গুণী লেখক অনেকেই, তবে কালজয়ী লেখক তারাই, যাদের লেখায় একইসাথে সমসাময়িক যুগের ও যুগোত্তরের প্রতিরূপ মূর্তি স্থাপনা হয়। প্রয়াত আহমদ ছফা ছিলেন সেরকম একজন লেখক। তার সময়ের লেখার যা বাস্তবতা, এক যুগ পরও আজকের সমাজের সেই একই মৌলিক পরিস্থিতি, খুব একটা ভিন্নতা নেই সেখানে। ‘গাভী বিত্তান্ত’ তেমনই একটি উপন্যাস, প্রকাশভঙ্গি নতুন স্বাদের হলেও বিষয়বস্তু একেবারে চিরচেনা আমাদের সমাজে।
মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ, চুপচাপ, গোবেচারা ধরনের মানুষ, যাকে নিয়েই পুরো গল্প। খুব প্রয়োজন না হলে মুখে রা’টি কাটে না তার, যেচে ঝামেলায় জড়ানো তার সাধ্যের বাইরেই বলা চলে। দেশের সবচাইতে প্রাচীন আর সম্ভ্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগপ্রাপ্তি হয় আবু জুনায়েদের, হাল আমলের তখন রণচণ্ডী চেহারা, হিন্দু-মুসলিম রেষারেষি, যখন তখন মিছিলের গর্জন, রাজনীতিকে কেন্দ্র করে দলীয় বন্দুক যুদ্ধ, যেখানে পুলিশ এসে পড়লে তিন দলই বন্দুকযুদ্ধে শামিল হয়। কোমলমতি ছাত্রদের চীনা কুড়াল দিয়ে অবলীলায় তাদের বন্ধুদের শরীর থেকে হাত-পা বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারার যে দক্ষতা, তা স্বয়ং পেশাদার কসাইদেরও আয়ত্ত করতে অনেক সময় লেগে যাওয়ার কথা।
অবসরপ্রাপ্ত কোনো শিক্ষকের বাসাটি দখলের জন্য কে কাকে ল্যাং মেরে আগে তালা খুলবে, সেটা তখন রীতিমতো এক গবেষণার বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষকদের এত সহজে কোনো কাজ পেয়ে যাওয়ার কিঞ্চিৎ সম্ভাবনাই নেই যেখানে, সেখানে আবু জুনায়েদের মতো এক রদ্দি মানুষের উপাচার্য বনে যাওয়া নেহায়েতই দিবাস্বপ্নের মতো। একইসাথে বলা যায়, সবকিছুই দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটের সাথে হুবহু মিলে যায়।
এদিকে আবু জুনায়েদের স্ত্রী নুরুন্নাহার বানু এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বেগম। তার খুশি আর মনে ধরে না, ফেটে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। যার পড়ালেখার খরচ জুগিয়েছেন নুরুন্নাহার বানুর বাবা, যার কোনোদিকে কোনো খেয়াল থাকতো না, সমাজে এমনকি ঘরের চার দেয়ালের মাঝেও তেমন দরাজ ছিল না যার, সেই আবু জুনায়েদ হঠাৎ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বনে যান, তার স্ত্রী তখন ভাবেন, এ তো সতীর ভাগ্যে পতির জয়। তাছাড়া আর কী!
