Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জেমস বন্ড এবং নেপথ্যের কাহিনী

পায়ে গুলি লেগে কাতরাচ্ছেন লোকটি। অনেক কষ্টে উচ্চারন করলেন, “হু আর ইউ?” উত্তর এলো, “দ্য নেইম ইজ বন্ড, জেমস বন্ড।” আড়াল থেকে সামনে এসে দাঁড়ালেন কালো বুট আর কালো স্যুট পরা আকর্ষণীয়, তীক্ষ্ণ পুরুষালি চেহারার এক ব্যক্তি, হাতে মারণাস্ত্র। হ্যাঁ, এই একই সাথে আবেদনময়ী আর অতি চালাক, সাক্ষাৎ মৃত্যুদূৎ এই মানুষটিই জেমস বন্ড। কোড নাম্বার ০০৭। এই দৃশ্যটি জেমস বন্ড সিরিজের ২১তম সিনেমা ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ (Casino Royale)-এর শেষ দৃশ্য। সিনেমার ধারাবাহিকতায় ২১তম হলেও বন্ড সিরিজের প্রথম বই কিন্তু এই ক্যাসিনো রয়্যাল।

জেমস বন্ডের নামের সাথে পরিচয় নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ধারালো বুদ্ধির ঘোরপ্যাঁচওয়ালা সব কাহিনী, নাম চরিত্রের মনোমুগ্ধকর পৌরুষ আর প্রত্যেক কাহিনীতে তার সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া হৃদয় হরণকারী সব রমনী, এই দিয়ে যুগ যুগ ধরে সাহিত্যে আর সিনেমাশিল্পে অত্যন্ত জনপ্রিয় স্থান দখল করে আছে জেমস বন্ড। আর সেই সূত্রে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়ে আছেন জেমস বন্ডের স্রষ্টা ইয়ান ফ্লেমিং।

১৯৫৩ সালে প্রকাশ পায় বন্ড সিরিজের প্রথম বই ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’। সেই থেকে আজ ছয় দশক পরেও জেমস বন্ড গোটা বিশ্বজুড়ে এক নামে সমানভাবে সমাদৃত। ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, পশ্চিমে এবং এমনকি উপমহাদেশের বলিউডেও স্পাইভিত্তিক সিনেমার প্রারম্ভ ইয়ানের জেমস বন্ডের ছায়া অনুসরণ করেই। কখনো প্রশ্ন এসেছে মনে, কোথা থেকে পেলেন এই ব্যক্তি এমন এক কালজয়ী সৃষ্টির প্রেরণা? এর উত্তর জানার জন্যে একটু হলেও জানতে হবে এর লেখক ইয়ান ফ্লেমিংকে। কারণ প্রত্যেক সাহিত্যিকেরই জীবনের কম-বেশি ছায়া থাকে তার সাহিত্যকর্মে।

ইয়ান ফ্লেমিং, নেপথ্যের জেমস বন্ড : pinterest.com

ব্রিটিশ সিক্রেট ইনটেলিজেন্স সার্ভিস MI6 এর সদস্য জেমস বন্ড। ০০৭ কোড নাম্বারটি ধারণ করেন তিনি। ডাবল ও বা ডাবল জিরো দ্বারা বুঝায়, কর্তব্যকর্মে যে কাউকে হত্যা করার অনুমতি তার আছে। ব্যতিক্রম শুধু ‘ইউ অনলি লিভ টোয়াইস’ উপন্যাসটি। সেখানে অস্থায়ীভাবে বন্ডকে ৭৭৭৭ নাম্বার দেয়া হয়েছে।

জেমস বন্ডের সহজাত ও স্বাভাবিক পোষাক হলো একটি ডিনার স্যুট। সাধারণত রোলেক্স সাবমেরিনার ঘড়ি পরতেই পছন্দ করেন তিনি, পরবর্তীতে তাকে ওমেগা পরতেও দেখা যায়। নারীদের প্রতি, বিশেষ করে বিবাহিত নারীদের প্রতি তীব্র আকর্ষণ আছে বন্ডের। তবে আবেগের বশবর্তী হয়ে কর্তব্যকর্মে কখনোই নারীকে বাধা হিসেবে দাঁড় করান না তিনি।

