এ তুমি কেমন তুমি চোখের তারায় আয়না ধরো
এ কেমন কান্না তুমি আমায় যখন আদর করো!
ভাবছেন ‘জাতিস্মর’ চলচ্চিত্রে রূপঙ্করের কন্ঠে গাওয়া জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত গানের দুই চরণ কেন টেনে আনা? একটি ঘর, অনেকদিন ধরে যাতে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ। একটি ঘর, যেটি রহস্য হয়ে ক্রমশ চোখের সামনে ঘোরে। সেই ঘরের তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করার সাথে সাথে নীলচে তারার রোশনাই এসে চোখ ধাঁধায়। উন্মুক্ত ছাদ বেয়ে নেমে বৃষ্টি যখন ছুঁয়ে দেয় অতৃপ্ত মুখখানা, তখন আনমনা মন বলে ওঠে, “এ কেমন কান্না তুমি আমায় যখন আদর করো!“
ব্যস্ত কলকাতা। দালানগুলো সব আকাশ ছোঁবার প্রতিযোগিতায় মত্ত। সেসবের পেছনে একতলা হলুদ বাড়ি। সামনে রোগা-পাতলা পেয়ারা গাছ, একপাশে ঠাকুরের জরাজীর্ণ পূজোর আসন। হলুদের রং বহু আগে ফিকে হয়ে গেছে, সেই ঘরের একমাত্র রক্ত-মাংসের মানুষটির মতো। পেশায় হরবোলা ছিলেন। টিভি-রেডিওর শোতে নকল করতেন পশুপাখির ডাক, মানুষের কন্ঠস্বর। একটা সময়ের পর মানুষ নাকি ঘুরে-ফিরে নিজের কাছেই এসে ঠেকে। নরসিংহের বেলায় ফিরে এসেছে পেশা। ভাগ্যিস, নকল করতে পারতেন। তাই বহু আগে গত হওয়া ঠাকুমাকে বাঁচিয়ে রাখেন নিজের মধ্যে। সকালে ঠাকুমার হাতে এক কাপ চা, গোটা তিনেক বিস্কুট সাক্ষাৎ অমৃত। মাঝেমাঝে স্বাদ বদলাতে পেঁয়াজ কুঁচি, কাঁচালঙ্কা দিয়ে ডিমের অমলেট। সকালের খবরের কাগজ পাঁচিল টপকে রোজ ঘরে আসে, কিন্তু পড়া হয় না। বাজারে যাবার সময় পাড়ার মোড়ে দিলীপের চায়ের দোকানে এক কাপ চা রুটিন করে গেলা হলেও ঠাকুমার চায়ের তুলনা কেবলই ঠাকুমা।
সকালের সূর্য দিনের পূর্বাভাস না দিলেও নরসিংহের বেলায় ভবিতব্য একদম দিনের আলোর ন্যায় পরিষ্কার। একা একজন মাঝবয়েসী মানুষ, স্ত্রী ছেড়ে গেছে। একমাত্র সন্তান স্ত্রীর কাছে। নিজের বলতে কেবল ঠাকুমা আর কল্পনায় বাঁচিয়ে রাখা নিজের ছোটবেলা। আরেকজন আছে। পাড়ার মোড়ে ভাঙারির ব্যবসা করা কেষ্ট। তারও কেউ নেই। যে যার মতো ব্যস্ত। ছুটছে গন্তব্যে।
নরসিংহের কোনো গন্তব্য নেই। বাজার শেষ করে বাড়ি ফেরা। পৃথিবীর বুকে যার চাহিদা যত বেশি, তার তৃপ্তি ততই কম। নরসিংহের অত চাহিদা নেই। অল্পতে তুষ্ট হওয়াদের দলে। সেই তত্ত্ব মেনে এগিয়ে যাওয়া নরসিংহের একদিন খায়েশ জাগে একটা কেদারার। ইচ্ছের কথা জানায় কেষ্টকে। ক’দিন বাদে কেষ্ট তা ব্যবস্থা করে দেয়। চেয়ারের বাংলা আভিধানিক অর্থ কেদারা হলেও, কেদারা বলতে আজও রাজকীয় ব্যাপার বোঝায়। রাজপ্রাসাদে রাজার পড়ার ঘরের কিংবা ব্যালকনির ঐ চেয়ারটা কেদারা হিসেবে সমাদৃত। নরসিংহের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। কেবল একটি চেয়ারই এসেছে। ব্যতিক্রম যা ঘটার ব্যক্তিত্বে ঘটতে শুরু হয়।
যে নরসিংকে বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করা ম্যানোকা কথা শোনায়, এমনকি এক কাপ চা চাইলেও কিংবা পাশের বাড়ির বুড়ো ভদ্রলোকটি কুশল জানার নাম করে এসে নরসিংহের ব্যর্থতার গল্প শুনিয়ে যায়, সে-ই তাদের সামনে ভিন্ন অবতারে হাজির হয় কেদারায় বসার পর। আকাশবাণীতে যুদ্ধের বিবরণী শুনতে শুনতে কখন যে নিজেকে যুদ্ধবিমানের পাইলট ভেবে উড়াল মারে নরসিংহ, টের পায় না। আবার নিমিষে চলে যায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাসের বেঞ্চিতে, সাদা ইউনিফর্ম পরা বাধ্য ছাত্রের বেশে! যেন ‘হারিয়ে যাবার নেইকো মানা’ তত্ত্ব মেনে যেথায় খুশি সেথায় ছোটে সে! সত্যিই তো, স্বপ্নে হারিয়ে যেতে মানা কীসে?
