শারদীয় পর্ণরাজির কার্পেটে মোড়া এক জনশূন্য বন, যেখানে বাতাসে খড়কুটোর মতো ভাসছে কৃষ্ণবর্ণের একটি ফেডোরা হ্যাট। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে কার্টার বারওয়েলের মনোমুগ্ধকর স্কোর। ওপেনিং ক্রেডিটের আগে বহুল চর্চিত এই স্বপ্ন দৃশ্যের মাধ্যমে কোয়েন ব্রাদার্স মিলার’স ক্রসিং (১৯৯০)-এ স্বাগত জানান দর্শকদের। হ্যাটের মালিক কে? জনশূন্য বনে এর কাজটাই বা কী? তা আমরা জানি না। আর জানার আগেই ভেসে ওঠে ক্রেডিট। এই হ্যাট নিয়ে কোয়েনরা এতটাই ঝামেলায় পড়েছিলেন যে, এটা বাদ দিয়ে লিখে ফেলেছিলেন পরবর্তী সিনেমার স্ক্রিপ্ট।
পরবর্তী সিকোয়েন্স দৃশ্যায়িত হয় একটি বোর্ডরুমে, যে ধরনের বোর্ডরুম ক্রাইম বা গ্যাংস্টার জনরায় হরহামেশা পরিলক্ষিত হয়। এখানে এক টেকো লোকের কথা আমরা শুনতে পাই। সে এথিকস বা নৈতিকতা নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে তার সামনে বসা, এখনো আমাদের অদেখা, কোনো ব্যক্তির উদ্দেশ্যে। সে বলে চলে,
“I’m talking about friendship, I’m talking about class, I’m talking about… ethics.”
টেকো লোকটি হচ্ছে জনি ক্যাসপার (জন পলিটো)। সে যাদের উদ্দেশ্যে কথা বলছে তার হলো আইরিশ মব বস লিও ও’ব্যানন (অ্যালবার্ট ফিনি) এবং তার বিশ্বস্ত সহচর টম রেগান (গ্যাব্রিয়েল বার্ন)। এথিকস সংক্রান্ত ক্যাসপারের বয়ান বা তাদের মিটিং কতটা ভালো যাচ্ছে সেটা আঁচ করা যায় লিওর মুখে ফুটে ওঠা বিরক্তিতে। এর একটা কারণ হতে পারে ক্যাসপারের বয়ানটাই ত্রুটিপূর্ণ। আবার আরেকটা কারণ হতে পারে আইরিশ মবে হয়তো বন্ধুত্ব, সচ্চরিত্রতা বা এথিকসের মতো ব্যাপারগুলো অতটা গুরুত্ব বহন করে না।
চলচ্চিত্রের মনোযোগী দর্শকরা হয়তো ইতোমধ্যেই বুঝে গেছেন প্রারম্ভিক কথোপকথনের সিকোয়েন্সের ক্ষেত্রে কোয়েন ব্রাদার্স শরণাপন্ন হয়েছেন ফ্রান্সিস ফোর্ড ক্যাপোলার ক্লাসিক দ্য গডফাদারের। এই ধরনের ইন্সপিরেশনের ঘটনা সিনেমায় কেবল এটিই নয়। এমন আরো নিদর্শন আমরা দেখি এখানে। এসব বিষয় নিয়ে কথাবার্তা এই লেখায়ও থাকবে।
এবার চলুন ১১৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই সিনেমার কাহিনীসংক্ষেপ জেনে নেওয়া যাক। মুভিতে নির্দিষ্ট করে কোনো সময় বা শহরের নাম বলা হয় না। তবে পারিপার্শ্বিক দেখে মনে হয় সময়টা ১৯২০ এর দশকের, হয়তো ১৯২৯। আর বিশাল বড় শহরকে দেখে নিউ ইয়র্কের কথাই সবার আগে মাথায় আসে। যদিও এর শ্যুটিং হয়েছিল লুইজিয়ানার নিউ অর্লিন্সে। পুরো শহরের কর্তৃত্ব রয়েছে আইরিশ কিংপিন লিও ও’ব্যাননের লৌহমুষ্টিতে। তার আধিপত্য এতটাই প্রবল যে শহরের মেয়র এবং পুলিশ কমিশনার পর্যন্ত তার আদেশ অনুযায়ী কাজ করে। তার কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার মতো উঠতি এক মাফিয়া বসও আছে শহরে। তার নাম জনি ক্যাসপার।
