বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদের একজন হুমায়ূন আহমেদ। পুরো জীবন ধরে তিনি পাঠকদের জন্য ছড়িয়ে গেছেন একরাশ মুগ্ধতা। সৃষ্টি করেছেন হিমু, মিসির আলি, শুভ্র, বাকের ভাইয়ের মতো জীবন্ত সব চরিত্র। বাঙালি মধ্যবিত্তের মনস্তত্ত্ব তার মতো করে আর কেউ অনুভব করতে পারেননি। তাই সারাটা জীবন ধরে তিনি উপভোগ করতে পেরেছেন পাঠকদের অকৃত্রিম গভীর ভালবাসা।
হুমায়ূন আহমেদের চল্লিশ বছরের বর্ণাঢ্য লেখকজীবনের সর্বশেষ উপন্যাস ‘দেয়াল।’ ২০১১ সালের মাঝামাঝিতে তিনি ‘দেয়াল’ রচনা শুরু করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর ২০১৩ সালের একুশের বইমেলায় উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। ইতিহাসের সত্যের সাথে কল্পনার রঙ মিশিয়ে হুমায়ূন আহমেদ জন্ম দিয়েছেন এই হৃদয়গ্রাহী উপাখ্যানের ।
সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের পরবর্তী সময়ের পটভূমিতে লেখক এ উপন্যাসটি লিখেছেন। চপলমতি তরুণী অবন্তিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে এর কাহিনী। সে তার দাদা সরফরাজ খানের সঙ্গে থাকে। অবন্তির বাবা নিখোঁজ এবং মা ইসাবেলা স্বামীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তার স্বদেশ স্পেনে চলে গেছেন। পিতামাতার সাথে অবন্তির যোগাযোগ হয় চিঠির মাধ্যমে। হুমায়ূন আহমেদ তার নিজস্ব ভঙ্গিমায় এ উপন্যাসে অবন্তির দাদা সরফরাজ খানকে একটি বিচিত্র এবং খেয়ালি চরিত্র রূপে উপস্থাপন করেছেন। তিনি অবন্তির গৃহশিক্ষক শফিকের উপর নজরদারি করেন, অবন্তির মা ইসাবেলার চিঠি তাকে দেওয়ার আগে কৌশলে খুলে নিজে গোপনে পড়েন। তার কীর্তিকলাপ উপন্যাসের শুরুতে যথেষ্ট হাস্যরসের জন্ম দেয়। যেমন, অবন্তির গৃহ শিক্ষক শফিক অবন্তির জন্মদিনে দারোয়ানের মাধ্যমে একটা বই উপহার পাঠিয়েছে। অতঃপর লেখকের ভাষায়,
“অবন্তির দাদা সরফরাজ খানের হাতে ‘ইছামতি’ বই। দারোয়ান বইটা সরাসরি তাঁর হাতে দিয়েছে। তিনি প্রথমে পাতা উল্টিয়ে দেখলেন, লুকানো কোন চিঠি আছে কি না। বদ প্রাইভেট মাস্টারেরা বইয়ের ভেতর লুকিয়ে প্রেমপত্র পাঠায়। অতি পুরনো টেকনিক। চিঠি পাওয়া গেল না। বইটা তিনি ড্রয়ারে লুকিয়ে রাখলেন। আগে নিজে পড়ে দেখবেন। বইয়ের লেখায় কোন ইঙ্গিত কি আছে? … গল্প-উপন্যাস হল অল্পবয়েসী মেয়েদের মাথা খারাপের মন্ত্র। তাঁর মতে, দেশে এমন আইন থাকা উচিত যেন বিয়ের আগে কোন মেয়ে ‘আউট বই’ পড়তে না পারে।”
অবন্তির জীবনে যুদ্ধপরবর্তী এ সময়ের সাথে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন এক ঘটনার যোগাযোগ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকে নিয়ে তার দাদা সরফরাজ খান ঢাকা থেকে পালিয়ে গ্রামে এক পীরের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে এক পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা তাকে দেখে ফেলে বিয়ে করতে চাইলে বিপদমুক্তির জন্য ঐ পীর তার পুত্র হাফেজ জাহাঙ্গীরের সাথে অবন্তির বিয়ে দেন। হাফেজ জাহাঙ্গীর অবন্তির প্রতি স্ত্রীসুলভ কোনো অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়নি। অন্যদিকে, অবন্তি এ বিয়ে মেনে না নিলেও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ঢাকার চলে আসার পর হাফেজ জাহাঙ্গীরের সাথে সে যোগাযোগ বজায় রাখে।
এই কাল্পনিক চরিত্রগুলোর সাথে সমান্তরালে বর্ণিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ইতিহাসের কুশীলবদের কঠোর বাস্তব কাহিনী। সরফরাজ খানের পুত্রের বন্ধুদের একজন হিসেবে খালেদ মোশাররফের সাথে এই পরিবারের যোগাযোগ ছিল। ইতিহাসের এই বাস্তব আখ্যানটি মেজর ফারুক ও রশীদের বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনার মাধ্যমে সূচিত হয়। লেখক বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনার এ অংশটি লেখার সময় অ্যান্থনী মাসকারেনহাসের ‘বাংলাদেশ: আ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ গ্রন্থটি দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
এরপর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড থেকে খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতাগ্রহণ, খালেদ মোশাররফের ব্যর্থ অভ্যুত্থান, কারাগারে চার নেতার করুণ মৃত্যু, কর্নেল তাহেরের সিপাহী-জনতার বিপ্লব, জিয়াউর রহমানের ক্ষমতাগ্রহণ এবং কর্নেল তাহেরের করুণ মৃত্যু- পর্যায়ক্রমে এ উপন্যাসে স্থান পেয়েছে। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুতে উপন্যাসটির সমাপ্তি ঘটেছে।