জেমস বন্ডের প্রেরণা আর কেউ না, লেখক ইয়ান ফ্লেমিং স্বয়ং। ইয়ান ল্যাঙ্কাস্টার ফ্লেমিং ১৯০৮ সালের ২৮ মে লন্ডনের মেফেয়ারের ২৭ নং গ্রীন স্ট্রিটে এক সমৃদ্ধ পরিবারে জন্ম নেন। মা ইভলিন রোজ ও বাবা ভ্যালেন্টাইন ফ্লেমিং। বাবা ছিলেন পার্লামেন্টের সদস্য; তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন এবং ১৯১৭ সালের ২০ মে ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে জার্মান শেলের আঘাতে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯১৪ সালে ইয়ান ডর্সেটের ডার্নফোর্ড স্কুলে ভর্তি হন। স্বাদহীন খাবার, শারীরিক পরিশ্রম আর অন্য ছেলেদের হাতে উত্যক্ত হওয়া- সব মিলিয়ে এখানে তার দিনগুলো ভালো কাটেনি। ১৯২১ সালে তাকে ভর্তি করা হয় ঈটন কলেজে। শুরু হয় তার অগোছালো জীবন যাপন। প্রাতিষ্ঠানিক রেজাল্ট বরাবর খারাপ হতে থাকে, যদিও অ্যাথলেটিক্সে তিনি বেশ পারদর্শীতা দেখান।

শেষমেষ তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবস্থা দেখে পরিবারের দুর্নামের ভয়ে তার মা তাকে ছাড়িয়ে অভিজাত মিলিটারি একাডেমি স্যান্ডহার্স্ট-এ এনে আর্মি অফিসারের ট্রেনিং শুরু করান। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এক পতিতার সাহচর্যে এসে ইয়ান গনোরিয়া বাঁধিয়ে ফেলেন। তার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে এবার মা ইভলিন তাকে অস্ট্রিয়ার কিযবেলের টেনেরফ নামক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দেন। টেনেরফ ছিল ধনীর বিগড়ে যাওয়া দুলালদের জন্যে বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটা চালাতেন সাবেক ব্রিটিশ গোয়েন্দা ইরনান ফোর্বস ডেনিস এবং তার সাহিত্যিক স্ত্রী ফিলিস বটম। একইসাথে গোয়েন্দাবৃত্তি এবং সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক এদের দ্বারাই প্রভাবিত হয়ে ইয়ানের ভেতরে আসে। ফ্লেমিং এর বড় ভাই পিটার ছিলেন একজন অভিযাত্রিক এবং ভ্রমণ কাহিনী লেখক। তার প্রভাবে ইয়ানও প্রথম দিকে ভ্রমণ বিষয়ক একটি নন-ফিকশন বই ‘থ্রিলিং সিটিস’ লিখে ফেলেন। পরবর্তীকালে ইয়ান ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখ ও ইউনিভার্সিটি অব জেনেভাতে পড়াশোনা করেন। কর্ম জীবনে কিছুদিন রয়টার্স নিউজ এজেন্সিতে কাজ করেন তিনি, এছাড়া ব্যবসারও চেষ্টা করেন। কোনো কাজেই তিনি বেশিদিন থিতু হননি।

১৯৩৯ সালের মে মাসে ব্রিটিশ নৌ-ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল জন গডফ্রে ইয়ানকে ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেন। তার কোডনেম হয় ‘17F’। ব্রিটিশ অ্যাডমিরালটির ৩৯ নাম্বার কক্ষটি ছিলো তার কার্যক্ষেত্র। বলা হয়, এই গডফ্রের আদলেই ইয়ান জেমস বন্ডের ‘M’ চরিত্রটির চিত্রায়ন করেন। ইয়ান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও অংশ নেন। তার এই রোমাঞ্চক জীবনের অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতাই তার লেখায় প্রভাব রেখেছে। সুতরাং বলা যায়- তিনিই নেপথ্যের আসল জেমস বন্ড।

