সিরিয়াল কিলারদের মানসিক বিকারগ্রস্ততা সাধারণ মানুষকে রীতিমতো আতঙ্কিত করে তোলে। এরশাদ শিকদারের ত্রাসের রাজত্বে খুলনার নিরীহ জনগণ যখন ভীতসন্ত্রস্ত ছিল, তখন খুলনা থেকে অনেকটা দূরে থাকা সত্ত্বেও ঢাকার মানুষকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল সেই ভয়ের আবহ। এই ভয় আর আতঙ্ককে ছাড়িয়ে কেন জানি সিরিয়াল কিলারদের প্রতি একধরনের ঋণাত্মক আকর্ষণ অনুভব করে অনেকে। তাদের প্রতিটি অপরাধকর্মের খুঁটিনাটি জানতে উৎসাহী হয়ে ওঠে তারা। সেক্ষেত্রে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ কিংবা সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ক্রাইম ডকুমেন্টরিই তাদের কৌতূহল নিবারণের একমাত্র উপায়। কিন্তু এমনটা যদি হত যে আমরা বইয়ের দোকানে গিয়ে সরাসরি সিরিয়াল কিলারদের লেখনীতেই জানতে পারবো তাদের সাথে আদতে কী, কেন আর কিভাবে ঘটেছিল তাহলে কেমন হতো? প্রিয় লেখক তো আমাদের সবারই আছেন, তখন নাহয় প্রিয় সিরিয়াল কিলার লেখক নামে আলাদা একটি ক্যাটাগরির সাথে পরিচিত হতাম আমরা!
এতক্ষণ ধরে যে প্রসঙ্গের অবতারণা করার চেষ্টা করছিলাম বাস্তবে সেই ঘটনাটি ঘটে গেছে উনিশ শতকের নব্বইয়ের দশকে। হ্যাঁ, সিরিয়াল কিলারদের লেখা বইয়ের কথাই বলছিলাম। যাদেরকে আমরা জঘন্য মানসিকতার খুনি হিসেবে জানি, সাহিত্যে তারাও রেখেছে উল্লেখযোগ্য অবদান। বেশিরভাগ প্রকাশকই এমন কুখ্যাত লেখকের বই ছাপাতে বিব্রত বোধ করেন। এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে ‘সন অফ স্যাম লস’ নামক আইনটি প্রশংসার দাবিদার। কেননা ১৯৭০ এর দশকের শেষভাগে পাস হওয়া এই আইনটিতেই সর্বপ্রথম বলা হয় সিরিয়াল কিলাররা তাদের অপরাধজীবন নিয়ে কোনো বই লিখলে নিজেরা তার লভ্যাংশের দাবিদার হতে পারবে না। এমন আগ্রহ জাগানিয়া মানুষদের আত্মজীবনী থেকে প্রাপ্ত মুনাফা প্রকাশকরা তুলে দেন ভিক্টিমের পরিবারের হাতে।
লেখক হিসেবে সিরিয়াল কিলারদের বিষয়টি যদি আপনাকে কৌতূহলোদ্দীপক করে তোলে, তবে তাদের লেখা কয়েকটি বই সম্পর্কে জেনে নিলে মন্দ হয় না।
এ কোয়েশ্চন অফ ডাউট, জন ওয়েন গেসি এবং শেন বাগবি
জন ওয়েন গেসি, যিনি ‘দ্য কিলার ক্লাউন’ নামে অধিক পরিচিত, সর্বকালের সর্বনিকৃষ্ট সিরিয়াল কিলারদের মধ্যে অন্যতম। প্রায় ৩৩ জনকে খুন করেছেন তিনি যাদের সবার বয়স ছিল ৯-২০ বছরের মধ্যে। যে কুরুচিপূর্ণ অপরাধের জন্য তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন সেই অপরাধটি সম্পন্ন করতে তাকে ভিক্টিম বেছে নিতে হয়েছে অনেক কষ্ট করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল তার পরিচিত, আবার কেউ ছিল নিছকই ঘরপালানো ভীরু কিশোর অথবা রাস্তার ধারে অপেক্ষারত বারবনিতা। একবার ভিক্টিমকে নিজের ঘরে আনতে পারলে তাদেরকে হাতকড়া পরিয়ে দিয়ে জাদু দেখার জন্য অপেক্ষা করতে বলতো গেসি। আটকা পড়া ভিক্টিমের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে যেত নির্মম সব অত্যাচার আর ধর্ষণের প্রক্রিয়া। মুহুর্মুহু এসব অত্যাচারের ফাঁকে এক সময় শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলা হতো ভিক্টিমকে আর মৃতদেহ লুকিয়ে ফেলা হত গেসির বাড়ির নিচের ছোট স্পেসটিতে।
শেন বাগবির সহায়তায় গেসি লিখে ফেলেন ‘এ কোয়েশ্চন অফ ডাউট’ বইটি। এখানে তিনি দাবি করেন তার বাড়ির নিচে খুঁজে পাওয়া মৃতদেহগুলোর হত্যা রহস্যের পেছনে তার চেয়ে অপর পক্ষেরই দোষ বেশি। বইটির মুখবন্ধে তিনি বলেন,