এই সিনেমায় চরিত্র তিনটি- নরসিংহ, কেষ্ট ও কেদারা। নরসিংহ চরিত্রে কৌশিক গাঙ্গুলির অভিনয় বাস্তবতাকে হার মানাবে। একজন মানুষ কতটা সাবলীল হতে পারে, চরিত্রের কতখানি গভীরে ঢুকতে পারে তাকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। সিনেমায় ঠাকুমার গলা, বাচ্চা ছেলের গলা, সবকিছুতে নিজেই কন্ঠ মিলিয়েছেন। একটা সিনেমার সার্থকতা তখন, যখন চরিত্রকে জীবন্ত মনে হবে! মনে হবে, “আরে আরে, এটা তো আমি! আমার গল্প বলছে ওরা!“
কৌশিক সেখানে অনবদ্য। হরবোলার ডাক, নির্লিপ্ত চলাচলে মনের ভেতর চলতে থাকা ঝড়কে শান্ত রাখার তুমুল প্রচেষ্টা। তাতে ব্যর্থতা আর সাফল্য সমান তালে পাল্লা দিয়ে চলে। যখন মনের সাথে পেরে ওঠা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে, ছুটে যায় কেষ্টর দোকানে। বাতিল জিনিসপত্র বিক্রি করা কেষ্ট বুঝতে পারে নরসিংহের দুঃখগুলো। অনর্গল তার কাছে বলে চলে। এতে দুঃখগুলো বাতিল হয়ে জমা পড়ে কেষ্টর ভাগাড়ে। এলাকার জনপ্রতিনিধিকে যেই বেলা অপমান করে ঘর থেকে বের করে দেয় নরসিংহ, কেষ্ট খুশিতে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে শূন্যে হাত ছোঁড়ে। এই জয় তো কেবল নরসিংহের নয়, কেষ্টরও!
ওর মতো সুবিধাবঞ্চিতদের যারা উঠতে বসতে লাথি দেয়, চাইলেও মুখের উপর কিছু বলতে পারে না। কেউ বললে তাই বিজয়ের আনন্দ ওরা সমানভাবে ভাগ করে নেয়। কেষ্ট চরিত্রটায় রুদ্রনীল ঘোষ আবারও জাত চিনিয়েছেন। অর্ধ মাতাল, ছন্নছাড়া চরিত্রে ডুবে যেতে রুদ্রের বালাই নেই। বর্তমান কলকাতায় রুদ্রনীলের মতো এত শক্তিশালী চরিত্রাভিনেতা খুব কমই চোখে পড়ে।
“সব মানুষই কোনো না কোনোভাবে ব্যর্থ। কিন্তু বার বার সেই ব্যর্থতার কথা তুলে তার কোনো উপকার করা যায় না।“- বদলে যাওয়া নরসিংহ বাড়িতে আসা প্রতিবেশি বুড়োকে কথাটা বলার সময় যেন এই সমাজের প্রতিটি মানুষের লুকায়িত সত্য প্রকাশ পায়। সত্যিই প্রত্যেকে কোনো না কোনোভাবে ব্যর্থ। সমাজ অনবরত ব্যর্থতার ফিরিস্তি তুলে সহানুভূতির পরিবর্তে বিধ্বস্ত সত্ত্বাকে সামনে এনে দাঁড় করিয়ে কাটা ঘাঁয়ে নুন ছিটায়।
পরিচালক হিসেবে প্রথম চলচ্চিত্রে বাজিমাত করেছেন ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত। কলকাতার সিনেপ্রাঙ্গনে মিউজিক কম্পোজার হিসেবে সুপরিচিত ইন্দ্রদীপ প্রথম ছবিটিই তৈরি করেছেন মূলধারা থেকে সরে এসে ভিন্ন এক গল্প নিয়ে। ইন্দ্রদীপের মতে, “আমি অনেকদিন ধরে একটা গল্প বলতে চেয়েছিলাম। সেসব মানুষের গল্প, সমাজে যাদের ঠাঁই হতে হতেও হয় না। তাদের চারপাশে সব থেকেও তারা উপেক্ষিত। দিন শেষে পায় স্রেফ একাকিত্বকে। সেটিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে শেখে। একটা সময় উপভোগ করতে থাকে একাকিত্বের যন্ত্রণাকে।“