প্রথম উপন্যাস হাতে ইয়ান ফ্লেমিং : spyworththrills.com

ব্যক্তি ইয়ানেরও এক প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়ে গেছে তার সৃষ্টি বন্ডের মধ্যে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ইয়ান কমান্ডার পদে উন্নীত হন। বন্ডকেও কিন্তু তিনি এই পদে বসান। তার তুখোড় ধুমপানের অভ্যেস ছিল। দিনে প্রায় ৮০টির বেশি সিগারেট খেতেন তিনি। এছাড়া ছিল অতিরিক্ত মদ্যপানের বদভ্যাস। ডাক্তার তাকে জিন খাওয়া ছাড়তে বললে তিনি নির্লিপ্তভাবে বারবনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। মদ নিয়ে বিলাসিতা জেমস বন্ডের মধ্যেও দেখা যায়। লেবু মিশিয়ে মার্টিনি আর ভদকার ককটেল, ‘শেকেন, নট স্টার্ড’, এই ছিল জেমসের পছন্দ।

বিবাহিত নারীদের প্রতি জেমসের আলাদা আকর্ষণের ব্যাপারটিও ইয়ানের জীবন থেকে পাওয়া। অ্যান চ্যারটেরিস নামক এক বিবাহিতা মহিলার সাথে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। পরকীয়ার কারণে অ্যানের স্বামী তাকে ডিভোর্স দিলে তারা দুজন স্বাচ্ছন্দ্যে বিয়ে করে নেন।

অ্যান চ্যারটেরিসের সাথে ইয়ান ফ্লেমিং : pinterest.com

১৯৫২ সালে অ্যানকে বিয়ে করার একদিন পর থেকেই ইয়ান ক্যাসিনো রয়্যাল লিখতে শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয় বন্ড সিরিজের এই প্রথম বইটি। প্রকাশের পরপরই সাড়া ফেলে দেয় এই উপন্যাস। ক্রমে সব মিলিয়ে বন্ড সিরিজে ১১টি উপন্যাস ও ২টি ছোটগল্প লিখেন ইয়ান ফ্লেমিং। বিশ্বজুড়ে একশ মিলিয়নের বেশি কপি বিক্রি হয়েছে বন্ডের এই উপন্যাস সিরিজ। পৃথিবীর সর্বকালের সেরা ফিকশনগুলোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে জেমস বন্ড। ২০০৮ সালে ‘দ্য টাইমস’ ১৯৪৫ সাল থেকে নিয়ে ৫০ জন সেরা ব্রিটিশ লেখকের তালিকায় ১৪তম স্থানে রেখেছে ইয়ান ফ্লেমিংকে। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিও ছিলেন ইয়ানের ভক্তদের তালিকায়।

’৬০ এর দশক থেকে শুরু হয় জেমস বন্ডের চলচ্চিত্রায়ণ। সব মিলিয়ে ২২টি সিনেমায় ৬ জন অভিনেতা জেমস বন্ড হয়েছেন এ পর্যন্ত। এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বন্ড বলা হয় পিয়ার্স ব্রসনানকে। সর্বশেষ ‘স্কাইফল’ সিনেমাটির মুক্তির আগ পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৩৫৪ জনকে খুন করে জেমস বন্ড। এর মধ্যে পিয়ার্স ব্রসনান একাই খুন করেন ১৩৫ জনকে। ১৯৫৩ সালে প্রথম প্রকাশিত ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ সিনেমায় রুপান্তরিত হয় ২০০৬ সালে। এতে বন্ডের ভূমিকায় ছিলেন ড্যানিয়েল ক্রেইগ। জেমস বন্ডের লুক বা চেহারার ধারণাটি ইয়ান গ্রহণ করেন মার্কিন গায়ক হাওয়ার্ড কারমাইকেলের চেহারা থেকে। আর এই কিংবদন্তী নাম ‘জেমস বন্ড’ ইয়ান নেন তার ছোটবেলায় পড়া ‘বার্ডজ অব ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ বইয়ের লেখকের নাম থেকে। পরে অবশ্য সেই লেখক চিঠি লিখে তাকে এজন্য ধন্যবাদও জানান।