ইতালিয়ান জনি ব্যবসা করে কিছু কঠোর নিয়ম-কানুন মেনে, যে কোডের কারণে সে তার মিত্র বা সহযোগীদের সাথে প্রতারণা করে না। তবে তার বিপরীতে গেলে সে অবশ্যই ছেড়ে কথা বলবে না। মাসল পাওয়ারের ক্ষেত্রে পিছিয়েও নেই সে। তার সাথে আছে এডি ডেইনের (জে. ই. ফ্রিম্যান) মতো ভয়ংকর সঙ্গী। জনির আদেশ বাস্তবায়ন করতে যার হাত আর বন্দুক দুটোই সমানতালে চলে। দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মাঝে বিরাজমান টম রেগান, যার মূল অস্ত্র হাতে থাকে না; বরং এর অবস্থান তার খুলির ভেতর। ঝামেলা হলে তাতে মার খেয়ে পর্যদুস্ত হওয়াকে টম রুটিন বানিয়ে ফেলেছে বলা চলে। তথাপি লিও আর জনি উভয়েই তাকে নিজের কৌঁসুলি হিসেবে চায়। টম অনুগত লিওর প্রতি, যদিও তার লিওর প্রেমিকা ভার্নার (মার্শিয়া গে হেইডেন) সাথে সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু জনি তাকে দলে টানতে চায় যেকোনো মূল্যে। আর রুপালী পর্দার অন্যান্য ইতালিয়ান মাফিয়াদের মতোই বলা যায়, হি মেইকস টম অ্যান অফার হি ক্যান্ট রিফিউজ।
এই যখন অবস্থা, তখন লিওর কাছে বার্নি বার্নবাম (জন টুরটুরো)-এর নামে বিচার দিতে আসে জনি। তার মতে, বার্নি তার কাছ থেকে চুরি করেছে, যে কারণে তার শাস্তি হওয়া দরকার। চুরি করে যদি সে পার পেয়ে যায়, তাহলে তাদের ব্যবসাটাই ভেস্তে যায়। কারণ এতে তারা দুর্বল বলে প্রতীয়মান হয়, আর মব গাইদের জগতে দুর্বলতা ধ্বংসের কারণে পরিণত হতে বেশি সময় লাগে না। কিন্তু বার্নি আবার ভার্নার ভাই। তাই টমের পরামর্শের বিপরীতে গিয়ে তাকে সুরক্ষা দেবে বলে ঠিক করে লিও। ভার্নার প্রতি দুজনের টান আর তার ভাইকে প্রটেকশন দেওয়া নিয়ে বসচা হয় রেগান আর লিওর মাঝে। যার ফলে নিজেকে অনিশ্চয়তার মাঝে আবিষ্কার করে টম। কারণ যত ক্ষুরধার মেধাই হোক, তার নিজেরও কিছু সমস্যা রয়েছে।
এমন সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল জনি, ঝোপ বুঝে কোপও মেরে দেয়। তবে নিজের দলে টানার আগে টমকে বাজিয়ে দেখবে বলে ঠিক করে সে। ফলে টমের উপর দায়িত্ব পড়ে মিলার’স ক্রসিং নামক বনে নিয়ে একজনকে খুন করার। সাথে জনির দলের লোকেরা থাকবে তবে গুলিটা টমকেই চালাতে হবে। এরপরে কী হবে তা জানতে হলে দেখতে হবে সিনেমাটি। কিন্তু যতটা সহজে কাহিনী সংক্ষেপ লেখা হলো, মুভির কাহিনী তার চেয়ে বহুগুণ জটিল। কারণ, এখানে কোয়েনরা দেখিয়েছেন টমের ভেতর-বাহির, তার টানাপোড়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া আর মনস্তত্ত্বকে। কাহিনী বুঝতে হলে আমাদেরকে দিতে হবে পূর্ণ মনোযোগ। আবার ওপেন এন্ডিংয়ের কারণে শেষটা সাজিয়ে নিতে পারব নিজেদের মতো করে।