ভাবনাটা কোথা থেকে এলো সেই প্রসঙ্গে পরিচালক জানান, “কয়েকবছর আগে আমি একা থাকতে শুরু করি। সেই সময় আমি উপলব্ধি করি, একা থাকার ভালো এবং খারাপ দুটো দিকই আছে। একদিকে সমাজের অদ্ভুত আচরণ, অন্যদিকে নিজের মতোন বাঁচা।” ইন্দ্রদীপের ভাবনাকে পর্দায় চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কৌশিক গাঙ্গুলি। অভিনয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “কেদারা এমন এক গল্প, যাতে অভিনয়ের সুযোগ পেলে কেউই ছাড়বে না। এটি আমাদের সবার ভেতরের গল্প।“
আক্ষরিক অর্থেই যেন কৌশিকের কথা মিলে যায়। চাকুরি, পরিবারবিহীন মাঝবয়েসী একজন মানুষের জীবন কতটা নির্জীব হতে পারে কেদারা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কেদারায় মূলধারার মশলা নেই, কিন্তু বাস্তবতার তেঁতো স্বাদ আছে। সেটি চিবুতে চিবুতে মুখের ভেতর মিষ্টি রসে জিহ্বা সাঁতার কাটে।
পাখিরা বুঝি মাইনে পায়?
মেঘেরা বুঝি অফিস যায় রোজ?
হাওয়ার বুঝি ব্যবসা আছে কোনো?
নদীরা বুঝি চুক্তি হলে তবেই করে সমুদ্রের খোঁজ?
ঝর্ণা বুঝি বিকোয় কখনো?
দূরের দেশে শব্দ হয়
শব্দ ভেসে আসে
মুদ্রাহীন সেই রঙিন শব্দ ভেসে আসে
যেমন পাখি, যেমন নদী, যেমন মেঘ, সমুদ্র বা হাওয়া
তেমনই কিছু মানুষ জানে, তাদের ডাক
শব্দ করে চাওয়া
মুদ্রাহীন সেই রঙিন শব্দ ভেসে আসে।
২০১৯ সালের ১লা নভেম্বর মুক্তি পাওয়ার আগেই বিশেষ জুরি অ্যাওয়ার্ড ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় কেদারা, যা অফট্র্যাক সিনেমার দর্শকদেরই নয় কেবল, আগ্রহ বাড়ায় মূলধারার বাণিজ্যিক স্বাদের দর্শকেরও। ট্রেইলার মুক্তির পর যে আগ্রহের পারদ তরতরিয়ে উপরে ওঠে। কেদারায় গানের বালাই না থাকলেও এতে দর্শকের অতৃপ্ত হবার সুযোগ রাখেনি ইন্দ্রদীপ। নিজে গানের মানুষ, সুরের আবেদন ঠিক জানেন। অরিজিৎ সিংকে দিয়ে তাই গড়েছেন দুর্দান্ত ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর। গোটা সিনেমায় যখনই চাহিদা জেগেছে সুরের, তখনই মূর্ছনায় মাতাল করেছে অরিজিৎ। শুভঙ্কর ভড়ের ক্যামেরার কারুকাজ আর অরিজিতের সুর অন্য জগতে ডুব দেওয়াবে পর্দার সামনে থাকা চোখেদের। সিনেমার শেষে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের গলায় শ্রীজাত বন্দোপাধ্যায়ের কবিতা যেন খাবারের শেষ পাতের পাতুরি! যাতে শেষ হওয়ার পরেও রেশ রেখে যাবে কেদারা। রেখে যাবে প্রশ্ন, নরসিংহের মতো মানুষদের সমাজের কাছে না করা অসংখ্য অব্যক্ত প্রশ্ন।