‘স্পাই স্টোরিজ’ বইয়ে উল্লেখিত গুপ্তচরদের একেকটি ঘটনা এত বেশি শিহরিত করবার মতো যে, পাঠকের কাছে তা অবিশ্বাস্য বলে মনে হতে পারে। খুব স্বাভাবিকভাবে একজন পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, এই বইয়ে উল্লেখিত ঘটনাগুলোর সত্যতা কতটুকু? লেখক কি আদৌ সত্য লিখেছেন নাকি মনের মাধুরী মিশিয়ে একেকটি কাহিনি রচনা করেছেন। পাঠকদের এই প্রশ্নের উত্তর বইয়ের মধ্যেই আছে। প্রত্যেকটি কাহিনি শেষে লেখক তথ্যসূত্র উল্লেখ করেছেন।
এই বইটি একজন পাঠক কেন পড়বেন বা কেন পড়া উচিত তার কয়েকটি কারণ দাঁড় করানো যেতে পেরে।
১) প্রথমত, কাল্পনিক জগৎ থেকে বেরিয়ে পাঠক পরিচিত হতে পারবেন ছয়জন সত্যিকারের স্পাইয়ের সাথে, যাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত অতিবাহিত হয়েছে নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে। পর্দায় জেমস বন্ডকে দেখতে বা বইয়ের পাতায় মাসুদ রানাকে পড়তে গিয়ে আমরা কত বেশি শিহরিত হয়ে উঠি, তাই না? আর এখানে তো পুরো ছয়জন সত্যিকারের স্পাইয়ের রোমহর্ষক কাহিনিই বর্ণিত!
২) বইয়ে ছয়জন গুপ্তচরের গুপ্তচরবৃত্তির পাশাপাশি একজন পাঠক তখনকার সময়ের দেশগুলোর রাজনৈতিক অবস্থা, বিশেষ করে বিশ্বরাজনীতির মোড় তারা কতটা বিচক্ষণতার সাথে ঘুরিয়েছেন, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কেও অবগত হতে পারবেন নিঃসন্দেহে।
৩) অনেক পাঠক আছেন, যারা ‘গুপ্তচর’ শব্দটির সাথে পরিচিত নন কিংবা বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা সম্পর্কেও তারা তেমন কিছু জানেন না। তাদের জন্য বইটি একটি মাস্টারপিস।
৪) বইটির একটি বিশেষত্ব হলো, নিমিষেই আকৃষ্ট করে ফেলতে পারে। শব্দের মায়াজালে পাঠককে ধরে রাখবার ক্ষমতা লেখক খুব ভালোভাবেই রপ্ত করেছেন। সহজ এবং প্রাঞ্জল উপস্থাপনার কারণে পাঠক এই বইয়ে মুগ্ধতা খুঁজে পাবেন এবং শুরু থেকে শেষপর্যন্ত একই মায়াজালে আটকে থাকবেন।
বইটি সংগ্রহ করতে
বই নাম – স্পাই স্টোরিজ
লেখক – মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা
প্রকাশনী: স্বরে অ
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২০
মুদ্রিত মূল্য: ২৭০ টাকা