কেবল সিনেমা দেখেই যে ভালো সিনেমা বানানো সম্ভব, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ টারেন্টিনো। নিজের ফিল্মের একটা দৃশ্যের মাঝে বেশ কিছু সিনেমার রেফারেন্স ঢুকিয়ে দিতে সিদ্ধহস্ত তিনি। এই কাজের জন্য ততটা বিখ্যাত না হলেও মিলার’স ক্রসিংয়ে আমরা দেখি কোয়েনদের দর্শক সত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ। সিনেমার প্রতি তাদের ভালোবাসার ব্যাপারটিও ফুটে ওঠে এখানে। ত্রিশের দশকের গ্যাংস্টার ঘরানার সাথে চল্লিশের দশকের নোয়ার ঘরানার অসাধারণ সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন তারা। ফলে একদিকে দেখা গেছে টমি গানসমেত অল আউট শ্যুটিং সিকোয়েন্স। ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে ওঠা সুরের মূর্ছনার সাথে লিওর বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার দৃশ্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এক্ষেত্রে। যেকোনো গ্যাংস্টার জনরার ভক্তকে পুলকিত করতে ঐ একটা সিকোয়েন্সই যথেষ্ট।
আবার, অন্যদিকে দেখা গেছে নোয়ারের রহস্যময় আবহ আর চরিত্রগুলোর দ্বিমুখী ভাব। এক্ষেত্রে টমের চারিত্রিক জটিলতার ব্যাপারটি গুরুত্ববহ। শুরুতে গডফাদার থেকে অনুপ্রাণিত দৃশ্যের কথা তো বলা হলোই। এছাড়া আরো যেসব চলচ্চিত্রের নির্যাস এখানে রয়েছে সেগুলোর মধ্যে ১৯৩২ সালের স্কারফেইস, দ্য গ্লাস কি, দ্য থার্ডম্যান (ফিউনারেলের দৃশ্যের পুননির্মাণ), রিয়ার উইন্ডো (লার্স থরওয়াল্ড নামের ব্যবহার), ইয়োজিম্বো, আ ফিস্টফুল অফ ডলার্স, ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন আমেরিকা (বার বার টেলিফোনের বেজে ওঠা), ফরাসি ক্রাইম ফ্লিক ল্যু ড্যুলোসের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে মিলার’স ক্রসিংয়ের পুরো প্লটের ব্লু প্রিন্ট তারা নিয়েছেন প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ড্যাশিয়েল হ্যামেটের ‘দ্য গ্লাস কি’ নামক উপন্যাস থেকে। যেটি অবলম্বনে স্টুয়ার্ট হেইসলার সিনেমা নির্মাণ করেন ১৯৪২ সালে। একই লেখকের ‘রেড হার্ভেস্ট’ নামক গ্রন্থ থেকেও কিছু উপকরণ ধার করেছেন তারা। আবার ১৯৪৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অল দ্য কিং’স ম্যান’ সিনেমার মূল চরিত্রের সাথেও মিল লক্ষ্য করা যায় এখানকার মূল চরিত্রের।
এতসব অনুপ্রেরণা সত্ত্বেও মিলার’স ক্রসিংকে কোয়েন ব্রাদার্সের কাজ বলেই মনে হয়। কেননা, যতকিছু তারা ধার করেছেন, সবকিছুকেই সিনেমায় ব্যবহার করেছেন নিজেদের সিগনেচারের সাথে। হ্যামেটের ব্লু প্রিন্টকে তারা ব্যবহার করেছেন সম্পূর্ণ নিজেদের মতো করে, গল্পকে নিয়ে গিয়েছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে। ফলে মূল রহস্য ঘরানার গল্প পরিণত হয়েছে বিশদ ক্যারেক্টার স্টাডিতে। আর তাদের চিরচেনা ডার্ক কমেডি তো ছিলই। রেফারেন্সের ব্যাপারগুলো হয়তো কোনো গড়পড়তা সিনেমাকে মাস্টারপিসে পরিণত করে না। কিন্তু এসব জিনিসের কারণেই একজন সিনেফাইলের মনে পরিচালক বা স্ক্রিপ্ট রাইটারের জন্য শ্রদ্ধা জন্মায়।