লেখক নিজেও যেহেতু এই সময়ের একটি অংশ, কাজেই ঐ সময়ে লেখকের নিজের ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনাও এ উপন্যাসে বিবৃত হয়েছে। উপন্যাসের কল্পিত অংশের গল্পের মতো এ পর্বটিও যথেষ্ট পরিমাণে কৌতূহলোদ্দীপক ও চমকপ্রদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে বাকশালে যোগদানের চাপ, রক্ষীবাহিনী গঠন, নিরাপত্তহীনতা, আবার শহীদ পরিবার হিসেবে সরকারের বরাদ্দ দেওয়া বাড়ি থেকে তাদেরকে রাত দুপুরে বের করে ঘটনাগুলো পাঠকদেরকেও পীড়িত করে। লেখকের ভাষায়,
“এক রাতে রক্ষীবাহিনী এসে বাড়ি ঘেরাও করল। তাদের দাবি- এই বাড়ি তাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তা এখানে থাকবেন। মা শহীদ পরিবার হিসেবে বাড়ি বরাদ্দ পাওয়ার চিঠি দেখালেন। সেই চিঠি তারা মায়ের মুখের ওপর ছুড়ে ফেলল। এরপর শুরু হল তাণ্ডব। লেপ- তোষক, বইপত্র, রান্নার হাঁড়িকুড়ি তারা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলতে শুরু করল। রক্ষীবাহিনীর একজন এসে মায়ের মাথার ওপর রাইফেল তাক করে বলল, এই মুহূর্তে বাড়ি থেকে বের হন, নয়তো গুলি করব। মা বললেন, গুলি করতে চাইলে করুন। আমি বাড়ি ছাড়ব না। এত রাতে আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে কোথায় যাব?
আমার ছোটভাই জাফর ইকবাল তখন মায়ের হাত ধরে তাঁকে রাস্তায় নিয়ে এল। কী আশ্চর্য দৃশ্য! রাস্তার নর্দমার পাশে অভুক্ত একটি পরিবার বসে আছে। সেই রাতেই রক্ষীবাহিনীর একজন সুবেদার মেজর ওই বাড়ির একতলায় দাখিল হলেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে উঠে পড়লেন।”
এ উপন্যাসে অবন্তির গৃহশিক্ষক শফিক চরিত্রটি পাঠকমনে বিশেষ স্থান দখল করে নেয়। নিজেকে প্রচণ্ড ভীতু মনে করলেও সময় তাকে সাহসী করে তোলে। সামরিক শাসনের ঐ আতঙ্কময় সময়ে সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ‘মুজিবহত্যার বিচার চাই’ বলে স্লোগান দেওয়ার সাহস অর্জন করে। এ অপরাধে তার গ্রেফতার হওয়া এবং পরবর্তী সময়ে বারবার নিপীড়িত হওয়ার ঘটনাগুলো পাঠকহৃদয়ে বিশেষভাবে সাড়া জাগায়।
হুমায়ূন আহমেদের অন্যসব রচনার মতো এ উপন্যাসটি পাঠের সময়ও একটি মোহাচ্ছন্নতা কাজ করে। সদ্যস্বাধীন একটি দেশের যাত্রা শুরুর রক্তরঙিন পথে পরিভ্রমণ করতে করতে আমরা ক্রমাগত বিস্মিত হই। খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল তাহেরের মতো অসীম সাহসী বীরদের করুণ মৃত্যু আমাদেরকে ব্যথিত করে। ক্রমাগত বিশ্বাসঘাতকতা এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার পাঠকদেরকে পীড়িত করে।
ইতিহাস আশ্রিত যেকোনো লেখাতেই লেখককে যথেষ্ট পরিমাণে সচেতন ও নির্মোহ থাকতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই দেখা যায়, লেখার মাঝে কোনো চরিত্রের প্রতি লেখকের দুর্বলতা প্রকাশ পায়। এটি ইতিহাসবিদের জন্য যেমন সত্য, তেমনি কথাসাহিত্যিকের জন্য আরও বেশি সত্য। ‘দেয়াল’ উপন্যাসেও ইতিহাসের কিছু চরিত্রকে হুমায়ূন আহমেদ মহিমান্বিত করেছেন, আবার কিছু চরিত্র তার সহানুভূতিবঞ্চিত হয়েছে। দেখা গেছে, খালেদ মোশাররফ বা কর্ণেল তাহের এখানে যতটা মহিমান্বিত হয়েছেন, বাকশাল গঠন ও রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারে গৃহহীন হওয়ার বেদনার ফলস্বরূপ রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ততটা মহিমান্বিত হননি।
এটিকে তাই ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’ নয়, বরং একটি ‘ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস’ হিসেবে আখ্যায়িত করাই শ্রেয়।
একটু লক্ষ করলেই দেখা যায়, আমাদের ইতিহাসের যে অংশটি সবচেয়ে বেশি ধোঁয়াশাপূর্ণ এবং সময় ও ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে যে অংশটি বারবার পরিবর্তিত হয়েছে, তা হল মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী এক যুগের ইতিহাস। ‘দেয়াল’ উপন্যাসের সবচেয়ে বড় মাহাত্ম্য এই যে, চিত্তাকর্ষক কাহিনী দ্বারা আকর্ষিত করার পাশাপাশি ইতিহাসের এই অন্ধকারাচ্ছন্ন অংশটির সত্য অনুসন্ধানে এটি পাঠকদের মনে আগ্রহ সৃষ্টি করে।
দেয়াল বইটি দেখতে ভিজিট করুন রকমারি ডট কমে।