যে লোক কর্মের মধ্যে তার জীবনদর্শন খুঁজে পেয়েছেন, তার সঙ্গী কিংবা আড্ডার প্রয়োজন কীসের! একাকিত্বের নিদারুণ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি ও প্রকৃত আনন্দের স্বাদও পেয়েছেন তিনি এরই ভেতর দিয়ে। সময়ের অপচয় তার কাছে পাপতুল্য অপরাধ। – পরিতোষ সেন
বুড়িগঙ্গার পাড় ঘিরে যে জনপদ গড়ে উঠেছিল, তা-ই মূলত আজকের পুরান ঢাকা নামে খ্যাত। আহসান মঞ্জিল এবং লালবাগ কেল্লা ছাড়াও এ অঞ্চলের অলিগলিতে ছড়িয়ে আছে ঐতিহ্য আর ইতিহাস। আধুনিক আর নতুন ঢাকার পাশাপাশি সেসব ঐতিহ্যকেই আঁকড়ে ধরেই বিচ্ছিন্ন এক জনপদের মতোই এখনো টিকে আছে পুরান ঢাকা এবং সেখানকার অধিবাসী ঢাকাইয়ারা। বিচিত্র স্বভাবের মানুষগুলোর বসবাস এই জনপদে। গলি-ঘুপচিতে পূর্ণ এই জনপদ ঘিঞ্জি এলাকা বলেও খ্যাত। তবে এখানকার বিচিত্র বাসিন্দাদের মতোই শত শত গলি-ঘুপচির নামেও রয়েছে বৈচিত্র্য। আর নতুন ঢাকার দিকে মুখ উঁচিয়ে এসব স্থান যেন তার হারানো ঐতিহ্য আর অতীত জৌলুসের কথাই প্রচার করে। আছে গলির বহর, বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর এই পুরান ঢাকা। তেমনই এক গলির নাম জিন্দাবাহার লেন।
উর্দু শব্দ জিন্দেগী (জীবন) থেকে জিন্দা (তাজা, জীবন্ত)। আর তার সঙ্গে এসে জুড়ে গেছে বাহার (বসন্ত)। একসঙ্গে জুড়ে দিলে হয় ‘জিন্দাবাহার’, যার অর্থ দাঁড়ায় ‘তাজা বসন্ত’। এমন অভূতপূর্ব আর অপূর্ব এক সড়ক নিয়ে গোটা কয়েক গ্রন্থ রচিত হলেও অবাক হবার কোনো কারণ নেই। কারণ যে গলির নামটাই এমন বৈচিত্র্যময়, সেখানকার বাসিন্দারা কতটা বিচিত্র হতে পারে, তা ভেবে আনন্দ অনুভূত হয়।
এমনই এক বৈচিত্র্যময় গলিতে জন্মেছিলেন ভারতবর্ষের ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী শিল্পী পরিতোষ সেন। শৈশব কেটেছিল তার এই ঢাকাতেই। ইউরোপ থেকে আর্টের শিক্ষা গ্রহণ করা সত্ত্বেও নাড়ির টানে ফিরে এসেছিলেন পরিতোষ সেন। তিনি ছিলেন কলকাতা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। কলকাতা গ্রুপ ছিল মূলত আর্ট মুভমেন্ট, যা ১৯৪২ সালের দিকে প্রতিষ্ঠা পায়। পরবর্তী সময়ে এই কলকাতা গ্রুপ থেকেই ভারতীয় শিল্পকলায় মডার্ন আর্ট ব্যাপক হারে প্রচার বৃদ্ধি লাভ করেছিল।