তা নয় আসলে। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের যিনি উপাচার্য ছিলেন, তার উপরে অন্যান্য দলীয়ভুক্ত শিক্ষকেরা ছিলেন ক্ষ্যাপা, এমনকি তার নিজের দলের মানুষও কিছু কিছু ব্যাপারে তার উপর ক্ষোভে ছিলেন। অন্যান্য দলপন্থীরা তাই তার ঐ পদে বহাল থাকাটা মেনে নিতে পারছিলো না। সব প্রবীণ শিক্ষকই তক্কে তক্কে ছিলেন এরকম একটা সুযোগের জন্য, কে কার ভুল-ত্রুটি তুলে ধরে উপাচার্যের আসনে বসার জন্য এক ধাপ সামনে এগিয়ে যাবেন এ নিয়ে চলছিলো সভার পর সভা। সেসব সভার মধ্যমণি ছিলেন এক সুন্দরী অবিবাহিতা শিক্ষিকা, দিলরুবা খানম। তারই জেরে আবু জুনায়েদ উপাচার্যের আসনে উন্নীত হয়ে যান, আর অন্যান্য প্রবীণেরা ভেতরে ভেতরে আবু জুনায়েদের প্রতি ক্ষোভের পাহাড় জমানো আরম্ভ করেন।
ব্রিটিশ স্থাপত্যের সুন্দর নিদর্শন উপাচার্য ভবনটিতে জুনায়েদ পরিবার উঠে আসার পর নুরুন্নাহার বানু সেখানে বহাল থাকা অন্যান্য সরকারী কর্মচারীদের ওপর কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা করতে গিয়ে তাদের উপর অযথা বিরূপ মন্তব্য করতে লাগলেন। স্বামীর সহকর্মীদেরকেও ছাড় দিলেন না। উপাচার্য-স্ত্রী হিসেবে কথার দমক একটু বেশিই ছোটালেন। তাই উপাচার্য হওয়ার পরে আবু জুনায়েদের মধ্যে দ্রুত যা পরিবর্তন আসছিল তাতে ছেদ পড়তে লাগলো।
পরিবারে যেকোনো ব্যাপার নিয়ে স্ত্রীর অশান্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ে তার দুর্বলতার সুযোগে দিন দিন রাজনীতি-খুন বেড়ে যাওয়া, সময়ের আগেই তহবিলের অর্থ ফুরিয়ে যাওয়া- এ নিয়ে আবু জুনায়েদের চিন্তার শেষ ছিল না।
গরিব কৃষক পরিবারে জন্ম আবু জুনায়েদের। গৃহপালিত পশু-পাখির প্রতি সেই ছোটবেলা থেকেই টান। বাবার মাটি কাটা দেখে বড় হয়েছেন, নিজের বানানো গোয়ালঘরে গরু পালনের শখ ছিল বরাবরই। সেই শখ পূর্ণ হয় তার। এক ঠিকাদার চাচা-শ্বশুরের কাছ থেকে উপহার পান খুবই দামী এক গাভী। সাথে নানা জাতের পাখিও উপহার পান তার এক সহকর্মীর কাছ থেকে। তারপর থেকে সেই গাভীকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মহলে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে। অনেক অপবাদও ছড়ায় বিরোধী দলের শিক্ষক আর ছাত্ররা। তবে তাকে পছন্দ করতেন কিছু নির্দলীয় মানুষ, যারা কোনোরকম রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না। আবু জুনায়েদের এই নিরীহ জীবপ্রীতিকে নিঃস্বার্থভাবে সমর্থন করেছেন তারা।
কিন্তু বাঁধ সাধলেন আবু জুনায়েদের স্ত্রী। তার ধারণা হয় এই গাভী ঘরে আসার পর থেকে তার স্বামী তার প্রতি আগের চেয়েও নিস্পৃহ হয়ে পড়েছেন। যে কারণে পরবর্তীতে ঐ গাভীটির খড়কুটোর সাথে বিষ মিশিয়ে নির্দ্বিধায় গাভীটিকে হত্যা করেন।
আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধীদলীয় শিক্ষদের তাক লাগিয়ে দিয়ে আবু জুনায়েদ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সমগ্র বিশ্বের একান্নটি দেশে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার একটি সুযোগ পেয়ে যান, যার জন্য মোটা অংকের সম্মাননাও ঘোষণা করা হয়।
উপন্যাসটি বিচিত্র ধরনের। সমসাময়িক বাস্তব প্রেক্ষাপটকে আধুনিকভাবে প্রদর্শন করেছেন লেখক। দেশের সবদিকেই অস্থিরতা, রাজনীতি, কী করে ভালোমানুষদের টেনে নিচে নামানো যায়, সে চিন্তায় তৎপর রাজনীতিবিদরা।
বাইরে রাজনীতি, উচ্ছৃঙ্খলা হরহামেশাই লেগে থাকে। ঘরটাও ছাড় দেয় না আজকাল। ঘরের শত্রুরাই বিভীষণ সর্বত্র। সন্দেহ-নীচতা-অশ্লীল শব্দকে তোয়াক্কা না করাটা দৈনন্দিন জীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলে, এই উপন্যাসে তার প্রতীকী ছবিও ভেসে উঠেছে।
মার্জিত ভাষা ব্যবহার করে কীভাবে স্যাটায়ার বা বিদ্রূপধর্মী উপন্যাস লেখা যায় ‘গাভী বিত্তান্ত’ বইটি তারই স্বচ্ছ উদাহরণ। নাম দেখে যে কেউই ভাবতে পারেন, বইটি গাভী প্রজাতির সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ নিয়ে লেখা। কিন্তু পড়লেই বোঝা যায়, আজকের মানব সমাজের চাইতে পশুসমাজ অনেকগুণে উন্নত। তারা নিরীহ, কিন্তু এখনকার জগৎ-সংসারের মতো কুটিল নয়।
বইয়ের নাম: গাভী বিত্তান্ত || লেখক: আহমদ ছফা
প্রকাশক: মাওলা ব্রাদার্স || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম