আচ্ছা, ইন্টারোগেশন রুমে আদতে কী হয়? সাধারণত, অপরাধীকে টর্চার বা নির্যাতন করে তার মুখ থেকে সত্যিটা বের করা হয়। আবার অনেক সময় দেখা যায় যে, একজন নিরপরাধ ব্যক্তিও অকথ্য নির্যাতন সইতে না পেরে অকপটে না করা অপরাধটাও স্বীকার করে নেয়। এই ধরনের ঘটনার কথা আমরা অহরহ শুনে থাকি।
আর কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যাতে এই ধরনের কোনো হীনতার স্বীকার না হয়, তাই পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রসমূহে মানবিকতার আইনের কারণে অপরাধী যত বড় অপরাধই করুক না কেন সে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পায়। অর্থাৎ সে নিজের উকিল রাখতে পারে। আর উকিলের পরামর্শ মতে অপরাধী একটা নির্দিষ্ট সময় মেনে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের সময়টুকু কোনোক্রমে কাটিয়ে সাধারণ অপরাধে দণ্ডিত হয়ে, এমনকি ছাড়াও পেয়ে যেতে পারে।
তাহলে তো উন্নত বিশ্বে অপরাধ প্রবণতা অনেক বেশি হবার কথা; কিন্তু আদতে দেখা যায় অপরাধ প্রবণতা কম। আর তার কারণ হচ্ছে, যেহেতু অপরাধী অপরাধ করার পরও এত সুযোগ পাচ্ছে তাহলে অপরাধীর মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য সেরকম জেরাকারী পুলিশ অফিসারও তাদের আছে। কোনো ধরনের শারীরিক নির্যাতন নয়; কিংবা ভয় প্রদর্শন নয়। শুধুমাত্র মনস্তাত্ত্বিকভাবে অপরাধীর মনোবল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে সত্যটাকে টেনে বের করে আনাই যাদের কাজ। এমনকি তাতে যদি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কিংবা দিনের পর দিন লাগে। এমনকি যদি বছরও লাগে তাতেও সমস্যা নেই। কেননা, তাদেরকে সেভাবেই প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হয়।
গত সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখ নেটফ্লিক্স থেকে বের হয়েছে ক্রাইম ড্রামা ভিত্তিক টিভি সিরিজ ক্রিমিনাল। বলা হচ্ছে, এই সিরিজটা এমন একটা সিরিজ যেটা দেখে হয় আপনার খুব ভালো লাগবে, আর নয়তো খুব বেশি খারাপ লাগবে!
খুব ধীরগতিতে আপনার আগ্রহকে খুব সূক্ষ্মভাবে ধরে রাখা এই সিরিজের জন্ম হয়েছে জর্জ কেই এবং জিম ফিল্ড স্মিথ এর হাত ধরে। প্রথম সিজনে আছে মোট বারোটি এপিসোড, যা চারটি দেশে বিভক্ত। অর্থাৎ একই ধারার ভিন্নধর্মী গল্পে চারটি দেশের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধরে রেখে প্রথম সিজন সাজানো হয়েছে। প্রত্যেকটি দেশের ভিন্নধর্মী তিনটি গল্প আর প্রত্যেক দেশেরই আলাদা গোয়েন্দার দল; সব মিলিয়ে চারটি দেশের বারোটি গল্প। তবে একই সেটে অর্থাৎ একই ইন্টারোগেশন রুমে প্রত্যেকটি দেশেরই দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে শুধুমাত্র অভিনয়/অভিনেত্রী বদলে। মূল শিরোনামের সাথে কেবল দেশের নাম জুড়ে দিয়ে আলাদা শিরোনাম করা হয়েছে সিরিজটিতে। যেমন- ক্রিমিন্যাল জার্মানি, ক্রিমিন্যাল ফ্রান্স, ক্রিমিন্যাল স্পেন এবং ক্রিমিন্যাল ইউকে (যুক্তরাজ্য)।
ইন্টারোগেশন রুমে বা পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের ঘরে একজন গোয়েন্দা পুলিশ অফিসার এবং একজন সন্দেহভাজন অপরাধীর প্রশ্নোত্তর পর্বের এক দারুণ মনস্তাত্ত্বিক গল্প ফুটে উঠেছে প্রতিটা গল্পে। প্রত্যেকটি প্রশ্নোত্তর পর্বই প্রত্যক্ষভাবে হলেও তা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত। আয়নার ওপাশে থাকা দলের বাকি আর উচ্চপদস্থ সদস্যদের দ্বারাও প্রভাবিত প্রতিটি গল্পই। আপনি ধুন্ধুমার মারামারি কিংবা বিভৎস কাটাকাটির দৃশ্য এতে পাবেন না।
তবে আপনি যদি ঠাণ্ডা মাথার মনস্তাত্ত্বিক কোনো খুনিদের সাথে পরিচিত হতে চান, তবে নেটফ্লিক্সের এই সিরিজ আপনার জন্যেই। অপরাধী পুরো খেলাটাই খেলে তার সংলাপের মাধ্যমে আর গোয়েন্দা অফিসাররাও সুযোগে সদ্ব্যবহারের আশায় বসে থাকে অপরাধীর সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অপরাধী আর গোয়েন্দার এ যেন এক ইঁদুর-বেড়াল খেলা।
প্রতিটি খন্ডে আলাদা আর ভিন্নধর্মী গল্প হওয়াতে এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গল্পগুলো অবিশ্বাস্য রকমের হজমযোগ্য। প্রত্যেকটি খণ্ড থেকেই একটি করে সেরা গল্পের বিবরণ দেওয়া হলো পাঠকদের স্বার্থে। তবে এটাও বলতে হয় যে, প্রতিটা গল্পই যেহেতু মৌলিক, তাই আলাদাভাবে তিনটির মধ্যে একটিকে সেরা বলা অযৌক্তিকই বটে। তবে তা-ও ভালোলাগা বলে একটা ব্যাপার থাকে।
ক্রিমিনাল: জার্মানি
শুরুতেই ইন্টারোগেশন রুমে হাতে অসংখ্য কাটা দাগ সম্বলিত দেখতে খানিকটা বিভৎস এক নারীকে দেখা যায়। গোয়েন্দা অফিসার শ্যুলজ ইন্টারোগেশন রুমে প্রবেশ করে এবং ক্লডিয়ার সামনে একটা মানচিত্র বিছিয়ে দেয় যেটাতে কয়েকজন তরুণীর ছবি পিন দিয়ে আটকানো। আর ক্লডিয়াকে জিজ্ঞেস করে মেলানি ওয়েস এর দেহটা কোথায় সমাধিস্থ করা হয়েছে।
গল্পের শুরুটা পড়ে আপনি ঠিক যতটা সহজ ভাবছেন ততটা সহজ নয় গল্পটা। কেননা, ক্লডিয়া সারাজীবন জেল খাটতে রাজি; এমনকি যেকোনো ধরনের অত্যাচার বা নির্যাতনও সহ্য করতে রাজি; কিন্তু কোনোক্রমেই সে তার মুখ খুলবে না। শ্যুলজ ব্যর্থ হয় ক্লডিয়ার কাছ থেকে কোনো তথ্য বের করতে। আর তাই গোয়েন্দা অফিসার কেলার আসে ক্লডিয়ার সাথে কথা বলতে, যিনি কিনা আবার গর্ভবতী।
আর তখনই আমরা জানতে পারি যে, স্প্রিডওয়াল মার্ডার (সিরিয়াল কিলার) এর জন্য পরিচিত মার্ক ক্রয়েটজারের সাবেক প্রেমিকা এই ক্লডিয়া হার্টম্যান। কিন্তু ক্লডিয়া যত নির্দয় আর মানসিক শক্তিসম্পন্ন সিরিয়াল কিলারই হোক না কেন, আদতে সেও একজন রক্তমাংসেরই মানুষ। আর মানুষ মাত্রই কোনো না কোনো দুর্বল দিক সমৃদ্ধ এক সত্ত্বা। আর কেলার ঠিক ঐ সত্ত্বাটাকেই আঘাত করে। গল্প এগিয়ে চলে।
ক্রিমিনাল: ফ্রান্স
একটি ড্যান্স ক্লাবে সন্ত্রাসীদের আক্রমণে ভেতরে থাকা বেশিরভাগ লোকজনই মারা যায়, এমিলি বেঁচে যাওয়া একজন। এমিলির সাথে থাকা ওর প্রেমিক অ্যালেক্সও মারা গেছে কিন্তু তার শরীরে একটি আঁচড়েরও দাগ নেই। অ্যালেক্সেরই কাছের কেউ এমিলির বিরুদ্ধে মামলা করে, আর সে সুবাদেই চলছে এমিলির জিজ্ঞাসাবাদের পর্ব।
এমিলির বয়ানে, কাউন্টার থেকে বিয়ার নিয়ে অ্যালেক্সের কাছাকাছি চলে আসার মুহুর্তে আক্রমণটা হয়। অন্য সবার মতোই এমিলিও মাটিতে শুয়ে পড়ে এবং অন্ধকারে গোলাগুলির আওয়াজ পায়। কিছুক্ষণ বাদে আলো ফিরে এলে অ্যালেক্সকে মাটিতে মৃত অবস্থায় দেখতে পায়। আক্রমণকারীরা মাটিতে শুয়ে থাকা প্রত্যেকটা মানুষ মৃত কিনা তা যাচাই করে দেখছিল। সেখানেও অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় এমিলি। এরপর আক্রমণকারীদের মুহূর্তের অসচেতনতায় কিছু লোকের সাথে এমিলিও দৌড়ে পালায় পেছনের গেটের দিকে। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি যে, বাকি সবাই মারা গেলেও একমাত্র এমিলিই বেঁচে যায়। কিন্তু কীভাবে?