১৯৫৯/৬০ সালের দিকে পরিতোষ সেন ‘জিন্দাবাহার নামে’ একটি গল্পসংকলন প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি তার শৈশব জীবনের নিত্যদিনের জীবনীকে পুঞ্জি করে গল্প বলেন পাঠকদের উদ্দেশে। একজন চিত্রকরের বয়ানে ঢাকার এক অচেনা আর অজানা রূপ সম্পর্কে জানতে পায় পাঠককূল। তাই জিন্দাবাহারকে কেবলই গল্পগ্রন্থ না বলে পরিতোষ সেনের আত্মজীবনী বা স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থও বলা চলে।
পরিতোষ সেনের উত্তরসূরীর অনুমতি নিয়ে বইটি পুনরায় বাংলাদেশ থেকে প্রকাশ করে বোধি প্রকাশনালয়। যা মূলত আজিজ সুপার মার্কেটের বুকশপ তক্ষশীলার প্রকাশনা বিভাগ। বইটির প্রচ্ছদ এবং ভেতরে থাকা গল্পের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আঁকা ১৩টি চিত্রকর্মও স্বয়ং লেখকেরই সৃষ্টি। ‘দর্জি হাফিজ মিঞা’, ‘সিন্-পেন্টার জিতেন গোঁসাই’, ‘ডেন্টিস্ট আখ্তার মিঞা’, ‘প্রসন্নকুমার’, ‘আমি’, ‘আগুন’, ‘ন’বাবু, সেজোবাবু’, ‘হে অর্জুন’ এবং ‘জামিলার মা নামে সর্বমোট নয়টি গল্প স্থান পেয়েছে বইটিতে। বইটির প্রচ্ছদ, কাগজ, বাঁধাই, চিত্রিত পাতা, সর্বোপরি বইটির আউটলুক এবং গেটআপ দারুণ।
গল্পগ্রন্থের শুরুতেই তিনি পাঠকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন ‘হাফিজ মিঞা’র। কেবল চোখের দেখাতেই একজন মানুষের পোশাক তৈরির অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল এই দর্জির। তাইতো, স্বয়ং নবাবপুত্রও আসতেন তার কাছে কাপড় বানাতে। তবে পেশার বাইরে মানুষ হিসেবে ভীষণ একরোখা আর রগচটা হাফিজ মিঞা। নেশার মধ্যে ছিল কালেজা-কা সালন্ (কলিজার তরকারি) আর কবুতর। একদিকে সালন্-এর জন্য দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কারো গায়ে হাত তুলতে যেমন দ্বিধাবোধ করতেন না, ঠিক তেমনি আবার পায়রাগুলোর সঙ্গে কাটানো সময়ে নরম মনের হাফিজ মিঞার দেখা মিলত।
এর পরই পাঠকদের সঙ্গে পরিচয় হয় জিন্দাবাহার লেনের আরেক গুণীর সঙ্গে। নাম তার জিতেন গোঁসাই। পেশায় তিনি একজন আঁকিয়ে। থিয়েটারের জন্য বিশাল থান কাপড়ে বিভিন্ন দৃশ্য আঁকাই ছিল তার নেশা ও পেশা। নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে গোঁসাইবাবু নিজের সুখটাকে খুঁজতেন বিশাল ক্যানভাসের বিভিন্ন দৃশ্যে। তার কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রায় প্রায়ই সেখানে উপস্থিত হতেন শৈশবের পরিতোষ সেন। অন্যদের তাড়িয়ে দিলেও তাকে বসিয়ে কাজ দেখাতেন। মাঝেমধ্যে জিতেন গোঁসাই বলতেনও বটে, “তোর হবে”। সেটাই কি তবে ছিল পরিতোষ সেনের চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠার শুরু? আর জিতেন গোঁসাই-ই ছিলেন তার গুরু?