কোয়েনদের প্রথম দুই সিনেমার মতো এখানেও কাস্টে বড় কোনো নাম নেই। নিজেদের চরিত্রে মার্শিয়া, বার্ন, ফিনি সকলেই ছিলেন অসাধারণ। তবে সবচেয়ে সেরা পারফর্মেন্স ছিল বার্নি চরিত্রে জন টুরটুরোর অভিনয়। এছাড়া টুরটুরোর মতো এই মুভির মাধ্যমে প্রথমবারের মতো কোয়েনদের প্রজেক্টে দেখা যায় স্টিভ বুশেমিকে, আনক্রেডিটেড একটা ক্যারেক্টারে দেখা গেছে ফ্রান্সেস ম্যাকডরম্যান্ডকেও। এই তিনজনকে পরবর্তী তিন দশকে আমরা বহুবার কোয়েন ভাইদের প্রজেক্টে দেখেছি, সাক্ষী হয়েছি সকলের ক্যারিয়ারের বিবর্তনের। তবে ফ্রান্সেস ছিলেন তাদের প্রথম চলচ্চিত্রেও। একটা বিখ্যাত ক্যামিওর কথা না বললেই নয়। সিনেজগতে পদার্পণের প্রথমদিকে দুই ভাই কাজ করেছিলেন স্যাম রাইমির সঙ্গে। প্রথম চলচ্চিত্র ব্লাড সিম্পলের ক্ষেত্রেও তার প্রভাব ছিল। এই রাইমিকে ক্ষণিকের জন্য পর্দায় দেখা গেছে মিলার’স ক্রসিংয়ে।
কার্টার বারওয়েলের হৃদয়গ্রাহী ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। পরিচালকের কাজকে আরো মহিমান্বিত করতে বিশাল ভূমিকা রেখেছে এটি। খেয়াল করলে দর্শক বুঝতে পারবেন- লিওর আইরিশ এবং জনির ইতালিয়ান হ্যারিটেজের কথা স্বরণ করিয়ে দিতে ঐ ঘরানার সঙ্গীত শোনা গেছে সিনেমাতে। কার্টারের মতো সিনেম্যাটোগ্রাফার ব্যারি সনেনফেল্ডও পরিচিত মুখ কোয়েন ভ্রাতৃদ্বয়ের প্রজেক্টে। ছিলেন তাদের প্রথম দুই চলচ্চিত্রেও। প্রয়োজনের সময়ে তার হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরার মুন্সিয়ানা মুভিতে যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা। সেটের ডিটেইলিংয়ের কথাও উল্লেখযোগ্য। বিশের দশক মূর্ত হয়ে উঠেছে পুরো ফিল্মে। আর লিওর অফিস এবং বাসায় তার আইরিশ উত্তরাধিকারের প্রতীক সবুজ বর্ণের ব্যবহার গল্পকে দিয়েছে আলাদা গভীরতা।
আগের দুটি সিনেমা ভালো ব্যবসা করলেও মিলার’স ক্রসিং মুখ থুবড়ে পড়ে বক্স অফিসে। গল্পের জটিলতা, গুডফেলাসের মতো কালজয়ী সিনেমার মুক্তি এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কারণ সম্ভবত কোয়েন ব্রাদার্সের অপরিচিতি এবং বড় বাজেট। বর্তমানে যেকোনো চলচ্চিত্র বোদ্ধার কাছে কোয়েনরা পূজনীয় হলেও ৩১ বছর আগের প্রেক্ষাপট এমন ছিল না। তাদের কাছ থেকে কী আশা করবে তা দর্শক বুঝতে পারেনি। তখনো তারা জানতো না এই দুই ভাই মিলে পরের দশকগুলোতে আবিষ্কার করবেন বিভিন্ন জনরার চলচ্চিত্র আর নিজেদের মেধার জোরে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখবেন প্রতিটি ক্ষেত্রে। তবে অর্থনৈতিক ব্যর্থতা মিলার’স ক্রসিংয়ের কাল্ট ফলোয়িং অর্জনে বাধা হতে পারেনি। এবং মুক্তির পরবর্তী তিন দশকে এই সিনেমা আর কোয়েন ব্রাদার্সের প্রতি সিনেফাইলদের সম্মান কেবল বেড়েছে।
তাই, ধৈর্য ধরে জটিল গল্প, থিম এবং অলংকারের ব্যাপারসমূহ মনোযোগ দিয়ে বুঝতে চাইলে পাঠকও বসে যেতে পারেন মিলার’স ক্রসিং দেখতে। আর উপভোগ করতে পারেন নব্বইয়ের দশকের আন্ডাররেটেড এই মাস্টারপিস।