ইন্টারোগেশন রুমে বসা দুই গোয়েন্দা অফিসারের এমন কাহিনী বিশ্বাস হয় না। বিশ্বাস হয় না আয়নার ওপাশে থাকা এই গোয়েন্দা দলের বর্তমান প্রধানেরও। বারবার গোয়েন্দা অফিসারদের সামনে দিয়ে কিছু একটা ছুটে যায়, যা তারা ধরতে পারে না। সেই কিছুটা কী? আর যদি এমিলি মিথ্যাও বলে থাকে, তাতেই বা তার লাভ কী? আর অ্যালেক্সের খুব কাছের সেই কেউ একজন ব্যক্তিটা কে, যে কিনা এমিলির বিরুদ্ধে মামলা করেছে? এই গল্পের শেষটা আপনাকে ক্ষণিকের জন্য হলেও স্তব্ধ করে দেবে।
ক্রিমিনাল: স্পেন
ইন্টারোগেশন রুমে বসা কারমিন এবং তার উকিল। অফিসার হিসাবে আছেন গোয়েন্দা লুইসা। এরই মধ্যে গোয়েন্দা দলে যোগ দেয় ছুটি কাটিয়ে আসা ঠাণ্ডা মাথার অফিসার মারিয়া। আয়নার পিছনে বসে ইন্টারোগেশন রুমের সন্দেহভাজনের গতিবিধি লক্ষ্য রাখছে মারিয়া এবং তার দল। সন্দেহভাজন কারমিন ১৪/১৫ বছরের কিশোরী। তার ছোট বোন, যে কিনা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ছিল, বাথরুমের বাথটাবে ডুবে মারা গেছে। অথচ ছোট বোন অরোরাকে এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল করত না কারমিন; তা সে অকপটেই স্বীকার করে। অরোরা মারা যাওয়ার দুই ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলে পৌঁছায় কারমিনের বাবা আর মা। এরপরই পুলিশ আসে আর সবকিছুর সূত্রপাত।
প্রথমত, কারমিনের চেহারায় মারের দাগ স্পষ্ট। তবে ছোট বোন মারা যাওয়াতে বাবা মেরেছে বলেই স্বীকার করে কারমিন। আর দ্বিতীয়ত, গোয়েন্দাদের কোনো প্রশ্নের উত্তরই ঠিক মতো দিতে চায় না সে। ‘আমি জানি না’ কিংবা ‘আমার মনে নেই’ অথবা ‘আমি ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছি’ এই কথাগুলোতেই সীমাবদ্ধ থাকে কারমিনের বক্তব্য। এসব শুনতে শুনতে অধৈর্য্য হয়ে পড়ে গোয়েন্দা লুইসা। উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে শুরু করে কারমিনের সাথে। কিন্তু আয়নার ওপাশ থেকে মারিয়া স্পষ্ট বুঝতে পারে যে, মানসিক ট্রমায় ভুক্তভোগী কারমিনের সাথে উত্তেজিত হয়ে না বরং শান্তশিষ্টভাবে কথা বলতে হবে। তাই সে ছুটে আসে ইন্টারোগেশন রুমে।
মারিয়া খুব ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলতে শুরু করে কারমিনের সাথে। উত্তেজিত কারমিন প্রথম প্রথম সেই একই উত্তরের পুনরাবৃত্তি করতে থাকলেও ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আসে। কারমিনের পরিবার সম্পর্কে বের হতে থাকে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। এরকমই বলতে বলতে এক সময় কারমিন জানায়, অরোরাকে মারার বুদ্ধিটা কার ছিল। এমন সময় কারমিনের উকিল সাময়িক বিরতি চায়।
বিরতিতে ব্যক্তিগতভাবে মারিয়ার সাথে সম্পর্কে জড়িত পুলিশ অফিসার রাইয়ের সাথে কথা হয় মারিয়ার। রাই মারিয়াকে বোঝায় যে, নিজেকে মুক্ত করার জন্যে কারমিন একটা পথ খুঁজছিল এতক্ষণ আর সে পথটা তৈরি করে দিয়েছে মারিয়া। আর সেজন্যেই কারমিন অন্য একজনকে দোষারোপ করে নিজেকে মুক্ত করতে চাইছে। মারিয়া ব্যাপারটা বুঝতে পারে। আবারও শুরু হয় তদন্ত আর জেরা।
এতদূর পর্যন্ত গল্প পড়ে যদি আপনি ভাবেন, এ আর এমন কী? তাহলে আপনি ভুল ভাবছেন। কেননা, এটি পুরো সিজনের একমাত্র গল্প যেটি আপনাকে বিহবল করে দেবে। আপনি বসে ভাববেন, কী হলো এটা? কেন হলো?