এর পরই আসে ডেন্টিস্ট আখ্তার মিঞার গল্প। জিন্দাবাহার লেনের এই ডাক্তার ওয়ার্ল্ড রিনাউন্ড, মানে বিশ্ববিখ্যাত। তার কারণও রয়েছে বটে। কেননা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যোদ্ধা এই ডেন্টিস্টের ঝুলিতে রয়েছে বাঘ শিকারের মতো বড় রকমের অর্জন। একদিন আচমকা সেই গল্প পরিতোষ সেনকে শুনিয়ে দেন আখ্তার মিঞা। পাঠক হারিয়ে যায় উনিশ শতকের সেই দুর্ধর্ষ অভিযানের জগতে।
পরের গল্পে এসে পাঠক শুরুতে ভিড়মি না খেলেও গল্পের মধ্যভাগে খানিকটা অবাক হবে লেখকের নির্মোহতা আর সত্যতার কাছে। নিজের পিতাকে নিয়ে রচিত এই গল্পের নাম ‘প্রসন্নকুমার’। পেশায় ভেষজ ডাক্তার। সেন পরিবারের মতো বিশাল এক পরিবারের কর্তাবাবু তিনি। পুরো গল্প জুড়েই পাঠকের কাছে এক প্রচ্ছন্ন শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হন লেখকের জনক। বিশ সন্তানের জনক, কবিরাজ এই মানুষটাকে এতটা সম্মান আর শ্রদ্ধার পাত্র বানানো সত্ত্বেও চাপা অভিমানও যেন পাঠকের কাছে স্পষ্টই প্রকাশ করেছেন লেখক।
‘আমি’ নামক গল্পের নিজেদের পারিবারিক টানাপোড়েনের সংসারের কথা বাদেও তখনকার সময়ে নবাববাড়ির কথাও তুলে ধরেছেন লেখক। এমনকি অসচ্ছল এক পরিবারের সন্তান হলেও যে মাঝেমধ্যে বিলাসিতার ইচ্ছা জাগে; সেটাও প্রকাশ পায় গল্পে। এমনকি রূপসী বাংলার যে অপরূপ দৃশ্য লেখকের চোখকে আজীবন প্রশান্তি দিয়ে গেছে, তার বর্ণনা তিনি দিয়েছেন এভাবে,
রূপসী বাংলার এ বিশিষ্ট ছবিটি মনে এলে, আজও আমাকে উদ্ভ্রান্ত ক’রে তোলে। আমাকে নিয়ে যায় অনেক দূরে, অনাবিল এক সৌন্দর্যের জগতে, যেখানে জীবন খুলে দেয় এক খুশির দুয়ার।
‘জিন্দাবাহার’ এতটুকু অবধি পড়ে যে কারোরই মনে হবে, লেখক হয়তো তার শৈশবের সুখস্মৃতির বর্ণনা দিয়ে গ্রন্থটি রচনা করেছেন। কিন্তু বাস্তব জীবনও তো এমন নয়। সুখ ক্ষণস্থায়ী, আর দুঃখ যে মানুষকে ভেঙেচুরে নতুন করে গড়ে– এই ব্যাপারটাই যেন পরিতোষ সেন বর্ণনা করেছেন তার পরবর্তী গল্পগুলোতে।
অর্জুন গাছের মতোই বিশাল পরিসর আর ছায়া হয়ে থাকা বিশ সন্তানের পিতার মৃত্যু দিয়ে পরিতোষ সেন ‘আগুন’ নামক এক গল্প লেখেন। নিজের পিতার মৃত্যুতে ব্যক্তি পরিতোষ, লেখক পরিতোষ এবং চিত্রকর পরিতোষ– তিনটি সত্ত্বা যেন মিলেমেশ একাকার হয়ে যায় এ গল্পে। পিতার চিতার আগুন তাকে যতটা যন্ত্রণা আর বেদনা দিয়েছে, ঠিক ততটাই যেন শক্তিশালী হবার মন্ত্রও ফুঁকে দিয়েছে। ঠিক একই রূপ তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তার ‘হে অর্জুন’ নামক গল্পে। দুটো গল্পের পটভূমির চাইতে বর্ণনার উপর বেশি নির্ভরশীল। তবে সে বর্ণনা পাঠককে শুধু মুগ্ধই নয়, বরং বাকরুদ্ধ করে দিতে সক্ষম।
পিতার মৃত্যুর পর এত বড় সংসারে বিমাতার গর্ভজাত ভাই-বোনদের স্বভাবচরিত্র কী নির্মোহ আর স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন লেখক ‘ন’বাবু, সেজোবাবু’ গল্পে। বটবৃক্ষের ছায়া হয়েই নয়, বরং শেকড় হয়ে যেভাবে বিশ সন্তানকে আগলে পরিবারকে টিকিয়ে রেখেছিলেন প্রসন্নকুমার, তা যেন এক নিমেষেই গুঁড়িয়ে যায় তার মৃত্যুতে। মধ্যবিত্ত সংসারের পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দেয় লোভ আর স্বার্থপরতা। তাই তো, সংসার হয়ে যায় বিভক্ত আর পরিতোষ সেন শোনান আমাদের সেই ভাঙ্গনের গল্পই। ভাইয়ের কীর্তিকলাপ এবং সেন পরিবারের ধ্বংসে লেখক তাই বলেন,
“আমার ভায়েরা অন্ধকার পাতালের অতলে এতটাই নেমে গিয়েছিল যে আকাশের দিকে আর কোনোদিন মুখ তুলতে পারেনি।”
আর সবশেষে এই সনাতনী ধর্মের বিশাল পরিবারে ‘জামিলার মা’ নামে বিধর্মী এক গৃহকর্মীর গল্প লেখক আমাদের শোনান। পিতার কবিরাজি কাজের জন্য জড়িবুটি পেষার কাজে নিযুক্ত ছিলেন এই হাড্ডিসার নারী। বাড়ির কনিষ্ঠ সদস্যদের মধ্যমণি ছিলেন তিনি। পরিবার, সন্তান আর সম্বলহীন এই নারী ভালোবেসে ফেলেছিলেন সেন পরিবারের বাচ্চাদের। হৃদয়ের সমস্তটা উজাড় করে ভালোবেসেছিলেন তিনি। আর তাইতো, নিত্যদিন চার মাইল পথ হেঁটে আসতেন তীব্র প্রখর রোদ উপেক্ষা করে, কালো রঙের এক বোরখা পরে। এমনকি প্রসন্নকুমারের মৃত্যুতে তার চাকরির অবসান হলেও তার ভালোবাসা ফুরোয়নি বিন্দুমাত্রও। অসাম্প্রদায়িক বোধসম্পন্ন এমন গল্প পাঠকদেরকে ভাবিয়ে তুলবে।
একজন চিত্রকর আঁকেন, আর লেখক বর্ণনা দেন। কিন্তু যখন এই দুয়ে মিলে যায়, তখন আসলে গল্প লেখার বদলে গল্প আঁকা হয়। ছবি আঁকার বদলে ছবি লেখা হয়। পরিতোষ সেনের ‘জিন্দাবাহার’ সেরকমই এক গ্রন্থ। লেখক তার চিত্রশিল্পীর সত্ত্বা থেকে বেরিয়ে আপন অনবদ্য আরেক শিল্পীসত্ত্বার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তার লেখনীর মাধ্যমে। তার বর্ণনা এতটাই নিখুঁত আর স্পষ্ট, যে পাঠকের মানসপটে মুহূর্তেই ফুটে উঠবে ত্রিশ-চল্লিশ দশকের ঢাকা। সকল গল্পেই তার লেখনশৈলীর মাধুর্যতা পাঠককে মুগ্ধ করে রাখবে।
তবে সবকিছু ছাড়িয়ে, এমনকি লেখক পরিতোষ সেন নিজেকেও ছাড়িয়ে গেছেন তার ‘আগুন’ এবং ‘হে অর্জুন’ নামক দুটি গল্পে। এই গল্পগুলোর বর্ণনা পড়ে পাঠকের মনে হতে পারে, লেখক যেন ছবি দুটো আঁকার সময়কার সম্পূর্ণ তার মানসিক চিন্তা-চেতনাকে লেখায় রূপ দিয়েছেন। তাই, পুরো গ্রন্থ জুড়েই এমন ভাবটা বজায় থাকে, হয়তো তিনি গল্প লেখেননি, বরং এঁকেছেন। পরিতোষ সেনের সার্থকতা এটাই যে, পাঠক এ গ্রন্থ পড়া শেষে পরিতৃপ্তির ঘ্রাণ পায় নিজেরই অজান্তে।
বই: জিন্দাবাহার
লেখক: পরিতোষ সেন
প্রকাশনী: বোধি প্রকাশনালয়
মলাট মূল্য: ৩২৫/- টাকা