“এটি আমার সমগ্র জীবনের গল্পে ভরা কোনো আত্মজীবনী নয়, বরং এটি হলো সেই বিভীষিকার বর্ণনা যা ১১ ডিসেম্বর, ১৯৭৮ থেকে ১৩ মার্চ, ১৯৮০ পর্যন্ত আমার সাথে ঘটে গেছে। পুলিশ ও গণমাধ্যম নির্মিত মিথ্যা, বানোয়াট ও প্রতারণার ইতিহাস এটি।”
১৯৯৩ সালে বইটি প্রায় ৫০০ কপির মতো মুদ্রিত হয়। এখন আর বইটি নতুন করে ছাপানো হয় না।
ফাইনাল ট্রুথ, ডোনাল্ড গাসকিন্স এবং উইলটন আর্ল
আমেরিকান সিরিয়াল কিলার ডোনাল্ড গাসকিন্স তার ৫’৪” উচ্চতার ছোটখাটো শারীরিক অবয়বের জন্য ‘পি উয়ি গাসকিন্স’ নামেই বেশি পরিচিত। ১৩ জনকে খুন করে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার জঙ্গলে দাফন করে আসে গাসকিন্স- এমনটাই জানে সবাই। ১৯৭৫ সালে আটটি খুনের জন্য তার সাজা হলেও এই আত্মজীবনীতে তিনি বলে গেছেন জীবদ্দশায় তার হাতেই ঝরে পড়েছে ১১০টি প্রাণ।
ব্যক্তিগতভাবে যারা গাসকিন্সকে চিনতো তারা সবাই তাকে একজন কর্মঠ ও বন্ধুভাবাপন্ন মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অস্বাভাবিকতা বলতে হিয়ারস বা শবদেহ বহনকারী এক ধরনের যানবাহন ব্যবহার করাটাই সবার চোখে লাগে। ১৯৯১ সালে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। প্রাথমিকভাবে তাকে আজীবন কারাদণ্ড দেয়া হলেও জেলখানার আরেক কয়েদীকে হত্যা করার পর তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
উইলটন আর্ল গাসকিন্সের সাক্ষাৎকার নিয়ে ‘ফাইনাল ট্রুথ’ নামক আত্মজীবনীটি সম্পাদনা করেন। আর্লের সাথে কথা বলতে গিয়ে গাসকিন্স জানান সারাজীবন তিনি এক অদ্ভুত বিরক্তিকর ও বিব্রতকর অনুভূতির মধ্যে দিয়ে গেছেন যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তার মনে হত এই অনুভূতিগুলো কেবল সহিংসতা দিয়েই প্রশমিত করা সম্ভব। আর এজন্যই একের পর এক নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়ে গেছেন গাসকিন্স। ‘ফাইনাল ট্রুথ’ এখন আর ছাপা হয় না।
কিলার ফিকশন, জেরার্ড জন শেফার
জেরার্ড জন শেফার মাত্র দুইটি হত্যাকাণ্ডের জন্য সাজাপ্রাপ্ত হন, তবে ধারণা করা হয় তিনি আরও অসংখ্য খুনের জন্য দায়ী ছিলেন। তার প্রকৃত শিকারের সংখ্যা জানা না গেলেও তিনি নিজমুখে ৮০ জনেরও বেশি নারীকে খুন করার কথা স্বীকার করেছেন। ১৯৭৩ সালে সুসান প্লেস এবং জর্জিয়া জেসাপ নামে দুই কিশোরীকে হত্যা ও নির্যাতনের অপরাধে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। ধীরে ধীরে তার কাছ থেকে আরও বেশ কিছু খুনের আলামত খুঁজে পায় পুলিশ। তিনি নিজেই কথা প্রসঙ্গে অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের কথা বলতেন। তার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে অনেক নিখোঁজ নারীদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
‘কিলার ফিকশন’ শেফারের গল্পগুলো নিয়ে রচিত একটি উপন্যাস। ১৯৯০ সালে সোন্দ্রা লন্ডন বইটি প্রকাশ করেন। স্কুলজীবনে লন্ডন শেফারের প্রেমিকা ছিলেন। লন্ডনের কাছে তাই অকপটে নিজের সব হত্যাকাণ্ডের কথা জানান শেফার। এই হত্যাগুলো তার কাছে ছিল রীতিমতো শিল্প। বইটি যখন পুলিশের হাতে পড়ে, তখন এই ফিকশন বা বানানো গল্পগুলোর মধ্যে সত্যের ছোঁয়া খুঁজে পান তারা। ‘কিলার ফিকশনের’ সংশোধিত সংস্করণে একটি চিঠি জুড়ে দেয়া হয় যা শেফারের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী হিসেবে সমাদৃত। চিঠিতে শেফার জিজ্ঞেস করে,