ক্রিমিনাল: যুক্তরাজ্য
সন্দেহভাজন ব্যক্তি একজন ডাক্তার, ডাক্তার এডগার ফ্যালন। তার সৎ মেয়েকে যৌন নির্যাতনের পরে মেরে ফেলেছে ঐ মেয়েরই প্রেমিক, এমনটাই তার ভাষ্য। কিন্তু ব্যাপারটা একে তো বিশ্বাসযোগ্য নয়ই, তার উপর আবার এডগার ঘটনার বিস্তারিত জানাতেও নারাজ। তাকে যাই-ই জিজ্ঞেস করা হোক না কেন, তার বিনিময়ে একটাই উত্তর ঠিক করে রাখা তার; আর তা হচ্ছে- নো কমেন্ট। প্রায় দুই ঘণ্টা যাবত দুইজন গোয়েন্দা অফিসার এডগারের মনোবল ভেঙে ভেতরের কথা টেনে বের করে আনতে চেয়েছেন। কিন্তু এডগার কেবল নো কমেন্ট বলেই দুই দুইজন বাঘা বাঘা গোয়েন্দাকে স্রেফ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
এরকম সময়ে ঘটনায় মোড় আনে আয়নার পেছন থেকে সবকিছু দেখতে থাকা আরেক গোয়েন্দা পুলিশ অফিসার পল অটাগার। হিউগোর স্থলাভিষিক্ত হয় সে। আর বসেই সবার প্রথমে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। এডগারের অস্বস্তি বোধ শুরু হলে পল নজর সরিয়ে নিয়ে বলে তারও একটা চৌদ্দ বছরের মেয়ে আছে। এবং কেউ যদি তার মেয়েকে নির্যাতন বা হত্যা করা দূরেই থাক, কেবল কুনজরে তাকিয়েও দেখে তাতেই খুন করে ফেলবে পল। এ কথা শুনে এডগার কিছুটা নড়েচড়ে বসে। এতক্ষণ যাবত নো কমেন্ট বলতে থাকা এডগারের মনোবলটা নড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে গল্প সাজানো শুরু করে এডগার। আর তার গল্পে যে ফাঁক ফোকর গুলো আছে সেগুলো খুঁজে বের করে বসে থাকা দুই গোয়েন্দা পুলিশ অফিসার। গল্প এগিয়ে চলে।
তো এই ছিল প্রথম সিজনের প্রত্যেকটা খণ্ড থেকে বাছাইকৃত চারটি গল্পের সারমর্ম। বারোটি গল্পের মধ্যে সবগুলোই যে বেশ দুর্দান্ত, এমন কিন্তু নয়। এমনকি কিছু গল্প দেখতে বসে বিরক্তির উদ্রেকও ঘটতে পারে। তবে সব মিলিয়ে গল্পগুলো দেখার মতোই। যেমন, জার্মান খণ্ডের প্রথম গল্পটি বেশ সুন্দর। যেখানে ফুটে উঠেছে পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানির মধ্যকার দ্বন্দ্ব, যা বার্লিন প্রাচীরের ধ্বংসের এতকাল পরও বিদ্যমান। এছাড়াও গোয়েন্দা বিভাগের পুলিশ দলের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, নিজেদের গোপন ইতিহাস আর অতীত কিংবা উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা যা আড়ালে রয়ে গেছে; এসব কিছুই ফুটে উঠেছে গল্পের ভাঁজে ভাঁজে।