গায়ক হাওয়ার্ড কারমাইকেল : xchelovek.ru

বন্ডের বিভিন্ন উপন্যাসে ঘটনাসূত্রে জ্যামাইকার কথা প্রায়ই এসেছে। ‘ড. নো’ এর কাহিনীতো পুরোটাই ছিল জ্যামাইকাতে। এর পেছনেও আছে ইয়ানের ব্যক্তিগত জীবনের প্রভাব। পরকীয়ার দিনগুলোতে জ্যামাইকাতে অ্যানের সাথে অনেক সময় কাটাতেন তিনি। পরবর্তীতে বিয়ের পরে অ্যানকে নিয়ে সেখানেই থাকেন তিনি। ‘গোল্ডেন আই’ নামে তার একটি বাড়িও ছিল জ্যামাইকাতে। এই ‘গোল্ডেন আই’ নামটি তিনি নিয়েছিলেন নৌ ইন্টেলিজেন্সে তার একটি অপারেশনের কোড নেম থেকে। এই ‘গোল্ডেন আই’তে বসেই ইয়ান শুরু করেন বন্ড লেখার কাজ। উপন্যাসেও তার এই নামটির ব্যবহার আছে। ইয়ান একমাত্র ব্রিটিশ লেখক, যার নামে জ্যামাইকাতে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর আছে।

অতিরিক্ত ধুমপান ও মদ্যপানের কারণে ১৯৬১ সালে ইয়ান ফ্লেমিং একবার হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন। তবে সে যাত্রায় তিনি বেঁচে যান। ১৯৬৪ সালের ১১ আগস্ট ক্যান্টারবারিতে তিনি পুনরায় হার্ট অ্যাটাক করেন এবং ১২ আগস্ট সকালবেলা ৫৬ বছর বয়সে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। সেদিন ছিল তার ছেলে ক্যাস্পারের ১২তম জন্মদিন। তার শেষ কথা ছিল অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভারদের উদ্দেশ্যে, “তোমাদের ঝামেলায় ফেলার জন্য দুঃখিত ছেলেরা, আজকাল এই রাস্তাগুলোতে কি করে যে তোমরা এত দ্রুত ট্রাফিক কেটে আগাও আমি বুঝি না।” সেভেনহ্যাম্পটন গ্রামের চার্চের আঙিনায় ইয়ান ফ্লেমিংকে শায়িত করা হয়। তার মৃত্যুর পরে বন্ড সিরিজের দুটো ছোট গল্প ‘দ্যা ম্যান উইদ দ্যা গোল্ডেন গান’ এবং ‘অক্টোপুসি অ্যান্ড দ্যা লিভিং ডেলাইটস’ প্রকাশিত হয়।

জীবদ্দশায় ইয়ান জেমস বন্ডের শুধু দুটি সিনেমা বড় পর্দায় দেখে যেতে পেরেছিলেন- ‘ড. নো’ আর ‘ফ্রম রাশিয়া উইদ লাভ’। আজ তার মৃত্যুর পাঁচ যুগ পেরিয়ে গেলেও, সেই সমান আবেদন নিয়ে পাঠক সমাজ ও সিনেমাপ্রেমীদের মন হরণ করে চলেছে জেমস বন্ড। দিয়ে যাচ্ছে নতুন স্পাইভিত্তিক সিনেমাগুলোর দিকনির্দেশনা। টেলিভিশন সিরিজ, সিনেমা, কমিক্স, ভিডিও গেমস সর্বত্র দৃপ্ত পদচারণা দেখিয়েছে জেমস বন্ড। আর নেপথ্যে তার বৈচিত্র্যময় জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে অতি যত্নে লালিত কল্পনা ঘুলিয়ে মিশিয়ে দিয়ে তৃপ্তির হাসি হেসেছেন বাস্তব জীবনের জেমস বন্ড ইয়ান ফ্লেমিং। ক্ষণস্থায়ী জীবনকালের সীমানা অতিক্রম করে মিশে থাকবেন চিরকাল তিনি নিজ সৃষ্টির নির্যাসে।

তথ্যসূত্র

১) en.wikipedia.org/wiki/Ian_Fleming

২) biography.com/people/ian-fleming-9296920

৩) telegraph.co.uk/culture/film/jamesbond/11026227/Ian-Fleming-the-real-James-Bond.html

৪) jamesbond.wikia.com/wiki/Ian_Fleming

৫) risingbd.com/entertainment-news/84670

৬) facebook.com/bbaria24/posts/1031251440279537

৭) techtunes.com.bd/download/tune-id/415883

Related Articles