“কোন কোন হত্যার কথা আমি স্বীকার করব? ফার্মার? ব্রিস্কোলিনা? তোমার কি মনে হয় হত্যাকারী দৈত্য আসলে কী? তুমি স্বীকারোক্তি চাও ঠিকই কিন্তু এটা বুঝতে পারো না যে এই স্বীকারোক্তির সাথে মিশে আছে শবযাত্রায় তোমার নিমন্ত্রণ”।
দ্য মেকিং অফ এ সিরিয়াল কিলারঃ দ্য রিয়েল স্টোরি অফ দ্য গেইনসভিল মার্ডারস ইন দ্য কিলার’স ওউন ওয়ার্ডস, ড্যানি রোলিং এবং সোন্দ্রা লন্ডন
ড্যানি রোলিং ছিল একজন প্রোফিলিক সিরিয়াল কিলার যে কিনা ‘গেইনসভিলের রিপার’ নামেই কুখ্যাত। ফ্লোরিডায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার ক্ষেত্রে পূর্বসূরি টেড বান্ডিকে অনুসরণ করেছিল সে। ১৯৯০ সালে হত্যার নেশায় উন্মত্ততায় কাটানো ৪৮ ঘণ্টায় রোলিং হত্যা করে একজন পুরুষকে আর ধর্ষণের পর খুন করে চারজন নারীকে। হত্যা করার পর রোলিং মৃতদেহগুলোর অঙ্গচ্ছেদ করা শুরু করে আর তাদেরকে বিকৃত সব ভঙ্গিতে সাজিয়ে রাখে। একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। এক ভিক্টিমের মাথা কেটে শেলফের উপর এমনভাবে সাজিয়ে রাখে রোলিং যে দেখলে মনে হবে যেন মাথাটি তার শরীরের দিকে তাকিয়ে আছে।
‘দ্য মেকিং অফ এ সিরিয়াল কিলার’ বইটিতে রোলিং গেইনসভিলের পাঁচজন কলেজ ছাত্র হত্যাকাণ্ডের বীভৎস বর্ণনা দেয়। শৈশবে কোন পরিস্থিতিতে সে বেড়ে উঠেছে এবং কিভাবে সে একজন খুনিতে পরিণত হয় তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে বইটিতে। এই বইটির সহলেখক সোন্দ্রা লন্ডন ছিলেন রোলিং এর বাগদত্তা। এই সেই লন্ডন যিনি শেফারের স্কুলজীবনের প্রেমিকাও ছিলেন বটে। বইয়ে বর্ণিত পাঁচটি নির্মম হত্যাকাণ্ডের জের ধরে ২০০৬ সালে রোলিংকে লিথাল ইনজেকশন প্রয়োগ করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
দ্য স্ট্রেঞ্জ কেস অফ ডক্টর এইচ.এইচ হোমস, জন বরোস্কি
এইচ.এইচ হোমস নামে বহুল পরিচিত হারমান ওয়েবস্টার মাজেটকে আমেরিকার একদম শুরুর দিকের সিরিয়াল কিলারদের পথপ্রদর্শক বলে মনে করা হয়। ১৮৯০ এর দশকে ২৭ জনকে খুন করেছে বলে একটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিলেও হোমসের হাতে নিহতের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গেছিল বলেই মনে করা হয়। দীর্ঘদিন যাবত নিখোঁজ থাকার পরও শেষ পর্যন্ত ৯টি হত্যাকাণ্ডের প্রমাণসহ পুলিশ তাকে খুঁজে বের করে।
মাজেটের মূল টার্গেট ছিল শিকাগো। সেখানকার নিরীহ শিকারদের মিষ্টি কথায় বশ করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করে মেরে ফেলে লাশগুলো তার ‘মার্ডার ক্যাসল’ এই গুম করে দিত মাজেট। বেঞ্জামিন পেটজেলের মৃত্যুতে সবার টনক নড়ে আর তার জের ধরেই ফাঁসি হয় এই দুর্ধর্ষ সিরিয়াল কিলারের।
কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় মাজেট তথা হোমসকে একাধিক ট্যাবলয়েড সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য মোটা অঙ্কের অর্থের প্রলোভন দেখায়। কিন্তু তার কনফেশন ছিল যাকে বলে একেবারেই রাবিশ। পারিবারিক দুরবস্থার দোহাই দিয়ে তার উপর শয়তান ভর করেছিল বলে জানায় হোমস। তার বিবৃতি অনুযায়ী, “শয়তানকে সাথে নিয়েই আমি জন্মগ্রহণ করেছি”।
‘দ্য স্ট্রেঞ্জ কেস অফ ডক্টর এইচ.এইচ হোমস’ হোমসের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। ১৮৯৫ সালে বইটি লেখার কাজে হাত দেয়া হয় আর সেই কাজ শেষ হয় ১৮৯৬ সালে। বইটিতে স্বহস্তে সংঘটিত ২৭টি খুনের নৃশংস বর্ণনা দিয়েছে মানসিক বিকারগ্রস্ত এই সিরিয়াল কিলার।