আবার, ফ্রান্স খণ্ডের বাকি দুটো গল্পও মোটামুটি রহস্যময় আর দারুণ প্রেক্ষাপটে রচিত। যেখানে স্বার্থপরতার সাথে বেইমানি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেখানে ভালোবাসা শ্রেণী বিবাদে আবদ্ধ হয়ে মৃত্যুর গান গায়। যেখানে সুখী পরিবার সম্পন্ন লোকটারও গোপনীয়তা অযাচিত। গল্পগুলো যেন একতরফা না হয়ে যায় এবং খানিকটা ভিন্নতা আনার জন্যে, জেরার বিরতিতে গোয়েন্দা পুলিশ অফিসারদের নিজস্ব দ্বন্দ্ব দেখানো হয়েছে। দেখানো হয়েছে কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠে তারা অপরাধীর মুখ থেকে কথা বের করতে।
স্পেন খণ্ডের বাদ বাকি দুটো গল্পের একটিতে কথা বের করার সর্বোচ্চ পন্থা কতটা ভীতিকর হতে পারে তাই প্রাধান্য পেয়েছে। তবে সবগুলো গল্পেই মারিয়া এবং তার ব্যক্তিগত জীবনের সাথে জড়িত কিছু ঘটনার বিবরণ দেয়া হয়েছে। হোক তা গোয়েন্দা দলের কারোর সাথে শারীরিক সম্পর্ক কিংবা কোনো সন্ত্রাসীর সাথে অতীতের কোনো যোগাযোগ। এতে করে ভিন্নতার পাশাপাশি চরিত্রগুলোর উপর বিশ্বস্ততাও খানিকটা জোরালো হয়েছে। কেননা, প্রত্যেকেই এখানে মানুষ, আর মানুষ মাত্রই ভুল।
ইউকে তথা যুক্তরাজ্য খণ্ডটি খানিকটা অগাছালো বলে মনে হয় বাকি তিনটি খণ্ডের তুলনায়। তবে এডগার চরিত্রে ডেভিড ট্যানেন্ট আর মার্ভেলের হেইলেই অ্যাটওয়েলের অভিনয় খানিকটা হলেও সে ভাবটা উজ্জ্বল করেছে। প্রথম দুটো গল্প বেশ ভালো লাগলেও শেষের গল্পটা খুব বেশি জমে উঠতে পারেনি।
অভিনয়ের কথা বলতে গেলে বিশেষভাবে উল্লেখ করা আসলে মুশকিল। কেননা, এই সিরিজটার প্রত্যেকটি চরিত্র নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তিগত জীবন, পুলিশি সত্ত্বা, গোয়েন্দা সত্ত্বা এসব কিছু ছাপিয়ে যেন নিজের অভিনয়টাই মূলত তাদের পরিচিতি হয়ে দেখা দিয়েছে। ক্রিমিন্যাল ইউকেতে আপনি পাবেন ক্যাথরিন ক্যালি, নিকোলাস পিনোক, ডেভিড ট্যানেন্ট, হেইলেই অ্যাটওয়েল এবং লি ইংলিবেরির মতো দুর্দান্ত সব অভিনয়শিল্পীকে।
সবদিক বিচারে বলতে গেলে প্রত্যেকটা খণ্ডেরই দুটো করে গল্প বেশ দারুণ বা দেখার মতো। একই সেটে প্রত্যেকটা গল্প সাজানো হয়েছে খানিকটা একঘেয়েমি দর্শকের মনে কাজ করতে পারে। কিন্তু গল্পের মধ্যে ডুবে গেলে দর্শক আসলে এসব খেয়াল করার সুযোগও হয়তো পাবেন না।
সাধারণত মানুষ দুশ্চিন্তায় ভুগলে সহজাত প্রবৃত্তির বলে হাত মোচড়া-মোচড়ি করা, পা নাচানো এই ধরনের যেসব মুদ্রাদোষগুলো করে থাকে, সেগুলোর সূক্ষ্ম চিত্রায়ন বিভিন্ন দৃশ্যপটে ভিন্নরকম উত্তেজনা যোগ করেছে। সবমিলিয়ে এটা বলাই যায় যে, নেটফ্লিক্সের এই সিরিজটিও অপরাধ জনরাপ্রেমী দর্শকদের জন্য অবশ্যই দর্শনীয় একটা সিরিজই হবে।
বই ও সিনেমা সম্পর্কিত চমৎকার সব রিভিউ আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/